Published : 12 Oct 2019, 06:16 PM
বছরের এই সময়টা অপেক্ষা করে থাকি নোবেল পুরস্কারের ঘোষণার অপেক্ষায়, বিশেষত পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের পুরস্কারের জন্য। অনেক সময়ে এই পুরস্কার দুটি যে ধরণের বিজ্ঞানের জন্য দেয়া হয় তা বোঝা সাধারণের পক্ষে একটু অসুবিধারই হয়, তবে এবার পুরস্কার এমন সব বিষয়ে গবেষণার জন্য দেয়া হয়েছে তা হয়তো কিছুটা সর্বজনবোধ্য হতে পারে। এ বছরের পদার্থবিদ্যার পুরস্কার তিনজন ভাগ করে নিয়েছেন। মহাবিশ্বের গঠন নিয়ে গূঢ় তত্ত্ব ও সৌরজগতের বাইরে সূর্যের মত একটি তারার গ্রহ আবিষ্কার ছিল এবারকার বিষয়। পুরস্করপ্রাপ্ত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিদ জেমস পীবলস (James Peebles) কয়েক যুগ ধরে আমাদের মহাবিশ্বের সার্বিক গঠন নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছিলেন, আর সুইজারল্যান্ডের দুই জ্যোতির্বিদ মিশেল মাইয়োর (Michel Mayor) ও দিদিয়ের কিলোজ (Didier Queloz) বহিঃসৌরজগতে প্রথম একটি গ্রহ আবিষ্কার করেন যা কিনা সূর্যের মতন একটি তারাকে প্রদক্ষিণ করছে।
জেমস পীবলস প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, প্রায় এককভাবে কসমোলজি বলতে আমরা যা বুঝি– বিগ ব্যাং-এর পরে মহাবিশ্বের সর্বত্র মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের গণনা, গ্যালাক্সির উৎপত্তি ও অনেক কটি গ্যালাক্সির মিলিতভাবে দল গঠন এবং এই প্রক্রিয়ায় কৃষ্ণ বস্তুর (ডার্ক ম্যাটার) ভূমিকা– এইসব নিয়ে তাঁর আদি কাজ বর্তমান মহাজাগতিক বিজ্ঞানকে সুদৃঢ় তাত্ত্বিক ভূমিতে প্রতিষ্ঠা করেছে। ১৯৬০ এর দশকে জেমস পীবলস তাঁর উপদেষ্টা রবার্ট ডিকির সঙ্গে গণনা করে দেখান যে বিগ ব্যাং হবার পরে যে উত্তাপ ছিল তার অবশিষ্টকে মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গে আমরা দেখতে পাব। পরবর্তীকালে তিনি দেখান যে ক্রমশ শীতল হওয়া এই বিকিরণ সর্বদিকে সমান নয়, তার মধ্যে ফ্লাকচুয়েশান বা ওঠা নামা আছে। পীবলস অনুমান করেন যে, মহাবিশ্বের শুরুতে বস্তুসমূহের ঘনত্ব কিছু জায়গায় বেশি হলে তা মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের তাপমাত্রাকে প্রভাবিত করবে এবং এই সব ঘনবস্তুর থেকেই পরবর্তীকালে গ্যালাক্সিসমূহের উৎপত্তি হবে। শুধুমাত্র ১৯৯০এর দশকে জ্যোতির্বিদরা সারা মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করে মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের এই তারতম্য নিরীক্ষণ করতে পারলেন।
১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকে পীবলস মহাবিশ্বের শুরুতে কী করে প্রসারণশীল মহাবিশ্বে বস্তুসমূহ একত্রিত হয়ে গ্যালাক্সি ও গ্যালাক্সিসমূহ এক হয়ে বড় বড় গ্যালাক্সির দল সৃষ্টি করতে পারে তা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, মহাবিশ্বে দৃশ্যমান বস্তুর চাইতে কৃষ্ণ বস্তুর পরিমাণ অনেক বেশি। এছাড়া তিনি আর একটি ধারণা ব্যবহার করেন যেটার সম্বন্ধে আমাদের বোধ তখন ছিল অস্বচ্ছ, সেটা হল আইনস্টাইনের মহাজাগতিক ধ্রুবক (cosmological constant)। এই মহাজাগতিক ধ্রুবক (যাকে lamda নামেও অভিহিত করা হয়) সাধারণ আপেক্ষিকতা সমীকরণের একটি টার্ম। আইনস্টাইন যখন সাধারণ আপেক্ষিকতার সূত্র প্রণয়ন করলেন তখনো আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে যে আরো গ্যালাক্সি আছে সেটা জানা ছিল না এবং এই সব গ্যালাক্সি যে একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তাও আবিষ্কার হয়নি। আইনস্টাইন ভেবেছিলেন মহাবিশ্ব মোটামুটিভাবে সমতা রক্ষা করে চলেছে, নক্ষত্ররা একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না, সেই সমতা রক্ষার্থে তিনি তাঁর আপেক্ষিকতা সমীকরণে প্রায় জোর করেই একটা টার্ম ঢোকালেন যাকে আমরা বলি লাম্বডা বা মহাজাগতিক ধ্রুবক। পরে যখন এডউইন হাবল তাঁকে দেখালেন যে মহাবিশ্বে ভারসাম্য নেই, গ্যালাক্সিরা একে অপরের কাছ থেক দূরে সরে যাচ্ছে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন লাম্বডা টার্মটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। পরবর্তীতে অবশ্য দেখা গেল মহাবিশ্বের প্রসারণে লাম্বডা ধ্রুবকের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। পীবলস তাঁর গ্যালাক্সি ও গ্যালাক্সি দল নির্মাণে কৃষ্ণ বস্তু ও লাম্বডা টার্মটি ব্যবহার করলেন। বর্তমানে আমরা জানি মহাবিশ্বের প্রসারণে ত্বরণ ঘটছে, অর্থাৎ যত সময় যাচ্ছে প্রসারণের মাত্রা তত বাড়ছে এবং সেটা লাম্বডা ধ্রুবকটির মান অশূন্য বলেই। তবে পীবলসের নোবেল পুরস্কার কোনো একটি নির্দিষ্ট তত্ত্বের জন্য নয়, বরং সামগ্রিকভাবে গত পঞ্চাশ বছরের তাঁর অবদানের জন্য।
পীবলসের পুরস্কার হল তাঁর সার্বিক গবেষণার জন্য, অন্যদিকে মিশেল মাইয়োর ও দিদিয়ের কিলোজের পুরস্কারটি একটি নির্দিষ্ট আবিষ্কারের জন্য। জ্যোতির্বিদরা গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমাদের সৌরজগতের বাইরে অন্য তারাদের চারদিকে গ্রহ আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, বেশ কয়েকটি আবিষ্কারও হয়েছিল কিন্তু সেগুলোর নিশ্চয়তা ভাল ছিল না। মাইয়োর ও কিলোজ ১৯৯৪ সনে ফ্রান্সের হুত-প্রভান্স মানমন্দির থেকে ১৪২টি সূর্যের মত নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলেন। তাদের হাতে ছিল একটি নতুন স্পেক্ট্রোমিটার বা বর্ণালীবীক্ষণ যা কিনা কোনো তারার সেকেন্ডে ১৩ মিটার (ঘন্টায় ৪৭ কিলোমিটারের মত) গতিবেগ থাকলেও তা মাপতে পারত। এইসব তারার কাছে যদি কোনো বড় গ্রহ থাকে তবে তাদের পারস্পরিক মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তারাটির চলনকে প্রভাবিত করবে। প্রভাবিত করলে ডপলার এফেক্টের জন্য সেটার থেকে নির্গত আলোর তরঙ্গের যে হেরফের হবে সেই হেরফের থেকে তারাটির গতিবেগ নির্ধারণ করা যায়। প্রায় ৫০ আলোকবর্ষ দূরের ৫১-পেগাসি নামে একটি তারার ভর ও পর্যায়বৃত্ত চলন দেখে এ দু'জন দেখালেন যে সেই তারাটির খুব কাছাকাছি, শুক্রগ্রহ যে দূরত্বে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে তার এক সপ্তমাংশ দূরত্বে, একটি বৃহস্পতির সমান গ্রহ রয়েছে। পরবর্তীকালে এইরকম বিশালাকায় গ্রহসমূহ অন্যান্য তারার কক্ষপথে আবিষ্কৃত হয় এবং সূর্যের খুব কাছাকাছি থাকায় এদের নাম দেয়া হয় উষ্ণ বৃহস্পতি। এই আবিষ্কারকে একটা বিপ্লব বলা যেতে পারে কারণ সূর্যের কাছে বৃহস্পতির মত গ্যাসীয় দানব থাকতে পারে এটা আমাদের সৌর জগৎ দেখে বোঝা যায়নি।
৫১-পেগাসির গ্রহই প্রথ্ম বহিঃসৌরজগতের আবিষ্কৃত গ্রহ নয়। এর আগে ১৯৯২ সনে আলেক্সান্দার ভোলশান ও ডেল ফ্রেল বেতার তরঙ্গে আমাদের থেকে প্রায় ২৩০০ আলোকবর্ষ দূরে একটি পালসারের চারদিকে প্রথমে দুটি গ্রহ আবিষ্কার করেন; পরবর্তীকালে ওই পালসারের চারদিকে আরো একটি গ্রহ আবিষ্কার হয়। পালসার হল একটি দ্রুত ঘূর্ণায়মান নিউট্রন নক্ষত্র যদিও একে আর নক্ষত্র বলা সঙ্গত নয়, কারণ একটি তারার অন্তিম পরিণতির মধ্যে একটি হল নিউট্রন তারা, মূলত এটি একটি মৃত তারা। সেজন্য মাইয়োর ও কিলোজের আবিষ্কারটিকে নোবেল কমিটি প্রাধান্য দিয়েছে কারণ বিভিন্ন সৌর জগতে কীভাবে গ্রহ সৃষ্টি হল এবং কীরকম গ্রহ সৃষ্টি হল তাই বুঝতে ওই আবিষ্কারের গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন সৌরজগতে উষ্ণ বৃহস্পতির অস্তিত্ব দেখে এখন ধারণা করা হচ্ছে যে, আমাদের সৌর জগতের সুদূর অতীতে বৃহস্পতি সূর্যের কাছাকাছি ছিল (অন্তত পৃথিবী যে কক্ষপথে আছে) এবং শুধু শনিগ্রহের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার ফলে সে দূরে সরে গেছে; পৃথিবীর উদ্ভবে বৃহস্পতি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বলেও মনে করা হচ্ছে।
বর্তমানে পৃথিবীর কক্ষপথে কেপলারসহ বিভিন্ন দুরবীন প্রায় ৫০০০ বহিঃসৌরজগতের গ্রহ আবিষ্কার করেছে। এদের মধ্যে অনেক গ্রহই ট্রানজিট পদ্ধতির মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়েছে। গ্রহ যখন তার কেন্দ্রীয় তারার সামনে আসে তখন তারার ঔজ্জ্বল্য কিছু কমে যায়; এই ঔজ্জ্বল্যের হ্রাস-বৃদ্ধির পর্যায়বৃত্ত মান থেকে সেই গ্রহের উপস্থিতি ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা যায়। এখন আমরা জানি আমাদের এই গ্যালাক্সির প্রতিটি তারারই হয়তো এক বা একাধিক গ্রহ রয়েছে। এখন জ্যোতির্বিদরা চেষ্টা করছেন ওই সমস্ত গ্রহগুলির বায়ুমণ্ডলের উপস্থিতি ও তার মধ্যে বিভিন্ন গ্যাসের পরিমাণকে নির্ধারণ করতে।
লিথিয়াম-আয়োন ব্যাটারি আমাদের আধুনিক সভ্যতার ধারক। মোবাইল ফোন বলুন, ল্যাপটপ কম্পিটার বলুন, কী বৈদ্যুতিক গাড়ি বলুন সব জায়গাতেই এই ব্যাটারি তার ছোট আকার, শক্তি ও ক্ষমতার জন্য ব্যবহৃত। বলতে গেলে এই ব্যাটারি আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারকে বদলে দিয়েছে। তাই লিথিয়াম ব্যাটারির ওপর কাজের জন্য রসায়ন পুরস্কার বোধহয় বহুদিন ধরেই প্রাপ্য ছিল। ২০১৯ সনে জন গুডেনো (John Goodenough), স্টানলি হুইটিংহ্যাম (M. Stanely Whittingham) ও আকিরা ইওশিনো (Akira Yoshino) লিথিয়াম-আয়োন ব্যাটারি উদ্ভাবনের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। জন গুডেনোর বয়স ৯৭, তিনি সবচেয়ে বর্ষীয়ান নোবেল বিজয়ী, ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস, অস্টিনে অধ্যাপক এবং এখনো গবেষণায়রত। স্টানলি হুইটিংহ্যাম নিউ ইয়র্ক স্টেটের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ও আকিরা ইওশিনো জাপানের নাগোয়াতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক।
১৯৭০এর দশকে স্টানলি হুইটিংহ্যাম লিথিয়াম ব্যাটারি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। লিথিয়াম হল সবচেয়ে হাল্কা ধাতু এবং খুব সহজেই লিথিয়াম পরমাণু থেকে ইলেকট্রনকে মুক্ত করা যায়; হুইটিংহ্যাম লিথিয়ামকে অ্যানোড ও টাইটেনিয়াম ডাইসালফাইডকে ক্যাথোড হিসেবে ব্যবহার করেন। টাইটেনিয়াম লিথিয়াম থেকে মুক্ত ইলেকট্রন গ্রহণ করে। কিন্তু লিথিয়াম খুবই একটি দাহ্য পদার্থ, তাই লিথিয়াম-টাইটেনিয়াম ব্যাটারির বিস্ফোরণ হবার সম্ভাবনা থাকত। এর পরে ১৯৮০ সনে জন গুডেনো টাইটেনিয়ামের বদলে কোবাল্ট অক্সাইড ব্যবহার করেন যা কিনা লিথিয়াম ব্যাটারিকে কিছুটা বিপদমুক্ত করে। এছাড়া তার ব্যাটারি ২ ভোল্টের বদলে ব্যাটারি ৪ ভোল্ট বিভব সৃষ্টি করল। ১৯৮৫তে আকিরো ইয়োশিনো সরাসরি লিথিয়াম ব্যবহার করার বদলে পেট্রোলিয়াম কোক নামে একটি পদার্থ ব্যবহার করেন। এই পদার্থটি খুব সহজেই লিথিয়াম আয়নকে গ্রহণ করে অ্যানোডের ভূমিকা পালন করতে পারে। এই ব্যাটারিটি ছিল নিরাপদ ও যাকে বহুবার রিচার্জ করা সম্ভব। ১৯৯১ সনে জাপানে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে এই ব্যাটারি বাজারজাত করা হয়। বলাই বাহুল্য বর্তমানে লিথিয়াম-আয়োন ব্যাটারির বহু উন্নত প্রকৌশল বাজারে এসেছে ও গবেষণাধীন আছে।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির উন্নয়নে একজন বাঙালীর নাম না বললেই নয়। ১৯৭৭ সনে যুক্তরাষ্ট্রের বেল ল্যাবে সমর বসু গ্রাফাইটের মধ্যে লিথিয়াম স্থাপন করে এক ধরনের নিরাপদ লিথিয়াম ব্যাটারির উদ্ভাবন করেন। সমর বসুর নাম যুক্তরাষ্ট্রের কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স হল অফ ফেমে লিখিত হয়েছে। কাজ থেকে অবসর নিলে সমর বসু ভারতে ফিরে যান।