Published : 02 Dec 2019, 02:53 PM
আবার এসেছে বিজয়ের মাস। আবার ডিসেম্বর।
আজকে তোদের যা কিছু চাই একাত্তরেই ছিল,
"বাংলাদেশী" নামের বড়াই, একাত্তরেই ছিল!!
ঐক্যবোধের শক্ত জাতি, মুল্যবোধের ভক্ত জাতি,
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিবোধ একাত্তরেই ছিল,
ধর্মচোরার অধর্ম রোধ একাত্তরেই ছিল !!ওই যে জ্বলে একাত্তরের মরণজয়ী শিখা,
পথভোলাকে পথ দেখানোর আলোকবর্তিকা…
১৬ ডিসেম্বর এই নশ্বর জীবনের অবিনশ্বর দিন। আমরা যারা একাত্তরের আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে এসেছি, জানি আমাদের ওপর কি নৃশংস ও মর্মান্তিক যুদ্ধাপরাধ হয়েছিল এবং কারা তা করেছিল। পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীরা পিছলিয়ে গেল সে দুঃখ চিরকাল রয়ে যাবে। কিন্তু একাত্তরের স্থানীয় কসাইরা একের পর এক ফাঁসিতে ঝুলেছে ঝুলছে সেটা কম সান্ত্বনাদায়ক নয়। যুদ্ধাপরাধটা হয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে, অভিযুক্তরা বাংলাদেশী, বাদী বাংলাদেশ সরকার, বিচার করছে বাংলাদেশের আদালত, বিচার হচ্ছে বাংলাদেশের আইনে। কিন্তু আদালতের নামটা "বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুন্যাল" না করে "আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (বাংলাদেশ)" করা হয়েছে। মনে হয় এই "আন্তর্জাতিক" শব্দটা আছে বলেই বিদেশে বাংলাদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা আর বাইরের বিভিন্ন কুতুবরা এর মধ্যে নাক গলাতে পেরেছে যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশন্যাল ইত্যাদি।
কিন্তু ওরা হলো সংগঠন, দেশ বা সরকার নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সবচেয়ে সিরিয়াসলি নাক গলিয়েছে একটা সার্বভৌম মুসলিম দেশ, তুরস্ক। গলিয়েছে একবার নয়, বারবার। সেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নাসিকাকে ঝামা দিয়ে ঘষে রক্তাক্ত করে দেবার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে টুপিখোলা ধন্যবাদ। তুরস্ক দেশটা হয় স্মৃতিভ্রংশ রোগে ভুগছে নয়ত স্মৃতিভ্রংশের নাটক করছে। তাকে কি কেউ মনে করিয়ে দেবেন, তার হাজার বছরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা এবং তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫০-১৯৬০) আদনান মেন্ডারিসকে সে নিজেই আদালতের রায়ে ফাঁসি দিয়েছিল? মনে করিয়ে দেবেন, আমাদের একাত্তরের কসাইদের মতোই তার নৃশংস "ইয়ং টার্ক" বাহিনী ১৯১৫-১৯১৮ সালে আর্মেনিয়ার নিরীহ নিরপরাধ ১৫ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে খুন করেছিল, লক্ষ নারীদের ধর্ষণ করেছিল? এখনো সেই গণহত্যার স্মরণে জাতিসংঘ প্রতিবছর ২৭ জানুয়ারি 'আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস' পালন করে। সেই মারাত্মক অপরাধের জন্য তুরস্ক ক্ষমা প্রার্থনা তো করেইনি বরং মিনমিন করে বলেছে- হ্যাঁ, ইট্টুখানি 'ইয়ে' হয়েছিল বটে কিন্তু ওই প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে অনেক মানুষই তো মরেছে, তাই ওটা তেমন ব্যাপার না …. ইত্যাদি। অর্থাৎ গণহত্যা-গণধর্ষণকে খাটো করে দেখা ও দেখানোর খাসলতটা রয়েই গেছে তার রাজনৈতিক রক্তে। তার "মুসলিম" বিবেকের দরজায় ব্যর্থ করাঘাতে ফিরে গেছে আল কোরান- তোমরা ন্যায়বিচারে অটল থেকো যদিও তা নিজেদের বিরুদ্ধে যায়– নিসা ১৩৫। প্রমাণ;
১. আমাদের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে বৈঠকে (২০১১) তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধ বিচার বন্ধের অনুরোধ করেছিলেন।
২. প্রেসিডেন্ট আহমেত গুল আমাদের প্রেসিডেন্টের কাছে অনুরোধ করেছিলেন যেন গোলাম আযমের ফাঁসি না হয়।
৩. জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির পর 'ক্ষুব্ধ' তুরস্ক বাংলাদেশ থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে 'ডেকে পাঠিয়েছিল', প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশও তুরস্ক থেকে রাষ্ট্রদূতকে 'ডেকে পাঠিয়েছিল'। এটা ছিল অঘোষিত প্রত্যাহার।
৪. প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন- "নিজামী মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মতো কোনো পাপ করেনি"। রিয়েলি, ইওর এক্সেলেন্সি??
৫. মীর কাসেম আলীর ফাঁসির পরে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে এই ফাঁসি "ভুল চর্চা" এবং সেজন্য তারা দুঃখিত।
৫. দিল্লিতে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ড. বুরাক আকচাপার বলেছে- নিজামীর ফাঁসি "এক বিরাট ভুল"। রিয়েলি, ইওর এক্সেলেন্সি??
আমাদের আদালতে, আমাদের আইনে, আমাদের মাটিতে ঘটে যাওয়া আমাদের ওপরে গণহত্যা-গণধর্ষণের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়। এর মধ্যে বাইরে থেকে কারো নোংরা নাকটা গলানোর কোনোই অধিকার নেই। অথচ যখন বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করার পর ইয়াহিয়া তার গোপন বিচারের পরিকল্পনা করেছিল তখন ওই নিজামীই সেটাকে "পাকিস্তানের নিজস্ব বিষয়" বলেছিল! উদ্ধৃতি:
"জাতিসংঘের মহাসচিব উ' থান্ট আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার বন্ধ রাখার জন্য যে বিবৃতি দেন, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় পরিষদ তার সমালোচনা করে বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব এ ব্যাপারে ক্ষমতা বহির্ভূত হস্তক্ষেপ করেছেন। পরিষদে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার অনুষ্ঠান পাকিস্তান সরকারের নিজস্ব বিষয়। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ মহাসচিবের হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার নেই"- দৈনিক জনকণ্ঠ ২১ অগাস্ট ২০১৯।
নিয়তির পরিহাস একেই বলে! এই তথ্যটার "তথ্যসূত্র:মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর"-এও থাকার কথা।
এবারে আসা যাক হারিয়ে যাওয়া বিস্মৃত দলিলে। ভুললে চলবে না, মুসলিমের ওপরে মুসলিমের গণহত্যায় মুসলিম ইতিহাস পরিপূর্ণ কিন্তু কোনোদিন কোনো খেলাফতে কোনো গণহত্যাকারীর বিচারই হয়নি শাস্তি তো দূরের কথা। বাংলাদেশই একমাত্র মুসলিম মেজরিটির দেশ যে মুসলিম গণহত্যাকারীদের বিচার করেছে, ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। একাত্তরে নাপাক সৈন্যরা ও রাজাকার আলবদর আমাদের ওপরে যা করেছে তা সমগ্র বিশ্ব-ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদ, সমাজবিদ, রাজনীতির বিশ্লেষক ইত্যাদি বিশেষজ্ঞেরা এগুলো নিয়ে চিরকাল গবেষণা করবেন। কাজেই আমাদের দায়িত্ব তাদের জন্য আমাদের সময়ের ছোটবড় প্রত্যেকটি দলিল সংরক্ষণ করে রাখা। কারণ কে জানে কোনটা তাদের কাছে কতটা দরকারি মনে হবে।
ভবিষ্যতের দুনিয়ার জানা দরকার আমাদের যুদ্ধাপরাধী বিচার বন্ধ করার তুর্কি অপচেষ্টা প্রতিবাদ-প্রতিরোধহীন যেতে পারেনি। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের কয়েকটি ইসলামী/মুসলিম সংগঠন তীব্রভাবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের অফিসিয়াল লেটারহেড-এ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তাদের মধ্যে ইংরেজীর পাশাপাশি তুর্কি ভাষাতেও প্রতিবাদটি ছড়িয়েছিল খোদ তুর্কিস্তানের প্রগতিশীল ইসলামিক সংগঠন 'ইসলামিক রিফর্ম'। নীচে সংগঠনগুলোর নাম ও তাদের অফিসিয়াল লেটারহেড-এ প্রতিবাদ দেয়া হল। এগুলো আমার পরবর্তী বই 'অতঃপর শারিয়া কি বলে'-তে যোগ করা হবে যাতে দলিলগুলো ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত থাকে। বইটি আগামী বইমেলায় থাকবে।
১. (ক ও খ) তুর্কিস্থানের সংগঠন "ইসলামিক রিফর্ম", (ইংরেজী ও তুর্কি ভাষায় নিন্দা-বিবৃতি),
২. আমেরিকার সংগঠন "ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস" (অধুনা প্রায়বিলুপ্ত),
৩. হল্যান্ডের সংগঠন "দ্বীন রিসার্চ সেন্টার" (অধুনালুপ্ত),
৪. মুম্বাই-এর (ভারত) সংগঠন "ইনস্টিটিউট ইফ ইসলামিক স্টাডিজ", এবং
৫. কানাডা'র সংগঠন "মুসলিমস ফেসিং টুমোরো"।
১. (ক) তুর্কিস্থানের সংগঠন "ইসলামিক রিফর্ম", (ইংরেজি)
১. (খ) তুর্কিস্থানের সংগঠন "ইসলামিক রিফর্ম", (তুর্কি ভাষায়)
২. আমেরিকার সংগঠন "ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস"
৩. হল্যান্ডের সংগঠন "দ্বীন রিসার্চ সেন্টার"
৪. মুম্বাই-এর (ভারত) সংগঠন "ইনস্টিটিউট ইফ ইসলামিক স্টাডিজ"
৫. কানাডা'র সংগঠন "মুসলিমস ফেসিং টুমোরো"