Published : 16 Apr 2022, 05:26 PM
দেশ আজ কোন পথে পরিচালিত? একদল স্বার্থান্বেষী মূর্খ সবকিছু দখলে নিয়ে নিয়েছে। তাদের দাপটে জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি-সমাজনীতি বিপর্যস্ত। চারিদিকে শুধু স্বার্থের দ্বন্দ্ব। মানবিক সংকট সেখানে প্রকট হয়ে উঠছে। কূটচাল আর শঠতার খেলায় নেমে মানুষের সর্বনাশে মেতে উঠেছে মানুষ। স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা, সম্পর্ক-সম্মান- এগুলো আজ কথার কথায় পরিণত। রাতের আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে সৃজনশীলতা, হারিয়ে যাচ্ছে হৃদয় মণ্ডলের মতো শিক্ষকরা।
মুন্সিগঞ্জের রাজকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল ও ক্লাসরুমের ছাত্রদের সাথে যে কথোপকথন হয়েছে তার ভিডিও শুনেছি, ট্রান্সক্রিপশন পড়েছি। পড়ে হৃদয় মণ্ডলকে অসাধারণ এক শিক্ষক মনে হয়েছে। বিজ্ঞান বিষয়ে তার পড়াশোনার ব্যাপ্তি, ধর্ম, সংস্কৃতি, মানব সভ্যতা সম্পর্কিত জ্ঞানের গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তার মতো শিক্ষক হাতে গোনা। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের ভিত রচনা হয়েছে যে চার মূলনীতির সমন্বয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হলে এদেশে আরো আরো হৃদয় মণ্ডলের মতো শিক্ষকের দরকার।
কিন্তু যে ষড়যন্ত্রের জাল ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হচ্ছে তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে লড়াই করাটা সত্যিই দুরূহ। তবে এই ষড়যন্ত্রের চক্রবুহ্যে প্রবেশ করে হৃদয় মণ্ডল ধৈর্য, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, দৃঢ়তা, সাহসিকতা ও আত্মমর্যাদা বোধের যে পরিচয় দিয়েছেন দৃষ্টান্ত হিসেবে তা বিরল। এরপরও হৃদয় মণ্ডলের মতো মানুষদের জায়গা হয় কারাগারে। যে ঘটনা আমরা পর্যবেক্ষণ করলাম তারপর কি কোনো শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের মতো করে এগিয়ে আসবেন? তবে এ সকল প্রশ্ন ধারণ করে হৃদয় মণ্ডল বলেছেন, "আমি আবার ক্লাসে ফিরবো। আমরা যেহেতু শিক্ষক, ক্ষমাই আমাদের ধর্ম। শিক্ষার্থীরা যাই করুক, আমাকে ওদের ক্ষমা করতে হবে, ভালোবাসতে হবে। এভাবে এগিয়ে যেতে হবে।"
একথা যখন লিখছি তখন অভিযোগ উঠেছে নওগাঁর এক স্কুল শিক্ষক আমোদিনী পালের নামে। তিনি নাকি হিজাব পরে আসায় ছাত্রীদের নির্যাতন করেছেন। এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে এলাকার অভিভাবকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। এর প্রেক্ষিতে আমোদিনী পাল বলেছেন, 'এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা।' পরে জানা গেছে সেখানে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং কিছুটা স্বার্থের গন্ধ পাওয়া গেছে। তা হলো স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে যিনি আছেন তার চাকরির মেয়াদ শেষ। কেউ একজন তার স্থলাভিষিক্ত হবেন। অন্যদিকে প্রধান শিক্ষক দায়িত্বে থাকাকালিন নিয়োগ বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক যেসব অনিয়ম ঘটেছে তা পছন্দের কাউকে বসাতে পারলে হিসাব দেয়ার জটিলতা কমে যায়। আর এসব ঘটনা আড়াল করতেই সাম্প্রদায়িক উস্কানির চেয়ে উৎকৃষ্ট উপায় আর কিই বা হতে পারে?
আরো একটি সমসাময়িক ঘটনা অনেকেরই নজর কেড়েছে। তা হলো, লতা সমাদ্দার নামে তেজগাঁও কলেজের এক শিক্ষিকার কপালে টিপ পরাকে কেন্দ্র করে। লতা সমাদ্দার টিপ পরে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় এক পুলিশ কর্মকর্তার তাকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন, তাকে হেনস্তা করেছেন। যা লতা সমাদ্দারের ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করেছেন। ঘটনাটি নতুন নয়। কিছুদিন আগেও দেশের জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর মায়ের সিঁথিতে সিঁদুর নিয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটূক্তি করতে দেখেছি।
এই ঘটনাগুলো নিয়ে মানুষ যখন উৎকণ্ঠার মধ্যে, তখন ফেইসবুকের আরেকটি বার্তা তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জে কৌশিক বিশ্বাস নামে এক যুবক ফেইসবুকে ইসলাম ধর্ম অবমাননা করে একটি পোস্ট দিয়েছে। সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য এবং স্থানীয় জনগণের উপস্থিতিতে একটি বৈঠক হয়। সেখানে যুবকটি ক্ষমা চাইলে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু রাতের আঁধারে পুনরায় একদল লোক মিছিলসহকারে যুবকটির বাড়িতে হামলা করে, বাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং কিছুদুরে একটি মন্দিরও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ধর্ম অবমাননার দায়ে আমরা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতেই পারি বা তার শাস্তিও দাবি করতে পারি। কিন্তু সে শাস্তি কে, কীভাবে প্রয়োগ করবে? এখানে আরও যে প্রশ্নটি সামনে আসে তাহলো, একটি ধর্ম অবমাননার দায়ে আরেক ধর্মের মানুষের উপাসনালয় ভাঙচুর কি নতুন অপরাধের জন্ম দেয় না?
বিষয়গুলো ভাবতে ভাবতে সকাল হয়, দুপুর হয়, আবার দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। অন্ধকার আমাদের ঘিরে ধরে। উত্তর মেলে না। উত্তর মেলে না যখন দেখি, রাজশাহীর গোদাগাড়ি থানার দেওপাড়া ইউনিয়নের নিমভুটুক গ্রামের আদিবাসী কৃষক অভিনাথ মারান্ডি ও রবি মারান্ডি ফসলি জমিতে পানি দিতে না পেরে বিষপানে আত্মহত্যা করেন তখন। উত্তর মেলে না তখন, যখন খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র অন্তু রায় হল ভাড়ার অভাবে পরীক্ষায় অংশ নিতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
সত্যি বলুন তো, এজন্যেই কি ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছিল এবং চার লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছিল? দল-মত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এক রক্ষক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধের এই বাংলাদেশ কি নির্মাণ করেছিল? সেখানে পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে এ ভূখণ্ডের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টি কি অন্যতম প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল না? সেদিন কি আমরা সমস্বরে গেয়ে উঠিনি- বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি।
তাহলে কেন বাংলাদেশের জনগণের ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি, বিজ্ঞানমনষ্কতার প্রতি, ভিন্ন ধর্মের মানুষের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারছি না? স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়েও এ কোন অন্ধকার পথে ধাবিত হচ্ছে রাষ্ট্র বা সমাজ। রাজনীতির মাঠে এ কোন নপুংসক-কাপুরুষোচিত খেলা? পাকিস্তানপন্থি মৌলবাদী উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সাথে পুঁজিবাদী অর্থলিপ্সু ক্ষমতালোভীরা এ কোন খেলায় মেতে উঠেছে, এরা বাংলাদেশকে মধ্যযুগীয় কোন অতল অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে চাইছে? সত্যি বলছি, এদেরকে যদি প্রতিহত করতে না পারি, বিতাড়ণ করতে না পারি তাহলে এরাই একদিন ত্রিশ লাখ শহীদ আর চার লাখ নারীর সম্ভ্রমে পাওয়া স্বাধীনতাকে খুন করবে।