Published : 20 Mar 2011, 07:30 PM
কুস্তি ছাড়া আমি মোটামুটি সব ধরনের খেলারই অনুরাগী। ক্রিকেটের প্রতি আমার অনুরাগ ছোট বেলা থেকেই। বলা যায় সেই স্কুল জীবন থেকেই। শুধু অনুরাগী নই, খেলেছিও। কলেজ জীবনে খেলেছি। ইউনিভার্সিটি টীমে খেলেছি। খেলাধুলাতো মানুষের জীবনে খুবই প্রয়োজন; শরীর ঠিক রাখার জন্য। মন ঠিক রাখার জন্য। ক্রিকেট আমার বিশেষভাবে পছন্দ এই জন্য যে ক্রিকেটের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ পরিচিতি হয়েছে। এ জন্যেও এই খেলার প্রতি আমার আগ্রহ আরও বেড়েছে।
আমি যখন স্কুলের ছাত্র তখনতো টেলিভিশন ছিলো না। টেলিভিশন সম্ভবত ৬৯-এ আসে। তো সে সময় ক্রিকেট খেললেও ভালো খেলাগুলো দেখার সুযোগ পেতাম না। আমি যখন কলেজে পড়ি তখন ৭১ সাল; পাকিস্তানের সঙ্গে কোন একটা টীম যেন খেলেছিলো। ঐ খেলাটা দেখেছিলাম। ইন্তেখাব আলম স্পিনার ছিলেন। উনি সম্ভবত ক্যাপ্টেনও ছিলেন। ঐ খেলাটা টেলিভিশনে দেখার সুযোগ হয়েছিলো। তখন সাদাকালো টেলিভিশনের যুগ। ক্রিকেট তখন এত ভালো করে বুঝিও না। কিন্তু দেখার একটা নেশা তখন পেয়ে বসেছিলো।
সেই নেশার ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। এবারের খেলাগুলোও প্রথম থেকে দেখছি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ তিনটি লেখায় জিতেছে। এটাতো বিশাল ব্যাপার। অনেকে হয়তো বলবেন বাংলাদেশ টীমের আরও বেশি দক্ষতা থাকা উচিৎ ছিলো। দক্ষতাতো আস্তে আস্তে তৈরি হবে। আমরা যত দ্রুত ক্রিকেটে সাফল্য অর্জন করেছি সেটা অনেক। আমি বলবো আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করেছে। আমাদের ফিল্ডিং অসাধারণ, বলা যায় আন্তর্জাতিক মানের। বোলিং অসাধারণ। এখন ব্যাটিংয়ের জায়গাটা একটু দুর্বল। ৩, ৪, ৫– এই নাম্বারে যারা খেলছেন তারা রান পাচ্ছেন না। এই জায়গাটা একটু খেয়াল রাখা দরকার। তারপরেও প্রত্যাশাতো অনেক। মানুষের প্রত্যাশারতো শেষ নেই। খেলার ব্যাপারে একটা প্রত্যাশা এই যে ওয়ার্ল্ড কাপ জিতবো–এই প্রত্যাশাতো সবারই থাকে। ফাইনালতো বাংলাদেশের মাটিতে হবে না। সুতরাং সেখারকার পিচ কী রকম রিয়েক্ট করবে, আবহাওয়া কী রকম–তা তো আমরা জানি না। গরম বাড়ছে। কুশায়া কমে যাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে এ মুহূর্তে প্রেভিক্ট করা খুব মুশকিল।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পরাজয়ে অনেকে মন খারাপ করেছেন। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ঐ খেলাতে আমরা তিন শ' রানের কাছাকাছি ছিলাম। আমি বলবো বাংলাদেশ ওদের সাথে ভালো খেলেছে। হেরে গিয়েও আমরা ভালো খেলেছি। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৫৮ রানে অল আউট হওয়াটা আমাদেরকে অনেক পেছনে নিয়ে গেছে। তবে এই পিছিয়ে পড়াটা আমরা রিকভার করতে পেরেছিলাম পরপর দুটো ম্যাচে জিতে। এসব কারণেই আমি আশাবাদের কথা বলছি।
আমাদের ক্রিকেট টীমের দক্ষতাকে আমি বলবো গড়পড়তা মানের অনেক উপরে। ৫৮ রানে হেরে যাওয়ার কারণে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এটা ঠিক না। এ রকম ঘটনা কিন্তু পৃথিবীর প্রত্যেকটা টীমের আছে। ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে ইন্ডিয়া ৫৪ রানে অল আউট হয়েছে। ভি. ভি. এস. লাক্ষ্মান, শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলী, রাহুল দ্রাবিড়ের মতো খেলোয়াড় যে-দলে আছে তারা হেরে গেছে। ক্রিকেট খেলা নিয়ে প্রেডিক্ট করা খুব মুশকিল। বিশ্বের প্রত্যেকটা দলে এরকম একটা করে ঘটনা আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। এটা নিয়ে মন খারাপের কিছু নাই। এরকম ভাবা কখনোই ঠিক নয় যে ক্যাপ্টেন তার দলবল নিয়ে মাঠে নেমেছে মাঠে হেরে যাওয়ার জন্যে।
অনেককে এমন মন্তব্য করতে শুনেছি যে শাকিবের জায়গায় আশরাফুল, কিংবা আশরাফুলের জায়গায় শাকিব থাকলে এরকম হতো না। এই ধারণা খুবই অমূলক। আমাদের যারা ম্যানেজমেন্টে আছেন কিংবা যারা কোচ বা ক্যাপ্টেন তারা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো চেনেন খেলোয়াড়দের। তারা যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সেটা অনেক বেশি সঠিক। তাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান করা উচিৎ।
আমরা আসলে খুব বেশি ইমোশনাল এবং খেলার প্রতি আমাদের প্রত্যাশাও এত বেশি যে হেরে গেলে আমাদের মন খারাপ হয় এবং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি। আমাদের এই প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণে আনা উচিৎ। শেষ পর্যন্ত এটা একটা খেলা। এরা তো এমন কিছু না যে আমাদের সন্তান মৃত্যুর পথে যাচ্ছে তাই আমি বেসামাল হয়ে পড়লাম। এটা একটা খেলা; খেলায় হারজিত থাকবে-এইটুকু বলতে পারি।
এই খেলার ব্যাপারে কোন কিছুই আগে থেকে বলা যায় না। একটা দেশের আবহাওয়া আছে, পিচ আছে–এরকম বহু বিষয় আছে যেগুলো একেক দেশে একেক রকম। যেমন ধরা যাক ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজ– এই ধরণের দেশগুলো হাই বাউন্সে খেলে অভ্যস্ত। বাংলাদেশের যে দুটো মাঠে খেলা হচ্ছে, অর্থাৎ মিরপুর এবং চিটাগং–এই দুটো জায়গাতেই কিন্তু বল খুব একটা হাই থাকে না। লো বলে খেলার পারঙ্গমতা ওদের খুব একটা নেই। এটা ওদের জন্য একটা ডিজআ্যডভান্টেজ। যেমন, ইংল্যান্ডের সাথে আমরা কীভাবে জিতলাম? ইংল্যান্ডের সঙ্গে জেতার পেছনে বোলিংয়ের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে।
সুতরাং এই বাস্তবতাগুলো আমাদের বোঝা দরকার। হেরে গেলেই অন্যায়ভাবে রেগে যাওয়া বা ক্ষিপ্ত হওয়া ঠিক নয়। আমি মনে করি কোচ বা ক্যাপ্টেন যেভাবে খেলার বিষয়টি পরিকল্পনা করছেন, তার প্রতি আমাদের সম্মান থাকা উচিত।
খেলাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা হবে–এটাই স্বভাবিক। তা না হলে খেলা কেন! খেলা নিয়ে উত্তেজনা কেবল যে আমরাই করি বা একটু বেসামাল পর্যায়ে চলে যাই–তাও কিন্তু নয়। স্প্যানীশ লীগে স্পেন হেরে গেলে যে অবস্থা হয় তা কল্পনাতীত। একেবারে রায়টের পর্যায়ে চলে যায়। সেই তুলনায় আমরা অনেক সংযত। তবে একটা জিনিস আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে যারা খেলতে এসেছেন তাঁরা আমাদের অতিথি। অতিথিপরায়ন হিসেবে আমাদের সুখ্যাতি আছে। আমার প্রিয় কবি হাইনরিশ হাইনের একটা লাইন এরকম: 'চিরকাল ভালো বাসবো তোমায় নারী/ এমনকি তারপরও।' একইভাবে আমি বলতে চাই আমরা এই সুখ্যাতি ধরে রাখতে চাই; খেলার সময়, খেলার পরে, এমনকি তার পরেও।
হুমায়ূন ফরীদি : টিভি-নাটক ও চলচ্চিত্রের অভিনেতা।