Published : 06 May 2020, 06:57 PM
মামুন ভাই, ৩ তারিখ বিকেল ৫টার দিকে আপনাকে ফোন করলে, আপনি অনেক ক্ষীণ ও জড়তাপূর্ণ স্বরে বলেন, "স্বদেশ, আমি মুগদা হাসপাতালে, আমার সমস্যা আমি খেতে পারছি না, বমি হয়ে যাচ্ছে। শ্বাস কষ্ট অনেক …"। এরপরে আপনি আরো কিছু কথা বলেছিলেন, কিন্তু শুনতে পাইনি। সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। আপনাকে যখন ফোন করি তখন যে বইটি পড়ছিলাম, সেখান থেকে ৫ এপ্রিল দুপুর ৩টা অবধি কোন বইও পড়তে পারেনি। কিছু লিখতেও পারেনি। সেদিন দুপুরের পরে দ্বিতীয় মেডিকেল বোর্ড বসে যখন আপনাকে কেবিনে দেয়, তখনই একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে যেন গত ৭২ ঘণ্টার বেশি সময়ের এক সীমাহীন কষ্ট থেকে মুক্ত করে।
আর সে মুক্তির আনন্দ শেয়ার করার জন্যে ফোন করি শামসুজ্জামান খান ভাইকে। তিনিও একই অবস্থায় কাটিয়েছেন এই সময়টা। শিল্পী হাশেম খান, শাহরিয়ার কবির ভাই, তারিক সুজাত এর কষ্ট কতটা সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এর ভেতর তো আছে সারা দেশ থেকে ফোন, মুক্তগাছার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে পরিতোষ সেন, দিনাজপুরের বিরল গ্রাম থেকে শফিউদ্দিন আহমদ এমনি কত যে সাধারণ মানুষ ফোন করে জানতে চাচ্ছেন, মুনতাসীর মামুন স্যারের অবস্থা কী? তাদের একটাই আকুতি, প্রধানমন্ত্রীকে বলুন, তিনি যেন তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তাদেরকে আশ্বস্ত করি, প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি দেখভাল করছেন। তাঁর অফিসের নির্দিষ্ট লোকদের দায়িত্ব দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। এখন স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করুন। তাদের কেউ বলছেন আমি তার জন্যে নামাজ পড়ে বার বার দোয়া চাইছি আল্লাহর কাছে; কেউ বলছেন, আমি মন্দিরে মানত করেছি।
ওই সাধারণ গ্রামের মানুষ থেকে আমরা যারা আপনার বন্ধু স্থানীয়, সকলেরই কিন্তু একটাই আকুতি, আমরা সুস্থ মুনতাসীর মামুনকে চাই, আমরা দেশের যে কোনও প্রগতিশীল দাবিতে সাহসী সেই মুনতাসীর মামুনকে আবার ফেরত চাই। আমরা বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে সেই কর্মবীর মুনতাসীর মামুনকে চাই। আপনাকে রোগ শয্যায় মানায় না মুনতাসীর মামুন। তাছাড়া শুধু আমরা আপনার কেবল আপনজনরা নই, বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষ কেউই মুনতাসীর মামুন ছাড়া বাংলাদেশকে ভাবতে রাজি নন।
মুনতাসীর মামুন, আপনি আমাদের ও বাংলাদেশের কে তা নিয়ে একটি ছোট নিবন্ধে লেখার আর কোনও উপায় নেই। কারণ, যে লেখকের বইয়ের তালিকা নিয়ে কয়েক খণ্ড বই বের হয় তাকে নিয়ে একটি ছোট নিবন্ধে কী আর লেখা যায়। তারপরেও মন মানে না। আমি একটা কাজই কিছুটা জানি পৃথিবীতে- তা হলো দুই কথা লিখতে। তাই বার বার মন চাচ্ছে, আপনাকে নিয়ে দুকথা লিখে নিজের প্রার্থনাটা জানাতে যে আপনি সুস্থ হয়ে আসুন। আমি সামান্য সাংবাদিক ও লেখক, আমার প্রার্থনার এই একটি মাত্র সৎ পথ। এটাকেই জীবনে সততার অবলম্বন হিসেবে নিয়েছি। তাই আপনার সুস্থতার জন্যে প্রার্থনার এ পথ বেছে নেয়া। কারণ, আপনাকে নিয়ে যদি প্রার্থনা না করি, তাহলে আমার জম্মভ'মি যে মাতা গাঙ্গেয় পূর্ববঙ্গ, সেই পূর্ববঙ্গকে অপমান করা হবে। কারণ, আপনিই একমাত্র বাঙালি লেখক ও ঐতিহাসিক- যিনি আমার জম্মভূমি মাতা গাঙ্গেয় পূর্ববঙ্গের এক পরিপূর্ণ ইতিহাস তুলে এনেছেন। ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানরা তাদের জম্মভূমি আজকের বাংলাদেশ একদার পূর্ববঙ্গ নিয়ে অনেক গবেষণা করবে। কারণ, জাতি যতই সভ্য হবে, শিক্ষিত হবে ততই সে ইতিহাস সচেতন হবে। তখন তারা আমাদের থেকে আরো বেশি সম্মান করবে মুনতাসীর মামুনকে। কারণ, আপনিই একমাত্র ঐতিহাসিক যার মাধ্যমে ছাড়া পূর্ববঙ্গকে জানার আর কোনও পথ নেই। একাজ একমাত্র আপনিই করেছেন। আপনাকে আমরা যোগ্য সম্মান হয়তো সব সময়ই দেয়নি। আমরা আপনাকে এমিরেটাস প্রফেসর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জুড়ে রাখিনি। আমরা আপনাকে ন্যাশনাল প্রফেসর করিনি। সে আমাদের ব্যর্থতা, তারপরেও আপনি তো আপনার কোন কাজ থামিয়ে রাখেননি। আপনি এই বয়সে এসেও চারণের মত সারা বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে গণহত্যার স্মারক চিহ্নিত করে চলেছেন। গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশে প্রথম গণহত্যা জাদুঘর। যা এখন পৃথিবীর অন্যতম সেরা গণহত্যা জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধ,গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে আপনি কাজ করে চলেছেন অবিরাম। আর কী অপরিসীম পরিশ্রম করে আপনি যে কাজ করেন সেটা আমরা যারা আপনাকে কাছ থেকে দেখি তারা জানি।
আপনি একদিন হঠাৎই বললেন, "স্বদেশ, ছয় দফার ওপর কোন পরিপূর্ণ বই নেই।" তার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে আপনি ছয় দফার ওপর একটা পরিপূর্ণ বই লিখলেন। আসলে মাঝে মাঝে আপনার কাজ দেখে মনে হয়, এখন যদি রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনি অন্তত আপনার মত একজন বাঙালিকে দেখে সন্তুষ্ট হতেন। যিনি শুধু সত্যি কাজ করেন। কারণ, এখনও ফেইসবুকের দিকে তাকালে বাঙালির জন্যে কষ্ট হয়। মনে হয় রবীন্দ্রনাথ অসন্তুষ্ট চিত্তে যে বাঙালিকে দেখে গিয়েছিলেন, বাঙালি এখনও সেখানে পড়ে আছে। ফেসবুকে একে অপরকে গালি দিচ্ছে, নোংরামি করছে অথচ তিল পরিমাণ কাজ করছে না। অর্থাৎ বাঙালি যে পঙ্কিলে ছিল সেখানেই আছেন।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'বাঙালির মধ্যে ভুলক্রমে দু একজন মানুষ জম্মিয়া যায়'। তিনি সকল বাঙালিকে মানুষ বলেননি। মুনতাসীর মামুন ভাই আপনি সত্যি সেই মানুষ। মানুষ যখন নিজে বেঁচে থাকার তাগিদে এখন তার সমস্ত মায়ার বন্ধন, সমস্ত সম্পর্ককে অস্বীকার করতে চলেছে সেখানে আপনি ব্যতিক্রম। আপনার চাচা আমাদের বাংলাদেশের অন্যতম সম্পদ বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর মারা গেলে আপনি তার জানাজা করে ফেরার পথে আমাকে ফোন করে বলেন, "স্বদেশ, আমি অন্তত সেই সন্তান হতে পারবো না যে আমার মা অসুস্থ হয়েছেন, কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন আর তাকে আমি স্পর্শ্ব করবো না, তাকে হাসপাতালে নেব না। এটা আমি পারবো না।"
এই আটষট্টি বছর বয়সের আপনি সেটা প্রমাণ করলেন। যেভাবে আপনি আপানার কোভিড আক্রান্ত মাকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন আর যার জন্যে নিজে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলেন, এটা মায়ের প্রতি সন্তানের ভক্তির একটি উদাহরণ হিসেবে থেকে যাবে আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য। যে সময়ে সমাজের মূল্যবোধগুলো অনেকাংশে ভেঙ্গে পড়ছে সেই সময়ে আপনি নিজের জীবনে ঝুঁকি নিয়ে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করে গেলেন। ছোট বেলায় বাবার মুখে শুনতাম, মাতৃভক্তি যার যতো, সেই সন্তান হয় কীর্তিমান ততো। আপনার এই বড় হবার আরেকটি কারণ সত্যিই আজ আমাদের সামনে, জাতির সামনে প্রকাশ হলো।
অন্যদিকে আপনার ভেতর যে একটি অন্য রকম পিতার চরিত্র আছে, যা ছিল প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের মধ্যে সেটা সব সময়ই আমরা দেখতে পাই। আপনি আপনার নিজ সন্তানের মত এক ঝাঁক ছাত্রকে মানুষ করেছেন। তাঁরা আজ সমাজে ও রাষ্ট্রে নানান জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। তারা অনেকে বড় বড় শিক্ষাবিদ হতে চলেছেন। তারা অনেকে আপনার অনুপ্রেরণায় লেখক ও গবেষক হয়েছেন। এদেরকে যে আপনি কী স্নেহছায়া দিয়ে বড় করেছেন, কীভাবে তাদের হাতে কলমে শিখিয়েছেন- তা আমরা নানান সময়ে দেখেছি। এরা আপনাকে কতটা ভক্তি করে, ভালোবাসে সেটা আমরা বুঝতে পারি।
এভাবে পরবর্তী প্রজম্মকে আপন সন্তানের মত বাংলাদেশে খুব কম শিক্ষকই গড়ে তুলেছেন। আমাদের কোন পেশায় আমরা পরবর্তী প্রজম্ম গড়ে তোলার দিকে নজর দেই না। বরং আমাদের অনেকের চরিত্র বনের মাঝের শিমুল গাছ, বা পাকুড় গাছের মত। যার তলায় অন্য গাছ জম্ম নিতে পারে না। সেক্ষেত্রে আপনি ব্যতিক্রম। আর তাই আপনাকে আরো অনেকদিন কর্মব্যস্ত থাকতে হবে পরবর্তী প্রজম্মের জন্যে।
মুনতাসীর মামুনকে নিয়ে লিখতে গেলে কোন ছোট নিবন্ধ লেখা সম্ভব নয় সেটা আগেই বলেছি। তাই অনেকটা জোর করেই এ লেখা শেষ করতে হবে। শেষে শুধু মুনতাসীর মামুনের একটি কাজের কথা বলবো সেটা আমাদের প্রিয় পুরোনো ঢাকা। আমার শেষ কৈশোর, তারুণ্য ও যৌবন ঘিরে আছে পুরোনো ঢাকা। ঢাকা বলতেই এই পুরোনো ঢাকা এখনও আমাদের কাছে। কারণ, এই পুরোনো ঢাকাই সেই ঢাকা যা সম্পর্কে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, "এ ঢাকায় ঢোকার গেট আছে বেরুনোর গেট নেই।"
সত্যি তাই। পুরোনো ঢাকা শুধু একটি শহরের একটি এলাকার নাম নয়, এ একটি অন্য ধরনের ভালোবাসার নাম। এই পুরোনো ঢাকার অলিগলিতে আমাদের ছড়ানো আছে আমাদের হাজার রকমের ভালোবাসা। এই বুড়িগঙ্গার পানিতে গোসল করে কখনো ওয়াইজ ঘাট দিয়ে উঠে আসা কখনো ফ্রেঞ্চ রোড দিয়ে উঠে আসা, আবার নারিন্দার কাবাব, দক্ষিণ মৈশুন্ডির রক, শ্রীষ দাস লেনের পানি ফল সে সব এক অন্য জগত। যাহোক, সে জগতের স্মৃতিতে ফেরা আজ নয়।
মুনতাসীর মামুন, তখনও আমি আপনার ঘনিষ্ঠ নই সে সময়ে সম্ভবত বিচিত্রায় আপনার পুরানো ঢাকা নিয়ে একটি প্রচ্ছদ কাহিনীতে ফ্রেঞ্চ রোডের নানান বাড়ির ইতিহাস পড়ে চৈত্রের দুপুর রোদেই লক্ষ্ণী বাজার থেকে হেঁটে চলে যাই, সেদিন তাকিয়ে তাকিয়ে নতুন এক ফ্রেঞ্চ রোডকে দেখি। এমনিভাবে আপনি কত জনের কতভাবে যে দেখার চোখ খুলে দিয়েছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। তাই অসুস্থতা আপনার জন্য নয়। আপনি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে দ্রুত ফিরে আসেন। কারণ, আমাদের যে ক'জন সব সময়ই মনোবলের জোগান দেন, আপনি তাদের একজন। আপনাকে ছাড়া আমাদের জীবন কখনই পরিপূর্ণ নয়। আপনি এই বাংলাদেশের প্রগতিশীল প্রতিটি পরিবারেরই আপন সদস্য। সকলেই আপনার জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছেন। আপনি দ্রুত সুস্থ হোন।