নেতানেত্রীদের ‘এই করেছি, সেই করেছি’ এই বিজ্ঞাপনটা বন্ধ করতে হবে। তারা নিজেদের পকেটের টাকায় কিছু করেন না। জনগণের করের টাকায় করেন। তাদের বোঝা উচিত, মানুষের সেবা করাটা তাদের কাজ।
Published : 17 Sep 2024, 04:38 PM
বদল, পরিবর্তন, সংস্কার, রূপান্তর। বর্তমান সময়ের আলোচিত কয়েকটি শব্দ। দেশের সব মানুষই আসলে পরিবর্তন চায়। সেটা এক দলের পরিবর্তে আরেক দলের শাসন নয়, বরং একটা প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন। ব্যবস্থার পরিবর্তন। যে ব্যবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেলে চাইলেই স্বৈরাচার হতে পারবে না। লুটপাট করতে পারবে না। প্রশাসন ও পুলিশকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারবে না। নিয়ম মেনে ভোটাভুটির মাধ্যমে নেতা নির্বাচন হবে। পরিবারতন্ত্র, অর্থ, পেশিশক্তি নেতৃত্ব নির্বাচনে মূল নিয়ামক হবে না। কোনো ধরনের অপকর্মের অভিযোগে অভিযুক্তরা দলের সদস্য হতে পারবেন না। দল, রাষ্ট্র ও সমাজের সকল পর্যায়ে সুশাসন ও জবাবদিহি থাকবে।
আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, স্বাধীনতার পর দীর্ঘ পাঁচ দশকেও দেশে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা বিকশিত হয়নি। উল্টো রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরতন্ত্রের প্রতিভূ শুধু নয়, হিংস্র দানবে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতায় গেলে সেই দানব চায় যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে। আর ক্ষমতায় যেতে না-পারা দল চায় যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় যেতে। ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে এবং ক্ষমতায় যেতে দলগুলো এমন কোনো কুকর্ম নেই যা করে না।
এবারের ছাত্রগণঅভ্যুত্থানে মানুষ কিন্তু একটা কার্যকর পরিবর্তন দেখার আকাঙ্ক্ষা থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে। শিক্ষার্থীরা অকাতরে বন্দুকের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবন দিয়েছে। আন্দোলনকারীরাই শুধু নয়, দেশের কেউই আসলে গতানুগতিক ও হিংস্র রাজনীতি আর দেখতে চায় না। দেখতে চায় না মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ রাজনৈতিক দলগুলোকে। তারা বদল বা পরিবর্তন চায় রাজনীতির, রাজনৈতিক নেতৃত্বের। বদল চায় নেতা হওয়ার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির। রাজনৈতিক দলের কাঠামো, গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচির।
কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো পরিবর্তিত হওয়ার, নতুনভাবে নিজেদের নীতি-কর্সসূচি, দল ও নেতৃত্বকে সাজানোর কোনো তাগিদ ও অঙ্গীকার চোখে পড়ছে না। বিএনপি অতীতের মতোই দখলদারিত্ব কায়েমে ব্যস্ত রয়েছে। নেতাদের মুখে অতীতের কার্যক্রমের কোনো মূল্যায়ন নেই। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। ব্যর্থ-বাতিল নেতৃত্ব পরিবর্তনেরও কোনো আলামত নেই। আওয়ামী লীগেরও একই দশা। আত্মগোপনে থাকা দলের কোনো কোনো নেতা যেসব বিবৃতি পাঠাচ্ছেন, তাতে তাদের মধ্যেও কোনো পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দৃশ্যমাণ হচ্ছে না। তাদের মধ্যেও অতীতের কৃতকর্মের জন্য কোনো অনুশোচনা নেই, সাধারণ মানুষের কাছে কোনো ক্ষমাভিক্ষা নেই। নেতৃত্ব পরিবর্তনের কোনো তাগিদ বা আকাঙ্ক্ষা নেই। আছে কেবল আবার ফিরে আসার ‘আশাবাদ’। তারা কোত্থেকে ফিরে আসবে? কেন দলের সব নেতা আত্মগোপনে? তাদের এত ইমেজ সংকট কেন হলো? কেন ঢালাওভাবে সবাইকে আত্মগোপনে থাকতে হলো? এসব বিষয়ে কোনো আত্মমূল্যায়ন নেই। নেই কোনো আত্মসমীক্ষা। তারা আবার আসবেন, রুখে দাঁড়াবেন, প্রতিশোধ নেবেন-বলা না-বলা কথা তাদের এইটুকুই!
এদিকে ধর্মাশ্রয়ী দলগুলোও কোনো রকম পরিবর্তনের ধার ধারছে বলে মনে হচ্ছে না। নারীদের ব্যাপারে, আবহমান বাংলা সংস্কৃতির ব্যাপারে, দেশের আদিবাসী ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে তাদের অবস্থান কী, ‘ইনক্লুসিভ’ সমাজ তারা কীভাবে কাদের নিয়ে গঠন করতে চায়, সে ব্যাপারেও তারা নীরব। এ পরিস্থিতিতে দেশের রাজনীতি নিয়ে আবারও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। সেই পুরনো চিন্তা, পুরনো, স্লোগান, পুরনো নেতৃত্ব, পুরনো কায়দায় দল ও নেতৃত্ব নির্বাচনের পদ্ধতিই যদি বহাল থাকে, তাহলে এত রক্তপাতের মাধ্যমে সরকার উচ্ছেদ তো ব্যর্থতার উদাহরণে পরিণত হবে মনে হচ্ছে।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কিন্তু এখন আর রাজনীতির নামে সেই পুরনো ‘বান্দরনাচ’ দেখতে চায় না। সবাই ইতিবাচক পরিবর্তন চায়। মনে রাখা দরকার যে, আমরা সবাই কিন্তু কমবেশি রাজনীতির মানুষ। রাজনীতি আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত রাজনীতি আমাদের মোহভঙ্গ ঘটিয়েছে। রাজনীতিবিদরা বিশ্বাস হারিয়েছেন। রাজনীতি মানে তো দায়িত্ব! দায়িত্বশীল হওয়া, দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন করা। রাজনীতিবিদরা দেশের প্রতি আসলে কতটা অনুগত, তা নিয়ে জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশের রাজনীতি দল ও নেতানেত্রীকে ভালোবাসতে শেখায়। দেশ বা দেশের মানুষ তাদের কাছে বড় নয়। চারদিকে ব্যক্তিপূজার মহাসমারোহ। সবাই নিজেকে নেতা ভাবেন। আর অন্ধ ভক্তরাও নেতার শ্রীচরণে নিজেকে সমর্পণ করে বসে থাকেন।
নিজ দলের নেতানেত্রী ও তাদের প্রয়াত আত্মীয়স্বজনদের নামেও কেত্তন গাওয়া হয়। তাদের বিক্রি করা হয়। নেতানেত্রীদের নামে যা যা প্রতিষ্ঠান, ভবন, রাস্তা, দোকানপাট রয়েছে, গোটা বিশ্বে এমন আর কোথাও নেই। পণ্য বিক্রি করার মতো নিজেদের দলের নেতানেত্রীকে বিক্রি করার প্রবণতাটা বন্ধ হওয়া উচিত। আমাদের দেশে ৮০ শতাংশ মানুষ ‘দিন আনা দিন খাওয়া’। তাদেরকে পেশির জোরে রাজনৈতিক মিছিলে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতাটাও বন্ধ হওয়া উচিত। চাটুকারিতা, তেলবাজি, নেতানেত্রীদের নামে বন্দনাগীতি– এসবেরও উচ্ছেদ প্রয়োজন।
রাজনৈতিক নেতারা কাজ করবেন নীরবে, নিভৃতে। প্রত্যেক জায়গায় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অবশ্যই প্রচারে যাবেন। ভদ্রভাবে তথ্য ও যুক্তি দিয়ে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। তারা কী করেছে, আর কী করতে চান। মানুষ জেনে-বুঝে সিদ্ধান্ত নেবে। নেতানেত্রীদের ‘এই করেছি, সেই করেছি’ এই বিজ্ঞাপনটা বন্ধ করতে হবে। তারা নিজেদের পকেটের টাকায় কিছু করেন না। জনগণের করের টাকায় করেন। তাদের বোঝা উচিত, মানুষের সেবা করাটা তাদের কাজ। তারা মানুষকে দয়া করছেন না। কিন্তু বাস্তবে তারা নিজেদের জমিদার বা সম্রাট মনে করেন। এই মনে করাটা বন্ধ হওয়া দরকার।
রাজনৈতিক দল কর্মসূচি পালন করবে নির্দিষ্ট মাঠে, খোলা জায়গায়। কিন্তু রাস্তা আটকে, পথচারীদের ভোগান্তির মুখে ঠেলে দিয়ে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম চলবে না। রাজনৈতিক দল পত্রিকায়, রেডিও-টিলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের মতাদর্শ ও বক্তব্য প্রচার করবে। সামাজিক মাধ্যমে ফাটিয়ে প্রচার চালাবে। কিন্তু রাস্তা-আটকে, অন্যের সমস্যা সৃষ্টি করে কিছু করতে পারবে না। একটা রাজনৈতিক দলের মিছিলের জন্য যেন কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। সব রকমের তদ্বির বন্ধ করতে হবে। এক জন রাজনৈতিক নেতার আত্মীয়-পরিচিত যত সহজে সরকারি হাসপাতালে বেড পেয়ে যান, সাধারণ মানুষ কেন সেই সেবা পান না? কেন তাদের অবহেলায় শুয়ে থাকতে হয় সরকারি হাসপাতালের বারান্দায়? কেন স্থানীয় সরকারের সেবা পাবার জন্য ভোগান্তির শিকার হতে হয়?
শাসন, ক্ষমতাসীন শব্দগুলো বদলে ফেলতে হবে। কেন রাজনৈতিক নেতারা সেবা না করে শাসন করবে? শাসকদল বলে তো গণতন্ত্রে কিছু নেই। সরকার শাসন করে না। সরকার সেবা করে, পরিষেবা দেয়। কিন্তু আমরা বলি শাসকদল। কিসের শাসক দল? শাসকদল বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা থাকা উচিত নয়।
রাজনীতির সংজ্ঞাটা বদলে দেওয়া দরকার। রাজনীতিতে এলেই যে ক্ষমতা ও সুবিধা পাওয়া যায়, সেগুলো প্রথমেই খর্ব করে দেওয়া উচিত। জীবনে এক বার সংসদ সদস্য হলে সরকারি প্লট, শুল্কমুক্ত গাড়ি পেয়ে যাওয়ার সুযোগগুলো বন্ধ হওয়া দরকার। এই ধরনের সুযোগ-সুবিধাগুলো বন্ধ হলে ‘সেবা করার ইচ্ছে’ বা প্রবণতা কমে যাবে। সেবার নামে লুটপাট বন্ধ হয়ে যাবে।
আর প্রশাসনকে মানুষ কেন ভয় পাবে? প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ভুলে যায়, দেশ স্বাধীন, দেশের মানুষও স্বাধীন। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের লাটসাহেব ভাবে, সাধারণ মানুষকে মনে করে তাদের ভৃত্য। কেন তাদের স্যার, মহোদয় বলতে হবে? জ্যেষ্ঠতা মেনে তারা বরং সেবাগ্রহীতা মানুষকে স্যার বলবেন। মানুষ কেন ডিসি, এসপি, উইএনও, ওসিদের ভয় পাবে? কেন মানুষ তাদের সামনে স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ বোধ করবে না?
প্রশাসনিক কর্তা ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাদের অতিরিক্ত সুবিধা, ক্ষমতা, নিরাপত্তা এগুলো তুলে দেওয়া উচিত। দেশ থেকে ভিআইপি, ভিভিআইপি কনসেপ্ট তুলে দিতে হবে। যারা দেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে আনবেন, বিজ্ঞানে গবেষণায়, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে যারা দৃষ্টান্তমূলক কিছু করবেন, বড় জোর তারা এবং দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা বিশেষ মর্যাদা পেতে পারেন। প্রতিবন্ধীরাও বিশেষ মর্যাদা পেতে পারেন। এর বাইরে রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের ভিআইপি বা ভিভিআইপি মর্যাদা প্রদানের কালচার অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। রাজনীতির ময়দানে বিতর্কসভা কনসেপ্ট চালু করতে হবে। এখন মঞ্চে উঠে যে যা পারছে, বলছে। কারো বক্তব্য চ্যালেঞ্জ জানানোর সুযোগ নেই। মিথ্যা বলার জন্য কাউকে দণ্ড প্রদানেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। নেতা, আমলা, ধনিকদের ভাষণের দায়িত্ব তাদের নিজেকেই নিতে হবে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে বুঝ দেওয়া, ভুল পথে চালিত করা, নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করাও এক ধরনের প্রতারণা। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করতে হবে। ভুল প্রোপাগান্ডা ছড়ানো, মিথ্যা বলা বন্ধ করতে হবে।
দেশের জন্য একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ দরকার। এটা নিশ্চিত করতে না পারলে কিছু দিন পর দেশ ‘স্বাধীন’ হতে থাকবে। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কার্যকর কোনো পরিবর্তন বা উন্নয়ন হবে না।