Published : 04 Sep 2021, 11:02 PM
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ১২ তারিখ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হচ্ছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি, বিশেষত সংক্রমণ ৭০ শতাংশ কমে আসায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বলাবাহুল্য এতে করে অনেকে যেমন প্রশ্ন তুলবেন, তেমনি অনেকে স্বাগত জানাবেন। স্বাগত জানানোর যথেষ্ট কারণ দেখছি। শিক্ষার্থীদের কথাতেই তা পরিষ্কার।
ঢাকার শহীদ বীরউত্তম লেফটেন্যান্ট আনোয়ার গার্লস কলেজের শিক্ষার্থী রায়া আদিবা আহমেদ। তার ভাষায়. "কলেজ লাইফটা কী, সেটাই তো জানলাম না। স্কুলের পর কলেজটা আসলে কেমন হয়, সেটা তো বুঝতে পারলাম না।" করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঘরে বসেই কলেজে ভর্তি হয়েছেন আদিবার মতো লাখো শিক্ষার্থী। প্রথম বর্ষ পেরিয়ে গেছে তাদের, কিন্তু কলেজে ক্লাস করা হয়নি। নিজেরা এখন কোন অবস্থানে রয়েছেন, সেটাও বোধগম্য ঠেকছে না লালমনিরহাটের পাটগ্রাম আদর্শ কলেজের শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর আলমের কাছে। এই শিক্ষার্থী বলেন, "কোন ইয়ারে আছি, সেটা বুঝতে পারছি না। মনে হয়, সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। কিন্তু আমাদের তো কোনো পরীক্ষাই হয়নি।" আদিবা ও জাহাঙ্গীরের মতো এমন শিক্ষার্থী রয়েছেন ১৪ লাখের মতো।
এই চিত্র এখন বাংলাদেশসহ দুনিয়ার বহু অংশের জন্যই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে, বাংলাদেশের মতো লাগাতার স্কুল-কলেজ বন্ধ খুব কম দেশে হয়েছে। সিডনিতে শুধু কঠোর লকডাউনের সময়টুকু ছাড়া মাঝে মাঝেই খুলে দেয়া হয়েছে স্কুল। শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতা আর লেখাপড়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এসব করার পরও কয়েকবার দুর্ঘটনা এড়ানো যায়নি। ছড়িয়ে পড়েছিল করোনাভাইরাস। শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল, শিশুদের ওপর কোভিড তেমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে না। আর তরুণ-তরুণীদের তো কাবু করতেই পারে না। এখন এসে বোঝা যাচ্ছে এসব ছিল অসার কথা। অস্ট্রেলিয়ায় কিশোর-কিশোরী এমনকি শিশুদেরও টিকার আওতায় আনার তালিকা করা হচ্ছে। এই মহামারী তার ছোবল থেকে কাউকেই ছাড় দিতে নারাজ।
বাংলাদেশের বাস্তবতা আর জনঘনত্ব মাথায় রেখেই বলি, এখন স্কুল-কলেজ খোলার কোনো বিকল্প নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মুখ না খুললে দেশে কিছুই হয় না। শেষপর্যন্ত তাকেই বলতে হলো, তৈরি হোন, স্কুল-কলেজ খুলতে যাচ্ছে। আমি জানি, এই সিদ্বান্তে অনেকেই আপত্তি জানাবেন। মুখে না বললেও মনে মনে মানতে না চাওয়ার মানুষের সংখ্যা বেশি। গোড়াতেই বলি, অভিভাবক পিতা-মাতা আর সন্তানদের দুর্ভাবনা কিংবা আসন্ন বিপদ-দুশ্চিন্তার সাথে আমি একমত। আমার শিশুকে স্কুলে পাঠাতে আমিও উদ্বিগ্ন থাকতাম। কিন্তু শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের অনেকের উদ্বেগের কারণ আমি বুঝি না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানাভাবে চেনাজানা অজস্র স্কুল-কলেজের শিক্ষককে দেখি, তারা নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোথায় যান না আপনারা? তাছাড়া কিশোর-কিশোরী, তরুণেরা কি গৃহবন্দী? না, তারাও নানা অজুহাতে ঘুরছে। তাহলে স্কুল-কলেজে গেলেই খালি করোনাভাইরাস হবে? আর কোথাও সে আক্রমণ করে না? স্পষ্ট করিই বলি, না যেতে যেতে বাড়িতে থাকার সংস্কৃতি গ্রাস করেছে অনেককে। আর ক্রমেই তা এক ধরনের ফোবিয়াতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এভাবে তো চলে না।
ইউনিসেফের মতে, বাংলাদেশ ছাড়া আরও ১৩টি দেশে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে লাগাতার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে অব্যাহতভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক বছরের বেশি বন্ধ রয়েছে। অন্য দেশগুলো সুবিধামতো সময়ে স্কুল-কলেজ খোলা রাখলেও আমরা তা করিনি। গত বছর লকডাউনের তিন মাসের অর্থনৈতিক ক্ষতির যে হিসাব দেয়া হয় তার মধ্যে কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ক্ষতির হিসাবটি বিবেচনায় আনা হয় না। শিক্ষার বহুমাত্রিক দিক থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি সহজে পরিমাপ করা যায় না। আমরা ভুলে যাচ্ছি, আমাদের দেশ শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা নির্ভর দেশ না। এই বড় শহরগুলোর বাইরে মফস্বল ও গ্রামে এক বছরের বেশি সময় বাড়িতে বসে থাকা ছেলে-মেয়েদের মা-বাবারা তাদেরতে বসিয়ে রাখতে পারেন না। হয় তারা কাজে ঢুকে পড়ে, নয়তো অভ্যস্ত হয় নানা ধরনের নেশায়। তাদের কীভাবে দোষ দেবেন?
এক বছর সময়কাল বাড়িতে থাকা ছেলে-মেয়েরা খালি অনলাইনে পড়বে বা শিখবে এটা কি ন্যায়সঙ্গত চাওয়া? এর ফাঁকে তারা মোবাইল-ল্যাপটপের প্রেমে পড়ে গেছে। এমনিতেই আমাদের দেশের শিক্ষার মান ভালো কিছু না। পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা কিংবা তেমন কিছুর ধারে কাছেও নেই আমরা। তার ওপর যদি বছর ধরে এমন বন্ধ থাকে তাহলে আখেরে যে কি হবে সেটা লেখাপড়া না জানা মানুষও বলে দিতে পারবেন।
এখন সরকার ধীরে ধীরে খোলার যে আদেশ দিয়েছে তার আলোকে কয়েকটা কথা বলি। করোনা যখন যাবে না এবং এর সাথেই থাকতে হবে তাহলে কৌশলও সেভাবে নির্ধারণ করা হোক। জনবহুল দেশে উপচে পড়া শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষগুলো চাইলে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ধরুন, যদি ১০০ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকে তাহলে তারা ৫০ জন করে দু ভাগে বিভক্ত হয়ে আসতে পারে। তাদের দুদিনে একই পড়া শেষ করানো যেতে পারে। এমন বিভক্ত করে দলে দলে ক্লাস করানো একেবারে না আসার চাইতে অনেক ভালো ও ফলপ্রসূ হবে।
সামাজিক দূরত্ব এবং স্যানিটাইজেশান নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি যাদের পক্ষে সম্ভব তারা যেন অতি অবশ্যই টিকা গ্রহণ করেন। সরকার এই দিকটা দেখবে বলেও কথা দিয়েছে। মোট কথায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর বন্ধ করে রাখাটা ঠিক না। আমাদের শিক্ষার্থীদের মানসিক ট্রমা আর বিষণ্নতার দিকটি কেউ ভাবে না। উন্নত দেশে ইতোমধ্যেই বিষণ্নতাজনিত আত্মহননের হার বেড়েছে। স্বাভাবিক জীবন আনন্দ আর উৎসাহবিহীন জীবন তো মৃতেরই জীবন। করোনাকে মোকবিলা করেই বাঁচতে হবে সবাইকে। তাছাড়া দুবছর ধরে সবাই এর গুরুত্ব, বিভীষিকা আর বাঁচার নিয়ম জেনে গেছে। একটা শিশুও জানে মাস্ক কী এবং কীভাবে পরতে হয়।
স্কুল-কলেজ খোলার সিদ্বান্তকে স্বাগত জানাই। আর দেরি না করে অন্য সবকিছুর মতো স্কুল-কলেজও খুলে যাক। সব ধরনের ভয় ও মানসিক চাপ মুক্ত হয়ে শিক্ষকদের উচিৎ নতুনভাবে শুরু করা। আর সরকার ও কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সময় থেকে এসব নিয়ে যেকোনো অপরাজনীতি বা হাঙ্গামা রোধ করা। আবার লেখাপড়ার জগত উন্মোচনের জন্য শুভকামনা। দেশ-জাতি ও শিশু-কিশোর এবং তারুণ্যের স্বার্থে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলাটা জরুরি মনে করি। সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার জন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানাই। ১২ তারিখ থেকে খুলে যাক আলোর দুয়ার।