পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান তো অর্জিত হয়ইনি, বরঞ্চ রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক আদিবাসী জুম্ম জনগণের ওপর বৈষম্য ও বঞ্চনার স্টিমরোলার অধিকতর জোরদার হয়েছে।
Published : 22 Aug 2024, 05:19 PM
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার তথা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন এবং পরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে এবং অতঃপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ছিল বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার। স্বভাবতই অন্যান্য দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল সংস্কার।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যেকোনো বৈষম্যের অন্যতম নির্মম শিকার হয়ে থাকে দেশের পিছিয়ে পড়া দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া সমতল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে আদিবাসী জুম্ম জনগণের ওপর দশকের পর দশক ধরে চলমান বৈষম্যের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে ষাটের দশক থেকে গণআন্দোলন সংঘটিত হয়ে আসছে। ওই আন্দোলনের ফসল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান তথা জুম্ম জনগণের ওপর বিদ্যমান বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তির কিছু বিষয় বাস্তবায়ন করলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। ফলে অন্যান্যের মধ্যে যেসব বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত থেকে যায় সেগুলো হলো— পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা; পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের হাতে সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি ন্যস্ত করা এবং নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন ও স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণপূর্বক এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা; পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য পুলিশ বাহিনী গঠন করা; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে জুম্মদের বেহাত হওয়া জায়গা-জমি ফেরত দেওয়া এবং এ লক্ষ্যে ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন করা; অস্থানীয়দের কাছে প্রদত্ত সকল ইজারা বাতিল করা; ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা; ভারত-প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের জমিজমা প্রত্যর্পণ পূর্বক তাদেরকে যথাযথ পুনর্বাসন করা; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে পাহাড়িদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ দেওয়া; পার্বত্য চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য সকল আইন, বিধি ও প্রবিধান সংশোধন করা; জুম্মদের জায়গা-জমি থেকে সেটেলার বাঙালিদের সরিয়ে নেওয়া ইত্যাদি অন্যতম।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান তো অর্জিত হয়ইনি, বরঞ্চ রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক আদিবাসী জুম্ম জনগণের ওপর বৈষম্য ও বঞ্চনার স্টিমরোলার অধিকতর জোরদার হয়েছে, নৃশংস দমন-পীড়ন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম জোরদার হয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনজীবনে অবৈধ গ্রেফতার, জেল-জুলুম, বিচার বহির্ভূত হত্যা, জোরপূর্বক গুম-অপহরণ, ভূমি বেদখল, স্বভূমি ও গ্রাম থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ, মিথ্যা মামলায় জড়িতকরণ, সাম্প্রদায়িক হামলা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, নারীর ওপর সহিংসতা ইত্যাদি নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার কেবল সারাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোই ধ্বংস করেনি, চুক্তি বাস্তবায়ন না করে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের ক্ষেত্রকেও ন্যাক্কারজনকভাবে নস্যাৎ করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে যে অধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ওই প্রতিশ্রুতি শেখ হাসিনা সরকার জঘন্যভাবে ভঙ্গ করেছিল। অবিশ্বাস্যভাবে জুম্ম জনগণের সাথে চরম প্রতারণা করেছিল। পার্বত্য চুক্তি অনুসারে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্স, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ইত্যাদি সংস্থাগুলোকে কার্যত অথর্ব সংস্থায় রূপান্তরিত করেছিল।
এটা প্রণিধানযোগ্য যে, তৃতীয় পক্ষ ছাড়াই স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি হচ্ছে উভয়পক্ষের স্বীকৃত একমাত্র গ্রহণযোগ্য কর্তৃপক্ষ, যার সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ চুক্তি স্বাক্ষরকারী দুই পক্ষ বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য। অথচ চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভাগুলোতে গৃহীত কোনো সিদ্ধান্তই বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা সরকার কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। এমনকি এ কমিটির জন্য বরাদ্দও করা হয়নি কোনো অফিস, জনবল ও তহবিল। এভাবেই এই কমিটি নামমাত্র সংস্থায় পরিণত হয়েছিল।
এ পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের স্বার্থে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক জনসংহতি সমিতির সঙ্গে আলোচনা করে অচিরেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক পদে একজন সুযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া জরুরি বলে বিবেচনা করা যায়। আহ্বায়ক পদে নিয়োগ দেওয়ার পর চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি সভায় বসে চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ নির্ধারণ করা যেতে পারে। অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটিতে সময়সূচিভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা (রোডম্যাপ) গ্রহণ করা অতীব জরুরি। ওই রোডম্যাপ অনুসারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে।
এক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভূমিকা অনস্বীকার্য। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এই পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। অথচ পার্বত্য মন্ত্রণালয় গঠিত হয়েছে পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে। স্বভাবতই এই মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সহায়ক এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বার্থের অনুকূলে ভূমিকা পালন করা। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা ছিল তার বিপরীত। আশা করা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাকে চুক্তি বাস্তবায়নের অনুকূলে নিয়ে আসতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
শেখ হাসিনা সরকার দেশবাসীর গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারের কথা বললেই দেশের উন্নয়নের কথা তুলে ধরতেন। মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পনের ফিরিস্তি তুলে ধরে দেশের গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে ধামাচাপা দিতেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায়ও একই কায়দায় উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যর্থতাকে এবং জুম্ম জনগণের ওপর দমন-পীড়নকে ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্র কাঠামোর এ ধরনের ষড়যন্ত্র ও প্রতারণামূলক ভূমিকার পরিবর্তে একটি গণমুখী, পরিবেশ-বান্ধব ও আদিবাসী সংস্কৃতি-বান্ধব ভূমিকায় নিয়ে আসতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সক্ষম হবেন বলে পার্বত্যবাসী আশা করে।
এটা আশা করা যায় যে, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন তথা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ওপর চলমান বৈষম্য ও বঞ্চনা গভীরভাবে উপলব্ধি করবেন এবং রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে এই বৈষম্য ও বঞ্চনা অবসানে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে আসবেন। জুম্ম জনগণের ওপর বিদ্যমান এই বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসানের ক্ষেত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্যে নিহিত রয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসানের লক্ষ্য বলিষ্ঠ উদ্যোগ গ্রহণে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখতিয়ার রয়েছে।