Published : 11 Jan 2020, 12:46 PM
'পয়লা কুত্তা, কুত্তা বোলে। দুসরা কুত্তা কুত্তা পালে। তিসরা কুত্তা জরুকা ভাই। চৌথা কুত্তা ঘরজামাই।' এই হিন্দি প্রবাদে কুত্তা কিংবা ভদ্রভাবে বললে, কুকুরকে একটি ঘৃণার্হ প্রাণী হিসেবেই দেখানো হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে উপমহাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় কুকুরের তেমন সম্মান নেই। কুকুরের প্রতি মানুষের আচরণ ও মনোভাবের সঙ্গে ভূগোলের একটা সম্পর্ক আছে। কুকুরের যেখানে আদর, সেটা অবশ্যই পাশ্চাত্য। কুকুর যেখানে কমবেশি ঘৃণার্হ, সেটা মধ্যপ্রাচ্য কিংবা উপমহাদেশ। কুকুরকে যেখানে খেয়ে হজম করে ফেলা হয়, সেটা দূর প্রাচ্য, চীন বা কোরিয়া।
২৬ ডিসেম্বর ২০১৯। হাতিরঝিলে যারা সেদিন বায়ুসেবনে গিয়েছিলেন একটি অভূতপূর্ব ঘটনা দেখার অভিজ্ঞতা তাদের হয়েছিল। লোকজন হাঁটছে। ভিড়ের ভিতর দিয়ে এক যুবকের গলায় কুকুরের বকলস বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক যুবতী। যুবকের চুলের রঙ সোনালী, স্বাস্থ্য ফেটে বেরিয়ে আসছে যেন। নাম টুটুল চৌধুরি। যুবতী আফসানা হাসান সেঁজুতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বা পারফর্মিং আর্টস বিভাগের ছাত্রী। সেঁজুতির ভাষ্য অনুযায়ী পুরো ঘটনাটি একটি সংলাপহীন চলমান পথনাটক।
আইডিয়াটিও নতুন নয়। ১৯৬৮ সালে ভিয়েনা শহরে ভেলি এক্সপোর্ট ও পিটার ওয়েভেলের 'ফ্রম দি পোর্টফোলিও অফ ডগেডনেস' বা কুত্তাবাজি প্রদর্শনীর পুনরাবৃত্তি। ভিয়েনার পথনাটকে তিনজন নারী চার হাত পায়ে হাঁটতে থাকা একটি পুরুষের গলায় বাঁধা তিনটি সাদা লেস ধরে টেনে নিয়ে গেছেন শহরের রাস্তার এদিক থেকে ওদিকে। কুকুরের ভূমিকায় অভিনয় করা লোকটির চুলের রঙ সোনালী। ঢাকায় কুকুরের ভূমিকায় অভিনয় করা যুবকটি কিছুটা রাস্তা মানুষের মতো হেঁটে গেছে। ভিয়েনার মানব-কুকুর পুরোটা সময় চার পায়ে হেঁটেছে, আসল কুকুরের মতোই একাধিকবার রাস্তার নারী পথচারীদের অঙ্গ শুঁকে দেখেছে। ঢাকায় মানব-কুকুর কুত্তাবাজিকে এই পর্যায়ে নিয়ে যায়নি, অর্থাৎ কাউকে বিরক্ত করেনি তারা।
ভিয়েনার রাস্তার পথচারীদের মধ্যে খুব কমই এই দৃশ্য দেখে ঘুরে তাকিয়েছে। কোনো পথচারী হা করে তাকিয়ে থাকেনি। দেখে হায় হায় করারতো প্রশ্নই আসে না। একজন পথচারীও তিন মহিলা ও এক মানব-কুকুরকে কোনো প্রশ্ন করেনি। কেউ পুলিশ ডাকেনি। পুলিশ নিজে থেকে এসেও কুশীলবদের গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়নি। যতটুকু দেখেছি ভিডিওতে, ঢাকাতেও লোকজন ঘটনাটা দেখেছে, কিন্তু হা করে তাকিয়ে থাকেনি কেউ। ভিয়েনার সঙ্গে ঢাকার পার্থক্যটা কী তাহলে? পার্থক্যটা হচ্ছে, ঢাকায় কেউ একজন পুলিশ ডেকেছে কিংবা পুলিশ নিজে থেকেই মিনিট পনেরোর মধ্যে অকুস্থলে হাজির হয়ে টুটুল ও সেঁজুতিকে থানায় ধরে নিয়ে গেছে। যতদূর জানা গেছে, তাদের মারধোর করা হয়নি। মৃদু ভৎর্সনা করে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
'রবীন্দ্র সঙ্গীতই যদি গাইবে, তবে সে পুলিশের চাকুরি কেন নেবে!'– বলেছিল পুলিশ বিভাগ ছেড়ে আসা আমার এক সংস্কৃতিমনা ছাত্র। সেঁজুতি আর টুটুলের কার্যকলাপ যে মূলত অভিনয় ছিল তা বোঝার মতো শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ কি বাংলাদেশের পুলিশ বা নীতিনির্ধারকদের আছে? এই দুই অভিনেতা কি কোনো অন্যায় বা বেআইনী কাজ করছিল? প্রাক্তন মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ঘটনাটা নাটক, তবে এটাও বলেছেন যে এলাকার শান্তিরক্ষার ব্যাপারটাও ভুলে গেলে চলবে না। সেঁজুতি-টুটুলের কার্যকলাপে কি এলাকার শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছিল? ভিডিওতে যতটা দেখা গেছে, সেঁজুতি ও টুটুলের চারপাশে কোনো ভিড়ের সৃষ্টি হয়নি। লোকজনের চলাফেরায় কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না। শিল্পীদের সংস্কৃতিচর্চার অধিকার কি নেই বাংলাদেশে? আমরা কি নীলদর্পণের যুগে আছি যে পথনাটক বা যে কোনো নাটক প্রদর্শনের আগে পুলিশের অনুমতি নিতে হবে! আমরা কি এই অসহিষ্ণু, পুলিশী বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?
এই অর্ধশিক্ষিত, অর্ধসভ্য দেশে সংস্কৃতি চর্চার কথা না হয় বাদই দিলাম। একজন স্বাধীন নাগরিক যদি মনে করে, সে দুপায়ের বদলে চার পায়ে হাঁটবে, তবে তাকে বাধা দেওয়া হবে কোন যুক্তিতে? টুটুলের গায়ে কি লেখা ছিল সে কুকুর, নাকি টুটুলের চেহারা কুকুরের মতো ছিল? কোনো একজন ব্যক্তি যদি চায়, তবে নিজের গলায় কুকুরের বকলেসইবা সে বাঁধতে পারবে না কেন? সেই বকলেসের সঙ্গে বাঁধা একটা দড়ি যদি সে স্বেচ্ছায় কোনো মেয়ের হাতে তুলে দিতে চায়, তবে তাতেই বা দোষের কী থাকতে পারে? 'যেমন খুশী সাজো' নামক খেলাটি কবে থেকে বাংলাদেশে বেআইনী ঘোষিত হয়েছে?
যারা বিশ্বাস করে, মানুষ আশরাফুল মখলুকাত, সৃষ্টির সেরা জীব, তাদের কাছে সর্বোত্তম জীবের গলায় কুকুরের মতো বকলেস লাগানোটা মানব জাতির অপমান বলে মনে হতে পারে বৈকি। পত্রিকায় খবর এসেছে: ২০১৯ সালে ২০১৮ সালের দ্বিগুণ ধর্ষণ হয়েছে বাংলাদেশে। সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকা শহরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষিতা হয়েছে অতি সম্প্রতি। মাঝেমাঝেই কেউ না কেউ নিজের সদ্যোজাত সন্তানকে রাস্তার ডাস্টবিনে ফেলে যায়। হাতিরঝিলের ডাস্টবিনও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের কোনো কুকুর কি কখনও এমন 'মানুষিক' আচরণ করেছে? কোনো কুকুর স্বপ্নেও কি কুকুরীর অসম্মতিতে তাকে ধর্ষণ করার কথা ভাবতে পারে? তিন বছরের কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করে তিন তলা থেকে ছুঁড়ে ফেলার ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে, যে কাজ নিকৃষ্টতম কুকুরটিও করবে না।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে ধর্ম পালন করে সেই ধর্ম অনুসারে কুকুর ঘৃণ্য প্রাণী– এমনটা দাবি করা হয়েছে একটি পত্রিকায় এবং সামাজিক গণমাধ্যমে। কিন্তু এই একই ধর্মে মিথ্যা বলা, চুরি করা, ঘুস খাওয়া, ওজনে কম দেওয়া, যাকাত ও আয়কর ফাঁকি দেওয়াও ঘৃণ্য, তাকওয়া-বিরোধী কাজ। এই কাজগুলো যখন কেউ করে, তখনও কি পুলিশ ছুটে এসে তাকে বাধা দেয় কিংবা গ্রেপ্তার করে? হাতিরঝিলের রাস্তায় পুরুষের গলায় কুকুরের বকলেস দেখে কেউ কেউ যেভাবে ছিছি করেছে, কর্মজীবনে দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ বাগিয়ে অবসরে যাওয়া কোনো আমলা বা বিচারককে হাতিরঝিলে সগর্বে হাওয়া খেতে দেখেও কি তারা একইভাবে ছিছি করে থাকে?
স্বীকার করছি, সেঁজুতি ও টুটুল একটি অসঙ্গতিপূর্ণ কাজ করছিল। মানুষ কুকুরের মতো ইতর প্রাণী হতে পারে না। মানুষ মানুষকে গলায় দড়ি বেঁধে টানতে পারে না। সত্য বটে, এগুলো মানবতার অপমান। 'মানবেতর' (মানবঃ+ইতর) কাজ। কিন্তু টুটুল আর সেঁজুতির কুত্তাবাজি ছিল অভিনয় মাত্র। মঞ্চের বদলে তারা ব্যবহার করেছে হাতিরঝিল। মানুষতো নাটক দেখতে আর আসে না, নাটক দেখতে চাওয়ার মতো মানসিক স্তরেও উন্নীত হয়নি বাংলাদেশের নাগরিক শিক্ষিত মানুষ। একান্তভাবে পরীক্ষামুখী, সংস্কৃতিবিমুখ শিক্ষার দোষ এটা। যাই হোক, মানুষ যেহেতু থিয়েটারে আসে না, থিয়েটারকেই অগত্যা মানুষের কাছে যেতে হবে।
সেঁজুতি-টুটুলের অসঙ্গত আচরণের কারণে সমাজের কোনো ক্ষতি হয়নি, বরং উপকার হয়েছে। সমাজের ক্যাথারসিস হয়েছে, মনের কথা মুখ দিয়ে বের হয়ে এসেছে, কিংবা এমন কিছু কথা বলার সুযোগ হয়েছে যেগুলো বলাটা জাতির মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে অপরিহার্য। সমাজে এমন হাজার হাজার অসঙ্গতি আছে, যেগুলোর কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্র পিছিয়ে পড়ছে ক্রমাগত। কয়েকটির কথা উল্লেখ করি। সারা জীবন নিঃস্বার্থভাবে রাজনীতি করে বাংলাদেশে সংসদ সদস্য হওয়া যায় না। দুই-তিন-চার নম্বরী করে, আক্ষরিক অর্থে গুণ্ডামি করে গরীব জনগণের কোটি কোটি কোটি নিজের পকেটে নিয়ে মাত্র কোটি দশেক টাকা নির্বাচনের আগে আগে নেতা-নেত্রীর পায়ে ফেলে দিতে পারলে সংসদের টিকেট পাওয়া যায়। ত্যাগী নেতাকর্মীরা বেমালুম বাদ। এভাবেই চলছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, চোরের খনি আর চাটার দল নিয়ে। প্রধান ও অপ্রধান মন্ত্রীরা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় সব গাড়ি থেমে গিয়ে যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকে হাঁসফাঁস করতে করতে বদদোয়া দিতে থাকে সাধারণ মানুষ। কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করলেও চলে বাংলাদেশে, ক্ষমতার ধামাধরা হলে। পুলিশ যেখানে জনগণের সেবক হবার কথা, সেখানে জনগণের সিংহভাগ পারতপক্ষে পুলিশের কাছে ঘেঁসতে চায় না। পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা– এই প্রবাদ কি সাধে তৈরি হয়েছে বাংলা ভাষায়? সমাজে এমন কেউ নেই, যে বিশ্বাস করে যে পুলিশ দুর্নীতিপরায়ণ নয়। খোদ পুলিশকেই কত টাকা ঘুস দিতে হয় ঢাকার কোনো থানায় পোস্টিং পেতে? কই এমন ঘটনাতো পাশ্চাত্যে ঘটে না! কেউ কেউ বলবেন, বাংলাদেশ পাশ্চাত্য নয়। কথা সত্য। ঢাকাওতো ভিয়েনা নয়। ভিয়েনায় কুত্তাবাজি চলতে পারে, ঢাকায় করতে গেলেই পুলিশ ধরবে, তবে কুত্তা যদি দুর্বল, গোবেচারা হয় তবেই।
যে ঘটনাগুলোর উল্লেখ করলাম উপরে, সেগুলোর একটিও অভিনয় নয়, সচেতনভাবে করা একেকটি অপরাধ। কোনো ইতর প্রাণী এই কাজগুলো করে না। সমাজ, রাষ্ট্র যারা চালায় সেই মহান ব্যক্তিরাই এই অপরাধগুলো করে। এগুলো কি স্বাধীনতার, মানবতার, বাঙালিত্বের অপমান নয়? এ ধরণের একটি রাষ্ট্রের জন্যেই কি প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন কিংবা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা? যে পুলিশ ১৫ মিনিটের মধ্যে বেচারা টুটুল ও সেঁজুতিকে থানায় ধরে নিয়ে যেতে পারে, সেই পুলিশ কি উপরের একটি অসঙ্গতিরও প্রতিকার করার সাহস করেছে কখনও? তারা বরং নীরবে এই সব অসঙ্গতির সহায়তা করেছে। বাংলাদেশের পুলিশ শক্তের ভক্ত, নরমের যম। সেঁজুতি-টুটুল দুর্বল, সুতরাং তাদের থানায় ধরে নিয়ে যেতে সমস্যা কী! দেশের আইন, দেশের শাসনযন্ত্র ব্যবহার করে দেশের মানুষকে কষ্ট দেওয়া এমন কি ব্যাপার! যার শিল, যার নোড়া, তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া! এটাও বাংলা প্রবাদ।
ভিয়েনার তুলনায় ঢাকায় শিক্ষিতের হার কম। ঢাকার নাগরিকদের সংস্কৃতিবোধ অবশ্যই ভিয়েনার নাগরিকদের তুলনায় নিম্নমানের হবার কথা। ভিয়েনায় যেখানে একট বই হাজার হাজার কপি ছাপা হয়, ঢাকায় ছাপা হয় কয়েক শ এবং সেই কয়েক শ কপি বিক্রি হতে কয়েক দশক চলে যায়। ঢাকায় ক'টা যাদুঘর আছে দেখার মতো? সিনেমা হলগুলো ইতিমধ্যে মার্কেট-মল-মূত্রে রূপান্তরিত। ভিয়েনা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে একটি উন্নতমানের পাঠাগার আছে। শত শত বৎসর ধরে বিরতিহীনভাবে সংস্কৃতিচর্চা করে ভিয়েনার নাগরিকেরা যে মানে পৌঁছেছে ঢাকার অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত নাগরিকেরা এখনি সে মানে পৌঁছে যাবে– এটা আশা করা ঠিক নয়। সুতরাং কোনো মানুষ যখন কুকুরের অভিনয় করে, তখন সে অভিনয় উপভোগ করা কিংবা হেসে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতা গড় বাঙালির না থাকারই কথা।
টুটুলের কুকুর সাজা এবং সেঁজুতির তার 'নাকে দড়ি নিয়ে ঘোরানোর' পথনাটক হেসে উড়িয়ে দেবার বিষয় অবশ্যই নয়। এর গভীরতর তাৎপর্য আছে। একজন ব্যাংককর্মীকে যখন সকাল দশটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত খাটানো হয়, তখন তার জীবনটা করুণ কুত্তাবাজী ছাড়া আর কী? এর কী প্রতিঘাত পড়ে সেই ব্যাংককর্মী, তার পরিবার-সন্তান ও পুরো সমাজের উপর, আমরা কখনও ভেবে দেখেছি কি? 'বিশ্রাম কাজের অঙ্গ, এক সাথে গাঁথা। নয়নের অংশ যেন নয়নের পাতা।' দিনে আঠারো ঘণ্টা খাটিয়ে একজন গার্মেন্টস শ্রমিককে যখন ফালতু অজুহাতে ঈদের বেতন-বোনাস দেওয়া হয় না, তখন তার সঙ্গে কি কুকুরের আচরণ করা হয় না? গৃহকর্মীদের সঙ্গে কুকুরের চেয়েও খারাপ আচরণ করা হয়, কারণ কুকুরের গায়ে কেউ গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দেয় না। টুটুল-সেঁজুতির পথনাটক সমাজে বিদ্যমান এইসব অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিকী প্রতিবাদ।
আলোচনার উজানে বলেছি, টুটুল ঘণ্টাখানেকের জন্যে কুকুরের ভূমিকায় অভিনয় করছিল মাত্র। সেঁজুতিও ঘণ্টাখানেক কুত্তার মালকিন সেজে কুকুরবেশী টুটুলকে টেনে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার স্ত্রীরা অদৃশ্য বকলেসে আটকানো চেন শক্ত হাতে ধরে সারা জীবন ধরে নিজেদের স্বামীদের এভাবেই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন বিপথে, কুপথে। 'আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী, হে প্রভূ আমাদের ত্রাণ করো!' লিখেছিলেন আবদুল গণি হাজারী। এদের অনেকের কুকুরের একটি ঠ্যাঙের পিছনে দিনে যে খরচ হয়, তাতে কোনো পণ্ডিত মশাইয়ের হয়তো মাস চলে যায়– বলেছিলেন গুরু সিতু মিয়া। এই টাকার উৎস, বলা বাহুল্য দুর্নীতি, জনগণের পকেটমার। দুদক দুর্নীতি সারাবে বটে, কিন্তু দুদক সারাবে কে? এবং প্রতিটি দুর্নীতির পিছনে এক বা একাধিক মহিলা অবশ্যই আছেন, কোনো না কোনো ভূমিকায়। স্রেফ স্ত্রী বা গার্লফ্রেন্ডদের বিকৃত শখ মেটাতে গিয়ে বহু বিচিত্র দুর্নীতির নোংরা ঘেঁটে চলেছেন সরকারি ও বেসরকারি যেসব কর্মকর্তা সারা কর্মজীবন ধরে, তারাতো টুটুলেরও, দুঃখিত, কুকুরেরও অধম। সেঁজুতি-টুটুলের পথনাটক আর কিছু নয়, স্রেফ এসব সামাজিক কুত্তাবাজির দিকে বিবেকবান মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
কুত্তাবাজি পথনাটকের প্রতি হাতিরঝিলের বায়ুসেবনকারীদের নির্লিপ্ত আচরণ প্রমাণ করে যে ঢাকার নিম্নমধ্যবিত্ত নাগরিকদের মানসিক স্তর ইতিমধ্যে ভিয়েনার ষাটের দশকের নাগরিকদের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সেঁজুতি ও টুটুলকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া প্রমাণ করে যে পুলিশ তথা প্রশাসনের মানসিক স্তর এখনও ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান আমলের দমনমূলক পর্যায়ে আটকে আছে, এর কোনো উত্তরণ হচ্ছে না। ব্যক্তির শরীরের যখন বিকাশ হয়, তখন তার পরিধেয় বস্ত্রের মাপ বাড়াতে হয় কিংবা নতুন কাপড় জোগাড় করতে হয়। শৈশবের বস্ত্র দিয়ে যৌবনের বিকশিত কিংবা বর্ধনশীল শরীরকে ঢাকা প্রায় অসম্ভব। কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ নতুন কাপড় জোগাড় করে নেয় কিংবা পুরনো কাপড়ের সঙ্গে নতুন কাপড় জোড়া দেয়। অপরিণামদর্শী ব্যক্তি নিজের শরীরটাকেই পোশাকের মাপে কেটে ছোট করতে চায়। কুত্তাবাজি পথনাটকের অভিনেতাদের থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া সেই অঙ্গচ্ছেদের নামান্তর। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে পুলিশের, প্রশাসনের মন-মানসিকতা ও আইনকানুন পরিবর্তন না হলে জাতি মননে পিছিয়ে পড়ে, যতই সে মেট্রোরেল আর পদ্মা সেতু বানাক না কেন। তরকারির হাতা দিয়ে চিনি নাড়তে গেলে, চিনিতো চায়ে মেশেই না, তার ওপর হয় চায়ের কাপ ভাঙে কিংবা চা উলটে পড়ে। হাতার অবশ্য কিছু হয় না– পুলিশের, প্রশাসনের যেমন কিছু হয় না। 'আমি চিনিগো চিনি তোমারে।' কেউ কেউ বলবেন, বহুমূত্রপ্রবণ এই পোড়া দেশে চায়ে চিনি না মেশা অবশ্য খারাপ না।
যারা বলছেন, টুটুল-সেঁজুতি বাংলাদেশে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চালু করার চেষ্টা করছেন, তারা কি জানেন পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গিজ গিজ করছে বাঙালির জীবন-মনন-সমাজে। সামাজিক গণমাধ্যমে যিনি সেঁজুতি-টুটুলকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের জন্যে দায়ী করছেন, তার পোশাক, চুলের কাট সবই পাশ্চাত্য ধাঁচের। আমাদের কোন জিনিসটা আমাদের নিজের? টেলিভিশন, সিনেমা, সামাজিক গণমাধ্যম– এ সবই কি পাশ্চাত্য সংস্কৃতি নয়? আমাদের সিনেমা বা মঞ্চনাটকও কি শুরু থেকেই পাশ্চাত্য-প্রভাবিত নয়? বাংলাদেশের প্রধান ধর্মগুলোর প্রত্যেকটি বাইরে থেকে এসেছে। বুরখা থেকে বিরিয়ানি, আমাদের খাবারের, পোশাকের একটি বড় অংশের উৎস বাইরের কোনো দেশ। আমাদের সংসদ, রাষ্ট্রকাঠামো, সরকার পরিচালনা পদ্ধতি, শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা সবকিছু থেকে পাশ্চাত্য প্রভাব বাদ দিতে গেলে লোম বাছতে কম্বল উজার হবে।
বর্তমানে প্রচলিত প্রধান ধর্মগুলোর প্রতিটিতে নারীর স্থান পুরুষের নীচে। প্রয়োজনে নারীকে পুরুষ প্রহার করতে পারে। মৃত্যুর পর পঁচার বাপ বেহেস্তে ভোগের জন্যে পঁচার মা ছাড়াও সত্তর জন হুর-গেলেমান পায়। পঁচার মাকে নিজের স্বামী অর্থাৎ পঁচার বাপকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পুরুষের মৃত্যু হলে নারী আজীবন বিধবা থাকে, মাছমাংস খাওয়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ধরেই নেওয়া হয়, পুরুষ এগিয়ে যাবে আর নারী একান্ত বাধ্যগতের মতো পুরুষকে অনুসরণ করবে। সেঁজুতি আর টুটুল এর বিপরীত চিত্র দেখাতে চেয়েছে। দেখতে কেমন লাগে, যখন একজন পুরুষকে কুকুরের মতো গলায় রশি বেঁধে টেনে নিয়ে যায় একজন নারী? মাঝে মাঝে গতানুগতিকের বিপরীত চিত্র দেখাটা সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে হিতকর বটে।
সমাজের সর্বস্তরে যে বিচিত্র কুত্তাবাজি চলছে, হাতিরঝিলের কুত্তাবাজি তার একটি প্রতিকী প্রতিবাদ। সেঁজুতি আর টুটুল- এই দুই শিল্পী যে কয়েকটি সত্যের দিকে তারা ইঙ্গিত করেছেন সেগুলো হচ্ছে: ১. বহু মানুষ কুকুরেতর জীবন যাপন করছে এই দেশে ২. সমাজে প্রতিকারহীন এমন বহু অসঙ্গতি রয়েছে যেগুলো রাষ্ট্রকে পিছিয়ে দিচ্ছে; ৩. এমন বহু মানুষও আছে আচরণের দিক থেকে যারা কুকুরেরও অধম এবং ৪. নারী পুরুষের পদানত থাকবে- এটা চিরকালীন সত্য হতে পারে না। একজন শিল্পীর কাজ হচ্ছে, সামাজিক অসঙ্গতির দিকে বিবেকবান মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। দৃষ্টিশক্তি থাকলেই অবশ্য দৃষ্টি আকর্ষণের প্রশ্ন আসে।
বাঙালি জাতির বাপের ভাগ্য যে বর্তমানের অনুর্বর সময়েও এমন মননশীল সন্তানের জন্ম হচ্ছে, যারা গ্রেপ্তার ও নিন্দিত হবার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে ১৯৬৮ সালে সুদূর ভিয়েনার সৃষ্টি হওয়া একটি শিল্পকর্মের সঙ্গে বাঙালি মননের পরিচয় ঘটিয়ে দেবার সাহস করছে। যারা এই দুই শিল্পীর সমালোচনা করছে কিংবা ওদের দুজনকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়াকে সমর্থন করছে, তাদের শিল্পবোধ ও সামাজিক বাস্তবতাবোধ আধুনিক ও আপ টু ডেট নয়– এটুকু সন্দেহ করাই যায়। সেঁজুতি ও টুটুলকে ধন্যবাদ।