আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বাইরে নানা উৎসব-পার্বণে বাঙালির পোশাকি প্রদর্শনের একটা ব্যাপার ঘটে। এসব ক্ষেত্রে নানা ধর্মের ও জাতের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন পোশাকি সংস্কৃতির প্রকাশ থাকে।
Published : 12 Apr 2024, 05:39 PM
আমাদের জীবনাচার হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। আমাদের সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত গ্রহণ ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বটে। তারপরও লাগসই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্মাণ করতে পেরেছি কি আমরা? একইসঙ্গে এটিও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই বাঙালি একটি ভাষাভিত্তিক জাতি। তা সত্ত্বেও আমরা কি আমাদের আত্মপরিচয়ের ঠিকানা আঁকড়ে থাকতে পেরেছি?
এই প্রশ্ন সামনে রেখেই বলতে চাই, আমাদের আত্মপরিচয়ের তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষেত্র হচ্ছে ‘বাঙালির ফ্যাশন সংস্কৃতি’। এক্ষেত্রে ইংরেজি ফ্যাশন শব্দের বাংলা করে বলা যায় ‘বাঙালির ঢং সংস্কৃতি’। বাঙালির আদি ঢং কী? এই ক্ষেত্রে নারীদের আটপৌরে শাড়ির কথা উল্লেখ করতে পারি। তবে পুরুষদের বেলায় কোনটা আদি পোশাক? লুঙ্গি? ধুতি? ফতুয়া? পাঞ্জাবি? এই শব্দগুলোর উৎস সন্ধান করতেই পরিষ্কার হবে এই পোশাকের আদি উৎস কোথায়। আমার বাবার কাছে বাঙালি পুরুষদের নেংটি পরার গল্প শুনেছি? তবে নেংটিই কি বাঙালি পুরুষের আদি পোশাক? তারও অনেক আগে, ক ফালি বস্ত্রই ছিল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ অঞ্চলের নারী-পুরুষের একমাত্র বস্ত্র। ইতিহাস বলে সেলাইবিহীন বস্ত্র ব্যবহারের রীতিতে পরিবর্তনের ঢেউটি লেগেছিল সম্রাট অশোকের সময়, যখন অশোক মৌর্যদের সাম্রাজ্য আফগানিস্তান থেকে পারস্য পর্যন্ত বিস্তার ঘটিয়েছিলেন।
এতসব প্রশ্ন মাথায় রেখে মোটাদাগে আধুনিক বাঙালির, বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর এবং পূর্বের বাঙালির ফ্যাশন সংস্কৃতির দিকে আমি নজর বোলাতে চাই। তবে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাঙালির ফ্যাশন সংস্কৃতির প্রসঙ্গটিও আমি বিবেচনায় রাখতে চাই।
বাঙালি পুরুষের ফ্যাশন বা ঢংয়ের অনুকরণীয় অগ্রগণ্য নামটি কী? তিনি হচ্ছেন একজন বাঙালির দ্বিতীয় পাসপোর্ট, আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার পোশাকও কতখানি বাঙালির আদি উৎসের? এক রবীন্দ্রনাথেরই নানাপর্যায়ের রকমারি ঢং আর ভঙ্গির ছবি পাওয়া যায়, আর কোনো বাঙালির ঢং ও ভঙ্গির এত এত ছবি পাওয়া যায় না। শুধু রবীন্দ্রনাথের নয়, ছবি পাওয়া যায় ঠাকুরবাড়ির অন্য নারী-পুরুষদেরও।
একইভাবে রবীন্দ্র-উত্তরকালে যে বাঙালি আমাদের শ্রেষ্ঠ অনুকরণীয়, তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একইসঙ্গে আরও একজন বাঙালির নাম উচ্চারণ করতে হয়, তিনি হচ্ছেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। গ্রাম বাংলার প্রায় ঘরেই, পাড়ায় বা মহল্লায় এক-একজন লুঙ্গি পরা গেঞ্জি গায়ের কিংবা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি আর ভাসানী টুপির এক-একজন বাঙালিকে আমরা মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারি।
আধুনিক বাঙালির সবচেয়ে আলোকসঞ্চারী রুচির কারিগরদের একজন বঙ্গবন্ধু। তার পোশাক ও বাচনের ভঙ্গি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মুজিব অনুসারীদের যেমন ঠিক অন্যদের জন্যও তাদের অজান্তেই অনুকরণীয়, তা তারা স্বীকার করুন বা না করুন।
কিছুদিন আগে ঢাকায় বিজিএমইএ ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার ফ্যাশন শিল্প নিয়ে একটা সেমিনারে কথা বলতে যাওয়ার আগে বাঙালির আত্মপরিচয় ও পোশাক সংস্কৃতি নিয়ে ভাবনাটা আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘আন্তর্জাতিক পটভূমিতে বাংলার ফ্যাশন শিল্পের গুরুত্ব’ বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে যে পোশাক পরে হাজির হয়েছিলাম, ওই পোশাক কী আমার পূর্বপুরুষ পরেছেন? আমি তো পশ্চিম থেকে আমদানি করা প্যান্ট-শার্ট পরেছি। তাহলে আমার ওই পোশাক কি আমার আত্মপরিচয় বহন করে? এই প্রশ্ন আমাদের অবিসংবাদিত নয়? মীমাংসিত নয়। এভাবেই বাঙালির ফ্যাশন নিরন্তর মিশ্রণের মধ্যে দিয়ে বৈচিত্র্যময় হয়ে চলেছে? তা যেমন দেশের ভেতরে সত্য, দেশের বাইরেও তাই।
বাঙালি নারীরা তাদের যতটুকু সচেতনতায় আত্মপরিচয়ের জায়গায় যতটুকু স্বনির্ভর বা নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন, পুরুষেরা সেই তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে। আদতে বাঙালির রুচি ও সুন্দরের বিষয়গুলো নারীরাই আগলে রেখেছেন কিংবা মহিমান্বিত করেছেন। এখানে আমি বিবি রাসেলের নাম অবশ্যই নেব। তার আগের সময়ের আমি নাম নিতে চাই বেগম রোকেয়া ও সুফিয়া কামালের। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালি নারীর আত্মপরিচয়ের জাতীয় যে নামটি সর্বাগ্রে নিতে হবে তিনি আমাদের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। যদিও তিনি অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার সর্বাত্মক তৎপরতা রেখে গেছেন। তার গোটা জীবনে একবার তিনি জনসভা মঞ্চে উঠেছিলেন স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সংবর্ধনা সভায়। যদিও তিনি কোনোভাবেই রাজি ছিলেন না জনসমক্ষে হাজির হতে। ইন্দিরা গান্ধীর সম্মান রক্ষার্থে এবং বঙ্গবন্ধুর পীড়াপীড়িতে তিনি রাজি গিয়েছিলেন। সেখানেও তিনি তার আটপৌরে বাঙালি নারীর স্বতঃস্ফূর্ত ভাবমূর্তির জায়গাটি মহিমান্বিত করতে ভুলে যাননি। বাঙালি নারীর আদি ফ্যাশন জামদানি শাড়ির এরকম প্রদর্শন এবং মনোযোগ আকর্ষণ এর আগে তেমন একটা ঘটেনি বললেই চলে।
এরপর দুর্ভাগ্যবশত ১৯৭৫ সালের ট্রাজেডিতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়ে গেল। আলোর পাদপ্রদীপে চলে এলেন কালো চশমার এক মেজর জেনারেল। তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাঙালির জামদানির কদর বোঝেননি। তিনি পরেছেন বিদেশ থেকে আনা নানা রঙের শিফন শাড়ি। ১৯৮০-এর দশকে বাঙালি নারীর জামদানি শাড়িকে মর্যাদার আসনে এনেছেন আরেক সামরিক শাসকের স্ত্রী তৎকালীন ফার্স্টলেডি রওশন এরশাদ।
গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা। ১৯৮১ সালে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে বাঙালি নারীর জামদানি শাড়ির অক্লান্ত মডেল হচ্ছেন তিনি। আমরা যদি ভুলে না যাই, ভারতের পত্রপত্রিকায় শেখ হাসিনার সফরের ওপর আলোকপাত করতে তার পরনের শাড়িকে রফতানি কূটনীতির তাৎপর্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল।
অনেকেই জেনে থাকবেন পরিবারের কোনো সদস্যের কিংবা কোনো পোশাক-আশাক কিংবা সাজগোজ প্রসঙ্গে আমরা ইতিবাচক অনুযোগ করে করে বলে থাকি কিংবা শুনে থাকি ও ‘বাব্বা ঢং কত’? এই ‘ঢং’ শব্দের তাৎপর্য কী? ঢংয়ের ‘মডেল’ কী? আধুনিক ব্যক্তিমানুষের সাজপোশাকে রুচি ও ব্যক্তির স্বর্তস্ফূর্ত মার্জিত সরল স্বাভাবিক প্রকাশকেই ফ্যাশন বলি বটে। আর এরকম প্রকাশ যার মাঝে ঘটে যা অন্যদের মাঝে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং অনুকরণীয় হয়, তাকে আমরা মডেল বলি।
এইপর্যায়ে আমাদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মহীয়সী মানুষের নাম নিতে চাই, তিনি হচ্ছে ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। গোটা জীবনে সোনা রূপা কিংবা হীরার কোনো অলঙ্কার ব্যবহার করেননি তিনি। শৈশব এবং তারুণ্যে আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে অলঙ্কার কেনার সামর্থ্য তাদের ছিল না। তিনি ছিলেন রুচিবান ব্যক্তিত্বের অধিকারী অসম্ভব সুন্দর একজন মানুষ। তিনি মাটির এবং কাঠের অলঙ্কার বানিয়ে বানিয়ে পরতেন। পরে যখন আর্থিক সঙ্গতি হলো তখনও তিনি তার কাঠের এবং মাটির অলঙ্কারের জায়গাটি সোনা বা রূপার জন্যে ছেড়ে দেননি।
দেশের ভেতরে আধুনিক বাঙালির আত্মপরিচয়ের ফ্যাশন সংস্কৃতির খবর আমরা জানি। দেশের বাইরে বাঙালির ফ্যাশন সংস্কৃতির হালহকিকত কী? এই ব্যাপারে বাঙালির আত্মপরিচয় এবং আত্মমর্যাদা তুলে ধরার ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীদেরকেই কৃতিত্ব দিতে চাই। আমাদের কূটনৈতিক মিশনগুলোতে কর্মরত বোনেরা আমাদের বাংলা মায়ের চিরায়ত শাড়িকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি দিচ্ছেন বা ব্র্যান্ডিং করে চলেছেন। একই কৃতিত্ব বাংলাদেশ বিমানে কর্তব্যরত আমাদের বোনদেরও। এর বিপরীতে আমাদের ভাইয়েরা কি আমাদের বাঙালির আত্মপরিচয়ের কোনো পোশাককে কি পরিচিত করাতে বা ব্র্যান্ডিং করতে পেরেছেন?
দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বাইরে নানা উৎসব-পার্বণে বাঙালির পোশাকি প্রদর্শনের একটা ব্যাপার ঘটে। এসব ক্ষেত্রে নানা ধর্মের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন পোশাকি সংস্কৃতির প্রকাশ থাকে। পহেলা বৈশাখের কিংবা পহেলা ফাল্গুনে বাঙালি নারী-পুরুষের থাকে সার্বজনীন ফ্যাশন সংস্কৃতি। অবশ্য বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর নরনারীরা, বিশেষ পার্বত্য তিন জেলার নরনারীরা তাদের নিজস্ব সাজপোশাকে এই উৎসবে আনেন বৈচিত্র্য।
ওপরের সামগ্রিক আলোচনার ভিত্তিভূমি ছিল অনেকটা দেশের ভেতর। এবার দুনিয়ার দেশে দেশে বাঙালি অভিবাসীদের ফ্যাশন সংস্কৃতির দিকে নজর দিতে চাই। যারা দেশের বাইরে থাকেন প্রায়শ তাদের দ্বিবিধ ফ্যাশন সংকট বা সাংস্কৃতিক সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। না তারা পারেন ভিন্ন সংস্কৃতির ফ্যাশনকে নিজের মতো করে পেতে, না পারেন নিজস্ব নৃগোষ্ঠীর নিজের ফ্যাশনের পুরোটা সুযোগ নিতে। এই ক্ষেত্রে তাদের কতগুলো বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ওইসব দেশের জীবনব্যবস্থা অর্থনৈতিক পঞ্জি বা ছুটিছাটা নির্ধারিত হয় তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে আশ্রয় করে। তাদের ফ্যাশন ব্র্যান্ডিং নির্ধারিত হয় তাদের জীবনাচার অভ্যাস ওইদেশের জলবায়ু এবং পরিবেশগত পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে।
আমাদের এই ভূখণ্ডের পোশাক এবং অভ্যাস নির্ধারিত কিংবা বিকশিত হয়েছে এখানকার পরিবেশ ও জলবায়ুগত অবস্থানকে বিবেচনায় রেখে। একজন বাঙালি নারী বা পুরুষের পক্ষে উত্তর মেরু কিংবা দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের প্রচণ্ড ঠাণ্ডার দাপটের মধ্যে থেকে কি সম্ভব বাঙালির শাড়ি-লুঙ্গি কিংবা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে থাকা? তাই তারা ঘরোয়াভাবে উৎসব-পার্বণে পিতৃভূমির পোশাকি সংস্কৃতির চর্চা করার চেষ্টা করে থাকেন।
এসব ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো আমাদের রফতানিনির্ভর পোশাকশিল্প ভিন্ন সংস্কৃতির ভিন্ন দেশের ফরমায়েশ এবং চাহিদা অনুযায়ী পোশাক সরবরাহ করে থাকে। তা অনেকটা বাইরের দেশের মানুষদের রুচি এবং চাহিদা অনুযায়ী হয়ে থাকে। এসব রফতানি বাজারে বাঙালির নিজস্ব ফ্যাশন সংস্কৃতিকে ধারণকারী কোনো পোশাকি ব্রান্ডের রফতানি বাজারে কতটুকু সুযোগ আছে? এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না।
সারাবছর কোনো বাঙালি নারী বা পুরুষের পক্ষে বাংলাদেশের পোশাকি রীতিকে দৈনন্দিন জীবনের অংশ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না নানাবিধ কারণে। প্রথমত ইচ্ছে করলেও বাঙালি ফ্যাশনের পোশাক হাতের কাছে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। একটি উদাহরণ দিতে চাই। আমি নিজে মোটেও ফ্যাশন সচেতন নই। এই দায়িত্বটি আমার স্ত্রীই সামলে থাকেন। আমি প্রথম দিকে যখন দেশে আসতাম বেশ কয়েকবার আমার স্ত্রীর জন্যে শাড়ি উপহার পেতাম। আমি নিয়ে যেতাম খুশিমনে। সংকট হতো শাড়ির সঙ্গে আনুষঙ্গিক পোশাকের জন্যে বিদেশে দর্জির অনুপস্থিতি।
আমাদের রফতানির বিবেচনার কেন্দ্রে অভিবাসীরা আমার পর্যবেক্ষণে অনেকটা উপেক্ষিত। আমাদের মাথার ফ্যাশন, পায়ের পাদুকা, মুখের সাজসজ্জা, কাজের ধরন অনুযায়ী পোশাকের যে বিবর্তন তা আমাদের পরিবেশ, জলবায়ু আবহাওয়া অনুযায়ী ঘটেছে। তেমনি নানা নৃগোষ্ঠীর জীবনাচারের প্রভাবও এর ওপর রয়েছে। দেশের বাইরে ওখানকার পরিবেশ, জলবায়ু ও কাজের ধরনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো আমাদের নিজস্ব ফ্যাশন সংস্কৃতির বিবর্তনের কোনো সুযোগ কি আমরা বাঙালিরা সৃষ্টি করতে পেরেছি?
আমার মেয়ে অতসীর কথাই যদি ধরি; ও নানা তরফ থেকে এত এত উপহার পেত তার বেশিরভাগই ব্যবহার করার সুযোগ বা উপলক্ষ সামনে থাকত না। ওর বয়স এখন ষোলো। ও যখন আরও ছোট ছিল কোনো কোনো ছুটির দিন বাসায় ওর কাপড়গুলো বের করে ফ্যাশন শো করত, ওর মা আর আমি ওর সঙ্গে তাল মেলাতাম।
এই চিত্র যে কেবল আমাদের ছোট্ট পরিবারের জন্যে সত্য, তা নয়। দেশের বাইরে বেশিরভাগ বাঙালি পরিবারকে একই বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, যদি তারা নিজেদের বাঙালি বলে দাবি করেন। বিপত্তি আরও আছে, কেউ কেউ তো নিজের বাঙালি পরিচয়ের পরিবর্তে ধর্মীয় পরিচয়কে মুখ্য মনে করেন। ওই অনুযায়ী বেশভূষাও রপ্ত করার চেষ্টা করেন। আমাদের নারীদের জাতীয় পোশাক বিদেশে আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় তুলে ধরার ক্ষেত্রে অনেকটা মীমাংসিত। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটি কী মীমাংসিত? এই প্রশ্নটি সংশ্লিষ্ট সকলের উদ্দেশে রাখতে চাই।
আপনারা খেয়াল করে দেখবেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী লম্বা হাতার পকেটসমেত একধরনের ফতুয়া পরেন তার চিরাচরিত জামদানি শাড়ির সঙ্গে। যা তার কাজের ধরন অনুযায়ী, যা বাঙালি নারীর ফ্যাশন আইকন হিসেবে নতুন এক সংযোজন। এই সংযোজন দেশের এবং দেশের বাইরে বাঙালির ফ্যাশনে নতুন এক লাগসই মাত্রা যোগ করতে পারে।
আমাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডিংয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা নিয়েও আমি খুশি নই। একটি উদাহরণ দিতে চাই। কয়েক বছর আগে ইউরোপের কয়েকটি দেশে আমাদের এক রাষ্ট্রদূত ‘তথাকথিত আম কূটনীতি’র প্রবর্তন করেছিলেন। উদ্দেশ্য বিদেশে আমাদের বাজার তৈরি করা। কোন বিবেচনায় রফতানি পণ্য হিসেবে আমকে তুলে ধরা হলো? আম কবে কোন অর্থবছরে এরকম রফতানিপণ্য হয়ে গেল? সেখানে কি আমাদের ফ্যাশন শিল্প অগ্রাধিকার পেতে পারত না?
এই সময়ের ফ্যাশন বিবর্তন নিয়ে আরও কয়েকটি প্রশ্ন রেখে যেতে চাই:
১. দেশে এবং দেশের বাইরে হিজাব এবং বোরকা মিলিয়ে পোশাকি যে বৈচিত্র্য, এর সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির কার্যকর যোগসূত্র কী? এরকম ছেলে এবং মেয়েদের অন্যবিধ পোশাকি বিবর্তন, সংস্কার ও বাহারি বৈচিত্র্য নিয়ে আমাদের দার্শনিক পর্যালোচনার প্রয়োজন নাই কী?
২. টাঙ্গাইলের শাড়ির ঐতিহ্য স্বত্ব আজ হাতছাড়া হয়ে যাবার হুমকির মুখে। আমি টাঙ্গাইলের সন্তান, টাঙ্গাইল বাংলাদেশের, টাঙ্গাইলের শাড়িও বাংলাদেশের। আশা করব প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি তাদের ঔপনিবেশিক ধারণার খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসে টাঙ্গাইলের শাড়ির ব্যাপারে তাদের দাবি থেকে সরে আসবে। একইসঙ্গে আমাদের সতর্ক এবং সজাগ থাকা অনিবার্য, দেশের ভেতরে এবং দেশের বাইরে থেকে, আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির উত্তরাধিকার কোনোভাবেই আমরা যেন খুইয়ে না বসি।
একটি খুশির প্রসঙ্গ দিয়ে লেখাটির সমাপ্তি টানতে চাই। মসলিন আর পাটের পোশাকের সমৃদ্ধ ইতিহাসের অধিকারী বাঙালি আজ ‘পোশাকশিল্প এবং ফ্যাশন সংস্কৃতি’র শীর্ষে থাকা জাতির জনপদ বাংলাদেশে একটি ফ্যাশন জাদুঘর রয়েছে। আমি আশাবাদ রাখতে চাই, এই জাদুঘরটি বাঙালির ফ্যাশন বিবর্তনের সমূহ ধাপ এবং নমুনাগুলো তুলে ধরতে সক্ষম হবে। দ্রুত বিকাশমান ঢাকা সহসাই কসমোপলিটনে রূপ নেবে। সেই বাস্তবতায় এরকম একটি জাদুঘর দুনিয়ার মানুষের আগ্রহের জায়গা হতে পারে, যা বাণিজ্যিকভাবেও লাগসই এবং লাভজনক হতে পারে। এটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাঙালির সমৃদ্ধ ফ্যাশন সংস্কৃতির মনযোগের কেন্দ্রের জায়গাটি অধিকার করতে পারে।