Published : 09 Sep 2021, 06:49 PM
হবুচন্দ্র রাজা স্বপ্ন দেখলেন, শিয়রের কাছে তিনটি বানর বসে পরম আদরে তার মাথায় উঁকুন বাছছে। অতঃপর স্বপ্নমঞ্চে আসে এক বেদে, যে কিনা 'পাখি উড়ে গেছে' বলে কাঁদতে থাকে। এক থুড়থুড়ি বুড়ি হেসে হেসে রাজার পায়ের নিচে সুড়সুড়ি দিতে থাকে। পা সরাতে না পেরে রাজামশাই যখন ছটফট করছেন, বেদে তার কানে কানে বলে: 'হিংটিংছট!'
রাজস্বপ্নের অর্থ ব্যাখ্যা করার জন্যে উঠে পড়ে লাগলো সবাই। উজ্জয়িনী থেকে শুরু করে সুদূর ফ্রান্স, কোনও জায়গার কোনও পণ্ডিত গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না। ব্যাখ্যা না পেয়ে দেশশুদ্ধ লোকের মাথা খারাপ হবার জোগাড়। হবু রাজার দেশে স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেওয়াও অবশ্য বিপজ্জনক হতে পারে। 'স্বপ্ন শুধু স্বপ্নমাত্র মস্তিষ্ক বিকার'- বলার অপরাধে ফরাসি পণ্ডিতকে উপরে-নিচে কণ্টকিত করে ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়ানো হলো, কারণ 'জগৎ বিখ্যাত মোরা ধর্মপ্রাণ জাতি। স্বপ্ন উড়াইয়া দিবে, দুপুরে ডাকাতি!'
অবশেষে গৌড়দেশ হতে ফরাসি পণ্ডিতের গুরুমারা বাঙালি চেলা এসে আবোল-তাবোল কিছু কথা বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে সংক্ষেপে স্বপ্নের অর্থ বলে দিল: 'হিংটিংছট।' রাজা থেকে প্রজা, সবাই যেন মুহূর্তে বুঝে গেল সব কিছু। প্রকৃতপক্ষে কেউ কিছুই বোঝেনি, কিন্তু বাঙালি পণ্ডিতের কথাবার্তা-ভাবসাব দেখে রাজ্যশুদ্ধ সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে এই লোক যে কোনও বিষয় 'ব্যাখ্যায় করিতে পারে ওলটপালট' এবং ব্যাখ্যা অন্য কিছু নয়: হিংটিংছট!
রবীন্দ্রনাথের এ কবিতার শানে নুজুল এই যে- মূল বিষয় থেকে বহুদূরে সরে গিয়ে অনতিবিলম্বে খেই হারিয়ে কিংবা ইচ্ছে করে আবোল-তাবোল বকার অভ্যাস বাঙালি বুদ্ধিজীবীর নতুন নয় এবং বাঙালি শ্রোতার দিক থেকে এমনতর বক্তৃতা তারিফ করার বদভ্যাসও হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। বাঙালি শুধু নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী বক্তব্য রাখার সময়, সে লিখিতই হোক কিংবা মৌখিক, নিজের বিষয়ে সাধারণত স্থির থাকতে পারে না। এমন কিছু বুদ্ধিজীবী আছেন, একটি বিষয়ও যারা ঠিক মতো জানেন না, কিন্তু সব বিষয়েই তারা বকতে পারেন। বখতিয়ার খিলজির হাত নাকি হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ছিল। এই 'বক্তিয়ার'দের সম্ভবত জিহ্বা অতিরিক্ত লম্বা।
ছাত্রজীবনে অনেকেই আমরা সেই পরীক্ষার্থীর গল্প শুনেছি যে কিনা শুধু 'গরু' রচনা মুখস্ত করেছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিল 'নৌকা ভ্রমণ'। কোনোমতে নৌকা ভ্রমণের নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েই পরীক্ষার্থী লিখলো যে নদীর পারে একটি গরু চরছে। ব্যস, তারপরই মুখস্ত গরু রচনা উগড়ে দিতে শুরু করলো সে দিস্তার পর দিস্তা। হালের 'বক্তিয়ারে'রা আরও এক কাঠি সরেস। নৌকাভ্রমণ সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শ্রোতাকে তারা বাৎলাতে শুরু করেন, কোন মানব জাতি প্রথম নৌকা আবিষ্কার করেছিল, নৌযুদ্ধে বিভিন্ন জাতি, বিশেষ করে আরব তথা মুসলমানদের অবদান কী, 'নৌকা' শব্দের ব্যুৎপত্তি কী, নৌ-ভ্রমণের সংস্কৃতি বা শুরু কত শতাব্দীতে এবং কোন দার্শনিক নৌ-ভ্রমণ নিয়ে কোন বইয়ের কত পৃষ্ঠায় কী বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ অতিরিক্ত নৌভ্রমণ করার কারণে বাংলা সাহিত্যের কী কী ক্ষতি হয়েছে, কোন বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী সারা জীবন নৌকা নিয়ে গবেষণা-লেখালেখি করেও নৌকা সম্পর্কে প্রকৃতপক্ষে কিছু জানে না… ইত্যাদি।
'বক্তিয়ার'দের নিয়ে গল্পের অভাব নেই বাংলা ভাষায়। বক্তৃতা করতে করতে খেই হারিয়ে বহুক্ষণ বকার পর অবশেষে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এক বক্তা জিভ কেটে বলেছিলেন: 'ইশ! ঘড়ি দেখতে ভুলে গিয়েছি।' শুনে এক রসিক দর্শক উত্তর দিয়েছিলেন: 'ঘড়ি দেখেননি ঠিক আছে, ক্যালেন্ডারটা অন্তত দেখলে পারতেন- রাত বারোটা বেজে তারিখটাও যে বদলে গেছে।'
ঘড়ি বা ক্যালেন্ডার খেয়াল করা নয়, আসল সমস্যা অন্য জায়গায়। বক্তার মুখে রাজ্যের প্যাঁচাল শুনতে শুনতে শ্রোতা অবশেষে হৃদয়াঙ্গম করেন যে, অনেক জ্ঞান তার হয়েছে বটে, একটু অতিরিক্তই হয়েছে, এতটা বেশি হয়েছে যে হাসফাঁস লাগছে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যে বিষয়ে বলার কথা, বক্তা নিজে বলবেন বলে ঘোষণা দিয়ে বক্তব্য শুরু করেছেন, সেই বিষয়ে তিনি সামান্যই বলেছেন, কিংবা কিছুই বলেননি। এটা সমস্যা, দুইটি কারণে। প্রথমত, জানা বা শেখার জন্যে শ্রোতা যে মনোযোগ ও সময় বিনিয়োগ করেছেন, সেটা মাঠে মারা গেলো; দ্বিতীয়ত, বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে জ্ঞানের আদান-প্রদানে যে জ্ঞানচর্চাটুকু হতে পারতো, সেটি হলো না। জ্ঞানচর্চায় অবদান রাখার যে সুবর্ণ সুযোগটুকু বক্তা পেয়েছিলেন, সেটা হেলায় হারিয়ে ফেলেন।
কোনো বিষয়ে বক্তৃতা করতে হলে আপনাকে প্রথমে ভালো শিক্ষক হতে হবে। ভালো শিক্ষক হতে হলে প্রতিটি আইডিয়াকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পর্যায়ে ভেঙে দেখাতে হবে শ্রোতা কিংবা শিক্ষার্থীকে। 'ছিল ঢেঁকি হলো তুল কাটতে কাটতে নির্মূল'। প্রথমে উদাহরণ দেবেন, তার পর প্রয়োজন হলে উপস্থাপন করবেন সাধারণীকরণ বা স্বতঃসিদ্ধ। উদাহরণ যদি ঠিকঠাক মতো দিতে পারেন, তবে শ্রোতা বা শিক্ষার্থীই নিজে থেকে সাধারণীকরণ করে নেবে। বেশির ভাগ বক্তা প্রথমে তত্ত্ব দেয়, তারপর দেয় উদাহরণ এবং শ্রোতার মনে সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যায়।
বক্তার দিক থেকে দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে বড় ভুলটা হচ্ছে শ্রোতাকে নিজের পণ্ডিতি দেখিয়ে অবাক করতে চাওয়া। গজ ফিতা নিয়ে বক্তার জ্ঞানের বহর মাপতে বসবে- শ্রোতার সত্যিই অত সময় নেই। তথ্যের বন্যায় সয়লাব করে শ্রোতাকে কিছুক্ষণের জন্যে চমকে দিতেই পারেন আপনি, কিন্তু সেই চমক বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। রুশ বিপ্লবে কী হয়েছিল, তা না বলে রুশ বিপ্লব নিয়ে রাসেল প্রমুখ বড় বড় দার্শনিকেরা তাদের কোন বইয়ের কত পৃষ্ঠায় কী বলেছেন, ইত্যাদি আগডুম-বাগডুম বলে শ্রোতাদের আপনি তাক লাগিয়ে দিতেই পারেন গুলিস্তানের চুলকানির মলম বিক্রেতার মতো। কিন্তু মোহ যে-ই ভঙ্গ হবে, শ্রোতা কিন্তু আপনার বাপ-মা তুলে গালাগালি করবে, তার অমূল্য সময় নষ্ট করার জন্যে। এক কান দুই কান হয়ে 'দাদার কীর্তি' একদিন সারা দেশে চাউর হয়ে যাবে।
'একজন গাহে ছাড়িয়া গলা, আরজন গাহে মনে'- গান শোনার জন্যে যেমন কমপক্ষে দুই জন ব্যক্তি লাগে, ধর্মাচরণের জন্যে যেমন কওম লাগে, তেমনি জ্ঞানচর্চার জন্যেও একটি 'কওমিউনিটি' লাগে। ধীরে ধীরে কওমের একটা সর্বজনবোধ্য যোগাযোগ মাধ্যম বা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কাও তৈরি হতে হয়। এই কওম একদিনে তৈরি হয় না, কয়েক প্রজন্ম লাগে একটি জ্ঞান-কওম তৈরি হতে। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সায়ীদুল হক খান ফেইসবুকে লিখেছিলেন, 'বীর্যবাহিত হয়ে কওমের এই বোধ প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হয়', কিংবা অনুরূপ কিছু। একাধিক পাঠক, কওমের সঞ্চারণের ব্যাপারটা খেয়াল না করে, বীর্যের প্রতি অতি মনোযোগ দিয়ে ফেলেছিলেন। তাদের মনে হয়েছিল, জেনেটিকসের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা অসম্ভব এবং লেখক বংশগতিবিদ্যার কিছুই জানেন না। এই পাঠকদের বোঝানো সহজ নয় যে জেনেটিকস জেনে বা না জেনেও এমন কথা বলা যায়, কিংবা প্রাচীন ঋষিরা এভাবেই বলতেন, কিংবা 'বীর্য' এখানে নিছক কথার কথা, কিংবা 'বীর্য' বলতে শক্তিও বোঝায়। বোধের, বোধায়নের এই সমস্যা হবার কারণ, বাংলাদেশে জ্ঞানচর্চার কওম এখনও সৃষ্টি হয়নি, লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা তো দূর কি বাত।
লোকিউশানারি, ইলোকিউশানারি, পারলোকিউশানার- এই তিন ধরনের অর্থের (শক্তি বা কর্মও বলা হয়) কথা বলা হয়ে থাকে ভাষাবিজ্ঞানের 'স্পিচ অ্যাক্ট' তত্ত্বে। 'ক্ষুধা লেগেছে'- এই কথার 'লোকিউশানারি' অর্থ 'বক্তা ক্ষুধার্ত'। কিন্তু 'আমাকে খাবার দাও!'- এই অর্থও থাকতে পারে বক্তার মনে। এটা 'ইলোকিউশানারি' অর্থ। শ্রোতা যদি একটা স্যান্ডুইচ বানিয়ে আনে বা কোনো রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায় বক্তাকে, সেটা হবে 'পারলোকিউশানারি' অর্থ বা কর্ম।
এত সব তাত্ত্বিক প্যাঁচাল পাড়ার কারণ এটা বোঝানো যে, সহজ নয় কোনোটাই- না বোঝা, না বোঝানো। বাংলা ভাষায় দুইটি 'বোঝা' আছে: ১. কোনো কিছু বুঝতে পারা এবং ২. মাথার উপরে চাপানো বোঝা। বোঝা এবং বোঝানো উভয়েই বক্তা-শ্রোতা, লেখক-পাঠক, উভয়ের জন্যেই এক বোঝা বটে। বক্তা কিংবা লেখক চাঁদ দেখাতে চাইলেন, শ্রোতা কিংবা পাঠক চাঁদের পরিবর্তে আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছেন- এ রকম প্রায়ই হতে দেখা যায়, যেমনটা হয়েছে বীর্যসঞ্চারণের ক্ষেত্রে। মূল বিষয়ের চেয়ে পারিপার্শ্বিক বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। ফরজের চেয়ে নফল বেশি নজর কাড়তে পারে। বোধের এ সমস্যার কারণে মতান্তর থেকে মনান্তর। দুর্বোধ্যতার, দ্ব্যর্থবোধকতার এ সমস্যা ভাষার সঙ্গে আজন্ম, অঙ্গাঙ্গি জড়িত। ভাষার বোঝা যতদিন বইবো আমরা, ভুল-বোঝাও আমাদের নিত্যসঙ্গী হতে বাধ্য।
আমার এক সহকর্মী টকশোতে যাবেন এক জনের সঙ্গে বাহাস করতে। 'ওর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তুমি কী জানো?' 'ওর' মানে উনার বিরোধী বক্তা। আমি বললাম 'আপা, উনার কথার পিঠে কথা বলবেন আপনি, উনার ব্যক্তিগত জীবনে আপনার কী প্রয়োজন?' সহকর্মী উত্তর দিলেন: 'না, মানে, কিছু তথ্য জানা থাকলে আক্রমণ করতে সুবিধা হতো।' এভাবে আক্রমণ করা যায় না। এগুলো সম্মানজনক আক্রমণ নয়, চোরাই আক্রমণ। গদাযুদ্ধ, অসিযুদ্ধের মতো তর্কযুদ্ধেরও কিছু নিয়ম আছে। মহাভারতের যুগে কোমড়ের নিচে আঘাত করা নিষিদ্ধ ছিল। তর্কযুদ্ধেও বক্তার ব্যক্তিগত বিষয়, জীবনের তথ্য ব্যবহার করে আক্রমণ করা যায় না।
ধরা যাক, আমি কোথাও দুর্নীতির বিপক্ষে বক্তব্য রাখছি, কিন্তু নিজেই আমি এক মহা দুর্নীতিবাজ। আমার বিপক্ষ বক্তা কিন্তু বলতে পারেন না যে, আমি নিজেই যেহেতু দুর্নীতিবাজ, সেহেতু দুর্নীতি নিয়ে কিছু বলার অধিকার আমার নেই। আমি নিজে কী, তার সঙ্গে আমার বক্তব্যের কোনো সম্পর্ক থাকার প্রয়োজন নেই। বক্তব্যের বিপরীতে বক্তব্য দিতে হবে, বক্তার ব্যক্তিগত জীবন সেখানে অবান্তর। যারা বলেন, চমস্কি দারিদ্র্য দূরীকরণের পক্ষে বক্তব্য রাখেন, কিন্তু নিজেই প্রাসাদোপম ভিলায় থাকেন, তারা আসলে তর্ক করতে জানেন না।
অন্য এক সভায় আমি ছিলাম প্রধান বক্তা, আমার বলার কথা, ধরা যাক, চল্লিশ মিনিট। বিশ মিনিট বলে আমি থেমে গেলাম, কারণ শ্রোতাদের কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে। আমার সম্পূরক বক্তা উঠে একাই চল্লিশ মিনিট একটানা বকে গেলেন। আমি মৃদু অনুযোগ করাতে আমাকে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: 'আপনি আপনার বরাদ্দ সময়ের পূর্ণ ব্যবহার করেননি বলে আমি অতিব্যবহার করবো না এটা কেমন কথা।'
'অ্যাই আমি কী বলি শুনেন'- এভাবে শ্রোতা আপনার বক্তব্যের ইয়েতে ঠিক সেই মুহূর্তে কাঠি ঢুকিয়ে দিল, যখন হয়তো আপনি আপনার বক্তব্যের একেবারে ক্লাইমেক্সে পৌঁছে গেছেন। বাংলাদেশে, দক্ষিণ এশিয়ায় কথা কাটার এই ব্যাপারটা প্রায়ই দেখা যায়, টকশো, আলোচনা সভা, সেমিনারে। গবেষণায় নাকি দেখা গেছে, আত্মপ্রেমী বা নার্সিসিস্ট লোকজন কথা বেশি কাটে, কারণ তারা মনে করে, তাদের নিজেদের বক্তব্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু হতে পারে না। বাঙালিরা কথায় কথায় কথা কাটার কারণ সম্ভবত এই যে বেশির ভাগ বাঙালিই আত্মপ্রেমী: 'মুই কী হনুরে'; এ স্বভাবের কারণে বাঙালিরা দল গড়তে পারে না। প্রতিটি বাঙালি সম্ভব হলে একাই নিজের রাজনৈতিক দল গঠন করতো।
কিছু বক্তা আছেন, কথা কাটা যাবার পর একেবারেই দিশেহারা হয়ে যান, ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো। কিছু বক্তা আছেন, কথার নাটাই হাতে ধরে ঘুড়ির নিয়ন্ত্রণ নিতে জানেন, যেমন আসিফ নজরুল। কিছু বক্তা আছেন, যারা কথা কাটা পছন্দ করেন, আবার এমন কিছু বক্তাও আছেন, যারা এতে প্রচণ্ড রেগে যান। রেগে গিয়ে সহবক্তাকে থাপ্পড় দিয়েছেন সর্বসমক্ষে, টেলিভিশনের পর্দায় এমন দৃশ্য সব দেশেই দেখা গেছে কমবেশি, বাংলাদেশে তো বটেই। যেসব দেশে নারীরা পুুরুষকে 'জ্বি হুজুর' করে চলেন না, কথা কাটার কারণে সেখানে দাম্পত্য সমস্যা হয়। আমেরিকায় পাঁচ হাজার আলোচনার ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষেরা ভাবে, নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি বার এবং বেশি রূঢ়ভাবে কথা কাটে। এটা অবশ্য একান্তই পুরুষের ধারণা।
কথা কাটা সম্পর্কে একেক জাতির মনোভাব একেক রকম। ইতালিয়ানরা ব্যাপারটা খুবই পছন্দ করে, কারণ তারা ভাবে, বক্তার বক্তব্যে খুবই আগ্রহী হয়েছেন বলেই না আপনি কথা কাটছেন। জাতি হিসেবে ইতালিয়ানরা একটু অস্থির স্বভাবের, বাঙালিদের চেয়েও এক কাঠি সরেস তারা। ফরাসিরা দুইয়ের মাঝামাঝি। ফরাসি দেশেও কথাকাটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। 'কথা কাটা' এবং 'কথা গোঁজা'র মধ্যে কিন্তু তফাৎ আছে। ইন্টারাপশান এবং ইন্টারজেকশান। কথাকাটিয়ে এবং কথাগুঁজিয়ে- দুই জাতের লোক। ফরাসিরা বা ইতালীয়রা মনে করে, 'কথাকাটিয়ে' প্রকৃতপক্ষে বক্তাকে সাহায্যই করছে, কথার পিঠে কথা গুঁজে দিয়ে। এ কথাগুলো অবশ্য আনুষ্ঠানিক আলোচনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সাধারণ আটপৌরে কথাবার্তায় কথাকাটা বা কথাগোঁজা আমরা প্রায়ই করি এবং তাতে বিশেষ কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রেও, জাতিতে জাতিতে কমবেশি পার্থক্য আছে বৈকি।
জার্মানরা কথা কাটা একেবারেই পছন্দ করে না। জাতি হিসেবে ফরাসি কিংবা ইতালিয়ানদের চেয়ে জার্মানরা তুলনামূলক গম্ভীরও বটে। জার্মান বক্তারা তাদের কথাকাটা পছন্দ না করার পিছনে ভাষাতাত্ত্বিক কারণ থাকতে পারে: যেহেতু লম্বাচওড়া জার্মান বাক্য শেষ হয় মূল ক্রিয়া দিয়ে, সেহেতু যতক্ষণ না বক্তা ক্রিয়াটা উচ্চারণ করছেন, ততক্ষণ শ্রোতা বক্তব্যটা ঠিকঠাকমতো বুঝতে পারবেন না। কথা কাটার কারণে জার্মান বক্তার রেগে যাবার প্রকৃত কারণ জার্মান সিন্ট্যাক্স হওয়া অসম্ভব নয়। জাপানিদের আচরণও জার্মানদের মতোই হবার কথা, চরিত্রগত এবং ব্যাকরণগত কারণে। বাঙালি বক্তার কথা কাটা যায়, কারণ বাংলা বাক্যে কর্তার পরেই থাকে কর্ম, ক্রিয়া আগে পরে যেখানে খুশি বসানো যায় (ক্রিয়া থাকেও না অনেক সময়, ভাদাম্যা জাতির ভাষা কিনা)। সুতরাং 'ক' বললেই শ্রোতা বুঝে যায়, বক্তা 'কলা', 'কমলা' নাকি 'কানমলা' বলছে।
বক্তা মোটামুটিভাবে দুই রকম: অতিজ্ঞানী এবং অজ্ঞানী। অতিজ্ঞানী বক্তা আশা করে, শ্রোতা সব জানে, কিংবা তারা এ কুসংস্কারে বিশ্বাস করে যে, তাদের বক্তব্য শুনতে হলে শ্রোতাকে একটা বিশেষ মানের হতে হবে। শ্রোতা যদি আপনার মতো মহাপণ্ডিত দীপঙ্কর অতীশই হবে, আপনার বক্তৃতা শুনে খামাখা যে 'অতিষ্ঠ' হতে যাবে কেন। অজ্ঞানী বক্তা আগডুম-বাগডুম বলে সময়ক্ষেপণ করতে চেষ্টা করে, যে রকমটা আমরা প্রায়ই দেখি বাংলাদেশের টকশোতে। শ্রোতারা কিন্তু বোকা নয়। অনতিবিলম্বে তারা যখন বুঝে যাবে যে আপনার বক্তব্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আপনার নিজেরই জ্ঞান হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভাষায় 'নিকটস্থ থামের মতো মোটা', তখন দ্বিতীয়বার আপনার বক্তব্য শুনে সময় নষ্ট করার আগে সে দুইবার ভাববে।
কথায় কথায় পৃষ্ঠা নম্বরসহ রেফারেন্স দিতে পারেন যারা, তাদের স্মৃতিশক্তি হয়তো অস্বাভাবিক রকমের ভালো। পৃষ্ঠাসংখ্যা না মিললেও ভয় নেই, কারণ সব সংস্করণে পৃষ্ঠাসংখ্যা এক থাকে না। কিন্তু স্মৃতি কিংবা তথ্যতো জ্ঞান নয়। আপনার স্মৃতি ভালো হবার মানে হচ্ছে, আপনি একটি ভালো ক্যাসেট বা সিডি প্লেয়ার (এ মেশিনগুলোও বাতিল হয়ে গেছে, আমারগুলো কবেই ফেলে দিয়েছি আস্তাকুঁড়ে)। শ্রোতারা অন্তর্জালে বা বইতেই যাবতীয় তথ্য পেতে পারেন। বইতে কিংবা অন্তর্জালে যেটা নেই, সেটা হচ্ছে আপনার নিজস্ব বিশ্লেষণ। শ্রোতা আপনার বিশ্লেষণটা জানতে চায় এবং সেটার সঙ্গে নিজের ধারণা মিলিয়ে দেখতে চায়। শ্রোতা যখন দেখে যে তার মনের কথাটুকুই আপনি বলছেন, তখন সে নিশ্চিন্ত বোধ করে। আপনার বিশ্লেষণের সঙ্গে যখন সে সহমত হয় না, তখন অন্য কোথাও মনমতো বিশ্লেষণের সন্ধান করে। গণমানসে এভাবেই জ্ঞানচর্চা হয়। উচিত বিশ্লেষণ না করে, তথ্যের জঙ্গলে ঘুরপাক খাইয়ে শ্রোতাকে খুশি করবেন ভাবছেন আপনি, সে গুঁড়ে বালি। আমার হাতে যখন ক্যালকুলেটর আছেই, আঠারোর নামতা আপনার মুখস্ত আছে দেখে কেন আমি খামাখা অবাক হতে যাবো।
আগেকার দিনে বুদ্ধিজীবীরাও এখনকার 'টকসওয়ার'দের মতো এখানে সেখানে বক্তব্য রাখতেন। লোকে শুনতো, শুনে খুশি কিংবা বিরক্ত হতো, কিছুদিন মনে রাখতো, তারপর এক সময় ভুলে যেতো। এখনতো বক্তিয়ারদের বক্তব্যের রেকর্ড থেকে যাচ্ছে অনলাইনে। হাতিরপুল কিংবা লিভারপুল, যে কোনো জায়গায় বসে সারা পৃথিবীর যে কেউ আপনার বক্তব্য শুনতে পারে এবং আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বক্তব্যের সঙ্গে আপনার বক্তব্যের তুলনা করে দেখতে পারে। আপনার পক্ষে কিছু মানুষকে কিছুদিনের জন্যে বোকা বানানো সম্ভব হতে পারে, কিন্তু সব মানুষকে সব সময়ের জন্যে বোকা বানানো আগেও কঠিন ছিল, এখন কঠিনতর।
সেই মিশরীয় যুগ থেকে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা অভিভাবকরা সন্তানদের লেখাপড়া (বা পড়ালেখা) শেখানোর জন্য প্রাণাতিপাত করে আসছেন। লেখা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ চিন্তা ও জ্ঞান লেখার মাধ্যমেই যুগান্তরে ছড়িয়ে যায়। যদি আপনি না লিখেন, তবে কৃপণের ধনের মতো আপনার জ্ঞানও বেহুদা নষ্ট হবে। অনেক জানেন আপনি, কিন্তু তাতে আমার কী, যদি আপনার জ্ঞান থেকে আমি উপকৃতই না হতে পারলাম। যখন থেকে লিপি আবিষ্কার হয়েছে, ঘটে আসলেই কিছু আছে এবং লিখতে জানে, কিন্তু লিখেনি, এমন ব্যক্তি বিরল। গর্ভবতী যেমন প্রসব না করে পারে না, সত্যিকারের লেখকও কি কোনো আইডিয়া মাথায় এলে না লিখে স্বস্তি পাবে? সুতরাং আপনি অনেক জানেন, কিন্তু কিছুই লেখেন না, এর একটা অর্থ হতে পারে এই যে আপনি আসলে তেমন কিছু জানেনও না। অন্ততপক্ষে আপনার নিজের এই আত্মবিশ্বাস নেই যে আপনি আসলেই কিছু জানেন।
বহু বিষয়ে বহু কিছু আপনি জানেন, কিন্তু কোনো একটি বিষয়ে গভীরভাবে জানেন না, আধুনিক বা কোনো যুগের বিচারেই আপনাকে ঠিক 'পণ্ডিত' বলা যাবে না। 'পণ্ডিত কানা অহংকারে, মাতবর কানা চোগলখোরে। সাধু কানা অন বিচারে আন্দাজে এক খুঁটি গেড়ে চেনে না সীমানা কার। সবই দেখি কানার হাটবাজার।' সেই কবে লিখেছিলেন লালন।
হস্তিনাপুরের কাকের গল্পটা এখানে প্রাসঙ্গিক। উত্তরমেরুর হাঁসেরা আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশের জলাভূমিতে আসে। আসার পথে একবার তাদের আলাপ হলো হস্তিনাপুরের কাকের সঙ্গে। মহা লায়েক এ কাক, কারণ সে শতপাতে (একশ রকমভাবে) উড়তে পারে। উড়ে দেখালোও সে এবং তার বিচিত্র ওড়াওড়ি দেখে মেরুহংসরা তো হতবাক। অতঃপর হস্তিনাপুরের কাকের শখ হলো, মেরুহংসদের সঙ্গে সেও বাংলাদেশে বেড়াতে যাবে। মেরুহংসেরা আপত্তি করলো: 'না ভাই, অতক্ষণ ধরে তুমি উড়তে পারবে না'। 'আমি কি তোমাদের শত পাতে ওড়ার কায়দা দেখাইনি'- পাল্টা সওয়াল করলো শতপাতী কাক। 'তুমি শতপাতে উড়তে পারো, কিন্তু একপাতে অনেকক্ষণ উড়তে পারবে না'। তাই হলো বটে, শ খানেক মাইল ওড়ার পর হস্তিনাপুরের কাকের পাখা ব্যথা করতে লাগলো এবং মেরুহংসেরা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে রেখে এলো দিল্লীতে।
অনেক কিছু পারে, কিন্তু একটা কিছু ঠিকমতো পারে না, এমন লোক দুই ধরনের হয়: রাজহাঁস টাইপ ও গোখরো সাপ টাইপ। রাজহাঁস খানিকটা উড়তে পারে, খানিকটা হাঁটতে পারে, খানিকটা ভাসতে পারে জলে, আবার বেশ বড়সড় ডিমও দেয়। গোখরো সাপ উড়তে পারে না বটে, কিন্তু উভচর সেও, ছোটখানো চ্যাপ্টা ধরনের ডিমও দেয়, সে ডিম যদিও মানুষের ভোগে লাগে না, সাপের বংশবৃদ্ধির কাজে লাগে শুধু। গোখরো এবং রাজহাঁস উভয়েই 'জ্যাক অব অল ট্রেডস, মাস্টার অব নান' হলেও গোখরোর বিশেষ একটা ক্ষমতা আছে: সে ছোবল দিতে পারে এবং সে ছোবল মারাত্মক। রাজহাঁস দেবী সরস্বতীর বাহন, কিন্তু গোখরো এমন বিপদজনক যে তাকে বাহন করতে দেবতারাও ভয় পায়।
আজ থেকে কয়েক দশক পরে সলিম-উল-আরাকান (বানানান্তরে 'সলিমুলার্কান') এবং আনারকলির (বানানান্তরে 'আনার্কলি') অমর প্রেমকাহিনী বাংলাদেশের পাঠক-শ্রোতাদের মনে পড়লেও পড়তে পারে। রোসাঙ্গ রাজপুত্র আর্কান অনেক বিষয়েই জানতেন, দাঁড়ি-কমা সহই জানতেন, কিন্তু কোনো বিষয়েই তিনি ঠিক বিশেষজ্ঞ ছিলেন না, যার প্রমাণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত এক অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতো কোনো বিষয়েই তিনি তেমন কিছু লিখে যাননি। এর কারণ হয়তো 'শতম বদ মা লিখ'- এ সংস্কৃত প্রবাদ তারা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করতেন। যার অর্থ: 'যত খুশি বকবক করো, কিছু লিখতে যেও না'; বকাবকি কেউ মনে রাখে না, কিন্তু লিখিত বক্তব্যের ভুল কেউ না কেউ ধরবেই, আজ নয়তো কাল। ভুল করার ঝুঁকি আর্কান কেন নিতে যাবে, খামাখা।
নিউ মার্কেটের বিডিআর গেইটের বটতলার এক ফেরিওয়ালা নাকি পোকা মারার ওষুধের পসরা সাজিয়ে বসতো এবং বসার কিছুক্ষণ পর হস্তধৃত চুঙায় 'সারমেয় শাবক', 'বরাহ শাবক' ইত্যাদি গালাগাল দিয়ে উঠতো হঠাৎ করেই। লোকজন কৌতূহলী হয়ে কাছে এগিয়ে আসলে ফেরিওয়ালা তার বাক্য শেষ করতো এই বলে: 'বরাহশাবক, সারমেয় শাবক ওরফে তেলাপোকা ও ছারপোকা মারার ওষুধ এখানে বিক্রি হচ্ছে!' অনেকটা এই ফেরিওয়ালার মতোই সমসাময়িক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অপছন্দের কাউকে কাউকে বিনা প্ররোচনায় 'মূর্খ', 'গাধা' বলে গালাগালি করতেন সলিমুলার্কান, শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যেই হয়তোবা। বাংলা ভাষা ও ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে প্রায় তিন দশকব্যাপী সাধ্যমতো পড়াশোনা ও লেখালেখি করেছেন, এমন এক সহকর্মী সম্পর্কে আর্কানের মূল্যায়ন ছিল, ভাষা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। এহ বাহ্য, নোয়াম চমস্কির মতো প্রাতস্মরণীয় ভাষাতাত্ত্বিক ভাষা সম্পর্কে জানেন না কিছু, এমন বক্তব্য যখন তিনি স্বকণ্ঠে দিয়েছেন অবলীলায়, সামনে বসা আনার্কলিরা হাততালি দিয়ে আর্কানকে সমর্থন করেছে, কারণ মুঘলে আজম ছবিতে একট গান আছে: 'প্যায়ার কিয়া তো ডরনা ক্যা!'
আনার্কলিরা সলিমুলার্কানকে অন্ধের মতো ভালোবাসতো। তাদের বিচারে, বুদ্ধিজীবী রাজপুত্র হিসেবে এক-আধটু গালাগালি তো তিনি করতেই পারেন। গালাগালি করা, পাগলের মতো মুখ দিয়ে যা আসে তাই বলা যদি মানবাধিকার হয়ে থাকে, তবে সে অধিকার তো যে কোনও মানবের থাকা উচিত। যুগে যুগে যে কোনো অন্ধ ভক্ত আসলে 'আনার্কলি' তিনটি কারণে: ১. বুদ্ধির অতিস্বল্পতাহেতু তাদের কথার দাম এক আনার বেশি নয়; ২. আজীবন 'আনাড়ি' কলিই থেকে যায় তারা, কখনই পাঁপড়ি মেলে ফুল হয়ে ফুটতে পারে না, এবং ৩. তারা ভাবে, পৃথিবীতে তাদের 'আনা' হয়েছে, কোনও না কোন সলিমের পক্ষে বুঝে না বুঝে বেহুদা 'কলকল' করার জন্যে।
তালি এক হাতে বাজে না, দোষ কিন্তু শ্রোতা কিংবা পাঠকেরও আছে। আর্কানের দোষ যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি দোষ আনারকলির। প্রশংসা যার প্রাপ্য তার প্রশংসা না করে, প্রশংসা অপাত্রে দান করলে কিংবা প্রয়োজনাতিরিক্ত দান করলে জ্ঞানচর্চার ক্ষতিই করা হয়। 'বিদ্যা বিনয় দান করে'- এই প্রবাদের অর্থ কিন্তু এই নয় যে কোনও 'বক্তিয়ার' ফালতু বকবক করলে কিংবা কোনো 'লিক্তিয়ার' যা লেখার কথা, তা না লিখলে, শ্রোতা কিংবা পাঠককে তার সময় ও মনোযোগ নষ্ট হওয়া জনিত রাগ ভদ্রভাবে চেপে যেতে হবে। একজন পাঠক কিংবা শ্রোতা হচ্ছে খদ্দের, বক্তা কিংবা লেখক হচ্ছেন দোকানদার। বিনয়ী হবে দোকানদার, কারণ তাকে অনেক সময় দুই নম্বরী মাল বেঁচতে হয়। পাঠক এবং রিভিউয়ারের বিনয়ী হবার কোনো দায় নেই, ঠিক যেভাবে অসন্তুষ্ট খদ্দেরের ভদ্রতা দেখানো অত্যাবশ্যক নয়।
'তুমি খারাপ লিখেছো, খারাপ বলেছো' এমন কথা মুখের ওপর বলতে হবে, যদি আসলেই কেউ খারাপ লিখেন কিংবা বলে থাকেন। জ্ঞানচর্চায় সত্যের স্থান আছে, বিনয়ের কোনো স্থান নেই। কালোকে কালো এবং সাদাকে সাদা বলার সংস্কৃতি সমাজে চালু না হলে জ্ঞানের মোড়কে ইংরেজিতে যাকে বলে 'বুলশিট', সেই গোবরে অ্যাকাডেমিয়া ভরে যাবে। ঠিক এ ব্যাপারটাই ঘটছে বাংলাদেশে- বেশির ভাগ অ্যাকাডেমিক মূলত গোবর প্রসব করেই আনন্দে অষ্টখণ্ড হচ্ছেন এবং আনার্কলিরা এ গোবর ভক্ষণ করে বা স্রেফ শুঁকে 'কী এক মহা 'বর' পাইছি' ভেবে মহানন্দে হাততালি দিচ্ছে। আগেই বলেছি, জ্ঞানচর্চার জন্যে একটা কওম লাগে। সেই কওমের অধিকাংশ সদস্য যদি 'সলিমুলার্কান' ও আনার্কলি টাইপ হয়, তবে সেই কওম হবে একটি 'গোবর-এ-অ্যাকাডেমিয়া', যেখানে শুধু গোবর পয়দা হবে, বিন্দুমাত্র জ্ঞানচর্চা হবে না।
নামিদামী পত্রিকায় হোমওয়ার্ক মুদ্রিত করে লেখক-গবেষকেরা ইদানিং আহ্লাদে অষ্টখণ্ড হচ্ছেন। রিভিউয়ার বুদ্ধিজীবীরা সোৎসাহে পরষ্পরের পৃষ্ঠকুণ্ডয়ন করে চলেছেন। এক ক্ষুরে মাথা কামানো চোরে চোরে মাসতুতো ভাই সব। পয়সা লাগেনা তো, সুতরাং ওয়েবিনারের মচ্ছব চলছে। আলুর গুদামে আগুন লেগেই আছে এবং স্বাভাবিকভাবেই গোপাল ভাঁড়েরা মুফতে পোড়া আলু পেয়ে খুশি, যতই অখাদ্যই তা হোক না কেন। কত হাজার জন আমার প্রবন্ধ পড়েছেন- ফেইসবুকে এ ঘোষণা দিয়ে কত আদেখলা লেখক আনন্দে আত্মহারা হচ্ছেন। কবির সুনাম এবং আনারকলিদের হাততালির কারণে পাঞ্জাবির পকেটে ভিজে শুকিয়ে থাকা লন্ড্রির রশিদ সর্বোত্তম কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছে। 'সত্য কাজে কেউ নয় রাজি, সবই দেখি তা না না না'- লালনের এই উপলব্ধি আজকের দিনেও শতভাগ সত্য।
লক্ষ লোকে কোকাকোলা পান করে, লাস্সি আর কজন খায়? এর মানে কি এই যে পানীয় হিসেবে কোকাকোলা লাস্সির চেয়ে উপাদেয়, স্বাস্থ্যকর? পড়া কি গাছে ধরে হে দাদা কিংবা দিদি? পড়ার লোক কোথায়? পড়ার জন্য যে সময়, শিক্ষা, অবসর, মনোযোগ, মানসিক প্রস্তুতি দরকার, সেটা কি আনারকলিদের আদৌ আছে? সুতরাং যাদের পাঠক মনে করে পুলকিত হচ্ছো তুমি হে নাদান লেখক, তারা মূলত ওষ্ঠসেবক, যারা কিনা যতটা না পড়ে, তার চেয়ে বেশি লিপসার্ভিস বা ওষ্ঠসেবা দেয়। বই কিনে, প্রবন্ধ ডাউনলোডায়, কিন্তু পড়ে না একটাও। পড়ে যে না, তাতো তাদের কথাবার্তা, মন্তব্য বা লেখালেখির মান দেখেই বোঝা যায়। 'পড়লে' তো তার একটা প্রভাব 'পড়তো', লেখা কিংবা বলায়।
না পড়ার কারণও অবশ্য আছে। নিউ মার্কেটের সেই ফেরিওয়ালা চাটাইয়ের ওপর আঠালো কিছু একটা ঢেলে দিতো এবং রাজ্যের মশামাছি সেই আঠার ওপর 'উড়ে এসে পড়ে মরতো'। সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেরিওয়ালারা আকর্ণ সহাস্যে, মুখে বেশ একটা বুজুর্গ ভাব এনে বলতো: 'পড়ে আর মরে'। পড়া আসলেই একটা আঠালো ব্যাপার। যে একবার ঠিকঠাক মতো পড়ে মজা পেয়েছে, তার গায়েই জ্ঞানস্পৃহার আঠা লেগে গেছে এবং সেই জন্মের মরা মরেছে, কারণ তারপর থেকে তাকে বার বার পড়তে হবে। ঠিক এ কারণেই বলা হয়: 'অজ্ঞরাই আশীর্বাদপ্রাপ্ত'। সুতরাং আনার্কলিরা যে মরার ভয়ে পড়ার ঝুঁকি নিতে চাইবে না, সেটাতো খুবই স্বাভাবিক একটা আচরণ। একটা কাজ অবশ্য তারা করে ঘুমিয়ে, ঘুমচোখে কিংবা জাগ্রত অবস্থায়: বন্ধু, বান্ধবী কিংবা সহকর্মী কিছু একটা লিখেছে, একটা লাইক তারা দিয়েই দেয়। 'যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়, তথাপিও মোর গুরু নিত্যানন্দ রায়'। কিংবা 'কাপড় তুলিয়া প্রভূ সভাতে বুতিলা ('ম' এর স্থলে 'ব' এর শালীন প্রয়োগ), শিষ্যগণে ভাবে বুঝি এও এক লীলা।'
বুদ্ধিজীবিতার একটা আকাল চলছে বিশ্বব্যাপী এবং সরব গোখরোদের ভয়ে কেউ টু শব্দ করছে না। 'দিকে দিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস', 'রাজা, তুমি উলঙ্গ'- বলার মতো সরল এবং সাহসী শিশু কোথায় আজকাল? 'ভয় দেখিয়ে করছো শাসন, জয় দেখিয়ে নয়'- লিখেছিলেন নজরুল। কেউ না কেউ, এক দিন না এক দিন, এই ভয়ের টুঁটি টিপে ধরবেই। সেই শুভদিন না আসা পর্যন্ত বাংলাদেশ কিংবা বিশ্বের বুদ্ধিজীবিতার বহতা নদীতে হিংটিংছট কবিতার সেই বাঙালি বক্তিয়ার, দিল্লীর শতপাতি কাক, গোখরো সাপ, সলিমুলার্কান এবং আনার্কলিদের মাৎস্যন্যায় আকছার সহ্য করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। গোবর-এ-অ্যাকাডেমিয়ায় এখন এদেরই রমরমা এবং জলে বাস করে কদাপি কুমিরের সঙ্গে বিবাদ চলে না।