৬-দফাকে সাধারণ জনগণের কাছে তুলে ধরতে বঙ্গবন্ধু এই সময় ৩৫ দিনে ৩২টি জনসভায় জনতার মুখোমুখি হন। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, সন্দ্বীপ থেকে শুরু করে লালমনিরহাট, সিলেট, হবিগঞ্জ, বরিশাল, রংপুর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে নেত্রকোণা বঙ্গবন্ধু জনমতকে সংঘটিত করতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। যার ফলে ৬-দফা জনগণের দাবিতে পরিণত হয়।
Published : 07 Jun 2024, 02:08 PM
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে একটি বড় মাইলফলক ৬-দফা ও ৭ই জুন। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবায়িত করার প্রথম সক্রিয় প্রচেষ্টা হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ১৯৬৬ সালের ৬-দফা ছিল সে পদক্ষেপ। ৬-দফা ঘোষণার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এটাকে ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ বলে অভিহিত করেন। ৬-দফা কেন্দ্রিক আন্দোলনের সময় বিভিন্ন জনসভায় বঙ্গবন্ধু বারবার উচ্চরণ করেছেন ৬-দফা ‘আমাদের মুক্তির সনদ’। ৬-দফাকে সাধারণ জনগণের কাছে তুলে ধরতে বঙ্গবন্ধু এই সময় ৩৫ দিনে ৩২টি জনসভায় জনতার মুখোমুখি হন। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, সন্দ্বীপ থেকে শুরু করে লালমনিরহাট, সিলেট, হবিগঞ্জ, বরিশাল, রংপুর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে নেত্রকোণা বঙ্গবন্ধু জনমতকে সংঘটিত করতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। যার ফলে ৬-দফা জনগণের দাবিতে পরিণত হয়। ৬-দফার সমর্থনে ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য ডাকা ৭ই জুনের হরতালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে যে ১১জন শহীদ হয়, তারা সকলেই ছিল সাধারণ শ্রমিক।
৬-দফা প্রশ্নে কোন আপস নাই, বঙ্গবন্ধুর এরূপ অনড় ও দৃঢ় অবস্থান এই আন্দোলনকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছিল। ৬-দফা অতি দ্রুত বাঙালির জাতীয় মুক্তির চেতনামূলে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে সংঘটিত হয় এবং বাংলাদেশ বিপ্লব, ১৯৭১। ৬ ছয় দফার পক্ষে যখন বঙ্গবন্ধু সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছিলেন ঠিক সেইসময় ১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জে শ্রমিকদের এক জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এক হাজার একুশ দিন পর ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান। দীর্ঘ এই বন্দি জীবনের শুরুতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের জুনের ২ তারিখ থেকে সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত নিজস্ব বয়ানে ছয় দফা আন্দোলনের ঐতিহাসিক মুহূর্ত, শাসকের অন্যায় আচরণ আর নেতা-কর্মীদের আত্মত্যাগের কথা হৃদয়গ্রাহীভাবে তুলে ধরেছেন ‘কারাগারের রোজনামচা’য়। পাশাপাশি কারাগারে বসেই শাসকের এই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দীপ্ত শপথও নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ‘যারা হাসতে হাসতে জীবন দিল, আহত হলো, গ্রেপ্তার হলো, নির্যাতন সহ্য করল তাদের প্রতি এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের প্রতি নীরব প্রাণের সহানুভূতি ছাড়া জেলবন্দি আমি আর কি দিতে পারি! আল্লাহর কাছে এই কারাগারে বসে তাদের আত্মার শান্তির জন্য হাত তুলে মোনাজাত করলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। যা কপালে আছে তাই হবে। জনগণ তাদের দাম দেয়। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে।’
‘কারাগারের রোজনামচা’র ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘বাংলার মানুষ যে স্বাধীন হবে এ আত্মবিশ্বাস বার বার তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে। এত আত্মপ্রত্যয় নিয়ে পৃথিবীর আর কোন নেতা ভবিষ্যৎবাণী করতে পেরেছেন কিনা আমি জানি না।’
রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘আওয়ামী লীগ: উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ছয় দফা হঠাৎ করে আসমান থেকে পড়েনি। দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি ও ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এর তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি হচ্ছিল। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছিল রাজনীতিবিদদের সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের যুগলবন্দী, স্বাধিকারের দাবিতে যাঁরা এক মোহনায় মিলেছিলেন।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছয় দফা আন্দোলনে গ্রেপ্তার হন ৮ মে ১৯৬৬। জেল জীবন শুরুর ২৪ দিন পর থেকে তিনি রোজনামচা লিখতে শুরু করেন। রোজনামচা মূলত বঙ্গবন্ধুর ২টি নোটবুকের সংকলন। প্রথম নোটবুকটিতে ১৯৬৬ সালের ২ জুন থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭২ দিনের দিনলিপি পাওয়া যায়। এর মধ্যে জুন ও জুলাই মাসের ৬১ দিনের প্রতিদিনের বিবরণ রয়েছে। এই ৬১ দিনের ডায়েরিতে প্রায় প্রতিদিনই ছয়দফার কথা উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচার শুরুটি হয়েছিল ছয়দফা কেন্দ্রিক আন্দোলনে সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের বিবরণ দিয়ে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষ করছিলেন ৭ই জুনকে কেন্দ্র করে কীভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের। কারাগারের রোজনামচায় শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর গভীর উৎকণ্ঠা বুঝা যায়,
‘২রা জুন ১৯৬৬।। বৃহস্পতিবার
সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম রাত্রে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে এসেছে। কয়েদিরা, সিপাহীরা আলোচনা করছে। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বুঝতে বাকি রইল না আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের নিয়ে এসেছে, ৭ই জুনের হরতালকে বানচাল করার জন্য।’
রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের পরিচয়, তাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভয়। ২ তারিখের বিবরণে আওয়ামী লীগের ৮ জন নেতাকর্মী আবদুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান, হাফেজ মুছা, মোস্তফা সরোয়ার, শাহাবুদ্দীন চৌধুরী, রাশেদ মোশাররফ, হারুনুর রশিদ ও জাকির হোসেনের নাম ডায়েরিতে উল্লেখ করেন। যাদের আগের রাতে গ্রেপ্তার করে আনা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু লিখছেন, ‘হাফেজ মুসা সাহেব, বুড়া মানুষ, কষ্ট পাবেন হয়ত, পূর্বে কোনদিন জেলে আসেন নাই। চৌধুরী সাহেব বেচারা খুবই নরম’।
সরকারের দমন নীতিতে শঙ্কিত বঙ্গবন্ধু। নিরপরাধ বয়ষ্ক লোকদের জেলে পুরছেন পাকিস্তান সরকার। উদ্দেশ্য একটাই ভয় দেখিয়ে ছয় দফাকে দমানো, ৭ জুনের হরতাল সফল হতে না দেওয়া। ‘পোস্টার লাগালে ছিঁড়ে ফেলা, মাইক্রোফোনের অনুমতি না দেওয়া, অনেক অত্যাচারই শুরু করেছে।’ সরকার এই কাজে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি পুলিশকে সম্পৃক্ত করেছে। ২ জুনের বিবরণে পাওয়া যায়, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় পুলিশ নিজেরাই দিনের বেলায় ৭ জুনের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে।
দিনলিপির দ্বিতীয় দিনের বিবরণেও নির্বিচারে আওয়ামী লীগ কর্র্মীদের গ্রেফতারের বর্ণনা, আর ৭ জুন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর উদ্বেগের বিবরণ।
তিনটার সময় বঙ্গবন্ধু পত্রিকা পেলেন। ইত্তেফাক, আজাদ ও পাকিস্তান অবজারভার তিনটি পত্রিকা তাকে দেওয়া হলো। কিন্তু ৭ জুনকে কেন্দ্র করে যত সংবাদ, গ্রেফতারকৃতদের নাম কালি দিয়ে মুছে দেয়া হল। ৪ জুনের দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধু আবার সংবাদপত্রের কথা লিখেছেন। আগের দিনের বঙ্গবন্ধু চিৎকার চেঁচামেচিতে আজ আর কালি দিয়ে সেন্সর করা হয়নি। পাকিস্তান সরকার নিজে দায়িত্ব নিয়ে ৭ই জুনকে জনগণ থেকে আড়াল করার কার্যক্রম হাতে নেয়। পত্রিকায় এই সংক্রান্ত সংবাদ ছাপা নিষিদ্ধ করে। দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ইত্তেফাক দেখে মনে হল ৭ই জুনের হরতাল সম্বন্ধে কোন সংবাদ ছাপতে পারবে না বলে সরকার হুকুম দিয়েছে। যে দেশে মানুষের মতামত বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে কেমন করে?’
৫ জুনের দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ কর্মিদের গ্রেফতার করে চলছে। আরও আটজন কর্মিকে গ্রেপ্তার করেছে বিভিন্ন যায়গায়। দমননীতি সমানে চালাইয়া যেতেছে সরকার।’ বঙ্গবন্ধু রাজপথের কর্মী ছিলেন। সেই পাকিস্তান আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, কিংবা পরবর্তীতে ৫৮ সালের সামরিক শাসন কিংবা ৬২’র ছাত্র আন্দোলন- এসব আন্দোলনকে দমানোর জন্য সরকারের কৌশল তিনি বুঝেন। তাইতো তিনি লিখেছেন, ‘নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গণদাবীকে দাবাইয়া দেওয়া যায় না। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক পথেই মোকাবেলা করা উচিত।’ রোজনামচায় উঠে এসেছে পাকিস্তান সরকার কতটা অমানবিকভাবে ৭ই জুনের হরতালকে সফল হতে না দেওয়ার কৌশল নিয়েছেন। ৭ ই জুনের হরতাল সফল হলে ৬-দফাকে উপেক্ষার শক্তি ক্ষমতাসীন শাসকদের নেই। আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর যে যথেষ্ট নির্যাতন করা হচ্ছে সেটি দিনলিপির বিবরনে পাওয়া যায়। মোনায়েম খানের একনায়কত্বের সমালোচনা, ভাষা আন্দোলনকে দমানোর জন্য তার যে তৎপরতা বঙ্গবন্ধু লিপিবদ্ধ কছেন ৫ জুনের রোজনামচায়। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, নির্যাতনের যে পথ মোনায়েম খান বেছে নিয়েছেন তার ফলাফল খুব একটা শুভ হবে না। বঙ্গবন্ধু মোনায়েম খানের উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, ‘তিনি ভুলে গেছেন এটি পূর্ব বাংলা, পশ্চিম পাকিস্তান নহে। আন্দোলন করা এবং নির্যাতন সহ্য করার ক্ষমতা এরা রাখে।’
এই অত্যাচার-নির্যাতনের সবচেয়ে ভুক্তভোগী ছিল আওয়ামী লীগের কর্মীরা। এতসব অত্যাচার-নির্যাতনের পরও বঙ্গবন্ধুর এই কর্মীরা আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন নাই। ৬-দফা কেন্দ্রিক আন্দোলনের পথ কি হবে গ্রেপ্তারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জনসভায় সেই নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া কোর্ট প্রাঙ্গনে জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যদিও দেশের দায়িত্বশীল মহল হইতে গৃহযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার ডাক পাওয়া গিয়াছে, তথাপি আমরা গৃহযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইতে রাজী নই। আমাদের সংগ্রাম শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম। আমাদের উপর আঘাত হানিলে আমরা প্রত্যাঘাত করিব না, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আঘাত সহ্য করিব। আমরা আঘাত করিব না, আমরা সত্যাগ্রহ করিব।’
পুলিশ ও মুসলিম লীগের কর্মীরা ৭ই জুনের পোস্টার তুলে ফেলছে, আওয়ামী লীগের কর্মী কোনো সংঘাতে যায়নি। আবার পোস্টার লাগিয়ে দিয়েছেন। প্যামফ্লেট বের করেছে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নিঃস্বার্থ কর্মীদের প্রশংসা করেছেন বঙ্গবন্ধু। শ্রমিকদের সাথে নিয়ে তারা ৭ ই জুন হরতালের জন্য নিয়মিত পথসভা ও মিছিল বের করেছেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘এতো গ্রেফতার করেও এদের দমাইয়া দিতে পারে নাই। সত্যই ততটা আশা আমি করতে পারি নাই।’ বঙ্গবন্ধু এই দিনের রোজনামচায় লিখেছেন, ‘ছয় দফা দাবী যখন তারা দেশের কাছে পেশ করেছে তখনই প্রস্তুত হয়ে গিয়াছে যে তাদের দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে হবে। এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচানোর সংগ্রাম’।
বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগে যে ৩২টি জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন সেখানে সাধারণের উপস্থিতি তার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল। তিনি জানতেন জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচানোর এই সংগ্রামে পূর্ব বাংলার জনগণ তার সাথে আছেন। ৫ই জুনের রোজনামচায় শেষ লাইগুলো যেন তারই প্রতিচ্ছবি। ‘মাথার ভিতর শুধু ৭ই জুনের চিন্তা। কি হবে! তবে জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। জনমত আমার জানা আছে’।
ঐতিহাসিক ৭ই জুনের আগের দিন। বঙ্গবন্ধু তার রোজনামচায় লিখেছেন ইতিহাসের ভবিষ্যত।
‘৬ জুন ১৯৬৬, সোমবার
আগামীকাল ধর্মঘট। পূর্ব বাংলার জনগণকে আমি জানি, হরতাল তারা করবে। রাজবন্দীদের মুক্তি তারা চাইবে। ছয়দফা সমর্থন করবে।’
৬-দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অগাধ আত্মবিশ্বাসের পরিচয় ৬ জুনের দিনলিপি। ৬-দফা এত দ্রুত সাধারণ জনগণ গ্রহণ করবে এতা সম্ভবত কেউ ভাবেনি। ২০ মার্চ পল্টনের জনসভা শুরু হওয়ার আগে প্রচণ্ড দমকা হাওয়া এবং বৃষ্টি। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিতে এসে বললেন, এইরূপ শত শত ঝড় ও ঝঞ্ঝাটের মধ্যেই জনগণের দাবি আদায় হয়। হাজার হাজার মানুষ বৃষ্টির মধ্যে পল্টনের উন্মুক্ত আকাশের নিচে এসে দাঁড়ায় বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন সাধারণ মানুষ ৬-দফা অনুধাবন করতে পারছে। এবং তাদের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে মর্যাদা দিয়েছেন।
সত্যিই ৬দফার দাবিতে সারাদেশের লোকজন নারায়ণগঞ্জের লোকজনের মতো নির্ভীকভাবে রাজপথে নেমে এসেছিল। অন্যদিকে মোনায়েম খানের নির্দেশে চলছিল গণগ্রেপ্তার। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ধরপাকড় চলছে সমানে। কর্মিদের গ্রেপ্তার করছে।’ এতসব বাধা উপেক্ষা করেও হরতালের সম্পর্কে আওয়ামী লীগ, শ্রমিক, ছাত্র ও যুবলীগ কর্মীদের সভা, মশাল মিছিলের খবর বঙ্গবন্ধুর কানে গিয়ে পৌঁছায়। সব যে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে কিংবা সংবাদপত্র পড়ে জানতেন তা নয়। নানাভাবে সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছাত। রোজনামচায় লিখেছেন, ‘তবে আমি পুরানা লোক- দুবার এই জেলে অতিথি হয়েছি। এই সেলের সকলেই আমাকে জানে। নিশ্চয়ই বের করে নেব।’
রোজনামচায় ৭ই জুনের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে নারায়নগঞ্জের জনসভায় গভর্নরের হুমকি ও বঙ্গবন্ধুর পর্যবেক্ষণের বিবরণ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু দিনলিপিতে আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে লিখেন, ‘শত অত্যাচার ও নির্যাতনেও কর্মীরা ভেঙ্গে পড়ে নাই। আন্দোলন চালাইয়া গেছে। নিশ্চয় আদায় হবে জনগণের দাবি।’ বঙ্গবন্ধু সেলে বসেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, গ্রেফতার জুলুম দিয়ে জনগণের দাবিকে তারা দমন করতে পারবে না। ‘ত্যাগ বৃথা যাবে না, যায় নাই কোনদিন।’ নিজের কারাজীবনের দুঃসহ একাকিত্ব এইদিনের বিবরণে স্পষ্ট। পরের দিনের চিন্তায় হয়তো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। লিখেছেন, ‘আমি একা থাকি, আমার সাথে কাহাকেও মিশতে দেওয়া হয় না। একাকী সময় কাটানো যে কত কষ্ট তাহা যাহারা ভুক্তভোগী নন বুঝতে পারবেন না।’
বঙ্গবন্ধুকে কারাগারের পুরোটা সময় জুড়েই রাখা হয়েছিল একদম বিচ্ছিন্ন করে। যাতে একাকিত্বের যন্ত্রণায় তিনি ভেঙ্গে পড়েন। রোজনামচায় লিখছেন, ‘রাত কেটে গেলো। এমনি অনেক রাত কেটে গেছে আমার। প্রায় ছয় বছর জেলে কাটিয়েছি। বোধহয় দুই হাজার রাতের কম হবে না, বেশি হতে পারে। আরও কত রাত কাটবে কে জানে? বোধ হয় আমাদের জীবনের সামনের রাতগুলো সরকার ও আইবি ডিপার্টমেন্টের হাতে। আমরা নীরবে সবই সহ্য করব ভবিষ্যৎ বংশোধরদের আজাদীর জন্য। আমাদের যৌবনের উন্মাদনার দিনগুলো তো কারাগারেই কাটিয়ে দিলাম।’ নিজের কক্ষে বসে এই সময় তিনি দেখেছেন শাসকের অত্যাচারের নমুনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন পাকিস্তানিরা যতই কারা প্রকোষ্ঠে রেখে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করুক না কেন, জনগণ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হবেন না। ‘দেশের শত শত কোটি কোটি মা-বোনের দোয়া আছে আমাদের ওপর।’ জনগণের ওপর অগাধ বিশ্বাস রেখে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জয়ী আমরা হবই। ত্যাগের মাধ্যমে আদর্শের জয় হয়।’
৬-দফা আন্দোলনের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট ছিল ৭ জুন। জেল থেকে পাঠানো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী ছয় দফার সমর্থনে ১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামী লীগের আয়োজিত পল্টনের জনসভায় ৭ জুন হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এই হরতালের উদ্দেশ্য ছিল দুটি, ৬-দফা দাবি আদায় ও গ্রেপ্তারকৃত নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবি।
৭ই জুনের হরতালকে সফল করার জন্য ছাত্রলীগের কর্মীরা শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রচার-প্রচারণা চালায়। ঢাকার তেজগাঁও, নারায়ণগঞ্জের আদমজী, টঙ্গী, গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক নেতারা হরতাল সফল করার লক্ষ্যে প্রচার চালাতে থাকে। হরতালের আয়োজন দেখে সরকার ভীত হয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার করতে থাকে। এর ফলে হরতালের প্রতি জনসমর্থন আরও বেড়ে যায়। ৭ই জুন যত ঘনিয়ে আসছিল শাসকমহলের মধ্যে হরতাল দমনের মনোভাব তত বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অপরদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শ্রমিক-ছাত্র, কৃষক ও সাধারণ মানুষ হরতাল সফল করার লক্ষ্যে প্রস্তুত হতে শুরু করে। উভয়পক্ষের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বাড়ছিল। সরকার হরতাল দমনে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে।
সরকারের গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন ছাপিয়ে ৭ই জুন সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ন্যাপের প্রচারপত্রে ৭ই জুনের হরতালের বিবরণ ছিল এ-রকম:
‘পাকিস্তানের জীবনেতিহাসে এমন হরতাল আর দেখা যায় নাই। পিকেটিংয়ের প্রয়োজন হয় নাই, স্বেচ্ছাসেবকের কথা কেউ চিন্তাও করে নাই-তবুও ৭ই জুন ভোরবেলা দেখা গেল লক্ষ জনতা নিজেরাই স্বেচ্ছাসেবক, চোখেমুখে তাদের দৃপ্ত শপথ, আত্মশক্তিতে গভীর আস্থা-কোনও ভ্রুকটি, কোনও চণ্ডনীতিই তাহাদিগকে টলাইতে পারিবে না।’
রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে খবর আসলো দোকান-পাট, গাড়ী, বাস রিকশা সব বন্ধ। এমন হরতাল নাকি কোনদিন হয় নাই। এমনকি ২৯শে সেপ্টেম্বরও না। তবে আমার মনে হয় ২৯শে সেপ্টেম্বরের মতই হরতাল হয়েছে।’
সামরিক শাসনের ১৪৪ ধারা নির্যাতন, গণগ্রেফতার ও গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে দেশব্যাপী ছয় দফার দাবিতে ছাত্র কৃষক শ্রমিক যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করেন তাতে ছয় দফার জন্য জনগণের গভীর আবেগ প্রমাণিত হয়। রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘তারা ছয়দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যাক্তি স্বাধীনতা চায়। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, কৃষকের বাঁচবার দাবি তারা চায় এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল।’
৭ই জুন হরতালে ঢাকা, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকায় পুলিশ ও ইপিআর-এর গুলিতে সরকারি ভাষ্য অনুযায়ীই এগারজন নিহত হন। অনেকে গুরুতর আহত হন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতালে একদিনে এত লোকের প্রাণহানি পূর্বে আর কখনো ঘটেনি। নিহতদের মধ্যে তেজগাঁ শিল্প এলাকার বেঙ্গল বেভারেজের মনু মিয়া (সিলেট) এবং আজাদ এনামেল এ্যান্ড এ্যালুমিনিয়াম কারখানার শ্রমিক আবুল হোসেন (নোয়াখালী) ছিলেন। আবুল হোসেন ইপিআরের রাইফেলের সামনে বুক পেতে দেন এবং ইপিআর সদস্যরা তাঁর বুকেই গুলি চালায়।
রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। শুধু পাইপই টানছি যে এক টিন তামাক বাইরে আমি ছয়দিন খাইতাম, সেইটিন এখন চারদিনে খেয়ে ফেলি। কি হবে? কি হতেছে? দেশকে এরা কোথায় নিয়ে যাবে, নানা ভাবনায় মনটা আমার অস্থির হয়ে রয়েছে।’
ভয়াবহ একটা অস্থিরতার মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ জুন জেল প্রকোষ্ঠে পার করেন। নানা গুজব, সংবাদ কারাগরে ছড়াতে থাকে। বিশেষ করে ঢাকা, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলি চালানোর সংবাদে বিচলিত হল বঙ্গবন্ধু। এই হরতাল থেকে বঙ্গবন্ধু জনগণের ভালোবাসা ও অদম্য মানসিকতা বুঝার প্রয়াস পান। বিশেষ করে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা, ছাত্র ও কর্মিদের প্রতি গভীর ভালোবাসায় তিনি আপ্লুত হন। ডায়েরিতে লিখেন, ‘তাদের জন্য ভালবাসা দেওয়া ছাড়া আমার দেবার কিছুই নাই’। লিখছেন, “মনে শক্তি ফিরে এল এবং আমি দিব্যচোখে দেখতে পেলাম ‘জয় আমাদের অবধারিত’। কোন শক্তি আর দমাতে পারবে না।”
৮ই জুনের রোজনামচায় দেখা যায়, এই শহীদের রক্ত থেকে বঙ্গবন্ধু আগামীর শপথ নিচ্ছেন। ‘যে রক্ত আজ আমার দেশের ভাইদের বুক থেকে বেরিয়ে ঢাকার পিচঢালা কাল লাল করল, সে রক্ত বৃথা যেতে পারে না’। ৮ই জুনের রোজনামচার শুরুতেই বঙ্গবন্ধু কারাগারের পরিস্থিতির বিবরণ তুলে ধরেছেন। ‘তবে এদের ত্যাগ বৃথা যাবেনা। এই দেশের মানুষ তার ন্যায্য অধিকার আদায় করার জন্য যখন জীবন দিতে শিখেছে তখন জয় হবেই, কেবলমাত্র সময় সাপেক্ষ। শ্রমিকরা কারখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কৃষকরা কাজ বন্ধ করেছে। ব্যবসায়ীরা দোকান-পাঁট বন্ধ করে দিয়েছে। ছাত্ররা স্কুল কলেজ ছেড়েছে। এতবড় প্রতিবাদ আর কোনোদিন কি হয়েছে’?
বঙ্গবন্ধুর কারাগারের ভেতরে তথ্যের বড় একটি উৎস ছিল সংবাদপত্র । এইদিন অধিকাংশ পত্রিকাই সরকারি প্রেসনোট ছাড়া কিছুই ছাপায়নি। এই দিনের দিনলিখিতে কারাগারে গ্রেপ্তারকৃতদের নানা বিবরণ, এসব দেখে বঙ্গবন্ধুর অর্ন্তজ¦ালা বিধৃত হয়েছে। ‘পুরানা বিশ সেল থেকে ৮২ জন ছেলেকে নিয়ে গেছে, বয়স ১৫ বৎসরের বেশি হবে না কারও। অনেকের মাথায় আঘাত। অনেকের পায়ে আঘাত, অনেকে হাঁটতে পারে না’। ৯ জুনের দিনলিপির শুরুতেই বঙ্গবন্ধু লিখছেন, ‘ভোরবেলা বাহির হয়েই চোখ পড়ল পুরানা বিশে যাদের রাখা হয়েছে তারা দরজার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে’।
বঙ্গবন্ধু এই নির্বাক চেয়ে থাকার মানে বুঝেছিলেন। তিনি জানতেন এই অপলক কারারুদ্ধ দৃষ্টি কি চায়। জননেতার মূল বৈশিষ্ট্যই জনগনের আকাঙ্খা অনুধাবন করা। জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের এটি আরো বেশি প্রয়োজন হয়। কারণ জাতীয়তাবাদী নেতা কিংবা রাজনীতি সবটাই জন্ম নেয় জনগণের আকাঙ্খাকে পুজিঁ করে। শেখ মুজিব যে বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন, কিংবা বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল তার মূল কারণ অপলক চেয়ে থাকা এই বাঙালীর দৃষ্টি তিনি পড়তে পেরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে বসে ইতিহাসের যে বিবরণ রোজনামচায় তুলে ধরেছেন তার ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। একদিকে তিনি ইতিহাসের নির্মাতা। ৭ই জুনকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের অংশ হিসেবে জেলখানা ভরে ফেলার যে নীতি বঙ্গবন্ধু রোজনামচায় সেসব বিবৃতি করেছে। ইতিহাসের এত অনুপঙ্খ বিবরণ আর কোথাও পাওয়া যাবে না। ফলে রোজনামচায় ৭ই জুন কিংবা ছয় দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর যে বয়ান তা প্রকৃতঅর্থে ঐতিহাসিক দলিল। বিশেষ করে ৭ই জুনের আগের ও পরের কয়েকদিনের সরকারি নির্যাতনের, গ্রেপ্তারের যে বিবরণ তিনি কারাগারে থেকে দিয়েছেন তা ইতিহাসের উৎস হিসেবে অমূল্য। দাবি যখন হয়ে পড়ে জনগনের জন্য, তখন জনগনই এটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। জনগণের চাওয়া পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও দাবানো যায়নি। রোজনামচায় লিখছেন বঙ্গবন্ধু, ‘ছয় দফা জনগণের দাবি। পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচা মরার দাবি। এটাকে জোর করে দাবান যাবে না। দেশের অমঙ্গল করা হবে একে চাপা দেবার চেষ্টা করলে’। ২৫ জুলাই কারাগরের দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধু আবারো উল্লেখ করেছেন সেই বিষয়টি। ‘ ইংরেজ কত লোককে হত্যা করেছিল কিন্তু দাবাইয়া রাখতে পারে নাই। এই দেশে কত ছেলেকে ফাঁসি দিয়েছিল। অনেকেরই সে কথা মনে আছে গোপীনাথ সাহা, নির্মল, জীবন ঘোষ, রামকৃষ্ণ রায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, তারকেশ্বর আরও কত লোককে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছিল। তবু আন্দোলন দাবাতে পারে নাই। আন্দোলন আরও জোরে চলেছিল’। সত্যিকার অর্থে জেল-জুলুমে আন্দোলন আরো গতি পেয়েছিল। একদিকে ছয়দফার বাস্তবায়ন অন্যদিকে বন্দী বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি মিছিল, মিটিং সমাবেশে সামরিক শাসকের ভিত কাপিঁয়ে দিয়েছিল পূর্ববঙ্গের জনগণ। ৭ই জুনের পর যখন গ্রেপ্তার-নির্যাতন বেড়ে গেলো তখন অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে আপস করতে বললেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন আপস নিরর্থক। এটি করলে জনগনের চাওয়াটি হারিয়ে যাবে। কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে ওই সময় তার সঙ্গে দেখা করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। কিন্তু ৬-দফায় অটল, অনঢ় ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাদের বলেছিলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত মত ৬-দফার জন্য জেলে এসেছি বের হয়ে ৬-দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ও ৬-দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাটছে তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না’।
ছয়দফার তাৎপর্য ছিল বহুমাত্রিক। শ্রমিকদের রক্তে ছয় দফা আন্দোলন সর্বজনীনতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু গণমানুষের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ৬-দফা ছিল পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে আমাদের মুক্ত হওয়ার প্রথম প্রয়াস। এর আগে আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আরো অনেক এজেন্ডা ছিল কিন্তু ছয় দফা দেওয়ার পর থেকে জাতীয়তাবাদের বিষয়টি একমাত্র এজেন্ডায় পরিণত হয়। এই কর্মসূচি ঘোষণার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি।
একইসাথে ছয় দফা কেন্দ্রিক আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত হন। চলে এলেন একেবারে সম্মুখভাগে। ছয় দফা ঘোষণা না করলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন হতো না। বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে আগরতলা মামলার মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন হত না। ‘সত্য কথা সোজাভাবে বলেছি তাই সোজাসুজি জেলে চলে গিয়াছি। কাহাকে ভয় করে মনের কথা চাপা রাখি নাই। বার বার জেলে যেতে হয়েছে আর মামলার আসামী হতে হয়েছে। কিন্তু মনের কথা চাপা রাখি নাই। জেলে যেতে হবে জেনেও ছয়-দফা জনগণের কাছে পেশ করেছিলাম। যদিও জানা ছিল শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর আঁতে ঘা লাগবে। ঝাঁপাইয়া পড়বে আমার ও আমার সহকর্মীদের উপর। অত্যাচার চরম হবে, তবুও গোপন করি নাই’।
এই আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ বাঙালি নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উঠতি ব্যবসায়ী, ছাত্র, শ্রমিক ও সাধারন বুদ্ধিজীবি সকলের অকুণ্ঠ সমর্থন অর্জন করতে শুরু করে। এসময় আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আশা আকাক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়। ৬-দফা ঘোষণা হওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগই জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে অত্যন্ত কার্যকর ও অর্থবহ হিসেবে স্বায়ত্বশাসন দাবির সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়। ছয়দফা বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোকে অনুপ্রানিত এবং সংঘবদ্ধ হতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। স্বল্প সময়েই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মুল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়।
কারাগারের রোজনামচার ভূমিকার সমাপ্তিতে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘এ ডায়েরি পড়ার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতার উৎস খুঁজে পাবেন’। সত্যিকার অর্থে আমাদের স্বাধীনতার উৎসমূল ৬-দফা। আমাদের বিকাশে যে পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজন সেই দাবি প্রথম তোলা হয়েছিল ছয় দফাতে। জনগণকে আন্দোলনের সাথে যুক্ত করার প্রথম প্রয়াসও ছয় দফা। ৭ই জুন পুলিশের গুলিতে যারা মারা গিয়েছিলেন তারা অনেকেই জানতেন না ৬-দফার কোন দফায় কি আছে। তাহলে তারা কেন প্রাণ দিলেন, কারন তারা জানতেন বঙ্গবন্ধুকে। দফা-টফা না বুঝলেও তারা বুঝত শেখ মুজিবকে।
শেখ মুজিবর রহমান ছয় দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাধারণের বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হয়। সাধারণের নেতায় পরিণত হওয়াটি বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল। ফলে জনগণের বিশ্বাস জন্মেছিল বঙ্গবন্ধু পারবেন। তার বহিঃপ্রকাশ পরবর্তীতে দেখা যায় সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে কিংবা ৭ মার্চে। সর্বোপরি জনগণের এই বিশ্বাস একাত্তরের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল। যেই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আমাদের সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল।
ছয়দফা মূলত পাকিস্তানী শাসনে পূর্ববঙ্গের জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা তারই অত্যাশ্চার্য সংক্ষিপ্ত বহিঃপ্রকাশ। পূর্ববাংলার জনগণ দীর্ঘকাল ধরে যে রাষ্ট্র, গণতন্ত্র কিংবা মর্যাদার কথা ভেবেছেন সবটাই উল্লেখ রয়েছে তাতে। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথের যাত্রাবিন্দু বলা যায় এটিকে। আর ইতিহাসের এই বিপ্লবী সময়ের নিখুঁত বিবরণ পাওয়া যায় ‘কারাগারের রোজনামচায়’।