আবারও মদিনা সনদ

রাষ্ট্রীয় গঠনতন্ত্রে রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যনীতি, বাণিজ্যনীতিসহ জীবন সংশ্লিষ্ট বিষয় থাকে। মদিনা সনদের মূল বিষয় শুধু মুসলিম-অমুসলিমের মধ্যে যুদ্ধ-শান্তিসহ পারস্পরিক সম্পর্ক।

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 22 Oct 2022, 03:27 PM
Updated : 22 Oct 2022, 03:27 PM

“... মদিনা সনদ পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান, সেখানে সব সম্প্রদায়ের লোক মিলে এক জাতি গঠন করার কথা বলা আছে।”- প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

চলতি মাসের ১৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আয়োজিত ‘হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং একটি মানবিক বিশ্ব’ শীর্ষক আলোচনা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে এ কথা বলেন তিনি। (সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)

মদিনা সনদ বলছে - “ইহা রসুল মুহম্মদের পক্ষ হইতে মুমিনগণ, কুরাইশ মুসলিমগণ এবং মদিনার যাহারা তাহাদের পরে আসিয়া যোগ দিয়াছে ও পরিশ্রম করিয়াছে তাহাদের ভিতরে সম্পর্ক স্থির করিবার জন্য। তাহারা সকলে এক উম্মা।”

অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি সঠিক বলেছেন, সব সম্প্রদায় মিলে এক জাতি গঠন। ইসলাম যদি শান্তি হয়, তবে সে শান্তি ওখানেই আছে।

কিন্তু আগে মাঝে মাঝেই একটা আশ্চর্য দাবি শোনা গেছে - “মদিনা সনদ একটা গঠনতন্ত্র, এই গঠনতন্ত্র মোতাবেক দেশ চলবে।”

দেখা যাক দলিলটা আসলেই কী এবং সেটা দিয়ে দেশ চালানো সম্ভব কিনা।

কোনও সংগঠনের গঠনতন্ত্রে তার উদ্দেশ্য ও কর্মকাণ্ড পরিচালনার পদ্ধতি লেখা থাকে। রাষ্ট্র একটা রাজনৈতিক সংগঠন, তারও গঠনতন্ত্র থাকতে হয়। নবীজী (স.) ৬২২ সালে মক্কা থেকে মদিনায় এসে পরের বছর মদিনার অমুসলিমদের কাছে এই প্রস্তাব পেশ করেন। দলিলটি রয়েছে ড. হামিদুল্লাহ-র ‘দ্য ফার্স্ট রিটেন কনস্টিটিউশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইতে, দলিলে এর নাম 'সহিফা’ - পৃষ্ঠা ১২। নবীজীর (স) সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জীবনীর একটি ইবনে হিশাম ইবনে ইশাক গ্রন্থ  ‘সিরাত’-এর ২৩১-২৩৪ পৃষ্ঠায় বিস্তারিত বর্ণনা অনুযায়ী এটা ‘দ্য কভেন্যান্ট বিটুইন দ্য মুসলিমস অ্যান্ড দ্য মেডিনিয়ান্স অ্যান্ড দ্য জিউস’ অর্থাৎ ‘মুসলিম ও মদিনাবাসী এবং ইহুদিদের মধ্যে চুক্তি’।    

রাষ্ট্রীয় গঠনতন্ত্র সুবিশাল ও ব্যাপক, যার মধ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যনীতি, বাণিজ্যনীতি ইত্যাদিসহ জীবন সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার বিষয় থাকে। কিন্তু ওই দলিলটার মূল বিষয় শুধু মুসলিম-অমুসলিমের মধ্যে যুদ্ধ-শান্তি সহ পারস্পরিক সম্পর্ক। সেজন্যই শারিয়াপন্থিরাও ওটাকে বলেছেন ‘চুক্তি’, ‘শান্তিচুক্তি’ ইত্যাদি; যেমন: "রসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসরত ইহুদী গোত্রসমূহের মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ইহুদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে না এবং কোন আক্রমণকারীকে সাহায্য করবে না। তারা আক্রান্ত হলে মুসলমানগণ তাদেরকে সাহায্য করবে। মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিভঙ্গের অপরাধে বনী-কুরায়জা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও বন্দি হয়েছে।… শান্তিচুক্তিতে আরও অনেক ধারা ছিল। … ওহুদ যুদ্ধ পর্যন্ত তাদেরকে বাহ্যত এই শান্তিচুক্তির অনুসারী দেখা যায়।…” 

(মওলানা মুহিউদ্দিনের অনুদিত বাংলা-কোরান পৃষ্ঠা ৪৮, ৩৩৫ ও ১৩৪৯।) 

এমনকি শারিয়ার কেতাবও ওটাকে ‘গঠনতন্ত্র’ বলেনি, বলেছে ‘মদিনা চুক্তি’ এবং ‘মদিনা সনদ’ (বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৬০)।   

সহীফাটা অনেক কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ। শারিয়া আইনে ইচ্ছাকৃত খুনের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড (বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন ১ম খণ্ড ধারা ৪১)। 

ড. হামিদুল্লাহ'র ‘দ্য ফার্স্ট রিটেন কনস্টিটিউশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বই থেকে উদ্ধৃতি দিই (পৃষ্ঠা ৪৫ ও ৪৭): “কেহ যদি কোন মুসলিমকে ইচ্ছাকৃতভাবে খুন করে ও তাহা প্রমাণিত হয়, তবে নিশ্চয়ই খুনির মৃত্যুদণ্ড হইবে”- ধারা ২১, এবং “কোন অবিশ্বাসীকে খুন করার বদলে কোন মুসলমান অন্য মুসলমানকে খুন করিবে না”- ধারা ১৪। এমন পক্ষপাতদুষ্ট অন্যায় চুক্তি প্রস্তাব করা কোন নবী-রসূল তো দূরের কথা কোন বিবেকমান মানুষের পক্ষেও সম্ভব নয়। কিন্তু নবীজী (স.) নাকি বলেছেন, কোনো মুসলিম যদি কোন অমুসলিমকে খুন করে সেক্ষেত্রে খুনি মুসলিমের মৃত্যুদণ্ড হবেনা (সূত্র: সহি বুখারী ১ম খণ্ড হাদিস ১১১ ও ৪র্থ খণ্ড হাদিস ২৮৩, সুনান আবু দাউদ হাদিস ২৭৪৫, ইমাম শাফি'র ‘রিসালা’ পৃষ্ঠা ১৪২ ইত্যাদি)।

এসবের ভিত্তিতেই শারিয়া আইন বানানো হয়েছে: “ইসলামি রাষ্ট্রে কোন অমুসলিমকে হত্যার অপরাধে কোন মুসলমানের মৃত্যুদণ্ড হইবে না” (দ্য পেনাল ল অব ইসলাম পৃ: ১৪৯)। 

সমস্যাটার গভীরতা ও জটিলতা বুঝতে পারছেন? এখনকার প্রেক্ষিতে এই আইন আলেমরা বাতিল করতে বা বদলাতে গেলেই একদল স্বার্থান্বেষী ওই হাদিসগুলোকে ব্যবহার করে হিমালয় হয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়াবে। নবীজীর (স.) নাম ব্যবহার করে শারিয়া কেতাবে ও হাদিসগুলোয় এমন অজস্র বিষয় ঢুকে পড়েছে, যেগুলো ফাঁক তৈরি করেছে।

যেমন, মদিনায় তখন মোটামুটি দশ হাজার লোকের বাস (হামিদুল্লাহ পৃঃ ১৩)। আর মুসলিমের সংখ্যা মুহাজির-আনসার সব মিলিয়ে মাত্র দুইশ (সূত্র: দ্য প্রসেস অব ইসলামিক রেভল্যুশন- মওদুদি, পৃঃ ৪২)। ওটা ওই অমুসলিমদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি। সেই দশ হাজার লোকের নেতারা নিজেদেরই দেশে বসে নিজেদেরই বিরুদ্ধে এই অন্যায় অপমানকর চুক্তিতে রাজি হবে মাত্র দুইশ জনের নেতার সাথে যার বেশির ভাগ বিদেশি? প্রশ্নই ওঠে না। নেতা কখনো নেতাগিরি ছাড়তে চায়? প্রশ্নই ওঠে না। ওরা নবীজীকে আল্লাহর রসুল বলেই মানেনি, তার নেতৃত্ব মানবে কেন? প্রশ্নই ওঠে না।  

ইসলামের রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় এমন অজস্র ফাঁক ও ফাঁকি আছে, সেগুলো প্রধানত হাদিস ভিত্তিক। হাদিসে এরকম অজস্র সমস্যার জন্যই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ওগুলো বাদ দিয়ে হাদিসের ‘পরিচ্ছন্ন’ কপি বানানোর সরকারি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। ইন্টারনেটে ‘The Turkish Hadith Project’ খুঁজলেই সে তথ্য পাওয়া যাবে। আলেম-উলামাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দুনিয়ার সর্ববৃহৎ ইসলামী সংগঠন ‘নাহদলাতুল উলামা’ আরো দুটো সংগঠনের সাথে মিলে বিশ্ব মুসলিমকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন তাদের ‘The illusion  of  an  Islamic  State’ (ইসলামী রাষ্ট্রের বিভ্রম) বইতে। এমন অজস্র কেতাবের মধ্যে আছে। বিশ্বের সর্বোচ্চ শারিয়া বিশেষজ্ঞদের অন্যতম ডক্টর হাশিম কামালী-র ‘প্রিন্সিপলস অব ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স’- এ একই সতর্কবাণী রয়েছে। তিনি বলেছেন, প্রচুর ঘষামাজা না করে যেন শারিয়া কেতাবে লেখা কিছু আইন প্রয়োগ না করা হয়। জাতি এইসব আলেমদের মতামত নিয়ে গবেষণা করে সিদ্ধান্ত না নিলে মহাসমস্যায় পড়বে।

মদিনা সনদ একটা শান্তিচুক্তি মাত্র এবং ওটার মধ্যে নবীজীর (স.) নামে ঘোর অন্যায়কে বৈধ করার চেষ্টা করা হয়। সেই অন্যায় ধারাগুলো বাদ দিলেও সেটা একটা শান্তিচুক্তি মাত্র। সুদূর অতীতের সেই শান্তিচুক্তির চরিত্র বদলে দিয়ে সেটাকে চিরকালের শ্বাশ্বত রাজনৈতিক রাষ্ট্রীয় গঠনতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কে কাকে ফাঁকি দিচ্ছে তাহলে? এই দলিল দিয়ে দেশ চালিয়ে জাতিসংঘে গিয়ে বসবে বাংলাদেশ!  

মদিনা সনদ দিয়ে কোনো রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়।