Published : 19 Oct 2020, 11:40 AM
নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণবিরোধী চলমান আন্দোলন সংক্রান্ত বিভিন্ন আলোচনায় বার বার ছোটকাল থেকে সন্তানদের জেন্ডার সমতায় বিশ্বাসী, নারীর প্রতি বৈষময়মূলক আচরণ বিরোধী, নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী ইত্যাদি মনোভাব সম্পন্নভাবে বড় করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং এর জন্য বাবা-মা তথা পরিবারের ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে অবহিত করা হচ্ছে। এটা অবশ্য কোনো নতুন বক্তব্য নয়। অনেক আগে থেকেই বলা হয়ে আসছে যে পুত্ররা যেন নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, তারা যেন বড় হয়ে নিপীড়ক বা ধর্ষক না হয় সেই শিক্ষা পরিবারকেই প্রথমে তাকে দিতে হবে। আবার কন্যাদের সাবলম্বী করে তোলা, তাদের ক্ষমতায়িত হতে সহায়তা করা – এগুলোও পরিবারের অন্যতম দায়িত্ব। এখানেই শেষ নয়। জীবনে চলার পথে নিপীড়িত বা ধর্ষিত হলে পরিবারকেই সবার আগে তাদের কন্যার পাশে দাঁড়াতে হবে, তাকে বোঝাতে হবে শরীর কখনো নষ্ট হয় না। নিপীড়ন বা ধর্ষণ মনে গভীর ক্ষত তৈরি করে বটে কিন্তু সেখান থেকেও উঠে দাঁড়ানো যায়। আবার পুত্র যদি নারী নিপীড়ন বা ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজ করে সেক্ষেত্রে পরিবারের উচিত নয় তাকে শেল্টার দেওয়া, ভুক্তভোগী পরিবারকে হুমকি দেওয়া বা তাকে আইনের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা।
এটা সত্য যে নিপীড়ক যদি তৈরিই না হয় তাহলে এমনিতেই নিপীড়নের ঘটনা কমে যাবে। কন্যারা যদি সাহসী স্বাবলম্বী হয়ে বড় হয় তাহলে যে কেউই তাদের আঘাত করতে ভয় পাবে। তাই বার বার আমরা নিপীড়ন, যৌন সহিংসতা ও ধর্ষণ বন্ধে পরিবারের গুরুত্বের কথা বলি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে এখন যারা বাবা-মা বা দাদা-দাদি – তাদের নিজস্ব চিন্তা ও চেতনার গণ্ডি সীমিত। তারা নিজেরাই এখনও জেন্ডার বৈষমের ফাঁদে আটকে আছেন। বাংলাদেশে মাত্র পঞ্চাশ/ষাট বছর আগেও প্রতিটি মেয়ের বাল্যবিয়ে হতো। এই মেয়েরা বার/তের বছর বয়সে মা হতেন। বাল্য বিয়ে এবং এত অল্প বয়সে সন্তান জন্মদান, দুটোই এ প্রকার নিপীড়ন এবং ধর্ষণের ইঙ্গিত দেয়। তবে সমাজে স্বীকৃত ছিল বলে সেগুলোকে স্বাভাবিক ঘটনা বলে ধরে নেওয়া হতো। সেই যুগ আজ আর নেই বটে কিন্তু নারীকে অবলা হিসেবে দেখার, তাকে ঘরের চারকোনায় আটকে রেখে সংসার ধর্ম পালন এবং মাতৃত্বকে মহিমান্বিত করার মানসিকতা এখনো আমাদের বয়স্ক নাগরিকদের জিনের মধ্যে রয়ে গেছে। এগুলোকে বছরের পর বছর ধরে পারিবারিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে আসছে। সুতরাং, বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারের বয়োজেষ্ঠ্যদের আগে নারীর ক্ষমতায়ন, জেন্ডার সমতা, যৌন সহিংসতা পরিহার করা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে সচেতন করতে হবে। তাহলেই সন্তানদের মানবিক মানুষ হিসেবে বড় করে তোলার গুরুদায়িত্ব তারা যথাযথভাবে পালন করতে পারবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা একটি জাতির সংস্কৃতির অংশ হতে পারে না।
এখন প্রশ্ন হলো পরিবারকে শেখাবে কে? কে পরিবারতন্ত্রের একদম শেকড়ে গিয়ে আঘাত করতে পারবে? এই কাজে দেশব্যাপী বৃহৎ আকারে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা একটি কার্যকরী পদ্ধতি হতে পারে। সারা দেশের মানুষকে খাবার স্যালাইন বানানোর পদ্ধতি শেখানো থেকে শুরু করে বাল্যবিয়ে রোধ, এসিড নিক্ষেপ বন্ধ করা ইত্যাদি অসংখ্য সাফল্যমন্ডিত সামাজিক ক্যাম্পেইন পরিচালনার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের রয়েছে। এই ক্যাম্পেইনগুলোতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য, নিপীড়ন এবং ধর্ষণরোধে সমন্বিত ক্যাম্পেইন এখন সময়ের দাবি। মনে রাখতে হবে, এই ক্যাম্পেইনগুলোর এত সাফল্যের পেছনে মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সহজ মেসেজ যা সকল শ্রেণির মানুষের জন্য বোধগম্য এবং গ্রহণীয় ছিল। নারী নিপীড়নবিরোধী সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের মূল মেসেজগুলোকেও সকলের জন্য বোধগম্য এবং গ্রহণীয় হতে হবে।
আরেকটি কাজ পরিবারকে সচেতন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সেটি হলো স্কুল পর্যায়ের শুরু থেকেই পাঠ্যপুস্তকে মানবাধিকার, নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন, শিশুর অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলোকে সংযুক্ত করা। যে পুরুষটি সকালে ফেসবুকে ধর্ষণবিরোধী স্ট্যাটাস লিখে বিকেলবেলা নারী বা স্ত্রীদের হেয় করে দেখানো জোকস ফেসবুকে আপলোড করেন বা সেলিব্রেটি নারীর ফাঁস হয়ে যাওয়া ছবি বন্ধুদের সঙ্গে চালাচালি করেন, তাদের বড়রাও আসলে জীবনের কোনো পর্যায়ে শেখাননি যে এই কাজগুলো মোটেই নিরীহ জোকস নয়। এগুলোতে নারীকে হেয় করা হয়, তাদের অবমাননা করা হয়। এ রকম একটু একটু মজা করার কারণে নারী ও পুরুষের মধ্যে ব্যবধান তৈরি হয়। তারা সহজভাবে মিশতে পারে না। তখন অনেকেরই মনে হয়, অবশ্যই ধর্ষণের বিচার চাই তবে সেলিব্রেটি নারীরা অনেকের ভোগপণ্য। তারা গনিমতের মাল, তাদের ফাঁস হওয়া ছবি চালাচালি করাই যায়। আরও মনে হয়, আমার বোন বা বউকে চাকরি করতে দেব না। পুরুষ কলিগরা তাদের নিয়ে জোকস করবে, বাজে মন্তব্য করবে, ঠিক যেমনভাবে আমি অন্য মেয়েদের নিয়ে বন্ধূদের সঙ্গে মশকরা করি।
তাই ছোটকাল থেকেই মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। নারী-পুরুষ, জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে শ্রদ্ধা এবং সম্মান করার দিক্ষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পেতে হবে। পূর্ববর্তী প্রজন্মকে যদি বদলানো নাও যায়, নতুন প্রজন্মকে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাহিরে গিয়ে সমতাভিত্তিক সমাজের দিক্ষা দিতে হবে। তারা যদি তাদের বাসায় জেন্ডার সংবেদনশীল আচরণ করে, তাহলে তা থেকে তাদের বাবা-মায়েরাও হয়ত কিছু শিখতে পারবেন। সম্প্রতি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী দিপু মণি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কথা বলেছেন। আসলেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মানবিক মানুষ হওয়ার কোনো বিদ্যা শেখানো হয় না। অথচ সবার আগে এটাই শেখানোর প্রয়োজন ছিল।
চলমান নিপীড়ন ও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আমাদের মুগ্ধ করেছে। তাদের দাবিগুলোর মধ্যেও পরিবারের কথা বার বার এসেছে। তারপরও বার বার প্রশ্ন শুনতে হয়, কেন নারী ছোট পোশাক পরে নিজেকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করে, কেন নারীকে বাহিরে যেতে হবে, চাকরি করতে হবে। অথচ এইসব বিষয়ে বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে। ইচ্ছা থাকলেই এসব বিষয়ে আর্টিকেল পড়া যায়। নেট ঘেটে নারীর ক্ষমতায়ন, জেন্ডার সমতা বিষয়ে জানা যায়। চলমান আন্দোলনের সময় পুরনো পশ্ন বার বার না তুলে বরং প্রতিটি মানুষের উচিত এই বিষয়গুলো নিয়ে কিছু পড়ালেখা করার। বিষয়গুলোকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করার। নিজে যা জানি না, সেই বিষয় নিয়ে পায়ে পা জড়িয়ে ঝগড়া বাধানো কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।
'কেউ ধর্ষক, কেউ দর্শক। আসল মানুষ কোথায় পাই' কয়েকদিন আগে ফেসবুকের একটি পোস্টে দেখা এই স্লোগানটা ভীষণ ভালো লেগেছে। আসলেই বাবা-মায়েদের প্রতি আহবান থাকবে আপনারা নিজেরা একটু পড়াশোনা করুন। আরেকজন বা রাস্ট্র এসে নারী নিপীড়ন অজীবনের জন্য ব্যান করে দেবে, সেই আশায় থাকবেন না। কারণ সমস্যাটা মনস্তাত্বিক। তাই নিজের চিন্তা ও আচরণে কোথাও ফাঁক থেকে যাচ্ছে কিনা, পুত্রকে জেন্ডার সেনসেটিভভাবে বড় করতে পারছেন কিনা, কন্যাকে সাবলম্বী হতে সহায়তা করছেন কিনা, তা একটু বোঝার চেষ্টা করুন। সন্তানদের মানুষ হিসেবে বড় করুন। পুরুষ বা নারী হিসেবে না।