Published : 20 Jun 2020, 09:09 PM
উনিশ শতকের আবর্তনে বিশ শতকের প্রতিমা নির্মাণে এক চিরপ্রণম্য দীপশিখা সুফিয়া কামাল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাঙালি জাতির মোহনিদ্রার আবর্তনকে একটা ধাক্কা দিয়ে কেবল জাগানোই নয়, সেই জাগরণকে চিরস্থায়ী করে একুশের পদপ্রান্তে তাকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সুফিয়া কামাল যেভাবে তার গোটা জীবনটিকে নিরলস ভাবে উৎসর্গ করে গিয়েছেন, তেমন দৃষ্টান্ত ভারতীয় উপমহাদেশে আর দ্বিতীয়টি মেলে না।
মানুষকে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা- এর বাইরে সুফিয়া কামালের জীবনে দ্বিতীয় কোনও উদ্দেশ্য বা স্বার্থ একটি মুহূর্তের জন্যে কখনো ফুটে ওঠেনি। মেয়েদের জন্যে একটি গোটা আকাশ উন্মোচিত করার সাধনায় সুফিয়ার মননে কখনোই নারীবাদের সঙ্কীর্ণ আবর্ত ফুটে ওঠেনি। তাই নারীবাদ নয়, মানুষ, মানুষের জন্যে চিন্তা, মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক- সার্বিক শোষণমুক্তি, বাঁধনের আগল ছিন্ন করা- এই সাধনার একমনে নিজের একতারাতে একটি সুরের মতো সুফিয়া কামাল তার গোটা জীবনটা ধরে সেধে গেছেন। 'লোকের কথা নিস নে কানে, ফিরিস নে আর হাজার টানে, যেন রে তোর হৃদয় জানে হৃদয়ে তোর আছেন রাজা…' এটি ই ছিল বঙ্গজননী সুফিয়া কামালের জীবনবেদ।
যাপনচিত্রের কাঠামো নির্মাণে সৃষ্টির আনন্দে সুফিয়া যেন ছিলেন বিভূতিভূষণের 'পথের পাঁচালি'-র অপূ আর দুর্গার এক আশ্চর্য সমন্বয়। শৈশবে বরিশালের শায়েস্তাবাদের নবাববাড়ির আয়মাদারি সুফিয়ার মননলোকে সবথেকে বড়ো করে খোদাই করে দিয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এ চেতনার ঋদ্ধতাতেই খণ্ড-ক্ষুদ্র করে বসুধাকে একটিবারের জন্যেও নিরীক্ষণ না করবার অনন্যসাধারণ প্রবৃত্তিতে সুফিয়াকে বিশ শতকের অন্যতম সেরা হিউম্যানিস্টে পরিণত করেছিল। অচেনা আনন্দকে উপলব্ধির ভিতর দিয়েই একদিকে যেমন তিনি নিজের চেষ্টায় পরিবারের রক্ষণশীল পরিবেশের ভিতরে থেকেই আধুনিক শিক্ষার সমস্ত রূপ-রস-গন্ধকে নিজের জীবনে আত্মস্থ করবার সাধনায় শৈশবেই নিমগ্ন হয়েছিলেন, তেমনই স্বচেষ্টায় অর্জিত শিক্ষাকে সমস্ত রকমের সঙ্কীর্ণবোধের উর্ধে স্থাপন করে মানবসেবা, মানুষকে আপন মর্যাদার উপরে প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে পরিচালিত করে গিয়েছেন। সেই কারণেই সুফিয়া কামাল নিছক নারীবাদী ছিলেন না। ছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষবাদী। এই মানুষে সেই মানুষের সন্ধান- বাউল ফকির তত্ত্বের সেই মানুষ রতনের সন্ধান তাই হয়ে উঠেছিল তার জীবনবেদ।
শৈশব-কৈশোরে পারিবারিক আভিজাত্যের ভিতরে যে বিষয়টি সুফিয়ার কাছে সব থেকে বেশি মনে দাগ কাটবার মতো পর্যায় বলে মনে হয়েছিল, সেটি হল; সামাজিক মণ্ডলের বহু অপূর্ণতার মাঝেই একটা পরিপূর্ণতার আভাস হিসেবে নারী আর পুরুষের ভিতর একটা আপাত সাযুজ্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণ, শ্রদ্ধা। শৈশবে তাদের শায়েস্তাবাদের নবাব বাড়িতে মেয়েদের প্রথাগত পড়াশোনার তেমন একটা প্রচলন না থাকলেও সুফিয়া তার মামাদের কাছ থেকে পড়াশোনার বিষয়ে পেয়েছিলেন সব রকমের সহযোগিতা। বাড়ির রক্ষণশীলতাকে অতিক্রম করে, আভিজাত্যেরই অংশীদার মামারা যেভাবে শিশু সুফিয়াকে ধর্মশিক্ষার পরিমণ্ডলেই কেবল আবদ্ধ না রেখে, আধুনিক বিজ্ঞানমুখী শিক্ষার প্রতি নানাভাবে আগ্রহান্বিত করে তুলেছিলেন, সেই গোটা ঘটনাক্রমটিই পরবর্তী জীবনে লিঙ্গসাম্যের প্রতি লড়াইয়ের ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল সুফিয়ার জীবনে। প্রকৃত শিক্ষার আঁতুর ঘর যে হলো নিজের বাড়ি, প্রকৃত শিক্ষক হিসেবে আত্মীয় পরিজনেরাই শিশুর কোমল বৃত্তিতে জল, মাটি , আগুনের স্পর্শ দিয়ে , সেই দলা পাকানো কাদার কালকে একটি পরাপূর্ণ ভাস্কর্যে পরিণত করতে সক্ষম হয়, সুফিয়া সে শিক্ষা অতি শৈশবে নিজের বাড়িতে, নিজের পরিবার পরিজনদের ভেতর থেকেই তা পেয়েছিলেন।
সুফিয়া কামালের জীবনের প্রেক্ষিত আলোচনার ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমান সমাজের অবরোধপ্রথাকে ঘিরে নানা ধরনের ভাবনার প্রাবল্য দেখা যায়। এই প্রবল্য উৎপাদনে বিশ শতকের অভিজাত মুসলমান পরিবারের প্রেক্ষিতকে আচ্ছন্ন করে ফেলে উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান জীবনের ছায়াবর্তকে । অনেকক্ষেত্রেই এই ছায়ার কালো ঘূর্ণায়মান আবর্তন রচনার ক্ষেত্রে অবাঙালি সমাজের ছায়াচিত্রের অনুরণনের ভিতর দিয়ে একাংশের বাঙালি একটা বিশেষ ধরনের আয়মাদারির মৌতাত উপভোগ করতে চায়। বাংলা ও বাঙালি পরিমণ্ডল থেকেই সংশ্লিষ্ট পরিবারটি বিকশিত হয়েছে- এটা বলবার থেকে তাদের একাংশ বেশি তৃপ্তি অনুভব করে মুঘল-পাঠান, সুলতান-বাদশাদের সঙ্গে তাদের একটা কাল্পনিক যোগসূত্রের মৌতাতকে ঘিরে।
এ প্রবণতার দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এক বিশিষ্ট্য সাহিত্য পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক তার খুঁড়িয়ে হাঁটার কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে বর্তমান নিবন্ধকারকে বলেছিলেন যে, তার পূর্বপুরুষ ছিলেন অভিজাত মুঘলদের আত্মীয় পরিজন। মুঘল রাজবংশের বংশধর হওয়ার কারণে তার পূর্বপুরুষদের দিনের বেশিরভাগ সময়ই ঘোড়ার পিঠে কাটাতে হতো। অতোটা সময় অশ্বারোহন থাকার দরুণ তাদের পূর্বপুরুষদের পা আর কোমরের সমস্যা তেরি হয়। সেই সমস্যা তাদের পরিবারে জিনগতভাবে আজও বিদ্যমান রয়েছে। সেই কারণেই তার এ খুঁড়িয়ে চলা। যদিও সেই ব্যক্তিকে পূর্ণযৌবনে যখন নিবন্ধকার দেখেছিলেন, তখন তার ভেতরে খুঁড়িয়ে হাঁটার বিন্দুমাত্র লক্ষণ ছিল না।
অপর এক মফস্বলের বাসিন্দা কথা সাহিত্যিক নিজের হাড়ের গরম বোঝাতে তাদের পূর্বপুরুষ উত্তরপ্রদেশের মানুষ এমনটা বললে জানালেন- তার বাড়ির প্রাচীন মানুষেরা আজও হিন্দিতে কথা বলেন। মুর্শিদাবাদের সন্তান সেই সাহিত্যিক নিজেকে উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত মিঞা মুসলমান হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করলেও , বিবাহ ইত্যাদি সামাজিক ঘটনার রীতিনীতিতে তাদের পরিবারে আজও হিন্দু- মুসলমানের যৌথ সাধনার ধারাগুলি, যেমন বিবাহের স্ত্রী আচার, বিয়ের দিন বাড়ি বাড়ি মেয়ের জন্যে সোহাগজল মেঙে বেড়ানো, তেল-সিঁদুর যাচ্ঞনা করা, কিংবা বিবাহের আসরে কলাগাছ দিয়ে হিন্দুদের আদলে ছাৎনাতলা তৈরি করার মতো ঘটনাগুলি কী করে মুঘল আয়মাদারির সংযুক্ত হল, সেই সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করে না।
বেগম রোকেয়ার ' অবরোধবাসিনী' ঘিরে উনিশ-বিশের প্রারম্ভের মুসলমান জনজীবন ঘিরে একটা ধারণা তৈরি হলেও , ওই আলেখ্যে বর্ণিত বিবরণ গুলি বেশিরভাগই রোকেয়ার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের কর্মস্থল ভাগলপুরের অবাঙালি মুসলিম জনজীবন ঘিরেই অনেক বেশি আবর্তিত হয়েছে- এই চরম সত্যটা অনেক সময়েই আমরা ভুলে যাই। ফলে বাঙালি মুসলমান জনজীবনে প্রবাহমান আভিজাত্যকে , রক্ষণশীলতার সাথে গুলিয়ে ফেলে, মুসলমান সমাজ সম্পর্কে সহজেই কেবল ভুল না, একটা বিকৃত ধারণা আমালের সামনে উঠে আসতে থাকে। মুসলমান সমাজের রক্ষণশীলতা বোঝাতে গিয়ে তাদের আধুনিকতার সার্বিক বিরোধী হিসেবে অনৈতিহাসিকভাবে দেখিয়ে একটা আত্মশ্লাঘার অনুভূতি গবেষক , আলোচকদের ভিতরে থাকে। এই অনুভূতি মারাত্মকভাবে কাজ করে পশ্চিমবঙ্গের গবেষকদের ভিতরে। এইসব গবেষকেরা নির্মোহ মন নিয়ে মুসলিম মানস ঘিরে কোনও চর্চাই করেন না। ফলে তাদের এ ইচ্ছাকৃত ভ্রান্তি সমাজের বুকে তৈরি করে একটা ভয়ঙ্কর রকমের ক্ষত।
বিশ শতকের প্রথাব্দে বরিশালের একটি প্রত্যন্ত অংশে সুফিয়া কামালের পরিবারে তার মামাদের বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ এবং তার প্রভাব শিশু সুফিয়ার মননলোকে একটি উদার, মানবিক, বিজ্ঞানসম্মত, আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডল রচনার ক্ষেত্রে কতোখানি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল, তার প্রেক্ষাপটকে যদি আমরা মনে রাখি, তাহলে গোটা বিশ শতক জুড়ে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি মণীষার সম্যক আলোকিত অধ্যায়টিকেও আমরা ঠিকমতো বুঝতে পারব না।
সুফিয়ার পূর্বসূরি বেগম রোকেয়ার পারিবারিক জীবনে অনেক রক্ষণশীলতার সঙ্গে লড়াই ছিল। তেমনি ছিল সাবের ভাইয়ের সাহচর্যে একটি খোলা আকাশের হাতছানি। ছিল বড় দিদি করিমুন্নেসা এবং তার দুই কৃতিপুত্র গজনভী ভাইদের মাধ্যমে শত প্রতিবন্ধকতাকে অস্বীকার করে মুক্ত-বিহঙ্গের মতো ডানা মেলার কাকুতি। ঠিক তেমনি মামাদের মাধ্যমে শৈশব-কৈশোরে খোলা হাওয়ার ঝাপটা সুফিয়াকে একদিকে করেছিল আধুনিকতার পিয়াসী, অপরদিকে করেছিল লিঙ্গ সাম্যে প্রত্যয়ী হওয়ার সংকল্পে দৃঢ়। সুফিয়া যে সারা জীবন নারীর স্বাধিকারের পক্ষে লড়াই করে গিয়েছেন, সেখানে কোথাও কখনো নারীর জন্যে বিশেষ কোনও অধিকারের কথা বলেননি। বলেছেন- পুরুষের সাথে সমান অধিকারের কথা অত্যন্ত জোর গলায়।
সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে অহেতুক পুরুষের সঙ্গে সংঘাতের পথে যেমন তিনি হাঁটেননি, তেমনই একটিবারের জন্যও নারীর আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে পুরুষতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণের কথাও ভাবেননি। সুফিয়া চিরকাল জোর গলায় বলতেন- "আমি ঘর ভাঙার নারীবাদে বিশ্বাস করি না।" তাই পুরুষের সঙ্গে অবৈজ্ঞানিক লড়াই করে, যৌনাঙ্গের স্বাধীনতাকেই নারী মুক্তির ধ্যান জ্ঞান হিসেবে কখনো ভাবতেই পারেননি তিনি। এই বোধের উন্মোচনে শৈশবে মামাদের, বড় ভাইদের কাছ থেকে প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া সুফিয়া যেভাবে স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে স্বামী কামালউদ্দিন খান তাকে যেভাবে সাহচর্য দিয়েছিলেন, তা কেবল ব্যক্তি সুফিয়ার জীবনকেই আলোকিত করেনি, গোটা বাঙালি সমাজকে ও অতিক্রম করে মানবসমাজের সামনে লিঙ্গ সাম্যের প্রশ্নে একটা নতুন ভাবনার জীবন্ত উদাহরণ তুলে ধরেছিল। শায়েস্তাবাদের বাড়িতে তার মামাদের কাছে হিন্দু-মুসলমান, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে আসা মানুষের স্রোতই সুফিয়ার জীবনে মানুষকে ভালোবাসার মন্ত্রের উদ্বোধন ঘটিয়েছিল। মুসলমান সমাজ সম্পর্কে রক্ষণশীলতার ভয়াবহতা ঘিরে একাংশের গবেষকদের (মূলত এসব গবেষকেরা জন্মসূত্রে হিন্দু। নিজেদের প্রগতিশীল বললেও তারা ধর্ম পরিচয়ের উর্ধ্বে কখনোই সেভাবে উঠতে পারেন নি) যেসব রোমহর্ষক কাহিনি, সেগুলির সার্বিক সত্যতা যে কতোটা ঠুনকো, সুফিয়া কামালের শৈশব-কৈশোরের প্রেক্ষাপট ভালোভাবে, নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলেই তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে সকলের কাছে।
শায়েস্তাবাদের নবাব বাড়ির আভিজাত্যে হিন্দু-মুসলমানের অবাধ মেলামেশাটা একটি দিনের জন্যেও কোনও অন্তরায় হয়ে ওঠেনি। প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি করেনি গরিবগুর্বোর অবাধ গতিবিধি ঘিরেও। গ্রাম বাংলার সামাজিক চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যটি বাংলার সমন্বয়ী , বহুত্ববাদী প্রবাহমান সংস্কৃতির যে ধারাটির পরিচয় রাখে, সেই পরিচয়ের সাক্ষ্য বহু গবেষক গবেষণাতে উঠে না আসলেও সুফিয়া কামালের পরিবারের মতো প্রকৃত শিক্ষিত পরিবারগুলি সেই ভাবধারাকে আন্তরিকভাবে আত্মস্থ করেছিল। তাই সুফিয়া গোটা জীবনব্যাপী সম্প্রীতির পক্ষে, হিন্দু-মুসলমানের পারষ্পারিক সৌহার্দ্যের প্রতি, মানুষের উপর সব রকমের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের যে সংকল্প, তার বীজ বপনটি হয়েছিল অতি শৈশবেই। আর সেই বীজের ভূমিতে হালকর্ষণ চলেছিল গোটা জীবন ধরে।
পারিবারিক পরিবেশের ভিতর দিয়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক অদলবদলের আভাস শিশু , কিশোরী সুফিয়ার মননলোককে আলোড়িত করত। রাজনৈতিক পটভূমিকা গোটা সামাজিক পরিমণ্ডলকে কীভাবে আন্দোলিত করছে, কতোটা প্রভাবিত করছে- এই বিষয়গুলি পরিণত সুফিয়াকে পরবর্তীতে যেভাবে পরিপূর্ণতা দিয়ে , তাকে বাংলা তথা বাঙালির বিবেকের সুউচ্চ মর্যাদাতে উপনীত করেছে, তার সার্বিক বেলাভূমি যেন ছিল শায়েস্তাবাদের নবাব বাড়িতে তার শৈশব-কৈশোরের দিনগুলি।
এরকমই শৈশবের সোনালী ডানার রোদের ঝলক হয়ে পারিবারিক পরিমণ্ডলের ভিতর দিয়েই সুফিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয় 'হেনা' গল্পটির। তখনও সুফিয়া গড়গড় করে কিছু পড়তে পারেন না। নিজের চেষ্টায় পড়তে শিখে বানান করে করে পড়েন। আর তেমন-ই বানান করে করে ছোট্ট মেয়ে 'হাচু' পড়ে ফেলেছেন, 'হেনা' গল্পটি। গল্পটির ভিতর প্রথম পরিচয় হল তার নজরুল ইসলাম নামটির সঙ্গে। নজরুল তার লেখার ভিতর দিয়ে ছোট্ট সুফিয়ার ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন পড়বার নেশা। নতুনকে জানবার আরও আরও আগ্রহ। তখনও সুফিয়া বানান করেই পড়েন। বিমুগ্ধতা থেকে মুগ্ধতার মধু আহরণ করে সেই মধু জীবনের শেষ সন্ধ্যা পর্যন্ত অকাতরে, অকৃপণভাবে বিতরণ করে যাওয়া একটি কালোত্তীর্ণ নাম হল সুফিয়া কামাল।
শৈশব- কৈশোরে মানসলোকের সুসংবন্ধনের সুলুক সন্ধান দিতে গিয়ে পরিণত বয়সে সুফিয়া কামাল লিখেছেন,
"নিত্য নতুন অতিথি আসা যাওয়ার নিত্য নতুন বাইরের খবর ও কিছুটা অন্দর মহলে গিয়ে পৌঁছে। নতুন দুনিয়ার খবর কানে আসত। প্রথম মহাযুদ্ধের শেষ, স্বদেশী আন্দোলনের পূর্ণ জোয়ার। হিন্দু- মুসলমানের মিলিত স্বপ্ন-দেশ স্বাধীন করা। নিজের অধিকার বুঝে নেওয়া। তখনও শৈশব কাটেনি। তবুও কিসের একটা আবেগ এসে মনকে দোলা দিত। এমনি কোনো বর্ষামুখর দিনে মুসলিম সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের লেখা 'হেনা' পড়ছিলাম বানান করে। প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, মিলন এ সবের মানে কি তখন বুঝি? তবু ও যে কী ভালো, কী ব্যথা লেগেছিল তা প্রকাশের ভাষা কি আজ আর আছে? গদ্য লেখার সেই নেশা।" (একালে আমাদের কাল, সুফিয়া কামাল, ১৯৮৮ সংস্করণ। পৃষ্ঠা-৫৩)
নজরুল আর রবীন্দ্রনাথ- এ দুই মহীরূহ সুফিয়ার মানসলোকে সত্যের উন্মোচনই শুধু ঘটালেন না, বিশ্ব মানবের দহলিজে বাঙালি মণীষার এক নবতম সংস্থাপনে এক শ্বেতশুভ্র ফলক স্থাপন করল। শৈশব উত্তীর্ণকালে 'প্রবাসী'-তে সুফিয়া পড়লেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। নিছক পড়া নয়, সুফিয়ার কাছে সেই পাঠ ছিল সত্যকে নিবিড় আবেগে পরম আবিষ্কার। কবিতার প্রতি একটা অন্যধরনের ভালোবাসা, ভালোলাগা আর সেই অনুভূতিকে মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত করবার সংকল্প, সুফিয়ার সেই সময়কাল থেকে শুরু। প্রবাসীতে প্রথম রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়বার অনুভূতিকে সুফিয়া বলতেন, তার কবিতার প্রতি 'মোহগ্রস্থ' হয়ে পড়বার সূচনা কাল। তবে সেই মোহগ্রস্থতা কখনোই তার জীবন এবং বোধ-কে আবরণে ঢেকে দেয়। তাই কখনো মোহ আবরণে আবদ্ধ হয়ে, সেই আবরণ খোলার প্রার্থনা তাকে জানাতে হয়নি। মোহ সুফিয়া কামালের দীর্ঘজীবনকে একটি মুহূর্তের জন্যও আকীর্ণ করতে পারেনি।
বেগম রোকেয়ার সার্থক উত্তরসূরী সুফিয়ার সঙ্গে রোকেয়ার একটা আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিল। রোকেয়া সম্পর্কে 'ফুফু' ছিলেন সুফিয়ার। শৈশবে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে রোকেয়ার সাহচার্য সুফিয়া পেয়েছিলেন। সেই সাহচার্য ছিল সুফিয়ার জীবনের পরম সম্পদ। রোকেয়ার সমাজসচেতনতার দিকটি, নারী মুক্তির দিক- এগুলির থেকেও কবি এবং সাহিত্যিক রোকেয়া, সুফিয়া কামাল-কে সব থেকে আগে প্রভাবিত করে। সুফিয়ার মা সৈয়দা সাবেরা খাতুনের কাছে ছোট্ট সুফিয়াকে নিজের স্কুলে ভর্তি করার প্রবল ইচ্ছে রোকেয়া জানিয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতায় তাদের সেই সময়ে স্থায়ীভাবে থাকা সম্ভব ছিল না। সেই কারণে সুযোগ পেয়েও সুফিয়ার পক্ষে রোকেয়ার স্কুলে পড়া সম্ভব হয়নি। রোকেয়ার স্কুলে পড়তে না পারার আফসোস সুফিয়ার জীবনে শেষ দিন পর্যন্ত ছিল। তবে শৈশব-কৈশোর ব্যক্তি রোকেয়ার সাহচর্য পেয়েও, সমাজসংস্কারক রোকেয়া অপেক্ষা, কবি রোকেয়া অনেক বেশি প্রভাবিত করেছিলেন সুফিয়াকে। কারণ, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতার আবেশে সুফিয়ার তখন কবিসত্তা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। তার পাশাপাশি সৈয়দা মোতাহারা বানু ('কাফেলা' নামক অনবদ্য কাব্যগ্রন্থের লেখিকা ছিলেন শের-ই-বাংলা ফজলুল হকের কন্যা) এবং বেগম সারা তাইফুরের কবিতাও তখন সুফিয়ার মানসলোককে আপ্লুত করে ফেলেছে।
কবিতার নিবিড় পাঠের ভিতর দিয়ে সমাজমনষ্ক হয়ে উঠলেও , বাড়ির মেয়ে কবিতা লিখছে, সে যুগের হালহকিকত অনুযায়ী এ বিষয়টি প্রায় অসম্ভব ছিল শায়েস্তাবাদের নবাব বাড়িতে। রোকেয়া যেমন জবরদস্তির বিদ্রোহ দিয়ে আসল লড়াইয়ের পরিমণ্ডলকে কখনো দুর্বল করে দেন নি, বৃহত্তর লড়াইকে আরও জোরদার করবার তাগিদে ব্যক্তি, পরিবার, সাংসারিক জীবনে ছোটখাটো আপস করেছিলেন বৃহত্তর দুনিয়ার উন্মুক্ত আকাশের আকাঙ্খায়, সুফিয়ার জীবনটিও ঠিক তেমনভাবে পরিচালিত হয়েছিল। বাড়ির মেয়ের কাব্য চর্চা মুরুব্বিদের কাছে যেহেতু খুব একটা সমর্থনযোগ্য নয়, তাই রোকেয়া যেমন বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লে মোমের নরম আলোতে পাঠাভ্যাস করতেন, ঠিক তেমনভাবেই, মুরুব্বিদের অগোচরে কবিতা লিখতে শুরু করলেন সুফিয়া। তার নিজের কথায়-
"কী গোপনে, কত কুণ্ঠায়, ভীষণ লজ্জায় সেই হিজিবিজি লেখা, ছড়া, গল্প। কিন্তু কোনোটাই কি মনের মতো হয়! কেউ জানবে, কেউ দেখে ফেলবে বলে ভয়ে ভাবনায় সে লেখা কত লুকিয়ে রেখে আবার দেখে দেখে নিজেই শরমে সংকুচিত হয়ে উঠি।"
এই যে কুণ্ঠা, সঙ্কোচের কথা সুফিয়া কামাল বলেছেন, 'আমারে না যেন করি প্রচার , আমার সকল কাজে- এটি ছিল তাঁর চরিত্রের সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য। 'আমি'-কে দূরে সরিয়ে দিয়ে একক মাত্রাকে একটি বৃহত্তর 'আমরা'-র বহুমাত্রিক বোধে উপস্থাপনের ভিতর দিয়ে গোটা পারিপার্শ্বিকতাকে বহুস্বরে পরিণত করা, সেই বহুস্বরে একটিও কণ্ঠ যদি সত্য বলে, ন্যায় বলে, সেই সংখ্যালঘু কণ্ঠটিকে সমুচিত মর্যাদা দেওয়া- এই শিক্ষা কেবল নিজের কাজ নয়, নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন সুফিয়া কামাল। এ দিক থেকে বিচার করে বলতে হয় যে, গান্ধীর মতোই সুফিয়া কামালের জীবনই হয়ে উঠেছে তার বাণী।
শ্রাবণের বুকের ভিতর যেমন আগুনকে দেখতে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তেমনই স্নেহের স্বচ্ছসলিলা সুফিয়াও ছিলেন অগ্নিতে দীপ্তগীতের এক স্রোতস্বিনী ধারা। তাকে যেমন কেউ কখনো রাগতে দেখেননি, তেমনই শরীরের ভাষাতে রাগের কোনও বাহ্যিক প্রকাশ না করেও, সেই ছোটোখাটো মানুষটি অন্যায়ের প্রতিবাদে কতোখানি কঠিন হতে পারেন তা দোর্দণ্ডপ্রতাপ আইয়ুব খান থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার সাক্ষাৎকার নিতে আসা পাকিস্তানের দালাল সাংবাদিক- প্রত্যেকেই খুব জোরদার ভাবে বুঝেছিলেন। তাই তসলিমা নাসরিনের মতো খ্রিস্টান মৌলবাদের দালালের পক্ষে সম্ভব হয় নি সুফিয়ার জ্যোতির্ময় প্রভার সামনে একটু দাঁড়াবারও। সুফিয়া কামাল একটিবারের জন্যও তসলিমার মতো নিজেকে আলু-পটলের মতো পণ্য হিসেবে তুলে ধরবার কথা ভাবতেই পারতেন না। ইসলামকে ব্যক্তি স্বার্থে গাল পেড়ে রাজনৈতিক হিন্দু-সাম্প্রদায়িকদের দালাল হিসেবে যে ভূমিকা তসলিমা পালন করে চলেছে, তেমনভাবে বিবেক বন্ধকের কথা সুফিয়া কামাল কখনো কল্পনাই করতে পারেননি। একারণেই কালের পাথারে সুফিয়া কামাল মানবতার জীবন্ত বিগ্রহ হিসেবে প্রতিটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, মানবমুক্তির পক্ষের বাঙালির হৃদয় মন্দিরে তিনি প্রতিষ্ঠিত।
ছবি: সুলতানা কামালের সৌজন্যে পাওয়া