‘ফিলিস্তিন প্রশ্ন’ নিশ্চিহ্নের আয়োজন

হোক ইসরায়েলি আর হোক ফিলিস্তিনি; সব মানুষের জীবনই তো আসলে মনুষ্যজীবন। সব মানুষের রক্তই একই লাল রঙের। তবুও পশ্চিমা উপনিবেশিক চৈতন্য মানুষে মানুষে পার্থক্য করে, রক্তে রক্তে বিভেদ করে। ইসরায়েলিদের হত্যা নিয়ে সরব পশ্চিমা বিশ্ব তাই গাজায় চলমান স্পষ্ট গণহত্যা নিয়ে নিশ্চুপ থাকে।

বাধন অধিকারীবাধন অধিকারী
Published : 5 Nov 2023, 10:10 AM
Updated : 5 Nov 2023, 10:10 AM

দুনিয়া থেকে ‘ফিলিস্তিন প্রশ্ন’কে নিশ্চিহ্ন করার আয়োজন ধাপে ধাপে সম্পন্নের প্রক্রিয়া চলছে। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর প্রথমেই শুরু হয় মনুষ্যকেন্দ্রিক (হিউম্যানসেন্ট্রিক) বিশ্বব্যবস্থার অমানবিকীকরণ (ডিহিউম্যানইজেশন) প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিলিস্তিনিদের আখ্যা দেন ‘মানুষরূপী জানোয়ার’ (হিউম্যান অ্যানিমেল)। নেতানিয়াহু গাজার নাম দেন ‘শয়তানদের শহর’ (সিটি অব ইভিল)। সুতরাং ‘আত্মরক্ষার্থে’ এবার ‘শয়তানদের শহরে’ হামলে পড়ো, ‘মানুষরূপী জানোয়ার’দের নাশ করো— এভাবেই আগ্রাসনের নতুন এই পর্বের শুরুটা জায়েজ হয়।

এই নাশকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যেদিন (১৭ অক্টোবর) গাজার আল-আহরি আরব হাসপাতালকে বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে কয়েকশ মানুষকে হত্যা করা হলো; তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঘনিষ্ঠতম মিত্র ইসরায়েলে উড়ে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সঙ্গে নিয়ে যান মিথ্যা (ডিসইনফরমেশন) আর প্রচারণার (প্রোপাগান্ডা) ফুলঝুরি। কোনোরকম তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই ইসরায়েলি সুরে সুর মিলিয়ে বাইডেন নেতানইয়াহুকে বলেন, হাসপাতালে হামলা আপনাদের নয়, ফিলিস্তিনে সশস্ত্র সংগঠনের কাজ। ততক্ষণে অপরাধের সমস্ত তথ্যপ্রমাণ বিনাশ করা হয়ে গেছে ইসরায়েলের।

এরপর প্রোপাগান্ডার এক অভাবনীয় নজির স্থাপন করেন বাইডেন। হামাস নাকি ইসরায়েলি শিশুদের শিরচ্ছেদ করেছে আর বাইডেন নাকি তার ছবি দেখেছে; এমন মিথ্যা বলতেও ছাড়েন না তিনি। বাইডেন অভিযোগ করেন, ইসরায়েলি নারীদেরও নাকি ধর্ষণ করেছে হামাসের সদস্যরা! হামাস কর্তৃক নারী-শিশুসহ ইসরায়েলিদের হত্যা ও জিম্মি করার তথ্য ছাড়া প্রমাণিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি শিরচ্ছেদ কিংবা ধর্ষণের। তবে এসব বলার দরকার হয় বাইডেনের। সঙ্গে ‘সন্ত্রাসী’ হামাসকে তুলনা করতে হয় ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে। তারপর তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, হামাস নির্মূল প্রকল্পের অংশ হিসেবে যেকোনো পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের সঙ্গে আছে যুক্তরাষ্ট্র। হামাসকে আইএসের সঙ্গেও তুলনা করেন বাইডেন। ইসরায়েলি আত্মরক্ষার অধিকারকে চূড়ান্ত এবং একমাত্র প্রায়োরিটি হিসেবে হাজির করেন তিনি। ততক্ষণে ইসরায়েলের সমর্থনে মার্কিন রণতরী ভিড়তে শুরু করেছে। জানানো হয়েছে সেনা রিজার্ভ রাখার কথাও। আর ‘খোলা জেলখানা’ গাজা উপত্যকায় সিস্টেমেটিক আগ্রাসনের অংশ হিসেবে পানি-বিদ্যুৎ আর খাবার বন্ধের রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে। শুরু হয়ে গেছে ধারাবাহিক বেসামরিক হত্যার সবথেকে ভয়াবহ পর্ব। নির্বিবাদে মারা শুরু হয়েছে নারী ও শিশুদের।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেলোশিপ অব রিকনশিলেশনের বিশ্লেষক অ্যারিয়েল গোল্ড। বাইডেনের ইসরায়েল সফরের পর তিনি আলজাজিরাকে বলেন, “ইসরায়েল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা এখন পর্যন্ত যত বক্তব্য দিয়েছেন বাইডেনের বক্তব্য সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইসরায়েলপন্থি”। তিনি বলেন, “সাধারণত আমরা অন্তত মুখের কথা হলেও অন্যদের সহিংসতা পরিহার করতে বলি। তবে এক্ষেত্রে বাইডেন ইসরায়েলের পক্ষে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইসরায়েল তাই এখন যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের পরিকল্পনা করছে।” গোল্ড সে সময় আরও বলেন, বাইডেন আইনের শাসনের কথা বললেও আন্তর্জাতিক আইনের কথা বলছেন না। কেননা যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন মানে না। “আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, আপনি কাউকে খাদ্য, পানি, জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত করতে পারবেন না। তবে গাজায় ইসরায়েল পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে এ সবকিছু বন্ধ করে দিলেও; এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো কথা বলেনি মার্কিন প্রশাসন”, বলেন তিনি। এসব প্রক্রিয়ায় ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গী হিসেবে আবির্ভূত হয় পশ্চিমা মিডিয়া। তারা জিম্মি ইসরায়েলিদের নিয়ে যত হিউম্যান স্টোরি করেছে, গাজার বিপন্নতা নিয়ে যদি তার অর্ধেকও করত! তারা হামাসের নৃশংসতাকে যেভাবে চিত্রিত করেছে, তার খানিকটাও যদি ইসরায়েলি সেনাদের নৃশংসতা নিয়ে করত!

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন যতক্ষণে জাতিগত নিধনের আশঙ্কা প্রকাশ করে ফেলেছে; ঠিক সেই সময় বাইডেনের মুখে ইসরায়েলি সুরের প্রতিধ্বনি তেল আবিবকে যা খুশি তাই করার সবুজ সংকেত দেওয়া হিসেবে দেখেন স্কটল্যান্ডের যুদ্ধ-বিশ্লেষক ও সাংবাদিক অ্যালান ফিশার। তিনি সে সময় বলেন, আমেরিকানরা যখন বলেছিল যে তাদের জাতীয় নিরাপত্তা দল গাজা হাসপাতালে বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধান করবে, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন একটি বিস্তৃত তদন্ত হবে। তবে দেখা যাচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে এই মারাত্মক হামলার পেছনে ‘অন্য দল’ রয়েছে। পরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকও একই সুরের প্রতিধ্বনি করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সংকেত পেয়ে ইসরায়েল তাদের ‘আত্মরক্ষার্থে’ নেওয়া ‘হামাস নির্মূল প্রকল্প’র নকশা প্রকাশ করে। তারা জানায়, প্রথমে তারা হামাসকে সমূলে ধ্বংস করবে। তারপর অবরুদ্ধ গাজার সঙ্গে সমস্ত সংযোগ ত্যাগ করবে। তখন অবশিষ্ট গাজাবাসী কী করবে; সেটা নিয়ে কোনো আলাপ তারা করেনি। করেনি, কেননা হামাস নির্মূলের নামে তারা আসলে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থনে, তাদের দেওয়া অস্ত্র ও সহায়তা নিয়ে এই জাতিগত নিধন প্রক্রিয়া (এথনিক ক্লিনজিং) সম্পন্ন করার ব্যাপারটি অনেকটা স্পষ্ট করেই ঘোষণা করে তারা। ইসরায়েলি বাহিনী বলেছে, গাজা সিটিতে হামাসই মূল শক্তি। তবে উপত্যকাজুড়ে হামাস সদস্যরা ছড়িয়ে রয়েছেন। তাই যেখানে হামাসের সদস্যদের দেখা যাবে, যেখানে তারা কর্মকাণ্ড চালাবেন, সেসব জায়গায় হামলা চালানো হবে। হামাসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সক্ষমতা খর্ব করা হবে। যেসব বাড়িতে হামাসের সদস্যরা রয়েছেন, বসবাস করছেন, সেসব ভবনকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হবে। এমনকি পাশে বেসামরিক মানুষজন থাকলেও তা বিবেচনা করা হবে না। দেশটির বিমানবাহিনীর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সম্প্রতি বলেন, “হামাসের সদস্য যেসব বাড়িতে রয়েছেন, সেগুলো তথাকথিত বেসামরিক বাড়ি নয়”।

হামাস নয়, ইসরায়েল যে আসলে গোটা ফিলিস্তিনি জাতিকেই নির্মূল করতে চায়; এসব অবস্থান তারই প্রতিফলন। এইভাবে আগ্রাসন ও জাতিগত নিধনের পক্ষে উৎপাদিত সম্মতিকে সঙ্গী করে কোনকিছুতেই হামলা থেকে রেহাই দেয়নি ইসরায়েল। তাদের সংজ্ঞায়িত হামাস অবস্থান হিসেবে এরইমধ্যে ধ্বংস হয়েছে জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুল, শরণার্থী শিবির ও আরও হাসপাতাল। ইসরায়েল এখন পর্যন্ত সাড়ে ৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। নিখোঁজদের বিবেচনায় নিলে ইসরায়েলি হত্যার শিকার শিশুর সংখ্যাও ছাড়িয়ে গেছে ৪ হাজার। তবুও একের পর এক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নাকচ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের দাবি, যুদ্ধবিরতি হলে হামাস সুবিধা পাবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্রে এই নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ, এই ভয়াবহ নৃশংসতা চালিয়ে যেতে দিতে হবে।

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক আইনের সাবেক অধ্যাপক ও একসময়কার জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত রিচার্ড ফক বলছেন, পশ্চিমা এই অবস্থান ইসরায়েলকে দেওয়া ফিলিস্তিনি জাতিগত নিধনের সবুজ সংকেত। ফিলিস্তিনি অ্যাকাডেমিশিয়ান সামি আল-আরিয়ান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, গাজার শিশুদের নিষ্পাপ রক্ত লেগে গেছে বাইডেন আর তার রক্তপিপাসু বন্ধুদের হাতে। তাদের মতে, “ফিলিস্তিনি শিশুদের বাঁচার অধিকার নেই। আপনাদের এই বর্ণবাদী অবস্থানকে জুতো মারি।”

হামাসের সুড়ঙ্গে নার্ভ গ্যাস ব্যবহার হতে পারে বলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এমন নিষিদ্ধ জিনিস নাকি ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ইতোমধ্যেই। এর সত্যতা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে তেমনটা হওয়া যে অস্বাভাবিক নয়, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। জাতিসংঘ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এরই মধ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে। তবে শুরু থেকেই বেসামরিক নাগরিক হত্যার ইস্যুকে আমলে নিচ্ছেন না ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। যুক্তরাষ্ট্র মুখে বেসামরিক সুরক্ষার কথা বললেও কার্যত ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের পক্ষে প্রতিদিন সম্মতি উৎপাদন করে যাচ্ছে। সবশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত মৃতের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে ক্ষোভের মুখেও পড়েছেন। এই সংশয় যেন পশ্চিমা মিডিয়ারও। বিবিসি হামাসের হত্যাযজ্ঞের শিকার ইসরায়েলিদের সংখ্যা প্রকাশ করছে এভাবে: Israel has been bombing Gaza since the 7 October Hamas attacks that killed 1,400 people with 239 people kidnapped as hostages. এই সংখ্যা কিন্তু ইসরায়েলের দেওয়া তথ্য, বিবিসি ভেরিফাই করেনি, তবুও এটা তারা নিজেদের বরাতে বলছে। কিন্তু গাজার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, The Hamas-run health ministry in Gaza says more than 8,500 people have been killed since Israel's retaliatory bombing began. ফিলিস্তিনি হত্যার তথ্য যদি হামাস পরিচালিত মন্ত্রণালয়ের তথ্য হিসেবে হাজির করা হয়, তাহলে ইসরায়েলি তথ্য কীভাবে নিজেদের বরাতে হাজির করছে বিবিসি?

‘স্ট্র্যাটেজিজ অব প্যালেস্টানিয়ান ইউমেন ইন ইসরায়েল’ নামের একটি বই লিখেছেন আর. এ. কানানেহ। তিনি সেই বইতে বলেন, ফিলিস্তিনি নারীদের জরায়ুকে হুমকি হিসেবে প্রচার করে ইসরায়েল। কেননা জায়নিস্ট রাষ্ট্রবাসনা আর সব জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। ফিলিস্তিনিদের জন্ম রুখতে চায়। ২০১৪ সালে ইসরায়েলি আইনপ্রণেতা এয়িলেট শ্যাকেড সমগ্র ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে শত্রু ঘোষণা দিয়ে নারীদের হত্যার ডাক দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছিলেন। তার সেই পোস্ট হাজার হাজার লাইক কুড়িয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ওই নারীদের হত্যা করতে হবে কেননা তারা ‘সাপের বাচ্চা’র জন্ম দেয়। নারী অধিকারকর্মী নাদা এলিয়ার ২০১৪ সালে লেখা ‘এন্ডিং জায়নিজম ইজ অ্য ফেমিনিস্ট ইস্যু’ নামের নিবন্ধে শ্যাকেডের ওই মন্তব্যের প্রসঙ্গ তুলেছেন। বলেছেন, পানি ও জরুরি ওষুধের সরবরাহ বন্ধ রেখে ব্যাপক গর্ভপাত ঘটানো, হাসপাতালের পথে থাকা ফিলিস্তিনি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের চেক পয়েন্টে বহু সময় ধরে অপেক্ষা করানো এবং ফিলিস্তিনকে অমানবিক পরিস্থিতিতে বাস করতে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে শিশুহত্যা নিশ্চিত করার যে ইসরায়েলি কাঠামো, তারই প্রতিফলন শ্যাকেডের ওই মন্তব্য।

ফিলিস্তিনিদের জন্ম রুখে দেওয়ার ‘ইসরায়েলি কাঠামো’র বিপরীতে প্রতিরোধও প্রবল। এবারের যুদ্ধেও তার নজির দেখা যাচ্ছে। ইসরায়েলি বিমান হামলায় মরতে বসেছেন; এমন অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভ থেকে জীবন্ত নবজাতক বের করে আনছেন গাজার ডাক্তাররা। মা মরে গেলেও নবজাতক আইসিইউতে প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে অপরিপক্ব শিশুদের বাঁচানোর। আমার কাছে থাকা শেষ খবর অনুযায়ী, উপত্যকার ৭টি নবজাতক আইসিইউতে রয়েছে ১৩০টি অপরিপক্ব শিশু। তারা বাঁচবে কিনা, তা নিশ্চিত নয়। কারণ যেকোনো মুহূর্তে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হতে পারে হাসপাতাল। তার ৫ মিনিটে ওই শিশুরা মারা যাবে।

হোক ইসরায়েলি আর হোক ফিলিস্তিনি; সব মানুষের জীবনই তো আসলে মনুষ্যজীবন। সব মানুষের রক্তই একই লাল রঙের। তবুও পশ্চিমা উপনিবেশিক চৈতন্য মানুষে মানুষে পার্থক্য করে, রক্তে রক্তে বিভেদ করে। ইসরায়েলিদের হত্যা নিয়ে সরব পশ্চিমা বিশ্ব তাই গাজায় চলমান স্পষ্ট গণহত্যা নিয়ে নিশ্চুপ থাকে। আর জায়নবাদী ক্ষমতাকাঠামো দুনিয়াজুড়ে আধিপত্য নিরঙ্কুশ করার যন্ত্র-প্রকৌশলের ল্যাবরেটরি হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে ফিলিস্তিনকে।

প্রশ্নহীন এই হত্যাযজ্ঞের স্বঘোষিত আইনকানুনের সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ক্ষুধার সঙ্গেও লড়তে হচ্ছে গাজাবাসীকে। ফুরিয়ে আসছে হাতপাতালের তেল। জাতিসংঘের কার্যক্রমও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এরইমধ্যে উইকিলিকস ফাঁস করেছে যে হত্যাযজ্ঞের পর অবশিষ্ট ফিলিস্তিনিদের সিনাই উপত্যকায় পাঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ইসরায়েলের। এভাবেই ফিলিস্তিন প্রশ্নকে নিশ্চিহ্ন করার কৌশল নেওয়া হয়েছে। জায়নবাদী প্রকল্পের অংশ হিসেবে শিশুহত্যাকে নির্বিচারি রূপ দেওয়া হয়েছে সেখানে। আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে, যে সংঘাতে এভাবে শিশু হত্যার নজির বিশ্বে আর নেই।

এখন ফিলিস্তিনিদের একটা রাষ্ট্রের প্রশ্ন টিকে আছে কেবল বিশ্ববিবেকের প্রতিরোধের মধ্যে। কেবল মুসলিম দেশ নয়, পশ্চিমা দেশগুলোও বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিনি অধিকারের সপক্ষে। খোদ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন ইহুদি গোষ্ঠী নেমেছে গাজার বিপন্ন মানবতার পক্ষে। তারা বলছেন, জায়নবাদী রাষ্ট্রপ্রকল্পের রক্তাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তাদের সংযোগ নেই। তাদের ইহুদি ধর্ম তাদেরকে নিপীড়তের পক্ষে থাকতে বলে।

বৈশ্বিক এই প্রতিরোধেই ঝুলছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রপ্রশ্নের ভাগ্য।