Published : 05 Jul 2020, 12:44 AM
কাসেম জুটমিলস, পাইলন, হাফিজ টেক্সটাইলস, হাফিজ জুট মিলস, গুল আহমদ জুট মিলস, আর আর জুট মিলস, সুলতানা জুট মিলস, এস কে এম জুট মিলস, এম এম জুট মিলস, গালফ্রা হাবিব… চোখ বুঝলেই স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে পাটকলগুলো একে একে। সীতাকুণ্ড থানায় ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের পূর্বপাশে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ছিল এ পাটকলগুলো। ধুম (পরে শুভপুর) বাস লাইনের একেকটি স্টপেজ। আমার কৈশোরের একেকটি মাইলফলকও বটে।
আমাদের এলাকার কর্মসংস্থানে ভূমিকা রেখেছিল এই পাটকলগুলো। এলাকার অর্থনীতি নির্ভর করতো পাটকলগুলোর উপর। বেশ কয়েকটি স্কুল গড়ে উঠেছিল মিলগুলোর কারণে, উদ্যোগে। জুনের ফুটবল খেলাতে অংশ নিতো মিলগুলোর ফুটবল টিম। বর্ষাকালের অন্যতম বিনোদন। খেলা হতো কুমিরা, সীতাকুণ্ড ইত্যাদি স্কুলের মাঠে। জুটমিল ছিল আমাদের এলাকার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
মিলগুলোর কারণে অন্য জেলার লোকজন-শ্রমিক আসতো সীতাকুণ্ড থানায়। জন-সংস্কৃতিমিশ্রণ হতো। চাঁটগাঁইয়া-বহিরাগত দাঙ্গা-ফ্যাসাদও কি হয়নি দুই একবার? বুক্কুইন্যা গুণ্ডার কথা মনে পড়ছে। খুব মোটাসোটা ছিলেন, গায়ের রঙ গড় বাঙালির চেয়ে ফর্সা ছিল। কুমিরা বাজারে হাইস্কুল গেটের অদূরে বদি সওদাগরের দোকানের সামনে বসে পত্রিকা পড়তেন মনোযোগ দিয়ে। নামের সঙ্গে যদিও 'গুণ্ডা' বিশেষণটি লেগে গিয়েছিল, ব্যবহার অত্যন্ত ভদ্র ছিল। সেকালের গুণ্ডা, পত্রিকা পড়তেন, একটা ক্লাস ছিল। ৬৯-৭০ সালে এক দাঙ্গায় বুক্কুইন্যাকে (আসল নাম কী ছিল জানি না) নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছিল বয়লারে জীবন্ত সিদ্ধ করে, মধ্যযুগীয় কায়দায়।
শহরের মধ্যবিত্তের বাড়িঘর কেমন হয়, কেমন জীবন যাপন করে তারা, ছোটবেলায় দেখেছি জুটমিলের অফিসারদের বাড়িতে। স্কুলে এক বন্ধু, গুল আহমদ জুটমিলের ম্যানেজারের ছেলের মুখে একদিন শুনলাম: 'বাবাকে শোকজ করেছে!' 'শোকজ' শব্দটা তেরো বছরের জীবনে সেই প্রথম বার শুনে বুঝতেই পারিনি। ভেবেছি, 'শো কেস' হবে হয়তো। আমাকে বোঝাতে বন্ধুটির অনেক বেগ পেতে হয়েছিল।
এই মিলগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। অনেকে বলেন, সরকারি অনুদানেই নাকি মিলগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পাকিস্তানের তথাকথিত শিল্পপতিরা কইয়ের তেলে কই ভেজেছেন। কথা হয়তো সত্য। কিন্তু এ কথাও তো সত্য যে এই মিলগুলো পাটশিল্পের বিকাশে ভূমিকা রেখেছিল। পাট যে সোনালী আঁশ হয়ে উঠেছিল সেতো এই মিলগুলোর কল্যাণেই।
হাফিজ জুট ও টেক্সটাইল মিলের মালিক হাফিজ সাহেব অন্ধ ছিলেন। অনেকগুলো সুন্দরী কন্যা ছিল তার। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ওর জীবন ও স্ত্রী-কন্যাদের ইজ্জত ঝুঁকির মুখে পড়েছিল। হাফিজ টেক্সটাইল মিলের এক হিন্দু অফিসার মালিকের জীবন রক্ষা করে নিরাপদে পুরো পরিবারকে পাকিস্তানে পাঠাতে ভূমিকা রাখেন। তিনি আমার আত্মীয়, কিন্তু সঙ্গত কারণেই এ ব্যাপারে মুখ খুলতে চান না।
ব্রিটিশ আমলে বাঙালিদের প্রতিষ্ঠিত কিছু মিল ছিল বৈকি। শরৎচন্দ্রের 'মহেশ' (পাকিস্তান আমলের পাঠ্যপুস্তকে এ গল্পের নাম ছিল 'গফুর'! রোগ আমাদের অনেক পুরনো!) গল্পে কৃষক গফুর মিয়া রাগের মাথায় তার গরু মহেশকে হত্যা করার পর মেয়েকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে হুগলির পাটকলে কাজ করতে গিয়েছিল।
সম্ভবত এ সময়ে, বিংশ শতকের প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠিত কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী মোহিনী মিল সত্তরের দশকের শেষে বন্ধ করা হয়েছিল, জিয়ার আমলে।
শিল্পকারখানা বিজাতীয়করণের সেই শুরু। প্রায় কুড়ি বছর পর, ২০০৭ সালেও মিলের আশেপাশে প্রাক্তন শ্রমিক-কর্মচারীদের বৃদ্ধাবস্থায় ভিক্ষা করতে দেখেছি। এই পোড়া দেশে কাজ একবার গেলে দ্বিতীয়বার পাওয়া যায় না।
আমরা পাকিস্তানের শোষণের কথা অহরহ শুনি। তারা যে শিল্পায়নও করেছিল এ অঞ্চলে, সে কথা কাউকে বলতে শুনি না। এশিয়ার বৃহত্তম জুটমিল আদমজী পূর্ব পাকিস্তানেই স্থাপিত হয়েছিল। ব্রিটিশ যেমন রেললাইনের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিল বাঙালিদের, পাকিস্তানিরা পরিচয় করিয়েছিল আধুনিক যন্ত্রপাতির সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে আদমজীসহ অনেক পাটকলের যন্ত্রপাতি চুরি, সেরদরে বিক্রি এবং ভিনদেশে পাচার হয়েছিল বলে শুনেছি। যা রটে তা কিছুটা তো বটে।
বিদেশে নালিতা শাক বা পাটপাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয়। প্যাকেটের গায়ে দেখেছি, সেই পাটপাতা রপ্তানি হয় মিশর থেকে। ভাবতে পারেন? পৃথিবীতে পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ নাকি সেরা, অথচ বিদেশের বাজারে বাঙালিদের মিশরীয় পাটপাতা কিনে খেতে হচ্ছে! আমাদের কী পণ্য আছে এবং তার বাজার কোথায়, তাই আমরা জানি না, খুঁজিও না। প্লাস্টিকের বিপরীতে পাটজাত পণ্যের চাহিদা ইদানিং সারা পৃথিবীব্যাপী বেড়েছে বৈ কমেনি। তবু মিলগুলো লাভ করতে পারে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা কি হয়েছে? লাভ করতে পারে না বলে পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। মাথাব্যাথা করছে বলে মাথাটা কেটে ফেলাটাই কি একমাত্র সমাধান?
বাংলাদেশের সব অলাভজনক সেক্টরই কি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, কিংবা হবে? গণপ্রজাতন্ত্রে লাভটাই কি রাষ্ট্রপরিচালনার লক্ষ্য হওয়া উচিত? কার লাভ? রাষ্ট্র কি কোনও ব্যবসা যে সরকার লাভের হিসাব করা উচিত? ডাকঘর, বিশ্ববিদ্যালয়, সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র- এই প্রতিষ্ঠানগুলো কি আদৌ লাভজনক? বাংলাদেশ বিমান কি জীবনেও লাভের মুখ দেখেছে? লাভের হিসাবইবা কীভাবে করা হয়? প্রতিটি পাটকলের যে একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক ভূমিকা আছে, কতগুলো পরিবারের ভাগ্য একেকটি মিলের সঙ্গে জড়িত- এই ব্যাপারগুলো কি হিসাবে নেওয়া হয়েছে কখনও? প্রতি অর্থবছরে রাষ্ট্রে যে পরিমাণ অর্থ চুরি হয়, যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয় রাষ্ট্র থেকে, তার সম্মিলিত অংক কি সবগুলো পাটকলের সম্মিলিত লোকসানের চেয়ে বহুগুণ বেশি নয়?
একের পর এক পাটকল দেশি উদ্যোক্তাদের হাতে নামমাত্র মূল্যে ছেড়ে দিয়েছে বিভিন্ন সরকার, গত পঞ্চাশ বছরে। বাঙালি উদ্যোক্তারা মিলগুলো ধ্বংস করতে দেরি করেনি। 'উপজাতি' কথাটা বলা যায় না, 'অপজাতি' বলা যায় কি? আমি মনে করি, বাঙালি হচ্ছে একটি অপজাতি। পাহাড়, নদী, বন, শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি… হাতে পাওয়ামাত্র যে কোনো ইতিবাচক বস্তু বা প্রতিষ্ঠান অচিরে ধ্বংস করা হচ্ছে কোনো অপজাতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শুনেছি আমাদের এলাকার হাফিজ টেক্সটাইলস মিলের গাছ এবং মাটি বিক্রি করেই নাকি মিল কেনার দাম উঠে গিয়েছিল। নিজের চোখে দেখেছি, এই পাটকলটি এখন একটি কনটেইনার গুদাম। একটি পাটকল যে পরিমাণ কর্মসংস্থান করতে পারতো, একটি গুদাম নিশ্চয়ই তার এক সহস্রাংশও পারার কথা নয়।
পাকিস্তান আমলে প্রতিটি জুটমিল লাভজনক ছিল। স্বাধীনতার পর কী এমন ঘটে গেল যে সবগুলো মিল লোকসানে পড়ে গেল? নব্বইয়ের দশকে ঢাকার একটি এলাকায় এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে বিজেএমসির এক প্রাক্তন কর্তাব্যক্তির বহুতল বসতবাড়ি চোখে পড়েছিল। পাটশিল্প ধ্বংসের অন্তত একটি কারণ সেদিনই পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম।
সরকার, নীতিনির্ধারক, ম্যানেজার, পাঠক্রয় কর্মকর্তা থেকে শুরু করে শ্রমিকনেতা, কার চৌর্যবৃত্তি কিংবা দুর্নীতির শিকার হয়নি আমাদের পাটশিল্প? কেউ কেউ এটাও বলছেন, সরকার অবশ্যই পাটশিল্পকে লাভজনক করতে পারে। কিন্তু লাভজনক হয়ে গেলে পাটকলগুলো ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দিয়ে নিজেরা এবং নিজেদের টেন্ডলেরা টু পাইস কামাবে কেমন করে?
কারও কারও মতে, সরকারপন্থী শ্রমিকসঙ্ঘগুলোই নাকি পাটশিল্প ধ্বংসের জন্যে মূলত দায়ী। কেউ বলছেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত শ্রমিকই মূল সমস্যা। তাদের জন্যে প্রতিমাসে অতিরিক্ত বেতন গুনতে হচ্ছে সরকারকে। যদি তা সত্যও হয়, যদি ভর্তুকিও দিতে হয়, ভর্তুকির টাকাটাতো আবার বাজারে ফিরে আসছে এবং মূলধন গঠনে ভূমিকা রাখছে। ভর্তুকি কোনওক্রমেই চুরির চেয়ে খারাপ নয়, কারণ চুরির বেশির ভাগ টাকাই ইদানিং দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং দেশের অর্থনীতিকে বিন্দুমাত্র ভূমিকা রাখছে না। শ্রমিকেরা বেকার হলে তাদের একাংশ যে অপরাধ-প্রবণ হয়ে উঠবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী?
বঙ্গবন্ধুর দোষ দেওয়া হয়, কারণ তিনি পাটকলগুলো জাতীয়করণ করেছিলেন। যত দোষ, মুজিব ঘোষ! উনি দেশ চালাতে পারছিলেন না বলে লঘু পাপে উনাকে, উনার পরিবারকেও গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর চার দশক কেটে গেছে। কই দেশটাকে উনার চেয়ে ভালো চালাতে তো দেখলাম না কোনো বাপের বেটা বা বেটিকে! ওর সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস ছিল, সে সময়টাই ছিল সমাজতন্ত্রের পক্ষে, সুতরাং জাতীয়করণ করাই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাভাবিক ছিল না কি? তাছাড়া সদ্য স্বাধীন একটা দেশে এমন অভিজ্ঞ, বিশ্বস্ত শিল্পপতি ছিল না, যাদের হাতে তিনি পাটকলগুলো তুলে দিতে পারতেন। আর তুলে দিলেই যে সেটা ভালো সমাধান হতো, তারই বা নিশ্চয়তা কি? স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও ব্যক্তিমালিকানায় দিয়ে পাটকলগুলোর অপমৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।
'হারাধনের একটি ছেলে কাঁদে ভেউ ভেউ। মনের দুঃখে বনে গেল রইল না আর কেউ!' আর মাত্র ২৫টি মিল আছে সরকারের হাতে। সেগুলোও সরকার চালাতে পারছে না। কে না জানে, সরকারের নীতিনির্ধারক এবং পাটকলের কর্মকর্তারাই একেকটি পাটকলের লোকসানের জন্যে প্রধানত দায়ী। অথচ সর্বক্ষণ দায়ী করা হচ্ছে নন্দঘোষ শ্রমিকদের।
সম্প্রতি বিবিসিতে এক কর্তাব্যক্তিকে এক সাক্ষাৎকারে বলতে শুনেছি: 'শ্রমিকেরা কদিন পর পর রাস্তা আটকে বেতন নিয়ে যায়!' কী আশ্চর্য! বেতন যদি বাকি থাকে মাসের পর মাস, তবে শ্রমিক তার পাওনা দাবি করবে না? শ্রমিক কি হাওয়া খেয়ে বাঁচে? নিজেরা একেকজন সেকেন্ড হোম বেগমপাড়ায় দেশের টাকা পাচার করবেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডিজিটাল উপায়ে মিলিয়ন ডলার চুরি হলে কিছু হয় না, আর শ্রমিক তার ন্যায্য বকেয়া পাওনা চাইলেই দোষ?
সুন্দরবনের একটি বাঘ মারা যাওয়া মানে নিছক একটি বাঘের মৃত্যু নয়। একটি বাঘ মারা গেলে মাসে ত্রিশটি হরিণ বৃদ্ধি পায়, যার ফলে ত্রিশটি গাছের পাতা কমে যায়, কমে যায় অক্সিজেন। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। প্রকৃতিকে একটি জাল বা শিকলের সঙ্গে তুলনা করা যায়। প্রকৃতি-শিকলের প্রতিটি আংটা একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত। একটি মাত্র আংটা ছিঁড়ে গেলেও শিকলটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্প্রতি পাটকলগুলোর ২৫ হাজার শ্রমিককে কর্মচ্যুত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গোল্ডেন হ্যান্ডশেক। ২৫ হাজার শ্রমিক মানে ২৫ হাজার পরিবার এবং তাদের উপর নির্ভরশীল বহু শত ব্যবসা ও উদ্যোগ, সব ধ্বংস হবে। আগে পরে মিলগুলো ব্যাক্তিমালিকানায় দিয়ে দেওয়া হবে। তার পর মিলগুলোর শেষনিঃশ্বাসটুকু ফেলা শুধু সময়ের ব্যাপার। আমরা সাধারণ মানুষেরা পাটশিল্পের আশুমৃত্যুর কথা ভেবে দীর্ঘনিঃশ্বাসটুকু শুধু ফেলতে পারি, তার বেশি কিছু নয়।
বাঙালি আর মাকড়শা- এই দুই প্রজাতির জীবের মধ্যে তিনটি ক্ষেত্রে মিল রয়েছে। প্রথমত, মায়ের শরীর খেয়ে, পেট ছিদ্র করে মাকড়শার বাচ্চারা ভূমিষ্ট হয়। ৭১ সালের শেষে বাঙালিরা ইতিহাসে প্রথম বারের মতো স্বাধীন হয়েছিল। ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে দেশমাতৃকার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বাঙালিদের এবং পরিচয় হওয়ার ক্ষণটি থেকেই তারা দেশমাতৃকাকে ভক্ষণ করে চলেছে, মাকড়শা-শিশুর মতো। এতে যে মায়ের মৃত্যু হতে পারে, সে ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথাই যেমন মাকড়শাদের থাকে না, তেমনি বাঙালিদেরও বাংলা মায়ের দুরবস্থা নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আপনি বাঁচলে বাপের নাম, মায়ের নামতো নয়!
দ্বিতীয়ত, যড়যন্ত্রের জাল বুনতেও বাঙালিরা সিদ্ধহস্ত।
তৃতীয়ত, মাকড়শার বাচ্চার মতোই বাঙালিদের সংখ্যাও এত বেশি যে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়েই বাঙালি জাতির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি অসম্ভব। প্রসঙ্গত বলি, বেশিরভাগ মাকড়শার বাস ঢাকা শহরে। সত্তর দশকের মাকড়শা কিংবা তাদের উত্তরপুরুষেরা বেশির ভাগ থাকে ধানমণ্ডিতে, আশির দশকের মাকড়শরা থাকে গুলশানে এবং নব্বইয়ের দশকের মাকড়শরা থাকে বারিধারায়। ঢাকায় কার কোথায় ঠিকানা শুনে বলে দেওয়া যায়, কোন পরিবারের মাকড়শা কোন যুগে মাতৃহননে ব্যস্ত ছিল। এই মাতৃহত্যা বাংলাদেশের অনুন্নতির একমাত্র কারণ না হলেও অন্যতম কারণ তো বটেই।
মাতৃহত্যা কিংবা দুর্নীতি জিনিসটাকে আমি এ কারণে খারাপ বলি না যে সেটা অনৈতিক। যদিও প্রত্যেক ধর্মে দুর্নীতিকে মানবের জন্যে পরিত্যাজ্য আচরণ ঘোষণা করা হয়েছে, তবুও সব ধর্মের বকধার্মিক লোকেরাই দুর্নীতি করে- এই কূটাভাষ বা আয়রনিও আমি ধর্তব্য বিষয় মনে করি না। দুর্নীতি আমার চোখে খারাপ, কারণ দুর্নীতি আমার প্রিয় গরীব দেশটির সার্বিক টেকসই উন্নতির অন্যতম প্রতিবন্ধক। কী বলবো, আমি তো মনে করি, দুর্নীতিবাজদের জন্যও দুর্নীতি খারাপ, কারণ সিংগাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত হলে বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাবানেরা কি বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে চুরি করতে পারতেন না?
ব্রিটিশ কিংবা পাকিদের দোষ দিয়ে লাভ নেই! স্রেফ জুটমিলগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, নিজের দেশ ও জাতিকে আমরা বাঙালিরা যে পরিমাণ শোষণ করেছি গত ৫০ বছরে, ব্রিটিশ কিংবা পাকিদের চেয়ে সেটা কোনো অংশেই ন্যূন নয়। আজ সাহস করে এই সত্যের মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন, অন্ততপক্ষে রাষ্ট্রপিতার জন্মবর্ষে, যিনি কিনা ক্ষমতার সাড়ে তিন বছরেই, 'স্বাধীন মানুষের দেশ' নয়, বরং একটি 'চোরের খনি' পেয়েছেন বলে আক্ষেপ করেছিলেন। সরল মানুষ ছিলেন বলে বঙ্গবন্ধু আসলে বুঝতে পারেননি, প্রকৃতপক্ষে একটি 'বেঈমানের খনি' পেয়েছিলেন তিনি। এই সত্যটি না জেনেই প্রিয় রাষ্ট্রপিতার অকালমৃত্যু হয়েছিল যে বাঙালিকে 'চোর' বললে আসলে চোরদেরই বিলক্ষণ অপমান করা হয়। প্রকৃতপক্ষে বাঙালিকে 'চোর' না বলে চোরদেরই 'বাঙালি' বলা উচিত।
'হায় সোনালী আঁশের কল! কৈশোরের স্মৃতি!