আমাদের ঘর-লাগোয়া ঘরের মাঝখানে এখন বিভেদের দেয়াল। অনড় ইট পাথরের আড়াল কেবল বাড়িতে বাড়িতে নয়, কী করে যেন উঠে গেছে হৃদয়ে হৃদয়ে। আমরা তখন জানতাম না, এখন খুব করে জানি আমাদের গলাগলি, দলাদলির দিনে বড় স্পষ্ট হয়ে গেছে যোজন যোজন দূরত্ব।
Published : 22 Apr 2023, 10:00 AM
আমার অনেক ঈদ ছিল। শৈশবে-কৈশোর থেকে তারুণ্য পর্যন্ত আমার সেই সব ঈদের বৃত্তান্ত বলব। সেই সঙ্গে বলব সেই ঈদ হারাবার বেদনাও। দুটোরই বড় অবশ্যম্ভাবী আগমন জীবনে। তারও আগে যে সত্য স্বীকার্য যে উৎসবে এখন এক হাতে গলাগলি আর অন্য হাতে সেমাই নেই, আঙুলের ফাঁক বেয়ে চুঁইয়ে পড়া দুধ কনুই থেকে চেটে খাওয়া নেই, প্রতিবেশী বাড়ি থেকে ধর্ম বিভাজনের বেড়া ডিঙিয়ে আসা পোলাও আর মুরগির সুরুয়ার গন্ধ নেই। আছে কেবল নিয়মের সামাজিকতা অথবা সামাজিক নিয়মতান্ত্রিকতা।
তাদের মচমচে জরি পাড় দেয়া নতুন জামা ছিল। আমাদের ছিল না। আমাদের নিত্য পরার রং চটে যাওয়া ফুল ছাপা ফ্রক আর ইলাস্টিক লাগানো প্যান্ট। তাই সই।কেউ আমাদের শিখিয়ে দেয়নি। তবু জানতাম আজ রেহানা, বদরুন্নেসা খেলতে আসবে না। ওরা মুসলমান। আজ ওদের ঈদ। আজ সাইরেন বাজবে না, রোজা শেষ। আমরা জানতাম ওদের আম্মা কাল গভীর রাত জেগে পিঠার গায়ে এঁকেছেন জটিল নকশা৷ সেগুলো তেলে ভাজার উৎসব-গন্ধ মেখে আমরা পাশাপাশি বাড়িতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছি। আর পরদিন দৌড়ে পিঠা খেতে গিয়ে নকশার ফুলের শুরু আর শেষ খোঁজে হন্যে হয়েছি।
আমাদের ঘর-লাগোয়া ঘরের মাঝখানে এখন বিভেদের দেয়াল। অনড় ইট পাথরের আড়াল কেবল বাড়িতে বাড়িতে নয়, কী করে যেন উঠে গেছে হৃদয়ে হৃদয়ে। আমরা তখন জানতাম না, এখন খুব করে জানি আমাদের গলাগলি, দলাদলির দিনে বড় স্পষ্ট হয়ে গেছে যোজন যোজন দূরত্ব। অনুভব, অনুভূতি, ভাবনা কিংবা গল্পের ভুবনে নেমে এসেছে অদৃশ্য নৈঃশব্দ্য। শৈশবের নিষ্পাপ ভাগাভাগিতে এখন কতো হিসাব নিকাশ, নিষিদ্ধতার রূঢ় নির্দেশ!
যে উৎসবে প্রেমিকের ইশারার গোপন শিহরণ নেই, যে উৎসবে প্রেমিকের নতুন পাঞ্জাবির ছায়া ধাওয়া করে না দিনমান, সে উৎসবে কোনোই রং নেই। প্রেমিকের এই গোপন ইশারা আর পাঞ্জাবির ছায়া হৃদয়ে মেখে নেয়ার মনটা যতোদিন জেগে থাকে, ততোদিন উৎসব রঙিন।
আর উৎসবের রং লেগে থাকে অপেক্ষার আয়োজনে প্রবীণের জীবনে। জীবনের অক্লান্ত যুদ্ধ শেষে যাদের অপেক্ষা ছাড়া কিছু করার নেই আর।
এই যে প্রায়শই বয়স্করা বলেন ঈদের আনন্দ নেই, তাদের প্রেমের মনটা মরে গেছে। স্বীকার করুন কিংবা না করুন ভেবে দেখুন, অনেক কিছুই হয়তো আছে, যুক্ত হয়েছে কিংবা বেড়েছে আয়োজনের প্রাচুর্যে। পোশাকের, খাবারের, মিডিয়ার, উদযাপনের সব আয়োজন রঙিন হয়েছে বহুগুণ।কেবল বদলে গেছে উৎসবের রং। একজনের কাছ থেকে চলে গেছে অন্যজনের কাছে। উৎসব রং হারায়নি। হারায় না তার রস কিংবা উল্লাস। কেবল হাতবদল হয় তার। একই বয়স আর বহু বর্ণিল রং নিয়ে উৎসব অপেক্ষা করে থাকে নব বোধনের, বৈচিতত্র্যের। আমরা বুড়িয়ে যাই, ক্ষয়ে যাই বয়সের ভারে, চামড়ার ভাঁজে, পাকা চুলে। ইহলৌকিক যৌবনের বিপ্লবী সুষম ভাবনা ছেড়ে আত্মসমর্যণ করি পরকালীন রহস্যময় ভোরে। কিন্তু উৎসব চিরযৌবনা, কালের সবচেয়ে আধুনিক গন্ধ গায়ে মেখে সে দাঁড়িয়ে থাকে পাড়ার মোড় থেকে সিনেপ্লেক্স কিংবা পাঁচতারায়। যুগের কোথাও অনভ্যস্ত বেমানান নয় সে কোনোকালেই।শুধু আমার কাছেই অচেনা হয়ে গেছে।
আমাদের কৈশোরে এই মফস্বলের বাতাস সকাল থেকেই ভাসতো আতরের গন্ধসাগরে। আমার বাড়ির পাশেই সওদাগর জামে মসজিদ।ঘুম ভাঙতো মাইকের আহবানে। সওদাগর জামে মসজিদে পবিত্র ঈদুল ফিতরের প্রথম নামাজ বেলা ৮টায় অনুষ্ঠিত হবে...। তখনই বাতাস ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকে আতর আর পাটভাঙা পাঞ্জাবির ঘ্রাণে। রাস্তার পাশে, মসজিদের পাশে আমার ঘর বর্ণিল হয়ে উঠতে শুরু করতো উৎসবের রঙে। সারাবছর যে ছেলেটি খাতা বই নিয়ে কেবল টিউশনি, মাস্টারের বাড়ি দৌঁড়ায়, এদিক-সেদিক তাকানোর ফুসরৎই নেই, সেও আজ ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো বাঁকা হাসি আর ইশারা নিয়ে তাকায়। ঈদ মানে উৎসব, উৎসব মানে আনন্দ, আনন্দ মানে শিহরণ, প্রেমের শিহরণ।
জন্ম পরিচয়ে হিন্দু বলে ঈদে বিশেষ নতুন জামা-টামা জুটতো না আগেই বলেছি। রোজার ছুটির আগে দিয়ে রাখা বন্ধুদের আমন্ত্রণে বিকেলে পুরানো জামাতেই যাওয়ার প্রস্তুতি নিতাম। প্রায়শই পরিবার থেকে অনুমতি মিলতো না। কদাচিৎ মিলতো কোনোবার, সন্ধ্যা নামার আগে আগে ফিরে আসার শর্তে। সে এক স্বর্গীয় বিকেল যেনবা, এ বাড়ি-ও বাড়ি! কতো অপেক্ষা প্রাণ পেতো সেই বিকেলে, শুরু হতো কতো লাইলি-মজনু উপাখ্যান। সেমাই-পিঠে পুলির ভাঁজে ভাঁজে হয়তোবা লুকিয়ে আছে সেই ইতিহাস।
আর রাতের আনন্দমেলা, নাটক...জুয়েল আইচ, আনিসুল হক, আফজাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ আর রোকন-দুলাল-জবা-কুসুমের মা দখল করে থাকতো কয়েক মাস। আলোচনা আড্ডা। আমাদের সেকালের ঈদের এইসব অপেক্ষার আনন্দ অনুবাদ করতে পারে কি একালের রিমোটের প্রতিটি সেকেন্ড কিংবা ফেইসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের বাহুল্য!
আমাদের জীবনে ঈদ আসে প্রেমের মহিমা নিয়ে। ধর্মীয় ভিন্নতা তুচ্ছ করা সর্বগ্রাসী প্রেম। ছুটিতে একসঙ্গে ফেরা, একটা উপহারের অপেক্ষা কিংবা ক্যাম্পাসের উদারতাহীন ক্ষুদ্র মফস্বলে ঈদের দিনে একনজর দেখা! এক একটা ঈদের জন্য কী উন্মাতাল অপেক্ষা। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঈদগুলো। একটা সামান্য লিপস্টিক কিংবা একটা বডি স্প্রে উপহারে যেন সাত রাজার ধন সম প্রাপ্তি থাকতো লুকিয়ে। টিউশনি করে দিন কাটানো যুবকের কাছে এর চেয়ে অধিক কোনো প্রাপ্তি প্রত্যাশা ছিল না। তারচেয়ে বরং অধিক কাঙ্ক্ষিত ছিল একনজর দেখা! ক্যাম্পাসের সহজলভ্যতা অধিক তৃষ্ণায় কাতর হতো এই মফস্বলের ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধতায় একনজর দৃষ্টি বিনিময়ে...।
তারপর চলে গেছে কতো আহ্নিকগতি-বার্ষিকগতির দিন-রাত, জোয়ার-ভাটার বছরের পর বছর! আমাদের বিটিভির অপরিমেয় নির্ভেজাল আনন্দ কেড়ে নিয়েছে ঈদের ‘পঞ্চম দিন’, 'ষষ্ঠদিনে'র গুন-মানহীন হুল্লোড়। আমার জীবনকে ফাঁকি দিয়েছে ঈদের আনন্দ। বন্ধুরা সব প্রতিষ্ঠিত স্বাবলম্বী। হয়তো কখনো হাজার টাকার উপহার আসে, তবু সেই একটা লিপস্টিক কিংবা বডি স্প্রে পাবার শিহরণ কই?
আমি জানি এই সময়ে প্রতিটি নরনারী যে পেরিয়ে এসেছে কৈশোর কিংবা যৌবন, ঈদ কাটে তাদের নস্টালজিয়ায়, স্মৃতিতে আর রোমন্থনে।
ঈদ আবার ফিরে আসে দেখি চতুর্পাশে বেশ কয়জন প্রৌঢ় আর প্রৌঢ়ার জীবনে।আমি দেখি নিঃসঙ্গ বাড়ি আগলে পড়ে থাকা জনক-জননী। সারাবছর কেবল মোবাইলে, ইমোতে কথা বলা নাড়িছেঁড়া ধনের আকুল অপেক্ষা এই একটি উৎসবে। তার আগে আচার দেয়া, পাঁপড় দেয়া, পিঠে-পুলির আয়োজন। ঈদ তাদের রঙিন হয়ে ওঠে সারাজীবনের সার খুঁজে। তারা হয়তো জানেন, হয়তো জানেন না, কিংবা জেনেও বুঝেন না ছেলে-নাতি-নাতনিরা পিঠে-পুলির স্বাদ কবে ভুলে গেছে। আনন্দ পাড়ি জমিয়েছে রান্নার চুলা থেকে ফাস্টফুডের টেবিলে। তবু ক্লান্তি নেই প্রৌঢ় প্রৌঢ়াদের। চুলায় রান্না চাপাতে চাপাতে, আচারের বৈয়াম রোদে শুকাতে দিতে দিতে তাদের দৃষ্টি পড়ে থাকে পথের ধারে...ঈদের আনন্দ আসে সেই পথ বেয়ে।
এই ঈদে পত্রিকা মিডিয়ায় কেবলই খবর হয়, শেকড়ের টানে খালি হয়ে যাচ্ছে রাজধানী। কিন্তু খালি হওয়া রাজধানী এসে যেখানে জমায়েত হয়, সেই মফস্বলগুলো যেন এই ঈদে এক একটা জমাট কার্নিভাল। অভূতপূর্ব বর্ণিল রং এর। পেশার টানে, জীবিকার টানে দেশে কিংবা দেশের বাইরে থাকা মানুষগুলো এই উৎসব কেন্দ্র করে ছুটে আসেন নিজ শহরে কিংবা গ্রামে। পাড়ায় মহল্লায় দোকানে মার্কেটে চায়ের স্টলে জটলা। সারাবছর নীরবতার গাঁজায়ঝিমুতে থাকা মফস্বলগুলো হঠাৎ যেন গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ায় ঝলমলে প্রাণসজীবতায়। বাড়ি বাড়ি, ঘরে ঘরে যেন প্রাণের স্পর্শ ফিরে আসার স্পন্দন। আত্মীয়-পরিজন, নাওঈরী-ঝিয়ারি, বন্ধু-বান্ধবে গল্পে, গুজবে, পুনর্মিলনে মফস্বলগুলো যেন গরবে ঝলমল করে। কতো কৃতি সন্তানের জন্মদাত্রী সে। যারা বারবার নাড়ির টানে ফিরে ফিরে আসে। ঈদ কখনোই কেবলই সীমাবদ্ধ নয় শুধুই ধর্মীয় আচারে। সবকিছুর উর্ধ্বে পারস্পরিক আত্মার মিলনে এক অন্য মাত্রা পেয়েছে এই মাটিতে। শিকড়ের টান এক অমোঘ টান হয়ে এই উৎসবকে দিয়েছে সার্বজনীন ঐতিহ্য।