Published : 10 Apr 2022, 07:32 PM
কয়েকদিন আগে হঠাৎ করে একজন শুভানুধ্যায়ী জানতে চাইলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা ভর্তি হওয়ার কারণে আগামীতে শিক্ষামান ঠিক রাখা যাবে কিনা? উত্তর দিতে গিয়ে দ্বিধান্বিত হলাম। কারণ, প্রথমত; আমাদের আগামীর ভাবনাই নেই, বর্তমান নিয়েই সর্বত্র ব্যস্ততা, দ্বিতীয়ত; বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কোথায়? প্রতিবছরই তো অবস্থান নিম্নমুখী। তৃতীয়ত; একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা ভাবনায় এলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্বনামধন্য অধ্যাপকের সাথে পরিচিত হওয়ার সময় তিনি নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোটার বলে পরিচয় দেন। বুঝতে পারি, রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রখর অনুরাগী কর্তৃপক্ষ এখন শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে ভোটার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। চতুর্থত; দেশে এখন কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করলে ব্যক্তিগত লাভ নিশ্চিত। পঞ্চমত; দেশের ক্ষমতাশালী বিত্তবানদের সন্তানরা হয় বিদেশে পড়ে নয়তো ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে থাকে। যারা নিজ সন্তানদের জন্য দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীন তারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিতে শ্রম দেবেন তা কি কোনোভাবে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? ষষ্ঠত; দেশের শিক্ষা পরিকল্পনায় খ্যাতনামা শিক্ষাবিদদের কোনো ভূমিকা নেই।
ভেবে দেখলাম, বিরাজমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার মান নিয়ে সর্বত্র চিৎকার করা সহজ কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ খুব কঠিন কাজ। কর্তৃপক্ষ কেন এই কঠিন কাজটা দেশ ও জাতির স্বার্থে কাঁধে তুলে নেবেন যেখানে এ উদ্যোগে তিনি নিজে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। পাগলেও তো নিজের ভালো বোঝে। তাই তো সাধারণ জনগণের অভিযোগের শেষ নেই, শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ অনড় পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দলীয়করণের নিগড়ে বাঁধা ব্যবস্থাপনা তাদের চতুর্দিকে ঘিরে আছে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখানকার পদধারীরা মনের মাধুরী মিশিয়ে ইচ্ছাপূরণে সক্ষম। তাই বিশ্বদ্যিালয়ের সর্বোচ্চ পদধারীদের কর্মকাণ্ডের সুগন্ধে মৌ মৌ করছে সারাদেশে। এদের মধ্যে একজন তো সবার চেয়ে এক কাঠি উপরে, তিনি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে থাকার পরও রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এসব কীর্তিমানদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার নামে দেশের সর্বত্র যা কিছু চলমান তার সাথে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্পর্ক আছে বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ফলে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান গড় পড়তার নিচে নামানোর প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে চলছে দেশ। অন্যরাও এ প্রতিযোগিতার বাইরে নেই। তাই এখানে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়টি কোনোভাবেই বিচার্য হতে পারে না।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থায় মাদ্রাসা শিক্ষাকে অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই। বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো মাদ্রাসা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠা, অনুমোদন, পরিচালনা এবং পড়াশোনার তদারকির ক্ষেত্রে তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আলিয়া মাদ্রাসাগুলো কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলেও কওমি মাদ্রাসাগুলোতে নিজস্ব শিক্ষাক্রমে পাঠদান চলে। এসব ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য শিক্ষার্থী মানসম্মত শিক্ষার পাশাপাশি ভাষা ও জ্ঞানের দক্ষতা অর্জনে কতটা সক্ষম হচ্ছে তা দেখার কেউ নেই। অথচ কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমতুল্য ঘোষণা করা হয়েছে। ড. বারাকাতের মৌলবাদের অর্থনীতিতে দেখা যায়, দেশে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ সে অনুপাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে দ্বিগুণ। বিপরীতে চিত্রে দেখা যায় দেশে দাখিল মাদ্রাসা বেড়েছে ৮ গুণ এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ১৩ গুণ। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীর জন্য মাথাপিছু ব্যয় ৩০০০ টাকা। অপরদিকে সরকারি মাদ্রাসা খাতে তা ৫০০০ টাকা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি একশ্রেণির বিত্তবান মানুষ নিজ গ্রামের দরিদ্র ও স্বল্পবিত্তের মানুষদের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যবস্থা করে চলেছেন যদিও সেখানে তাদের নিজেদের সন্তানরাই পড়াশোনা করে না।
২০১০ সালের শিক্ষানীতি ৭২- এর সংবিধানকে সামনে রেখে করা হয়নি। করা হয়েছে, সামরিক সরকারের সংবিধানকে সামনে রেখে। ফলে নৈতিক শিক্ষার নামে ধর্ম শিক্ষাকে পাঠ্য বইয়ে সংযোজন করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে জলাঞ্জলির পর আরোপিত হয়েছে নৈতিক শিক্ষা যার মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থী 'দেশকে ভালোবাসবে, মানুষকে ভালোবাসবে, প্রাণীকে ভালোবাসবে, প্রকৃতিকে ভালোবাসবে' সে ভাবনা বিসর্জিত হয়েছে। ধর্মশিক্ষায় ইসলামের উদারতা, পরমত-সহিষ্ণুতা, প্রতিবেশির প্রতি সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ইত্যাদির জায়গায় মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সহানুভূতি ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করা, কায়িকশ্রমের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা এবং স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তোলাকে বলা হচ্ছে ইসলামী শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। সাধারণ শিক্ষায় যা শেখানোর কথা তাকে ইসলামী শিক্ষার মধ্যে নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছে। আমাদের শিক্ষানীতিতে বলা আছে 'বিজ্ঞানমনষ্কতা এবং সাম্প্রদায়িকতামুক্ত উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী লালন ও বিকশিত করা'। একজন বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার্থী যে প্রশ্ন করতে পারে, মাদ্রাসা শিক্ষক কি সে প্রশ্ন করার অধিকার দেয়? সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না শিক্ষা কমিশন ১৪টা দেশ ভ্রমণের পর কোন দেশের অনুকরণে ধর্মশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছেন। তারা মনে করে, শিক্ষা কমিশন কোনো সুপ্ত উদ্দেশ্য থেকে এমন কাজে ব্রতী হয়েছেন। যদি কোনোদিন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় আসে সেদিনও তারা যেন প্রতিকূল পরিবেশে থাকতে পারে সেটাই তাদের সুপ্ত বাসনা।
আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ দিনে দিনে কমতে বসেছে। ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা বৃদ্ধির বহুমুখী প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধ যে সাম্যের আশা জাগিয়েছিল তা পথ হারিয়েছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সর্বক্ষেত্রেই সাম্যের অভাব। একদিকে রয়েছে ক্ষমতাধর বিত্তবান মানুষ যাদের উত্তরোত্তর জাতীয় আয়ে অংশ বেড়েই চলেছে, বিপরীতে সংখ্যাগুরু ক্ষমতাহীন মানুষ যাদের উত্তরোত্তর জাতীয় আয়ে অংশ কমেই চলেছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি সর্বত্রই লুটের সংস্কৃতি জাতির মাথার ওপর চেপে বসেছে। পেশি শক্তি, সন্ত্রাস, অবৈধ অস্ত্র, ঘুষ, চাঁদাবাজি অপশাসন, দমন, পীড়ন, কালো টাকা এসব লুটের সংস্কৃতির অংশ হয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ আজ জিম্মি। ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যা সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির আত্মতুষ্টির উদাসীনতায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সুযোগ নিচ্ছে, ফলে ক্ষমতাহীন সংখ্যাগুরু মানুষের জীবনে মৌলিক পরিবর্তন ঘটছে না, আগামীতেও ঘটবে কিনা সন্দেহ। এই বিষয়গুলোকে হাতিয়ার করেই নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য গোপনে রেখে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিকগোষ্ঠী তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের পাশে কাজ করে চলেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রনেতার কাছে শোনা– বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার লিচু গাছের ফল তাদের সময়ে কেউ বড় হতে দেখেনি। পাকা তো অনেক দূরের কথা। পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ক্ষমতায় আসে তখন গাছগুলোতে লিচু পাকবার সময় তারা প্রত্যেক হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের জানায়– 'এ ফল আমাদের তাই কেউ যেন আমরা তা নষ্ট না করি। লিচু পাকলে আমরা সবাই একদিন খাবো।' সত্যিই লিচু পাকবার পর একদিন সব লিচু সংগ্রহ করে প্রকাশ্যে তা ভাগ করে প্রতিজন ছাত্রের টেবিলে ২২/২৩টা করে লিচু পৌঁছে দেওয়া হয়। এভাবেই দেশের শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, স্বল্পবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে শক্তিবৃদ্ধি করছে এ গোষ্ঠী।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের। অথচ সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে যা বোঝে তার সাথে রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের কর্মকাণ্ডের বিন্দুমাত্র মিল নেই। এখানে শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা হয় কিন্তু কি সেই চেতনা- তা কেউ বলে না। তবে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য যা প্রয়োজন তার সবকিছুই তারা করে। তারা রাজা আর প্রজার সম্পর্ক সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়েছে। আর দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে এবং আজও করে চলেছে। একসময় যা গোপন ছিল আজ তা প্রকাশ্যে এসেছে। গোপন কর্মকে ক্ষমতার মসনদ দখলের অংশ করে ফেলা হয়েছে। নিভৃতে সাধারণ শিক্ষার পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন করা হচ্ছে পাশাপাাশি ধর্মভিত্তিক শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। নিজেদের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে গিয়ে এরা সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাগুলোকে বলী দিয়ে দেশকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির জোয়ারে ভাসিয়ে দিচ্ছে। এখানে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। উচ্চশিক্ষা সবার জন্য উন্মুক্ত ও সবার অধিকার, এখানে প্রয়োজন-অপ্রয়োজন বিবেচনা বিন্দুমাত্র জরুরী নয়। দেশে এখন এক কোটি মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। তাদের ভবিষ্যতের ভাবনায় রাষ্ট্রক্ষমতা সাধারণ মানুষকে কতদিন অপেক্ষায় রাখবে? যেদিন কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্ত একজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে পদায়ন করা হবে সেদিন পর্যন্ত?