Published : 19 Dec 2021, 07:15 PM
'মুজিববর্ষ', 'মুজিব-বর্ষ', নাকি 'মুজিব বর্ষ'। কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কোন বানানটি তারা প্রচলিত করতে চান। যদিও তিনটির কোনোটিতেই ভুল নেই, আমি প্রথমটির পক্ষপাতি, কারণ হাইফেন কিংবা ফাঁক এড়ানোর কারণে এটি সর্বাধিক সাশ্রয়ী। 'মুজিববর্ষ' একটি সমাসবদ্ধ পদ বা সমাসের নিয়মে গঠিত (মধ্যপদলোপী) কর্মধারয় সমাসান্ত শব্দ, যার একটি ব্যাসবাক্য হতে পারে: মুজিব (নামাঙ্কিত/মুজিবের স্মরণে যে) বর্ষ। আমি অবশ্য জানি না, 'বর্ষ' বলতে কী বোঝানো হচ্ছে: ২০২০ সাল থেকে নতুন কোনো সাল বা সন শুরু করার পরিকল্পনা কি আছে, নাকি বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষপূর্তি সাল ২০২০ কেই 'মুজিববর্ষ' বলা হচ্ছে?
সরকারি একটি অনুষ্ঠানে 'মুজিববর্ষ' শব্দটির বানান লেখা হয়েছে: 'মুজিবর্ষ'। সামাজিক গণমাধ্যমে হৈচৈ ওঠার পর দাবি করা হচ্ছে, এটি নিছকই একটি কারিগরি ত্রুটি। গত দুই বছর ধরে চোখের সামনে ভাসতে থাকা একটি অতি পরিচিত শব্দের ভুল বানান লেখা হলো সেই ডায়াসে, যেখানে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা জাতিকে শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বার্ষিকী এবং রাষ্ট্রপিতার জন্মের শতবর্ষপূর্তিতে। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই অনুষ্ঠান। টিএসসির কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এটা নয় যে 'সাত-পাঁচ-চৌদ্দ' একটা ব্যাখ্যা দিয়েই আমরা পার পেয়ে যাব।
ভুল মানুষ মাত্রেই করে—এটা যেমন সত্য, আবার ভুল মাত্রেরই মাশুল গুনতে হয়, সেটাও মিথ্যা নয়। যেকোনো ভুল থেকে একটি গোষ্ঠী লাভবান হয় এবং অন্য একটি গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের জন্মের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু যেহেতু মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন, সেহেতু 'মুজিব' নামটাকেই অশ্রদ্ধা করেন, এমন লোকের সংখ্যা আগেও যেমন ছিল, এখনও আছে। 'মুজিব' শব্দের অঙ্গহানি এদের বেশিরভাগের উল্লাসের কারণ হয়েছে। এই বানান ভুলের কারণে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানের আয়োজনের সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সামাজিক গণমাধ্যমের পোস্ট ও লাইক দেখে আমার অন্তত মনে হয়েছে, ভুল বানান 'মুজিবর্ষ' থেকে প্রথমত সরকারবিরোধীরা এবং দ্বিতীয়ত বাংলাদেশবিরোধীরা লাভবান হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে 'মুজিবর্ষ' বানানভুলটির 'কম্পাউন্ড এ্যাফেক্ট' কী হতে পারে, অর্থাৎ এই ভুল সম্মিলিতভাবে ইতিমধ্যে কী পরিমাণ ক্ষতি করে বসে আছে, তা পরিমাপ করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
অনেকে বুঝতে পারছেন না, 'মুজিবর্ষ' বানানে কোন 'ব'-টি কাটা গেছে। উত্তর সোজা, 'মুজিববর্ষ' যদি একটি বর্ষ হয়ে থাকে, তবে যে 'ব' বর্ণটি কাটা গেছে, সেটা 'বর্ষ' শব্দের 'ব' নয়, 'মুজিব' শব্দের 'ব'। এর মানে হচ্ছে, 'মরার উপর খাড়ার ঘা'-এর মতো কারিগরী জটিলতার শিকার হয়েছে রাষ্ট্রপিতার নামটিই। 'মুজিবর্ষ' শব্দটিকে 'জোড়কলম শব্দ' হিসেবে চালানোর চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। 'ধোঁয়া আর 'কুয়াশা' মিলে 'ধোঁয়াশা' একটি জোড়কলম শব্দ। কিন্তু জোড়কলম শব্দ কাকতালীয়ভাবে কিংবা বানান ভুলের কারণে গঠিত হয় না। যিনি এই শব্দ বানিয়েছেন, তিনি এটা সচেতনভাবে বানিয়েছেন এবং শব্দটি বাংলা ভাষার ব্যবহারকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। 'মুজিবর্ষ' শব্দটি কেউ সচেতনভাবে বানায়নি, বানালে ২০২০ সাল থেকে সরকারি চিঠিপত্রে 'মুজিববর্ষ'-এর পরিবর্তে 'মুজিবর্ষ' বানান দৃশ্যমান হতো।
ভুল করে কেউ 'মুজিবর্ষ' উচ্চারণ করলে সেটাকে ব্যক্তির উচ্চারণপ্রমাদ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যেত। লেখার ফলেই হয়েছে যত বিপদ। 'শতম বদ মা লিখ!' সংস্কৃত প্রবাদ। এর অর্থ 'হাজার বক বক করো, কিন্তু লিখতে যেও না যেন!' বলার চেয়ে লেখা হাজারগুণ শক্তিশালী এবং স্থায়ী। যে অস্ত্র যত বেশি শক্তিশালী, তার ভুল প্রয়োগও তত বেশি বিপদ ডেকে আনতে পারে বৈকি। সংস্কৃত প্রবাদ আছে, 'মুনিনাঞ্চ মতিভ্রম' অর্থাৎ জ্ঞানীদেরও ভুল হয়। জ্ঞানী ব্যক্তির কোনো ভুল যখন সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়, সংস্কৃতে তাকে 'আর্ষপ্রয়োগ' বলা হয়। এখানে 'আর্ষ' কথাটা এসেছে 'ঋষি' শব্দ থেকে। 'মুজিবর্ষ' কোনো বিচারেই আর্ষপ্রয়োগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
অনুরোধ করা হচ্ছে, বানান ভুলটিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্যে। ক্ষমা তো করাই যায়, আর না করে উপায়ই বা কী! ভুল যা হবার, তা তো হয়েই গেছে। এটাও সত্য যে কাজ করতে গেলে ভুল হবেই এবং সেই ভুল করে না, যে কোনো কাজ করে না। সমস্যা হচ্ছে, সব ভুলের গুরুত্ব সমান নয়। বইয়ের পৃষ্ঠায় ভুল হলে মানা যায়, প্রচ্ছদে, বইয়ের নামে ভুল কি গ্রহণযোগ্য হতে পারে? প্রশ্ন হচ্ছে, এত এত লোকের চোখের ছাঁকুনি এড়িয়ে এমন ভুল হলো কী করে? একজন ভুল করতে পারে, দশজন কীভাবে এমন একটি ভুল করে? অতি তুচ্ছ কারণে যে দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার আসামীকে জামিন-অযোগ্য হাজতবাস করতে হয়, সেই দেশে সরকারি প্ল্যাটফর্মে রাষ্ট্রপিতার নামাঙ্কিত বর্ষের বানান ভুল করার ঝুঁকি এক মহামান্য সরকার বাহাদুরের সর্বশক্তিমান প্রশাসন ছাড়া আর কে-ইবা নিতে পারে!
তিন প্রকার ভুলের কথা ভাবা যেতে পারে: ১. ইচ্ছাকৃত, ২. সকারণ এবং ৩. অকারণ। ইচ্ছাকৃত ভুল অপরাধ। সকারণ ভুলের কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে, যাতে একই কারণে একই ভুল দ্বিতীয়বার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। ভুল মানুষের অতি স্বাভাবিক একটি প্রবণতা, যদিও কারও কারও ক্ষেত্রে ভুল করা একটি রোগও হতে পারে। সমস্যা হচ্ছে, ভুলের কোনো প্রতিষেধক বা টিকা নেই। ভুল যে কারও, যে কোনো সময় হতে পারে। কিন্তু ভুলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ব্যক্তি কিংবা জাতিকে একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে, যদি ভুলের পুনরাবৃত্তি আমরা কমাতে চাই।
এই প্রক্রিয়ায় কমপক্ষে চারটি পর্যায় আছে। প্রথমত, ভুল স্বীকার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সাধারণ ভুলের জন্য দুঃখপ্রকাশই যথেষ্ট, কিন্তু মারাত্মক ভুলের জন্যে ক্ষমা চাইতে হবে। তৃতীয়ত, মারাত্মক হোক কিংবা সাধারণ, ভুল মাত্রেই সংশোধন করতে হবে, যদি সম্ভব হয় এবং চতুর্থত, সতর্ক থাকতে হবে, যাতে একই ভুল দ্বিতীয়বার না হয়। একই ভুল বার বার হলে শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। যদি কোনো কাজের জন্য কেউ পারিশ্রমিক বা পুরস্কার পেয়ে থাকেন, তবে ভুলের জন্যেও তাকে কমবেশি শাস্তি পেতে হবে। শাস্তি যদি না হয়, তবে একই অপরাধ, একই ধরনের ভুল বার বার সংঘঠিত হতে থাকে। শাস্তির সংস্কৃতির অনুপস্থিতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি একাধারে অপরাধী এবং আনাড়িদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠার একটি বড় কারণ।
'মুজিবর্ষ' ভুলটির পেছনে কারও না কারও গাফিলতি অবশ্যই আছে। সমস্যা হচ্ছে, অন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও (যেমন, বিদেশি রাষ্ট্র কিংবা বিদেশি কোনো কোম্পানির সঙ্গে করা কোনো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিপত্র, আলোচনা কিংবা দরকষাকষি) যে অবলীলায় অনুরূপ গাফিলতি করা হবে না, কিংবা ইতোমধ্যে করা হয়নি, তার কী নিশ্চয়তা আছে? এবারের বানান ভুলটি জনগণের চোখে পড়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ সরকারি কর্মকাণ্ডই তো গোপনীয়তার চাদরে ঢাকা থাকে, যদিও প্রশাসনের যাবতীয় গাফিলতির দুর্ভোগ ভুগতে হয় বেচারা সেই জনগণকেই। প্রশাসনের সব ভুল বানান ভুলের মতো নিরীহ ও নিরাপদ নাও হতে পারে। 'মুজিবর্ষ' বানানটি প্রশাসনের সার্বিক দুর্বলতার উপসর্গ কিনা, খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে।
দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে 'ছাপাখানার ভূত'-এর সঙ্গে বহুবার আমার দেখা হয়েছে। এই ভূতে বিশ্বাস আছে বলে আমি দ্বিগুণ সতর্ক হই। তবুও আমার ভুল হয়ে যায়, প্রকাশনায় ভুল থেকে যায়। এর মূল কারণ, আমি মনে করি, বাঙালি সমাজের সার্বিক অশিক্ষা, যার ফলে, শাসক, প্রশাসক, লেখক, প্রকাশক, মুদ্রক সবাই কমবেশি অ-শিক্ষিত। এই অশিক্ষার শুরু প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়ে। মাতৃভাষা বাংলা এবং ধাত্রীভাষা ইংরেজি ঠিকমতো লিখতে ও পড়তে শেখানো হয় না বিদ্যালয়ে। প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ গ্রহণযোগ্য বানানে ও কাঠামোতে লেখা যে একটি গুরুত্বপূর্ণ আচরণীয় সংস্কৃতি– সে ব্যাপারটা শিক্ষার্থীদের মনোগত করতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে।
বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য গাফিলতি। অন্য সব ক্ষেত্রের মতো ভাষার ব্যাপারেও আমাদের একটা গা-ছাড়া ভাব আছে। অনেকে বলেছেন, বানান ভুল হয়েছে তো কী হয়েছে, শপথের দিকে মনোযোগ দিন। এর কারণ, আমরা ভাবি, একটা কিছু লিখলেই চলে, বুঝতেই পারলেই তো হলো– এমনতর যুক্তি আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও হরহামেশাই দিয়ে থাকেন। বাংলা বানানের জটিলতা নিয়ে হাসাহাসি করা এক শ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর স্বভাব, ভাবখানা যেন এই ইংরেজি বানানে কোনোপ্রকার জটিলতা নেই। 'মুজিবর্ষ' বানান ভুলের পিছনে এই 'ঢিলেঢালা' সংস্কৃতির প্রভাব থাকা অসম্ভব নয়। এই ধরনের এবং কোনো ধরনের ভুল না করার ব্যাপারে, আসুন মুজিববর্ষ থেকেই আমরা যথাসাধ্য সতর্ক হই!
ভুল করার বিলাসিতা কোনো দেশের পাবলিক সর্ভেন্টকে মানায় না, কারণ প্রথমত, ভুল করার জন্যে আমাদের বেতন দেওয়া হয় না এবং দ্বিতীয়ত, আমাদের একেকটি ভুল জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য বিপদজনক প্রমাণিত হতে পারে। আমরা যারা সরকারি বেতন নি-ই, সবাই আমরা পাবলিক সার্ভেন্ট। জনগণ মালিক, আমরা ভৃত্য। ভুল করা ভৃত্যকে মালিক যে এখনও জবাব দিচ্ছে না, সেটা ভৃত্যের সৌভাগ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের হোক, কিংবা রাষ্ট্রের, যেকোনো প্রশাসন হচ্ছে জলে ভাসমান একটি কাঠের নৌকার মতো, প্রতিমুহূর্তেই যার বিপদ হতে পারে, কারণ তার পায়ের তলায় মাটি নেই। ভুলগুলো হচ্ছে জাহাজের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা একেকটি ইঁদুরের অপকর্ম এবং ইঁদুরের স্বভাবই হচ্ছে নৌকার তলা কেটে দেওয়া। নৌকা ডুবতে শুরু করলে ইঁদুরগুলোই প্রাণ বাঁচানোর জন্যে প্রথমে জলে লাফ দেয়, কিন্তু হায়! নৌকার সলিল-সমাধি হলে কেউই আর বাঁচে না, মাঝিও না, যাত্রীও না, ইঁদুরতো নয়ই।