এমন একটা ব্যবস্থায় যেখানে শিক্ষকের ভয় নেই এবং শিক্ষার্থীদের যাওয়ার জায়গা নেই, এর মধ্যে যৌন হয়রানির অভিযোগ ঠিকঠাক সময়মতো কেউ করবে কীভাবে? করলে তাকে রক্ষা করবে কে?
Published : 10 Apr 2024, 03:33 PM
আমার ছাত্র এবং শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই আমি বরাবরই খুব জোর দিয়েই বলি যে, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোতে একজন শিক্ষার্থীর সাফল্য, রেজাল্ট, ক্যারিয়ার এবং পুরো জীবনকে যেভাবে জিম্মি করে রাখা হয়। যেমন করে এটা করা হয় ওই ব্যবস্থার মূলে পরিবর্তন না এলে শুধু আইনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানি রোধ সম্ভব নয়। আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো থেকেই শুরু করছি এবং ক্যাম্পাসগুলোতে যৌন হয়রানি বন্ধের জন্য কাঠামোতে কী ধরনের পরিবর্তন সম্ভব— সেটা নিয়ে কিছু বলতে বলছি।
অর্থনীতির শিক্ষার্থী হিসেবে প্রণোদনা (ইনসেনটিভ) দিয়ে মানুষের ব্যবহার পরিবর্তন সম্ভব— এটা বিশ্বাস করি। ওই বিশ্বাস থেকেই লিখছি। আমার প্রথম প্রশ্ন, ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীর একেবারেই ভয় ছাড়া প্রচলিত ব্যবস্থাপনার কাছে অভিযোগ জানানোর জায়গা কতটা আছে? বিধি অনুযায়ী অভিযোগ জানানোর বিপরীতে তার ইনসেনটিভ কী? অভিযোগ জানানোর পর তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব কি সিস্টেম নিচ্ছে?
বর্তমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সিস্টেমটা এমন— ইন্টারমিডিয়েট পাশ ছেলেমেয়েরা অ্যাডমিশন টেস্ট দেয়, একটা ভাইভা হয়, এবং তারপর তাদের মধ্যে সাবজেক্ট চয়েস হয়। এই সাবজেক্ট চয়েসের পরে শিক্ষার্থীর আর কিছুই করার থাকে না। জানালাহীন একটা কক্ষের মধ্যে ঢোকার মতো ব্যাপার ঘটে। পাঁচ বছরের ভবিষ্যৎ বদলানোর আর উপায় থাকে না তার। সে অন্য কোনো বিভাগে যেতে পারে না, তার কাছে ক্লাসের চয়েস খুব কম থাকে কারণ আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিভাগের ছাত্র অন্য বিভাগে গিয়ে ক্লাস করতে পারে না। অর্থাৎ কোনো একজন শিক্ষকের সঙ্গে ঝামেলা হলে তাকে এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব আমাদের বিদ্যমান কাঠামোতে। ক্লাস টেস্ট, অ্যাসাইনমেন্ট কম রেখে বা একেবারেই না রেখে শুধু একটা বড় পরীক্ষা হয়। একটা বড় পরীক্ষায় খারাপ করে আর কি ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব?
এবার তাকানো যাক পরীক্ষার দিকে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কোনো একটি পরীক্ষার খাতা কোনোদিন ফেরত পাইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার খাতা কাউকে ফেরত দেওয়া হয় না। খাতা মূল্যায়নে শেষে ফেরত না পেলে, শিক্ষার্থী কীভাবে শিখবে? আর শিক্ষকের জবাবদিহিতা কীভাবে হবে? একজন শিক্ষক চাইলেই, ইচ্ছা হলেই শিক্ষার্থীদের বসিয়ে দিতে পারেন। পারলে করবেন না কেন?
এরপর প্রতিটা পরীক্ষার ফলাফল দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের প্রাইভেসি নিয়েও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বিধান নেই। সত্য হচ্ছে, এইভাবে টাঙ্গিয়ে দেওয়ার সিস্টেম আমি আমার স্কুল-কলেজেও দেখিনি, কেবল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই দেখেছি। মেজর পরিবর্তন করা বা ক্রেডিট ট্রান্সফার করার কোনো ব্যবস্থা নেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। জীবন নরকে পরিণত হলেও এর মধ্যেই অনার্স শেষ করতে হবে। কেবল টাকা থাকলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়া ছাড়া এই শিক্ষার্থীদের বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। এর ওপর চাকরির বাজার সীমিত। বিশেষ করে স্যোশাল সায়েন্সের মতো জায়গায় কিছু এনজিও প্রতিষ্ঠানের চাকরির বাইরে তেমন কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে, যেসব আবার কয়েকজন শিক্ষকের হাতে রক্ষিত।
এই সব ব্যবস্থাই এমনভাবে করা যেন একজন শিক্ষার্থীর যৌন হয়রানির বিপরীতে অভিযোগ করার কোনো ইনসেনটিভই না থাকে। কেন একজন তার সারাটা জীবন বাজি রেখে অভিযোগ করবে? যৌন হয়রানি বা অন্য যে কোনো হয়রানি ঢেকেঢুকে বের হয়ে যাওয়াই কী আমাদের জন্য লজিক্যাল নয় দিনশেষে?
এবার যাই শিক্ষকের তরফে। তিনি মাস্টার্স শেষ করে ঢোকেন। তাকে প্রফেসনালিজমের সংজ্ঞা কেউ শেখায় না, কী করতে পারবেন, কী পারবেন না— এগুলো কেউ বলে দেয় না। আমি এই কথাটায় একটু জোর দিতে চাই। তিনি জানেন তার চাকরি যাওয়ার, জবাবদিহিতার জায়গা প্রায় নেই, এটাই তাকে অনেক সাহসী করে তোলে।
তো, এমন একটা ব্যবস্থায় যেখানে শিক্ষকের ভয় নেই এবং শিক্ষার্থীদের যাওয়ার জায়গা নেই, এর মধ্যে যৌন হয়রানির অভিযোগ ঠিকঠাক সময়মতো কেউ করবে কীভাবে? করলে তাকে রক্ষা করবে কে? তার পরীক্ষাগুলোর কী হবে? রেজাল্টের কী হবে? চাকরি কীভাবে হবে? সবার বুলিং থেকে তাকে কে বাঁচাবে?
আমার কাছে মনে হয় এই দুটি ব্যবস্থা পরস্পরের কমপ্লিমেন্ট। এরা একে-অপরকে বাঁচিয়ে রাখে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পদ্ধতিকে জিম্মি করে শিক্ষকেরা যৌন এবং অন্যান্য হয়রানি করেন।
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে চিন্তা করতে তাই সার্বিক কাঠামো নিয়েই ভাবতে হবে।
১) শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট, ক্যারিয়ার, জীবন শিক্ষকদের হাতের মুঠোতে থাকতে পারবে না। সাবজেক্ট বদলানো, ক্রেডিট ট্রান্সফার করা, অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে চয়েস করার ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের জন্য থাকতে হবে। পরীক্ষার খাতা ফেরত দিতে হবে, মূল্যায়নের রুব্রিক জানাতে হবে। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্যের মূল্য বুঝতে হবে। দেওয়ালে রেজাল্ট টাঙ্গিয়ে দিয়ে বুলিংয়ের মধ্যে ঠেলে দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ, পরীক্ষা ব্যাপারটাকে জীবন-মরণের ব্যাপার বানানো যাবে না।
২) শিক্ষকের চাকরির নিয়োগ ধারায় ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করার অপশন থাকতে হবে। ইউজিসির নিয়ন্ত্রণে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা থাকবে, জানা থাকবে কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোথাও যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে কিনা। এই কাজ অন্তত সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আজকের ডিজিটালাইজেশনের যুগে কঠিন কিছু নয়।
৩) ২০০৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি বন্ধে সেল গঠন করার কথা থাকলেও মাত্র নাকি ২৮টা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সেল রয়েছে। এই সেলকে কার্যকরী করার সব ব্যবস্থা নিতে হবে। আর এই সেলের বা লিগ্যাল দীর্ঘসূত্রতা যেন নারী শিক্ষার্থীর সময় নষ্ট না করে একেবারেই সেই খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে অভিযোগকারীর পরীক্ষা আলাদাভাবে নিতে হবে।
৪) প্রফেশনাল ট্রেনিং থাকতে হবে। আপনি আমাদের সমাজের কথা চিন্তা করেন। এখানে কি ছোট থেকে আমরা যৌন হয়রানি নরমালাইজ জেনেই বড় হই না? বিশেষ করে নিজের চেয়ে ক্ষমতাহীন নারীর ক্ষেত্রে? এই ধরনের প্রিমিটিভ সমাজ ব্যবস্থায় সবাইকে এক ট্রেনিংয়ের আওতায় না নিয়ে এসে ‘প্রফেশনাল সম্পর্ক’ কীভাবে শেখানো সম্ভব?
একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কী বলতে পারবেন, করতে পারবেন— তা নিয়ে প্রশিক্ষণ দরকার। কেবল যৌন হয়রানি নয়, বুলিংয়ের বিরুদ্ধেও এভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
৫) এই সম্পূর্ণ কাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারণেই তৈরি হয় স্যোশাল প্ল্যাটফর্মের ‘বিচার’। প্রমাণের আগপর্যন্ত এই কমপ্লেইনের বিষয়টি গোপন রাখার সিস্টেম দরকার, যাতে মানুষ অন্যকে হেনস্থা করার সুযোগ না নেয়।
এই লেখাটায় আমি বর্তমান ‘রাজনীতি’ সচেতনভাবেই এড়িয়ে গিয়েছি। আমার মতে কাঠামোর ফাঁক থাকার কারণেই শিক্ষক-শিক্ষার্থী পলিটিক্স এত বাড়তে পেরেছে। রাজনীতিই সব সমস্যার একমাত্র কারণ নয়, অনেক ক্ষেত্রে হয়তো কেবল সমস্যার লক্ষণ মাত্র। রাজনীতি নিয়ে তো কথা হচ্ছেই, বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা কাঠামো নিয়ে চিন্তা করারও সময় এসেছে।