Published : 23 Nov 2011, 07:09 PM
ষোল তলার দক্ষিণের জানালা খুলতে খুলতে ভাবলাম খোলা হাওয়ায় মন ভরে যাবে। আকাশের অনেকখানি কাছাকাছি থাকবো। কিন্তু হলো না। বাতাসের কোন গন্ধ পেলাম না। আকাশের মেঘ দেখে দেখে ষোল দিন কেটে গেলো।
আমার চিকিৎসকদের পরামর্শে শাহবাগে ডায়বেটিক হাসপাতালের (বারডেম) ষোল তলায় ১৫২৯ নং কেবিনে থাকতে হলো । ডায়বেটিস বেড়ে ২৫ উঠে গেছে। এ এক বিশ্রী ও নীরব ঘাতক রোগ। জীবনটা তেতো করে দেয়। রক্ত মাপা, ইনসুলিন নেয়া, হিসেব করে খাওয়া দাওয়া, এক ঘণ্টা হাঁটা, আমার দ্বারা এইসব নিয়ম শৃঙ্খলিত জীবন যাপন সম্ভব নয়। আমি সারাদিন খাবো, ইচ্ছেমতো খাবো-ইচ্ছে না হলে খাবো না। আহা কতদিন মন ভরে রসগোল্লা-সন্দেশ-পান্তুয়া-গুড়ের পায়েস খেতে পারি না। একেবারে নিষেধ থাকলেও লুকিয়ে-চুরিয়ে একটু আধটু খেয়ে ফেলি – আর সে কারণে এই অসুস্থতা। নিয়ম ভাঙ্গার শাস্তি। এ বড় কঠিন। বড় নিষ্ঠুর! মনের স্বাধীনতায় আমি বিশ্বাসী। মনকে ছুটি দিতে আমি কখনও কার্পণ্য বোধ করি না।
দক্ষিনের জানালা খুলে আমি খোলা হাওয়া পেলাম না সত্য, কিন্তু এই প্রিয় ঢাকা শহরের অনেকখানি দেখতে পেলাম। দিবারাত্রির এই ঢাকা দেখে আমি মুগ্ধ। নীচে থেকে থেকে মনে হয় মনটাও জীর্ণ হয়েছিল। ইটের পর ইট সাজিয়ে বড় বড় ভবন, রাস্তার যানজট, ভিড়ভাট্টা আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা থেকে সরে এসে ষোলদিন এই ষোল তলায় জীবনযাপন আমাকে অনেকখানি আপ্লুত করেছে।
দু'চোখ যতদূর ইচ্ছে মেলে দিতে পারি। জাতীয় জাদুঘর, আর্ট কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়িয়ে দৃষ্টি চলে যায় দূরে বহু দূরে তার পক্ষে যতখানি সম্ভব। সবুজ গাছ পালা দু'পাশে। বিকেলের রোদ মুছে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা নামে। যেন এক সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। কখনও কখনও এই কুয়াশা আবার মধ্যরাত থেকে নামে। সকালে রোদ ছড়ানোর পরও হেমন্তের এই কুয়াশা সরে যেতে অনেকখানি সময় নেয়। সামনে শীত নামলে এই কুয়াশা আরও ঘন হবে, আরও সুন্দরতর হবে এই বিশ্বাস হলো। তবে দু:খটা এই, আমার তা দেখা হবে না। হেমন্তের ভোরের আলো বড় শান্ত। শালিক পাখির কিচির মিচির শুনে ঘুম ভাঙ্গে। এত উচুতে মনে হলো, চড়ুই পাখি আসতে পারে না। কেননা তাদের চোখেই পড়লো না আমার। যাই হোক, ষোলতলায় বসে এই প্রাকৃতিক দৃশ্য আমার মন ভরিয়েছে।
প্রকৃতির বাইরেও আছে আরও আকর্ষণীয় দৃশ্য। দক্ষিণের জানালায় দাঁড়িয়ে আমি শাহবাগ মোড়টাও স্পষ্ট দেখি। গাড়ির হর্ণ ও আওয়াজ সারাদিন এই ষোল তলায় আমার কর্ণকুহরে এসে ঢুকে পড়ে। দিনের বেলায় আরামে ঘুমুতে পারি না। তবে অনেক রাতে শব্দটা কমে যায়। আর রাতের বেলা ট্রাকের শব্দ ও হর্ণ বিশ্রীভাবে লাগে। শব্দ-দুষণ নিয়ে আইন আছে, কিন্তু আন্দোলন বা প্রচার নাই, কার্যকারীতাও নাই। এ এক অদ্ভূত দেশ আমাদের। আর অ্যাম্বুলেন্সের শব্দও হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়। এই মোড়টার দিকে তাকালেও আমার মনে হয় নদীর স্রোতের মত উপচে পড়া গাড়ির স্রোত। বাস, পিকআপ, মাইক্রো, অটো, জীপ কারের নানা রঙ নানা ঢং। তারপর নানা ধরনের মানুষের স্রোত তো আছেই। ভোর ছয়টা থেকেই একটু একটু করে রাত বারোটা পর্যন্ত চলে এই গতি। তারপর আবার সন্ধ্যা নামলেই আলোর উৎসব। বাড়ি-গাড়ি-রাস্তার লাল নীল সবুজ বাতি। দেখতে দেখতে ভাবি দেশের অবস্থা, অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক ব্যবস্থা মানুষের লোভার্ত প্রতিযোগিতা দেশকে কোথায় নিয়ে চলেছে। এই একটি মোড় নিয়ে ভাবছি, ঢাকায় এমনই সহস্রাধিক মোড় আছে, সর্বত্র একই চিত্র দিনে-রাতে। চেয়ে চেয়ে দেখতে ভালোই লাগে। এমন আলো ঝলমল প্রকৃতি রাজধানীর গৌরব বৃদ্ধি করে বৈকি!
পৃথিবীর সব দেশেই এমনটি দেখা যায়। তবে অমাদের দেশে শৃঙ্খলা মেনে কেউ চলে না। যে যার সুবিধামত আগে যাবার স্রোতে ভাসে যেন। লাইন ধরে সারি সারি চললে ভালোই লাগে। আমার কাছে এই অস্থিরতা কেমন উন্মাদনা মনে হয়।
অনেক রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে যখন জানালায় দাঁড়াই তখনও দেখি গাড়ির চলাচল। রাস্তা অনেক ফাঁকা। তবে ট্রাক ছুটে চলে কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ নাই, সুতরাং আইন ভেঙ্গে চলাচলেও বাঁধা নেই। দু'চারটা অটো বা রিকশাও চলতে দেখা যায়। পথচারীও থাকে আর পুলিশের পেট্রল গাড়িও চলে। মালপত্র ভর্তি ট্রাক থামায়। কিছুক্ষণ পর ট্রাক চলে। কাগজপত্র দেখে, না কি আপোষ করে কে জানে! রাত গভীর হয়ে উঠলে এইসব কাজে সুবিধা বেশি! দিনে ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকে। কিন্তু রাত আটার পর তারা যেন রাস্তা দখল করে নেয়। ফলে রাত বারোটা পর্যন্ত পাবলিক গাড়ি চলাচলে সাবধানতা অবলম্বন করা ছাড়া উপায় নেই। বারডেমের পূর্বদিকে ঢাকা ক্লাব, রমনা পার্কের সবুজ গাছপালাও দেখা যায়। তারই ফাঁক ফোকর দিয়ে রাস্তায় যানজট-গাড়ির লালবাতি। ষোলতলায় থাকলাম বলেই প্রকৃতিকে অনেক উচু থেকে দেখে নয়ন জুড়ালাম। নীচে থাকলে কিন্তু এমনটা ভাবা যায়না।
ডায়বেটিস খুব বিশ্রী রোগ আগেই বলেছি। গত দশ বারো বছর ধরে এ রোগে ভুগছি। আমার চিকিৎসকদের কাছে আমি অবাধ্য রোগী। তাদের বেধে দেয়া নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলি না। নিয়ম বেধে জীবনযাপন করা কী যায়? কেউ পারে? এ রোগের সুস্থ থাকার একমাত্র সেটাই উপায়। বারডেমের শ্লোগান হচ্ছে 'ডিসিপ্লিন ইজ লাইফ'। বড় কঠিন বিষয়। আমি জানি, 'আছে দু:খ আছে মৃত্যু তারপরও জীবনটা কাজের মধ্য দিয়েই ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করি। এই ব্যস্ততাই আমাদের ক্ষয় করে দিচ্ছে। আজকের এই যুগে জীবন নানাভাবে বিকশিত হচ্ছে। সেখানে আমরা যারা পুরোনো মানুষ তারা আধুনিকতার স্বাদ সুযোগ ও সুবিধা নেবার চেষ্টায় থাকি। কিন্তু সবার ভাগ্যে কী সেটা জোটে?
বারডেম ছেড়ে ঘরে ফিরে যাবো নিশ্চয়। কিন্তু এখানকার স্মৃতি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। চিকিৎসকদের সহযোগিতা, পরামর্শ আদেশ নির্দেশ, সিস্টারদের সেবা সবই ভালো লেগেছে। ঢাকা শহরের কোনও হাসপাতালের সিস্টারদের কাছ থেকে এমন বন্ধুন্তপূর্ণ হাসিমুখের ব্যবহার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
আমাদের জীবন ডায়বেটিসে তিক্ত বিরক্ত হলেও ইনসুলিনের সঙ্গে আপোষ না করে উপায় নেই। প্রতিদিন রক্ত মাপা এটা বড় বিব্রতকর ও স্বস্থিহীন বিষয়। হাতের আঙ্গুল ফুটো করে রক্তফোটা দেয়া, আবার ইনসুলিন নেয়াও হয় চামরা ফুটো করে। বড় কষ্ট। বড় কষ্টের যন্ত্রণা। এ রোগ নিয়ে এতো গবেষণা হচ্ছে, কিন্তু সফল হবে কবে? এ রোগ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়া কেন সম্ভব নয়? অন্ততপক্ষে ইনসুলিন তো টেবলেট আকারে হতে পারে। আর রক্ত মাপার জন্য টাচ মেশিন তো আবিস্কার হওয়া উচিত। তাহলে আর ফুটোফুটির ঝামেলা থাকে না। কবে হবে এমন স্বস্থিহীন আরামপ্রদ চিকিৎসা?
আমার জীবনযাপনে তার অনধিকার চর্চা কেন? মানতে চাইনা, মানতে পারি না এ শৃঙ্খলা।
বেবী মওদুদ: লেখক ও সাংবাদিক।