Published : 06 Apr 2022, 07:08 PM
যেকোনো ধর্মের মূল ও প্রথম শিক্ষাটি হলো মিথ্যা না বলা। এখনকার বিশ্বে প্রচলিত প্রধান ধর্মগুলোর পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস পাওয়া যায়। তারও অনেক আগে থেকে মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে, সমাজকে টিকিয়ে রাখতে হলে, সমাজে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে মিথ্যাকে দূর করতে হবে। কারণ যেকোনো খারাপ কাজের প্রাথমিক ভিত হচ্ছে মিথ্যা। মিথ্যাকে দূর করা গেলে অনেক পাপ কিংবা অন্যায় কাজ আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে।
কথাগুলো মনে আসে টেলিভিশন দেখতে-দেখতে, পত্রিকা পড়তে-পড়তে। দেখি, শুনি, পড়ি ব্যবসায়ীরা কী নির্দ্বিধায় মিথ্যা বলে যাচ্ছে। শুধু টেলিভিশন বা পত্রিকায় নয়, দোকানে দোকানে সওদা করতে গিয়ে প্রতিদিনই ব্যবসায়ীদের মিথ্যা কথাগুলো শুনতে হয়।
আমার বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখছি রোজার মাস এলেই একদফা দাম বাড়ে নিত্যপণ্যের। আবার ঈদের আগে আরেক দফা বাড়ে। বিষয়টা এখন সবার গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। এদেশের 'কালচার'- এ পরিণত হয়েছে তা। সাধারণ মানুষ বা ভোক্তারা মেনেই নিয়েছেন রোজার আগে দাম বাড়বে, ঈদের আগে দাম বাড়বে।
এই দাম বাড়ানো নিয়ে খুচরা বিক্রেতা থেকে শুরু করে পাইকার এবং তার ওপর আমদানিকারক সবাই মিথ্যা কথা বলেন, জনগণকে ভুল তথ্য দিয়ে থাকেন। তারা প্রতিবছর চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম এ ধরনের একটি খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করান। তারপর আমদানিকারক বা উৎপাদনকারী বল ঠেলে দেন পাইকারি ব্যবসায়ীদের কোর্টে, ওরা ঠেলে দেয় খুচরা দোকানিদের দিকে। তারপর এই তিনজনের মিলিত চেষ্টায় বল ঢুকে যায় জনতার গোলপোস্টে আর এইভাবে বছরের পর বছর সাধারণ মানুষ হেরে যাচ্ছে ব্যবসায়ী নামের কিছু লুটপাটকারীর হাতে।
বাংলাদেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র কয়েকটি পরিবার। এরাই উৎপাদনকারী, এরাই আমদানিকারক। এদের ইচ্ছায় বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়। পণ্যের দাম ওঠানামা করে। এদের কৃপার ওপর নির্ভর করতে হয় দেশের জনগণকে। ধরতে গেলে এখন এরাই ১৭ বা ১৮ কোটি জনগণের 'ভাগ্যনিয়ন্তা'। দুই বা তিন দশক আগে এ পরিস্থিতি ছিল না। খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই ও মৌলভীবাজারের অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নিজেরাই বিভিন্ন পণ্য আমদানি করতেন। ফলে একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন ছিল সেসময়। কিন্তু একটি সময়ে বড় বড় কোম্পানিগুলো মিলে এমন পরিস্থিতি তৈরি করে যার ফলে ক্ষুদ্র আমদানিকারকরা সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসে গেছে। ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়েছে। আর এভাবে মাত্র কয়েকটি উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে ভোগ্যপণ্যের বাজার।
প্রতিবছর রোজার মাসে চাহিদা বৃদ্ধির যে কথা বলা হয় তা ঠিক বলা হয়। সঙ্গত কারণে রোজায় অনেক পণ্যের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু সরবরাহ কমের যে কথা বলা হয় তা ডাহা মিথ্যা কথা। রোজার বাড়তি চাহিদার কথা মাথায় রেখেই ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি করেন। উৎপাদকরা উৎপাদন করেন। তাদের ব্যবসাটাই হলো পণ্য আমদানি বা উৎপাদন করা। যত আমদানি বা উৎপাদন ততই লাভ, কাজেই তারা কম আমদানি ও উৎপাদন করবেন কেন? দ্বিতীয়ত, রোজায় বাড়তি দামের প্রশ্নইবা আসবে কেন? কারণ, তারা বিভিন্ন পণ্য কেনেন বিভিন্ন দেশ থেকে রমজানের বহু আগেই। ফলে রমজানের জন্য তাদের বাড়তি খরচ তো করতে হয়নি। ওই একই দাম, একই ট্যাক্স-ভ্যাট, একই পরিবহন ব্যয়। উৎপাদকের অবস্থাও তাই। আর বিক্রি বেশি হবে জেনেই তো পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতা বেশি বেশি মাল কেনেন। মালের চাহিদাপত্র দিয়ে থাকেন। এভাবে কখনো কোথাও সংকট হওয়ার তো কথা না। তারপরও যখন সংকট হয় তখন বুঝতে হয় এই সংকট মনুষ্যসৃষ্ট। ভুল বললাম, মনুষ্যসৃষ্ট নয়, বলা উচিত লুটেরাসৃষ্ট সংকট। কাজেই এদের আর যাই বলা হোক ব্যবসায়ী বলা যাবে না (সব ব্যবসায়ী নন, যারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে)।
কিন্তু একটা অঙ্ক মেলাতে পারছি না। বাংলাদেশ ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশ। সে হিসেবে সরলীকরণ করলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৯২ শতাংশই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। আমরা যাদের চিনি তাদের ব্যাপারে তো জানি-ই। তাছাড়া টিভি-পত্রিকায় অন্যদের ছবি দেখে মনে হয় তারা খুবই ধার্মিক ধরনের মানুষ। এদের কেউ কেউ ইসলামী লেবাসেও চলাফেরা করেন। তাদের নুরানি চেহারা দেখে সাধারণ মানুষের ভক্তির শেষ থাকে না। তাই আমি ভাবি তাহলে রোজা-ঈদে দাম বাড়িয়ে জনগণকে ঠকাচ্ছে কারা? রোজায় পচাবাসী খাবার বেঁচে কারা? নকল, ভেজাল খাদ্য তৈরি করে বিক্রি করছে কারা? ভোক্তা তথা ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে কারা? আমার তো বিশ্বাসই হয় না এরা এ ধরনের গর্হিত কাজ করতে পারে। এরাই রোজার শেষে ওমরাহ করতে যাবে, ওমরাহ থেকে ফিরে টেরিবাজার থেকে ১০০ টাকা দামের লুঙ্গি আর ১৫০ টাকা দামের শাড়ি বিলাবে জাকাত হিসেবে। এরাই স্থানীয় মসজিদ-মাদরাসায় মুক্ত হস্তে দান করবে। এলাকার মানুষ এদেরকে প্রাণখুলে দোয়া করবে। এরা সমাজের অভিভাবক হিসেবে সালিশ-বিচার করবে।
ইসলাম ধর্মমতে ব্যবসা করা সুন্নত। নবীজি নিজে ব্যবসা করেছেন এবং উম্মতদেরকে ব্যবসা করার জন্য উৎসাহিত করেছেন এবং ব্যবসা করার ক্ষেত্রে কিছু নীতিজ্ঞানও দিয়ে গেছেন। দেশের অধিকাংশ মুসলিমদের সময় কাটে এখন ওয়াজের ভিডিও দেখে দেখে। কাজেই ব্যবসায়ীরাও নিশ্চয়ই এমন বয়ানগুলো শুনে থাকবেন। তারা যেহেতু 'ঈমানদার' ও 'পরহেজগার', তাদের পক্ষে কোনোরূপ অনৈতিক কাজ করা সম্ভব নয়। কাজেই এখন আমার প্রশ্ন হলো মুসলিমদের রোজা এলে জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে কারা? কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে কারা? তা খতিয়ে দেখা দরকার। এই সংযমের মাসে রোজা রেখে, নামাজ পড়ে এমন কাজ কি কেউ করতে পারে?
প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। বাংলাদেশ ছাড়া অধিকাংশ মুসলিম দেশে রোজা ও ঈদ উপলক্ষে জিনিসপত্রের দাম কমানো হয়। সাধারণ মানুষের চাহিদার প্রতি খেয়াল রেখে অনেক জনহিতকর কাজ করা হয়। বিশ্বে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। প্রায় ২৩০ কোটি। পৃথিবীর অনেক দেশে শুধুই খ্রিস্টানরা বাস করে। সেসব দেশে তো বটেই পৃথিবীর প্রায় সব দেশে বড়দিন উপলক্ষে 'বিশেষ সেল' বা ছাড় দেওয়া হয়। ৫০ শতাংশেরও বেশি ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়। এটা বাধ্য হয়ে বা চাপে পড়ে করে না। ব্যবসায়ীরা নিজ উদ্যোগেই করে। বিক্রি বেশি লাভ কম নীতিতে তারা লোকসান দেয় না। লাভ ঠিকই করে তবে তা ভোক্তার জান কবজ করে নয়। তাহলে বাংলাদেশের চিত্র উল্টো কেন? এ দেশে কেন রোজায় দাম বাড়ে পণ্যের? ভেজাল দেওয়া হয় পণ্যে?
সমাজে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ধর্মের প্রভাব বেড়েছে, ধর্মের আচার বেড়েছে অর্থাৎ ধার্মিক বেড়েছে। এতে আমাদের খুশি হওয়ার কথা। কারণ ধার্মিক বাড়লে সমাজে ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতি, লুটপাট, ভেজাল, নকল অর্থাৎ সবধরনের অপকর্ম বা খারাপ কাজ কমে যাওয়ার কথা, বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা না হয়ে হচ্ছে এর উল্টোটা। সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, মিথ্যাচার, অনাচার, ঘুষ, ধর্ষণ, খুন-খারাবি দিনদিন বেড়েই চলেছে। অথচ 'ইহুদি-নাছারার' দেশ বলে যে দেশগুলোকে আমরা সবসময়ে গালাগাল করি সে দেশের চিত্র কেমন তা বিশদ বর্ণনা করে পাঠকদের বোঝানোর দরকার আছে বলে মনে হয় না।
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধকে দায়ী করে দেশে অনেক পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। পণ্যগুলো যুদ্ধের অনেক আগে আমদানি করা। যুদ্ধ শুরুর পরপরই প্রায় সমস্ত পণ্যের দাম বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা। আমি যে দোকান থেকে বাজার করি সেখানে দেখলাম শুকনো মরিচের দামও বাড়ানো হয়েছে। দোকানিকে বললাম, এই মরিচ কি ইউক্রেইন থেকে আসে? এটার দাম বাড়ল কেন? আমার পাশে দাঁড়ানো আরেক ক্রেতা এক কদম আগ বাড়িয়ে বললেন, এটা তো ভাই হাটাজাইজ্যা (হাটহাজারী) মরিচ, এইটার দাম বাড়বে কেন? দোকানদার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, 'আমরা বাড়াই নাই। পাইকারি বাজারে দাম বাড়ছে তাই আমরাও বাড়াইছি'। সরকার সয়াবিন তেলের ভ্যাট কমিয়েছে দশ শতাংশ এর বিপরীতে তেলের কেজিপ্রতি দাম কমেছে ছয় টাকা। একশ টাকায় দশ টাকা ভ্যাট দিতে না হলে দেড়শ টাকার তেলের বোতলে দাম কমবে পনের টাকা। বাস্তবে কমলো ছয় টাকা।
আমি আবার ধন্দে পড়ে গেলাম। আবার সেই চক্র। উৎপাদনকারী বা আমদানিকারক বলে পাইকার, পাইকার বলে খুচরা ব্যবসায়ী। আবার নিচ থেকে ওপরে গেলে দোকানদার বলে পাইকার, পাইকার বলে আমদানিকারক বা উৎপাদনকারী- এভাবে বলটা এর পা থেকে ওর পায়ে ঘুরছে এবং এভাবে প্রতিনিয়ত জনগণের গোলপোস্টে বলটা ঠেলে দিচ্ছে। গোহারা জনগণ কিছুই করতে পারছে না যদিও সংখ্যায় তারা ঢেরবেশি।
ব্যবসায়ীরা এমন করতে পারে তা শুরুতেই আঁচ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার পরপরই সরকারিভাবে খাদ্য আমদানির জন্য তিনি গঠন করেছিলেন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ বা টিসিবি। আর তা ন্যায্যমূল্যে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে গড়ে তুলেছিলেন 'কসকর' নামে ন্যায্যমূল্যের দোকান। ব্যবসায়ীরা যাতে কখনো বাজারে মনোপলি সৃষ্টি করতে না পারে সে লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয়েছিল টিসিবি, কসকরের মতো প্রতিষ্ঠান। তাকে হত্যা করে যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারাই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অচল করে দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল। শেখ হাসিনা টিসিবিকে আবার চাঙা ও সক্রিয় করেছেন। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিসিবি এখন ভালো ভূমিকা রাখছে বটে তবে তা যথেষ্ট নয়। একে আরও কার্যকর করা যায় কীভাবে এবং দেশের অন্তত তিন কোটি মানুষকে কীভাবে কম মূল্যে পণ্য সরবরাহ করে ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরতা কমানো যায় সে উপায় বের করতে হবে। প্রয়োজনে সরকার রেশন সিস্টেম চালু করতে পারে। তাতে বাজার পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিলে ব্যবসায়ীরা প্রবল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে। নানাভাবে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে। সংসদে এখন রাজনীতিকের চেয়ে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশি ফলে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা থাকলেও সরকারি দলের এমপি, মন্ত্রী এবং ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো তলে তলে গোড়া কাটার চেষ্টা করতে পারে। তারপরও শেখ হাসিনাকে জনগণের পক্ষেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
এটা তার পিতার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজও বটে।