নির্বাচন তো ‘অর্থবহ’ও হতে হয়। এতে ভোটারদের জন্য থাকতে হয় ‘বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প’। দলীয় সরকারের অধীনে আয়োজিত নির্বাচনে আর সবাই অংশ নিলেও—মাঠের বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নিলে সেটি স্বভাবতই ঘটবে না।
Published : 21 Jul 2023, 09:45 AM
নির্বাচনের পরিবেশ দেখে সদর দপ্তরে রিপোর্ট করতে আসা ইইউ প্রতিনিধিদলটি রাজধানীতে অবস্থানকালে ঢাকা-১৭ উপনির্বাচন যেভাবে অনুষ্ঠিত হলো, সেটা নির্বাচন কমিশন ও সরকারের জন্য ইতিবাচক হলো না। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার সময়টায় অনেক টিভি ক্যামেরার সামনে প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী যেভাবে আক্রান্ত হলেন, তাতে নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা কারও হবে না।
নির্বাচনটি হয়ে যাওয়ার পর জাল ভোটের কিছু অভিযোগও উঠে এসেছে প্রধানত ফেসবুক ও ইউটিউবে। ভোট কিনতে অর্থ বিতরণের কিছু অভিযোগও ওই অঞ্চলে বসবাসকারীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। তারপরও নির্বাচন কমিশনের হিসাবে ভোট পড়েছে ১২ শতাংশের কম। যে দেশে ৮০ শতাংশের বেশি ভোটেরও নজির আছে, সেখানে এত কম অংশগ্রহণ নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি ভোটারের তীব্র অনাস্থারই প্রকাশ।
এদিকে জাতীয় নির্বাচনের বেশি বাকি নেই। এ অবস্থায় ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ রক্ষায় উপনির্বাচন আয়োজন করতে হয়েছে। এমন নির্বাচন করতে না হলেই যে ভালো হতো, এমনটাই সাধারণ মানুষের ভাবনা। এতে তো রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এই মানের নির্বাচন হতে থাকলে জনগণ এটাকে তাদের কষ্টার্জিত অর্থের অপচয় বলেই মনে করতে পারে, করাটাই স্বাভাবিক। জনগণের অর্থের আরও নানান অপচয় অবশ্য রয়েছে।
ইতোপূর্বে যে দুটি জাতীয় নির্বাচন করা হয়, সেগুলোয়ও ভোটারের অংশগ্রহণ ছিল খুব কম। যে প্রেক্ষাপটেই অনুষ্ঠিত হোক, ওই নির্বাচন দুটিতে জনইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি। তারপরও ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায়’ সেগুলো সম্পন্ন হয়েছে। তার ভেতর দিয়ে গঠিত হয়েছে সরকার এবং ওই সরকারই একের পর এক বাজেট ঘোষণা করে দেশ পরিচালনা করে যাচ্ছে। তার রাজস্ব আহরণের অধিকার নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। এটা হলো বাস্তবতা।
সামনে যে জাতীয় নির্বাচন রয়েছে, সেটি সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের কথা অবশ্য বলছে সরকার। জনগণকে যত না, তারচেয়ে বেশি বলা হচ্ছে এ নির্বাচন নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদেরকে। ২০১৪ ও ১০১৮ সালের নির্বাচন ঘিরে তাদের এতটা আগ্রহ অবশ্য পরিলক্ষিত হয়নি। তাই বলে কোনো বিদেশি শক্তির আগ্রহই পরিলক্ষিত হয়নি, সেটা নয়। ২০১৪-এর নির্বাচনে এদেশের রাজনীতিতে বরাবরই প্রভাবশালী প্রতিবেশী দেশ ভারতের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা রয়েছে। এবার তাদের ভূমিকা এখনও স্পষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাই এক্ষেত্রে বেশি এবং ক্রমে আরও স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত। বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু করার কথা বলে তারা বিশেষ ভিসানীতিও ঘোষণা করেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া বিনষ্ট করতে যারাই ভূমিকা রাখবে, তারা পড়বে এর আওতায়। নির্বাচনের অনেক আগে এ ধরনের নীতি গ্রহণের ঘটনা বলতে গেলে নজিরবিহীন।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোও নাকি একই নীতি অনুসরণ করবে। এ দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের গভীর থেকে গভীরতর নানামাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে। ইতোপূর্বেও নির্বাচন ও গণতন্ত্রের সংকটকালে লক্ষ করা গেছে তাদের ভূমিকা। পশ্চিমাদের অনুসৃত নীতিকাঠামো অর্থনীতির পাশাপাশি আমাদের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিকেও প্রভাবিত করেছে। এখন বলা হচ্ছে, ভূরাজনৈতিক স্বার্থও বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন বিষয়ে তাদেরকে সবিশেষ আগ্রহী করে তুলেছে। তাই বলে তারা রীতিবিরুদ্ধ দাবি কিন্তু তুলছে না। তারা বলছে, নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এদেশের জনগণ। নির্বাচন ঘিরে তীব্র মতপার্থক্য নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপে আগ্রহ থাকলেও তারা বলছে, এতে তারা সম্পৃক্ত হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সবশেষ প্রতিনিধিদলটি ফিরে যাওয়ার আগে গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব বিষয় তারা স্পষ্ট করেছে। এতে ক্ষমতাসীন মহলে পরিলক্ষিত হচ্ছে কিছুটা স্বস্তি। প্রকাশ্যে যা বলা হয়েছে, তার বাইরে কোনো পর্যায়ের একান্ত আলাপে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা গভীরতর কোনো মনোভাব ব্যক্ত করে গেছেন কিনা, সেটা জানার সুযোগ অবশ্য নেই। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তার বক্তব্যে অনেক সময় ক্ষমতাসীনদের কথাবার্তা বদলে যেতে দেখা যায়। নতুন ধারায় শুরু হয় তাদের বক্তব্য প্রদান। এদিকে মাঠের বিরোধী দল বিএনপির নেত্রী এখনও আছেন সক্রিয় রাজনীতির বাইরে। এ অবস্থায় দলের মহাসচিবের বক্তব্যেই তাদের অবস্থান প্রকাশ পাচ্ছে। এতে বিদেশে অবস্থানরত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের মনোভাবও স্বভাবতই প্রতিফলিত।
আগামী নির্বাচনে দলটি অংশ নিতেই চাইছে এবং মনে করছে, তখন একটি নির্দলীয় সরকার দায়িত্বে থাকলে তারা সহজেই জিতে যাবে। তিন-তিনটি মেয়াদে তারা আছে ক্ষমতার বাইরে এবং একটি দাপুটে সরকারের চাপের মুখে। এ অবস্থায় আরও একটি মেয়াদ ক্ষমতার বাইরে থাকতে হলে দল হিসেবে অস্তিত্ব ধরে রাখাই হয়তো কঠিন হবে। তাই নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠাকেই তারা করে তুলেছে কেন্দ্রীয় দাবি। তার সহযাত্রী দল আর গ্রুপগুলোও এ বিষয়ে গভীরভাবে একমত। ক্ষমতাসীনদের দীর্ঘদিনের মিত্র জাতীয় পার্টিও বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তবে শেষপর্যন্ত দলীয়ভাবেই নির্বাচন আয়োজিত হলে তারা কী করবে, বলা কঠিন। সরকার তো তেমন নির্বাচন আয়োজনের পথেই এগোচ্ছে। স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে রেখেই নির্বাচন। এতে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কিনা, সেটা তাদের ব্যাপার। সবশেষ গণভবনে আয়োজিত ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী মোটামুটি একই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।
এখন যেটুকু সময় হাতে আছে, তাতে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করার মতো আন্দোলন বিএনপি গড়ে তুলতে না পারলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এ ব্যাপারে তাকে সহায়তা জোগাবে কি? প্রকাশ্যে ‘অসাংবিধানিক’ দাবিতে তাদের সমর্থন দেওয়ার কথা নয়। তারা আবার জানে, নির্দলীয় সরকারের মাধ্যমেই এদেশের জাতীয় নির্বাচনগুলো কমবেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। আর তাতে প্রতিবারই সরকার পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেয় জনগণ। সুযোগ থাকলেও কোনো শাসক দলকেই তারা ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে চায়নি। এটা তাদের দুর্ভাগ্যও! তবে সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য বোধহয় ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগটাই হারিয়ে ফেলা, যা নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনঅনাস্থাই তীব্র করে তুলেছে। গুলশান উপনির্বাচন এর সর্বসাম্প্রতিক প্রমাণ।
ইতোপূর্বের দুটি জাতীয় নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্য হয়নি, সরকার কিন্তু তা অস্বীকার করছে না। নির্বাচন প্রশ্নে তাদের দিক থেকে এটুকু ইতিবাচক। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয়ে ‘প্রতিশ্রুতি’ দিলেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তা বিশ্বাস করছে না। ২০১৮-এর নির্বাচনটি তাদের বিশ্বাসভঙ্গের সবশেষ কারণ। এখন তাদের মধ্যে কিছুটা বিশ্বাস উৎপাদনের জন্যও কার্যকর কোনো ছাড় দেওয়া কি ক্ষমতাসীনদের পক্ষে সম্ভব? সেটা সম্ভব হলেও প্রশ্ন হলো, এ নিয়ে কাজ করবেন কারা? এদিকে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে কোনোভাবেই কোনো নির্বাচন নয়—বিএনপি এতটাই অনড় হয়ে আছে কিনা, কে বলবে। তারা হয়তো বিশ্বাস করে বসে আছে, হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো খুবই সম্ভব এবং তাদের এতদিনের সাজানো প্রশাসনও তখন ‘নিরপেক্ষ’ করে নেওয়া যাবে।
এ অবস্থায় নির্দলীয় সরকারের ব্যবস্থা না হলে ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন করা বোধহয় যাবে না। নির্বাচন তো ‘অর্থবহ’ও হতে হয়। এতে ভোটারদের জন্য থাকতে হয় ‘বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প’। দলীয় সরকারের অধীনে আয়োজিত নির্বাচনে আর সবাই অংশ নিলেও—মাঠের বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নিলে সেটি স্বভাবতই ঘটবে না। তাহলে পশ্চিমারা যে ‘অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র’ ও ‘স্থিতিশীল বাংলাদেশের’ কথা বলছে, তার সূত্রপাত হবে কীভাবে? এ জায়গাটায় অগত্যা তাদেরই বোধহয় প্রকাশ্যে না হলেও নীরবে কাজ করতে হবে। সেখানে নিহিত রয়েছে বিএনপির আশা। তার দাবি যত যুক্তিপূর্ণই হোক—নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার প্রশ্নে তো আদালতে হেরে বসে আছে দলটি। এদেশের বাস্তবতায় সুতীব্র আন্দোলনের আঘাতই কেবল পারত সরকারকে এ প্রশ্নে নমনীয় করে আনতে। সেটা যে কারণেই হোক, ঘটেনি। এখন সামনের ক’মাসে তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টির সম্ভাবনা কি রয়েছে?
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার সরকারকে চায় না এবং তাদের ক্ষমতা আছে সরকারের পতন ঘটানোর। অপছন্দের সরকারকে কাবু করতে আরও কার্যকর হাতিয়ার কিন্তু আছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের। এর প্রয়োগ তারা ঘটাবেই, সে নিশ্চয়তা অবশ্য নেই। সরকার কেমন নির্বাচন করে, সে পর্যন্ত অপেক্ষাও করতে পারে তারা। আন্দোলন যথেষ্ট তীব্র করতে ব্যর্থ হলে বিএনপিও হয়তো সে নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেখাতে চাইবে নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রয়োজনীয়তা। ‘চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবেই’ এমনটা করতে পারে তারা। তখন হয়তো আরও একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি পশ্চিমা মহল থেকেও উঠবে। একই অর্থবছরে দু-দুটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে তখন দ্বিগুণ হয়ে যাবে জনগণের অর্থ ব্যয়। এই কঠিন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সময়ে সেটা কি কারও কাম্য হতে পারে? গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সঙ্গে স্থিতিশীলতার প্রশ্নও জড়িত আছে।