Published : 06 Dec 2020, 05:37 PM
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ অর্জন। মুক্তিযুদ্ধ বহুমাত্রিক, এটি বিরাট সংখ্যার ধারণাতীত ত্যাগ, অশ্রু, বেদনাভোগের সফল পরিণতি। মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরেও এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মানেই বিজয়ের ইতিহাস। আর বিজয়ের ইতিহাস বলতে রণাঙ্গনের সশস্ত্র বিজয়ের কথা বলা হয়। আবার রণাঙ্গনে বিজয়ের প্রসঙ্গে অবধারিত হয়ে ওঠে ১১টি সেক্টরের বিজয় এবং সে বিজয় অর্জনে সেক্টর ও সাব-সেক্টর নেতৃত্বের ভূমিকা। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয়ে উঠেছে মূলত ১১টি সেক্টরের বিজয় কাহিনী। এর বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সাথে যুক্ত বাংলাদেশ সরকার, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বা মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট, বিদেশি সিভিল সমাজ, অবরুদ্ধ দেশ, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ, গণহত্যা-নির্যাতন প্রভৃতি সেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্থান পায়নি।
২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ৩০ মার্চ ভারতে যান ও ২ এপ্রিল দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলে তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে জয়ী এমএনএ এবং এমপিএ-দের একটি অধিবেশন আহ্বান করেন কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে। এই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ এপ্রিল গঠন করা হয় একটি সার্বভৌম সিভিল কর্তৃপক্ষ যার নাম বাংলাদেশ সরকার। মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য গঠিত হয় মন্ত্রিপরিষদ। ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার প্রথম বেতার ভাষণে বাংলাদেশে চলমান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ৮টি রণাঙ্গনের কথা উল্লেখ করেন। ১১ এপ্রিল সরকার এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে। ১২ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার থেকে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেন। জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে যুদ্ধ-পরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রিসভার এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এখানে সার্বিক যুদ্ধ-পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীন রণাঙ্গন তথা যুদ্ধাঞ্চল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই উদ্দেশ্যে কর্নেল ওসমানীকে সমন্বয় সভা আয়োজনের নির্দেশ দেওয়া হয়। ১১ থেকে ১৭ জুলাই সেনা সদরদপ্তরে তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে যুদ্ধকৌশল ও যুদ্ধ পরিচালনায় বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়। সার্বিকভাবে একটি কমান্ডে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি, লে. কর্নেল এম এ রবকে চীফ অফ স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ নিযুক্ত করা হয়। এ সভায় সম্পূর্ণ বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টর বা রণাঙ্গনে বিভক্ত করা হয় এবং প্রতিটি সেক্টরের সীমা নির্দিষ্টকরণ ও সঠিকভাবে চিহ্নিতকরণ করা হয়। এসব কর্মকাণ্ড শেষ করতে করতে সরকার অগাস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময় নিয়ে ফেলে। ডিসেম্বরে বিজয় অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত সামরিক ফ্রন্টে বাংলাদেশ সরকার উল্লিখিত কাঠামোই বলবৎ রাখে। বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত মুক্তিবাহিনী এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে অগাস্ট পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগী শক্তিকে মোকাবেলা করেছিল প্রধানত দেশের সীমান্ত এলাকায়। কিন্তু অবরুদ্ধ দেশের অভ্যন্তরে এপ্রিল থেকেই চলছিল সর্বাত্মক প্রতিরোধযুদ্ধ। তাহলে প্রশ্ন ওঠে কারা করেছিল এসব প্রতিরোধ?
বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ও সমর্থনের বাইরে অঞ্চল ভিত্তিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছিল বেশকিছু আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের শেষাবধি তারা অবরুদ্ধ দেশে অবস্থান করেই পাকিস্তানি সৈন্যদল ও তাদের এদেশীয় দালালদের মোকাবেলা করেছিল। অবরুদ্ধ জনগণের মনোবল বৃদ্ধি করে, অসংখ্য যোদ্ধা তৈরি করে, বাংলাদেশ সরকারের অধীন নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুতে সহায়তা করে ও নানাভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সফল করতে এসব বাহিনী খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এ ধরনের অঞ্চলভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা দলকে আমরা আঞ্চলিক বাহিনী বলছি। আঞ্চলিক বাহিনী বলতে আমরা সেই সব মুক্তিযোদ্ধা দলকে বুঝি যারা ভারত সরকার, বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা (অস্ত্র, প্রযুক্তি, অর্থ, প্রশিক্ষিত যোদ্ধা ও অন্যান্য লোকবল, ইত্যাদি) ব্যতীত সম্পূর্ণ ব্যক্তি প্রচেষ্টায় ও স্থানীয় জনগণের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে অবরুদ্ধ দেশে গড়ে উঠে এবং মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষাবধি দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করে দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদল ও তাদের এদেশীয় সহযোগী শক্তির (রাজাকার, আল বদর, আল শামস, শান্তি কমিটি, দালাল, ইত্যাদি পাকিস্তানপন্থি) বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। আঞ্চলিক বাহিনীসমূহ সর্বদাই স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো কোনো আঞ্চলিক বাহিনীর সামর্থ্যে ও কর্মকাণ্ডে আশ্বস্ত হয়ে বাংলাদেশ সরকার বা সেক্টর কর্তৃপক্ষ অগাস্টের পর থেকে নভেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বাহিনী প্রধান বা অধিনায়ককে সাব-সেক্টর কমান্ডার বা এরিয়া কমান্ডার বা থানা কমান্ডার হিসেবে ঘোষণা করেছিল এবং এই কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনো বাহিনী সামান্য অস্ত্র সহায়তাও পেয়েছিল। এ ধরনের সহায়তা প্রাপ্তি সত্ত্বেও যেসব মুক্তিযোদ্ধা দল তাদের স্বকীয়তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল এবং যুদ্ধকালে কখনোই অন্য কোনো বাহিনী বা দলের কমান্ডের অধীন থেকে যুদ্ধ করেনি সেসব মুক্তিযোদ্ধা দল আঞ্চলিক বাহিনী হিসেবে গণ্য। উপর্যুক্ত সংজ্ঞানুসারে মুক্তিযুদ্ধকালে টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী ও বাতেন বাহিনী, ময়মনসিংহের আফসার বাহিনী, মানিকগঞ্জের হালিম বাহিনী, গোপালগঞ্জের হেমায়েত বাহিনী, চাঁদপুরের পাঠান বাহিনী, কুড়িগ্রামের আফতাব বাহিনী, সিরাজগঞ্জের লতিফ মির্জা বাহিনী, নওগাঁর ওহিদুর বাহিনী, মাগুরার আকবর বাহিনী, বাগেরহাটের রফিক বাহিনী, সুন্দরবনের জিয়া বাহিনী আঞ্চলিক বাহিনী হিসেবে বিবেচ্য।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা আঞ্চলিক বাহিনীসমূহের অবদান রয়ে গেছে অনালোচিত। অবরুদ্ধ দেশে গড়ে ওঠা আঞ্চলিক মুক্তিবাহিনীসমূহের প্রায় সবগুলো দল এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকেই পাকিস্তানি সৈন্যদল ও তাদের এদেশীয় সহযোগী শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করে। ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে সেক্টর ও সাব-সেক্টর গঠন করা পর্যন্ত সীমান্ত এলাকা বাদে দেশের অভ্যন্তরে সরকারি বাহিনী উল্লেখযোগ্য কোনো সামরিক তৎপরতা চালায়নি। এ সময়ে অবরুদ্ধ দেশে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহযোগী শক্তির বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তার সিংহভাগ গড়ে তুলেছিল আলোচ্য আঞ্চলিক বাহিনীগুলো। সেক্টর ও সাব-সেক্টর গঠনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক তৎপরতা চলেছিল মূলত সীমান্ত এলাকায়। অথচ আঞ্চলিক বাহিনীগুলোর সামরিক তৎপরতা (আফতাব বাহিনী বাদে) চলেছিল অবরুদ্ধ দেশের অভ্যন্তরে- আরো এগিয়ে বললে দেশের ভূখণ্ডের প্রায় মাঝখানে পাকিস্তানি সৈন্যদলের পেটের ভেতর। এটি নিঃসন্দেহে খুবই দুঃসাহসী ভূমিকা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার দাবি রাখে। সাব-সেক্টর বহির্ভূত এলাকাগুলোর মধ্যে সিরাজগঞ্জ-পাবনা এলাকায় লতিফ মির্জা বাহিনী, নওগাঁ দক্ষিণ ও রাজশাহীর বিল এলাকায় ওহিদুর বাহিনী, মাগুরায় আকবর বাহিনী, টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনী ও বাতেন বাহিনীই মূলত তৎপর ছিল। এ বাহিনীগুলোর আওতাভুক্ত এলাকায় অগাস্টের পর থেকে সেক্টর কর্তৃপক্ষ ছোট ছোট দলে মুক্তিযোদ্ধা (এফএফ) পাঠাতে শুরু করলেও তারা ছিলেন সংখ্যায় ও সামর্থ্যে নগণ্য। এ ধরনের ছোট ছোট মুক্তিযোদ্ধাদলের অধিকাংশই রণক্ষেত্রে কৌশল ও নিরাপত্তার কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সক্রিয় আঞ্চলিক বাহিনীর মধ্যে লীন হয়ে গিয়েছে। সুতরাং এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, উল্লিখিত এলাকাগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তিই ছিল পূর্বোক্ত আঞ্চলিক বাহিনীগুলো।
আঞ্চলিক বাহিনীগুলোর অবস্থান দেশের অভ্যন্তরে হওয়ায় এ বাহিনীগুলোর আওতাভুক্ত এলাকা হয়ে উঠেছিল ভারত প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় স্থল ও অনেকটা নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র। বাংলাদেশ-ভারত যৌথকমান্ড গঠনের পর মিত্র বাহিনীর অভিযানে আঞ্চলিক বাহিনীগুলোর বেশিরভাগই কৌশলগতভাবে খুব তাৎপর্যপূর্ণ সহকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ভারতীয় বাহিনীর উত্তর-পূর্ব সেক্টর জামালপুর-টাঙ্গাইল-ঢাকা অক্ষরেখা বরাবর যে অভিযান পরিচালনা করে সে অভিযান সফল করতে কাদেরিয়া বাহিনী, বাতেন বাহিনী, আফসার বাহিনী খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর দক্ষিণ-পূর্ব সেক্টর এর ৬১ মাউন্টেন ব্রিগেড ডিসেম্বরে চাঁদপুর শহরে পৌঁছানোর পূর্বেই এই এলাকার অধিকাংশ থানা ও সবশেষে চাঁদপুর শহর পাঠান বাহিনীর যোদ্ধাদের হাতে মুক্ত হয়। এর বাইরে মিত্র বাহিনীর পশ্চিম সেক্টরের ৬২ মাউন্টেন ব্রিগেড ৮ ডিসেম্বরে মাগুরা পৌঁছানোর পূর্বে আকবর বাহিনী মাগুরা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আঞ্চলিক বাহিনীসমূহ তাদের আওতাভুক্ত এলাকার অধিকাংশ এককভাবে দখলদার মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য যৌথ নেতৃত্বেও তারা বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করে। কাদেরিয়া বাহিনী পুরো টাঙ্গাইল জেলা মুক্ত করে। এই কাজে বাতেন বাহিনীও সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আফসার বাহিনী দক্ষিণ ময়মনসিংহের ভালুকা, ত্রিশাল, গফরগাঁও থানা মুক্ত করে। হালিম বাহিনী মুক্ত করে পুরো মানিকগঞ্জ মহকুমা। হেমায়েত বাহিনী মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জসহ আরো কয়েকটি থানা। চাঁদপুরে পাঠান বাহিনী মুক্ত করেছিল হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি, ফরিদগঞ্জ ও চাঁদপুর সদর। ওহিদুর বাহিনীর তৎপরতায় মুক্ত হয়েছিল নওগাঁ মহকুমার আত্রাই, রানীনগর, মান্দা, নিয়ামতপুর, নাটোর মহকুমার সিংড়া, বাগাতিপাড়া এবং রাজশাহীর পুটিয়া, দুর্গাপুর, বাগমারা থানা। লতিফ মির্জা বাহিনীর বদৌলতে সিরাগঞ্জের তাড়াশ, উল্লাপাড়া, বেলকুচি, চৌহালী থানা মুক্ত হয়। মাগুরার আকবর বাহিনী মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল শ্রীপুর ও মাগুরা সদর থানা। সুন্দরবন এলাকায় গঠিত জিয়া বাহিনী মুক্ত করে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া, কাঁঠালিয়া, পিরোজপুর সদর থানা। এছাড়া বাগেরহাট সদর থানা পাকিস্তানি সৈন্যমুক্ত করতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল রফিক বাহিনীর সদস্যদের।
আঞ্চলিক বাহিনীসমূহ নিজ নিজ ব্যবস্থাপনায় যুদ্ধকালে পঁয়তাল্লিশ হাজারের অধিক প্রশিক্ষিত যোদ্ধা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অধ্যুষিত দেশে এই বিরাট সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা তৈরি মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিশ্চয়ই খুব তাৎপর্যবাহী ছিল। এছাড়া বাহিনীর নানা প্রয়োজনে (গোয়েন্দা কার্যক্রম, চিকিৎসা সেবা, জনসংযোগ প্রভৃতি) অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ধরনের প্রশিক্ষণ মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর একটি রাজনৈতিক বোধ তৈরিতে সহায়ক হয়। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার সুযোগ কমে আসে। আঞ্চলিক বাহিনীগুলো তাদের আওতাভুক্ত এলাকায় শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধের সূচনাপর্ব থেকেই সক্রিয় ছিল। সাধারণভাবে সমাজবিরোধী উপাদান (চোর, ডাকাত, লুটেরা, নির্যাতনকারী ইত্যাদি) নিমূর্লের মাধ্যমে এ প্রচেষ্টার সূত্রপাত হয়েছিল। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এদেশীয় শক্তি (রাজাকার-দালাল-শান্তি কমিটির সদস্য ইত্যাদি) যারা সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধপন্থি জনতার শান্তি, সম্পদ, সম্মান ও জীবনহানির কারণ হয়েছিল, তাদের অনেককেই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে শাস্তি (আর্থিক দণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত) দিয়ে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করেছিল আঞ্চলিক বাহিনীগুলো। এর ফলে সাধারণ জনতা নিজ নিজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যুদ্ধের সূচনাপর্ব থেকেই আরো বেশি মাত্রায় সহযোগিতা করতে শুরু করেছিল। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের এই প্রচেষ্টার ফলেই সাধারণ জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ড ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয় এবং এর ফলেই মুক্তিযোদ্ধা জনতার মিলনে সূচনা হয় জনযুদ্ধের। মুক্তিযুদ্ধকালে আঞ্চলিক বাহিনীগুলোর অনেকেই শরণার্থী (এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বা দেশ থেকে ভারতে নিরাপদ আশ্রয় পেতে চেয়েছিলেন যারা) সেবা কার্যক্রম চালিয়েছিল। শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য, নিরাপত্তা (সম্পদ, সম্মান ও প্রাণ-এর) প্রদানের পাশাপাশি ভারতে গমনেচ্ছুদের নিরাপদে সেখানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নানামুখি পদক্ষেপ (গাইড সরবরাহ, পরিবহন, আর্থিক সহায়তা, নিরাপত্তার স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধাদল প্রেরণ ইত্যাদি) গ্রহণ করেছিল। আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে শরণার্থী সেবা কার্যক্রম চালিয়েছিল কাদেরিয়া বাহিনী, ওহিদুর বাহিনী, আকবর বাহিনী, জিয়া বাহিনী।
আঞ্চলিক বাহিনীসমূহের মধ্যে কাদেরিয়া বাহিনী (ভূঞাপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায়), ওহিদুর বাহিনী (আত্রাই ও রাজশাহীর বিল এলাকায়), আকবর বাহিনী (শ্রীপুরের একাংশে), আফসার বাহিনী (ভালুকার একাংশে), জিয়া বাহিনী (মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলার একাংশে), আফতাব বাহিনী (রৌমারী-রাজিবপুরের একাংশে) মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। স্মর্তব্য, ১১টি সেক্টরের মধ্যে ৬ নং সেক্টরভুক্ত সীমান্ত এলাকা ব্যতীত সেক্টরভুক্ত কোনো এলাকায়ই এ ধরনের সাফল্য মেলেনি।
মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পাঁচ দশক পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আঞ্চলিক বাহিনীগুলোর মধ্যে শুধু কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, হালিম বাহিনী, বাতেন বাহিনী ও আফসার বাহিনীর অনানুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিলেছে। এদের মধ্যে আবার কাদেরিয়া বাহিনী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে বেশিরভাগটা এই দলের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য আর বাকিটা দল প্রধান কাদের সিদ্দিকীর পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের কারণে। আর হেমায়েত বাহিনী রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল মূলত এ বাহিনীর যুদ্ধ এলাকার রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে। কিন্তু উল্লিখিত বাহিনীসমূহের তৃণমূলের সংগঠকগণ ও সদস্যগণ সে অর্থে উপযুক্ত দৃষ্টি পায়নি।
আঞ্চলিক বাহিনীসমূহের সশস্ত্র সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৬০,০০০। এই সংখ্যার মধ্যে অবশ্য কিছু সংখ্যক ভারতে প্রশিক্ষিত যোদ্ধা ও সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন। আঞ্চলিক বাহিনীসমূহ যেহেতু অবরুদ্ধ দেশে সক্রিয় ছিল, সেহেতু ভারতে থাকা বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তুতকৃত তালিকায় এসব বাহিনীর যোদ্ধাদের নাম পরিপূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত থাকার সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে যুদ্ধ-পরবর্তীকালে বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রস্তুতকরণে ভিত্তি হিসেবে যেহেতু ভারতীয় তালিকা এবং লাল মুক্তিবার্তাটি সঠিক বলে ধরা হয় সেহেতু এক্ষেত্রেও আঞ্চলিক বাহিনীর সকল সদস্যকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। এসব কারণে আঞ্চলিক বাহিনীগুলোর অসংখ্য সদস্য মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থান পাননি। এছাড়া এসব আঞ্চলিক বাহিনীর সাথে যুক্ত প্রায় এক লাখ স্বেচ্ছাসেবক তো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিটুকুই পাননি। অথচ এই স্বেচ্ছাসেবকদের সর্বাত্মক সহযোগিতাতেই মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল প্রকৃত জনযুদ্ধ। স্মর্তব্য, অবরুদ্ধ দেশে এই স্বেচ্ছাসেবকদের জীবন ও সম্পদহানির ঝুঁকি মুক্তিযুদ্ধে জড়িত কোনো পক্ষের চেয়ে কম ছিল না, বরং বেশিই ছিল। এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহযোগিতা করতে গিয়ে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক ও তাদের পরিবার প্রাণ, মান ও সম্পদ হারিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত।
আঞ্চলিক বাহিনীসমূহের বহুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা যেমন এখনও তালিকাভুক্ত হতে পারেননি, তেমনি এই বাহিনীসমূহের যোদ্ধাদের বীরত্বের স্বীকৃতিও সে অর্থে মেলেনি। মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য সরকার ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে খেতাব প্রদান করে। এর মধ্যে ৫০০ জন সদস্য সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর এবং ১৭৬ জন গণবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। আরেকটি উৎসে গণবাহিনী থেকে খেতাবপ্রাপ্ত সদস্য সংখ্যা ১৬০ উল্লেখ করা হয়। আঞ্চলিক বাহিনীর প্রায় ষাট হাজার সদস্যের মধ্যে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য মাত্র ৩৬ জন সদস্য খেতাব পেয়েছেন। এদের মধ্যে আবার সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন ২৪ জন। এছাড়া আঞ্চলিক বাহিনীর ১৫ জন বাহিনী প্রধানের মধ্যে শুধু ৩ জন খেতাব পেয়েছেন যাদের মধ্যে আবার ২ জন সেনাসদস্য ছিলেন। অন্যদিকে সেক্টর কমান্ডারদের ১৪ জনের মধ্যে ১২ জন এবং সাব-সেক্টর কমান্ডারদের ৭৯ জনের মধ্যে সিংহভাগই খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সুতরাং বোঝা যায় যে, খেতাব প্রদানের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বাহিনীসমূহের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সুবিচার করা হয়নি।
গণযুদ্ধ বা জনযুদ্ধ (People's War) তত্ত্বের প্রবক্তা মাও সে-তুঙ এর মতে, "People's War is always revolutionary war … the revolutionary war is a war of the masses; it can be waged only by mobilising the masses and relying on them." জনযুদ্ধের এই সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, জনযুদ্ধের তত্ত্ব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সফলভাবে প্রয়োগকৃত হয়েছে। আর আঞ্চলিক বাহিনীসমূহ ছিল অবরুদ্ধ দেশে জনযুদ্ধের প্রকৃত কারিগর। অথচ স্বাধীনতা প্রাপ্তির এত বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধে প্রভূতভাবে বিপুল অবদান রাখা আঞ্চলিক বাহিনীসমূহকে উপযুক্তভাবে মূল্যায়ন করা থেকে রাষ্ট্র ও সমাজ অনেক দূরে।