Published : 08 Jun 2020, 04:34 PM
বাফালো সোলজার/ইন দ্য হার্ট অব আমেরিকা। ড্রাইভেন ফ্রম দ্য মেইনল্যান্ড/কামিং টু ক্যারাবিয়ান/স্টোলেন ফ্রম আফ্রিকা/ব্রট টু আমেরিকা। ফাইটিং অন অ্যারাইভাল/ফাইটিং ফর সারভাইভাল…
-বাফেলো সোলজার, বব মার্লের জনপ্রিয় গান
বব মার্লের বাফেলো সোলজাররা আবারও রাস্তায় নেমেছে। ২৫ মে (২০২০) আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ পুলিশের নির্মম 'হাটু চাপায়' গ্রেফতারকৃত ও হাতে হ্যান্ডকাফ বাধা কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড নিহত হলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে আমেরিকার সাধারণ মানুষ। সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ রাস্তায় নেমে এলে কিছু মানুষের ক্ষোভে হোয়াইট হাউজের কাছের এক গীর্জা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডনাল্ড ট্রাম্পের গীর্জা পরিদর্শন ও বাইবেল হাতে ছবি তোলা ভাইরাল হলে অনেকে দক্ষিণ আফ্রিকার একটা ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার নির্যাতিত কালো মানুষরা বলতো- 'হে ঈশ্বর, বহু বহু বছর আগে সাদা মানুষের দল যখন এখানে আশ্রয় নিতে এসেছিল তখন তাদের হাতে ছিল বাইবেল আর আমাদের হাতে ছিল পুরো দক্ষিণ আফ্রিকা। হায় ঈশ্বর নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! আজ আমাদের হাতে বাইবেল আর সাদাদের হাতে পুরো দক্ষিণ আফ্রিকা'!
সাদাদের হাতে এখন পুরো পৃথিবী। আর মৃত্যুর আগে জর্জ ফ্লয়েড যেমন বলছিল আমি শ্বাস নিতে পারছি না (আই কান্ট ব্রিদ) তেমনি আমেরিকায় কালো মানুষদের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বহু বছর ধরে। এরিক গার্নারেরও শ্বাসকষ্ট হয়েছিল। সে শ্বাস নিতে পারছিল না। ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই নিউ ইয়র্কের আইসল্যান্ডের বাড়ির পাশ থেকে গার্নারকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ আয়কর ফাঁকি দিয়ে সিগ্রেট বিক্রির অভিযোগে। গ্রেফতার করার এক পর্যায়ে তার গলা টিপে ধরেছিল পুলিশ। মরে যাবার আগে বারবার বলছিল গার্নার- আমি শ্বাস নিতে পারছি না!
২০১৫ সালের এপ্রিলে ম্যারিল্যান্ডের বাল্টিমোর শহরের পুলিশ ফ্রেডি গ্রেকে গ্রেফতার করে ব্লেড রাখার অপরাধে। পুলিশ ভ্যানে ওঠানোর পর ফ্রেডিকে ডান্ডাবেড়ি ও হাত পেছনে এনে হাতকড়া পরানো হয়। এরপর মেঝেতে ফেলে দিলে ফ্রেডির শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সারা পথে তাকে এভাবে শাস্তি দেয়ার ফলে ফ্রেডি অসুস্থ হয়ে পরে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল মারা যায় ফ্রেডি গ্রে!
রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেটে যাবার অপরাধে মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের পুলিশ মাইকেল ব্রাউনকে গুলি করে হত্যা করেছিল ২০১৪ সালের অগাস্টে! দুই মাস পরে ইলিনয়নের শিকাগো শহরে লাকুয়ান ম্যাকডোনাল্ডকে ছুরি দিয়ে ভয় দেখানোর অভিযোগে পর পর ১৬টি গুলি ছুড়ে হত্যা করে পুলিশ। এগারো বছরের কিশোর তামির রাইসকে ওহাইও অঙ্গরাজ্যের পুলিশ পার্কে খেলার সময় গ্রেফতার করে পুলিশভ্যানে তোলে। তামির বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলে পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করে।
কালো মানুষদের পুলিশী মৃত্যুর এমন তালিকা বেশ দীর্ঘ। কয়েকটি আলোচিত নাম হচ্ছে সাউথ ক্যারোলিনার ওয়ালটার স্কট, মিনেসোটার জামার ক্লার্ক, লস অ্যাঞ্জেলেসের অ্যাস্টন স্টারলিং, ক্যালিফোর্নিয়ার স্টেফন ক্লার্ক, টেক্সাসের ডালাসের বোথাম জেন এবং কেনটাকির লুইসভিলের ব্রিয়োন্নো টেইলর। এই তালিকার সর্বশেষ নাম হচ্ছে মিনেসোটার জর্জ ফ্লয়েড! ২০১৯ সালে এমন পুলিশী মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১০১৪ জন যার ভেতর ৬৮২ জনই কালো মানুষ!
আমেরিকান উন্মাদ খ্যাত রাষ্ট্রপতি ডনাল্ড ট্রাম্পের মতো কালো মানুষরা আমেরিকার আদিবাসী নন। মাত্র তিন পুরুষ আগে ডনাল্ড ট্রাম্পরা জার্মানী থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন বলেই জনশ্রুতি আছে। অত্যাচারের বদলে 'আফ্রিকান আমেরিকান' খ্যাত এই কালো মানুষদের কাছে আমেরিকার অন্যান্য নাগরিকদের আজন্ম ঋণী থাকা উচিত ছিল। স্পেনের রানীর হয়ে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর বদলে যেতে থাকে আমেরিকার ইতিহাস। আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের ভেতর 'দাসপ্রথা' চালু ছিল না। ইউরোপিয়ানরা আমেরিকাতে নিজ স্বার্থ সংরক্ষণে আর সম্পদ বিনির্মাণে প্রকৃতির সন্তান খ্যাত আফ্রিকার কালো মানুষদের 'দাস' হিসেবে ধরে আনা শুরু করে যেটা 'ট্রান্স আমেরিকান স্লেভ ট্রেড' হিসেবে খ্যাত। বব মার্লের (বাফেলো সোলজার) গানে যেমন আছে-'স্টোলেন ফ্রম আফ্রিকা/ব্রট টু আমেরিকা/ড্রাইভেন ফ্রম দ্য মেইন ল্যান্ড/কামিং টু ক্যারাবিয়ান…
অমানবিক আর নির্মম প্রথায় আফ্রিকা থেকে এসব কুন্টাকিন্টেদের (অ্যালেক্স হ্যালির 'রুটস' উপন্যাসের দারুণ আলোচিত চরিত্র কুন্টাকিন্টে। একদা বাংলাদেশ টেলিভিশনে এই উপন্যাস অবলম্বনে একটা সিরিয়াল প্রচারিত হতো) ধরে আনা হতো। জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দেবার সময় কুন্টাকিন্টেরা বিনা চিকিৎসা, ক্ষুধা আর পিপাসায় মারা যেত। যারা বাঁচত তাদের 'ডাম্প' করা হতো ব্রাজিল বা হাইতি ও ক্যারাবিয়ান বিভিন্ন দ্বীপ দেশে (বব মার্লের গানে এই 'ক্যারাবিয়ানে'র কথাও উল্লেখ আছে) এরপর এই কালো দাসদের পাঠানো হতো আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। মূলত এই কালো মানুষদের ঘাম আর শ্রমে, রাস্তা-রেললাইন বা খনির কাজে, ধান, তামাক বা তুলা উৎপাদনে একবেলা আর আধবেলা খেয়ে অসহায় কালো মানুষদের 'অর্থনৈতিক আত্মহননের' বিনিময়ে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায় আমেরিকা ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অর্থনীতি। কালো মানুষরা তবু 'দাস'ই থেকে যায়। কিন্তু একবার তাদের সামনে চলে আসে বাঁচা মরার লড়াই। ফ্রান্স আর পরে বৃটেনের শোষণ আর সম্পদ লুন্ঠনের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল আমেরিকার সাধারণ মানুষ। শেষমেষ এই জনবিদ্রোহ রূপ নিয়েছিল যুদ্ধে। ১৭৭৫ থেকে ১৭৮৩ পর্যন্ত চলা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে কালো মানুষদের সাহসী প্রতিরোধ আলোচিত হতে থাকে সর্বত্র। কালো মানুষদের সমন্বয়ে গঠিত যুদ্ধের এই ব্যাটেলিয়নকে অনেকে ডাকতেন 'বাফালো সোলজার' হিসেবে যা বব মার্লের গানে আছে!
কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের পরেও কালো মানুষরা দাসই থেকে যান। প্রায় আশি বছর পরে ১৮৬১ সালে আব্রাহাম লিংকনের উদ্যোগের কথা সবাই জানেন। দাস প্রথা উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ বেধে যায়। রক্তক্ষয়ী সেই গৃহযুদ্ধের সময়েও এগিয়ে এসেছিল কালো মানুষদের সমন্বয়ে গড়া সেই 'বাফোলো সোলজার্সরা'! ১৮৬৩ সালে আব্রাহাম লিংকনের বিজয়ের পর তিনি দাসপ্রথা উচ্ছেদ করে তাদের মুক্ত ঘোষণা করেন। আব্রাহাম লিংকন সরকারিভাবে দাসপ্রথা উচ্ছেদ করলেও শেতাঙ্গ প্রভাবিত আমেরিকানদের মন ও মগজ থেকে দাসপ্রথা বা বর্ণবাদকে কেউ মুছে ফেলতে পারেনি। তারা আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের 'জাদুঘরে' যাবার ব্যবস্থা করেছে আর কালো মানুষদের বানিয়েছে 'কর্পোরেট স্লেভ'!
সমুদ্র জয় করুক আর আকাশে কসরত দেখাক, অ্যাথলেটিকসে বিশ্ব জয় করা সোনার পদক জিতুক আর টেনিসের জগতে রাজত্ব করুক, ফুটবল, রাগবী আর বাস্কেটবলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হোক কিংবা মুষ্ঠিযুদ্ধে চ্যাম্পিয়ন হোক বছরের পর বছর, চলচ্চিত্র ও সংগীতে যতই নতুন ধারা তৈরি করুক, দিনশেষে কালো মানুষরা কালোই (নিগার), বড়জোর একালের 'কর্পোরেট শ্লেভ'!
ইউরোপিয়ান সাদা চামড়ার মানুষেরা নতুন আমেরিকায় চাষাবাদ আর কলকারখানা চালু করেছিল। সেটা ছিল আমেরিকার 'দাসতান্ত্রিক' পুঁজি ব্যবস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকাতে সেটাও নেই। আমেরিকা এখন হোটেল রেস্তোরা, পাব কাম নাইট ক্লাব, লাসভেগাস মার্কা ক্যাসিনো ও রেডলাইট সিটির দেশ। তথাকথিত ভোগবাদী দেশ। সেখানকার কর্পোরেট স্লেভরা এখন কথায় কথায় চাকরি হারায়। করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি মরেছে এই কালো মানুষেরাই! আগে চাবুক পেটা হয়ে একবেলা খাবার জুটলেও কালো মানুষদের অনেকের এখন আর সেটাও জোটে না। চাবুক পেটা হয়ে একবেলা খাওয়া কালোরা আগে তাই খামার বা কারখানা ভাংচুর করত, এখন বৈষম্যের জোয়ারে ভেসে আসা জল সাঁতরে এসে তারা রেস্তারা, পাব বা সুপারশপ ভাংচুর করে! হুমায়ুন আজাদের ভাষায়- 'গরীব মানুষদের তখনই মানায় যখন তারা প্রতিবাদ করে'! তিউনিসীয় ফেরীওয়ালা মোহাম্মেদ বুজজায়ীর মতো সাবেক বাস্কেটবল খেলোয়াড় জর্জ ফ্লয়েড আমেরিকায় জেগে ওঠার যে বসন্তের বাতাস বইয়ে দিয়েছেন শেষমেষ সেটাতে আমেরিকানদের মন জুড়োবে কিনা এখনও বলা যাচ্ছে না।
নিহত ফ্লয়েডের এক ছেলে ও ছয় বছরের একটা মেয়ে আছে। তাদের জন্য নিবেদিত কয়েকটা লাইন-
'দম নিতে চাই। সরিয়ে নাও রংয়ের হাটু।
একটু নেব শ্বাস।
চাপিয়ে দেয়া তোমার রংয়ে সবার সর্বনাশ।
ঈশ্বর কী রং আসক্ত?
সাদা কালোর এক রক্ত
কোন হিসেবের ভুল?
আমার জন্য একটু রেখো 'কালো আগুন' ফুল।
নাকি আমি আজও আছি বিশ্বাসী গাধা?
জানি না তো ঈশ্বর তুমিও কী সাদা?
আমি কালো চারিদিকে নিয়তির বাধা!
জিয়ানার বয়স হলো ছয়
জর্জের কাছে সে এর বড় নয়
হবেও না কোনোদিন। জিয়ানা বড় হবে এই পৃথিবীতে
স্মৃতিগুলো পারবে না কেউ মুছে দিতে
যদি পারো জিয়ানাকে 'শ্বাস' দিও ধার!
ঈশ্বর পৃথিবীটা কালো কারাগার'?
জর্জ ফ্লয়েডের একমাত্র মেয়ের নাম জিয়ানা। আমেরিকাসহ পৃথিবীর অনেক দেশে বব মার্লের 'বাফেলো সোলজার'রা এখন যুদ্ধ করে যাচ্ছে। ফাইটিং ফর সারভাইভাল। তাদের একটু শ্বাস নিতে দিন! ছয় বছরের জিয়ানাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- তোমার বাবা কী করেছে? জিয়ানার উত্তর- পৃথিবীটা বদলে দিতে পেরেছে!
জিয়ানার মনের কামনা পূর্ণ হোক। বব মার্লের বাফেলো সোলজাররা বদলে দিক পৃথিবী।
বসন্ত বাতাসে ঊড়ে যাক পুঁজি নির্ভর আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ!