Published : 20 Mar 2013, 10:15 PM
বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান মারা গেলেন। সম্ভবত শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারী ও অনুগামীদের মধ্যে যারা এতদিন জীবিত ছিলেন তাদের মধ্যে তিনিই সর্বশেষ ব্যক্তি। শেখ মুজিবের সঙ্গেই নিজের রাজনৈতিক জীবনের বড় একটি সময় কাটিয়েছেন জিল্লুর রহমান। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল এর ঠিক তিন বছর আগে। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানে হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের জন্য অভিন্ন ইলেকটোরেল সিস্টেম চালু হওয়ার পর, দলটি নামের মধ্য থেকে 'মুসলিম' শব্দটি ফেলে দিয়ে 'আওয়ামী লীগ' নাম নেয়।
তার মানে, বাঙালি জীবনে একটি নতুন ভাবধারার উদ্ভব হচ্ছিল তখন। প্রতিটি সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের ভাবনায় আলোড়িত হচ্ছিল বাংলা। সদ্যপ্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ছিলেন সেই সময়েরই অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা। তখন থেকেই তাঁর আদর্শিক গুরু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নতুন সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন তিনি।
একটি দিক থেকে তাঁর প্রজন্মটি অন্য অনেক প্রজন্মের চেয়ে আলাদা। তাঁদের একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছিল যেটি একই সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিশ্রুতিও বটে। জিল্লুর রহমানের জন্ম এমন এক সময়ে যখন পুরো সমাজ ছিল বৈষম্যের শিকার। ঔপনিবেশিক সমাজের নানা অবমাননা তো তাদের সইতে হয়েছেই, পাশাপাশি সংখ্যাগুরু ও সুবিধাভোগী হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে থাকার চেষ্টাও করতে হয়েছে তাদের।
শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনীতে এর পক্ষে সাক্ষ্য পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায়, এ নিয়ে মুসলিম তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের একটি ভাষা ছিল, তবে জিল্লুর রহমানের মতো তরুণরা একে ব্যক্তিগতভাবে নেননি বা এর প্রভাবে তাদের খোলামেলা মন বিষাক্ত হয়ে ওঠেনি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পরই পুরনো সেসব দিনের কথা ভুলে গিয়েছিলেন তরুণ শিক্ষার্থী ও সংগঠকরা। দুবছরের মধ্যেই ওরা বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলতে থাকেন যেগুলো পরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির নির্মাণের পেছনে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির গড়ে ওঠার পেছনের ইতিহাসের দিকে চোখ বুলালে আমরা দেখতে পাব, আমাদের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক অর্জন ছিল ভাষা আন্দোলন। এরপরের অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে চুয়ান্নতে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৫৮ থেকে পরের এগারো বছরে আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম এবং এর পরের ঘটনাপ্রবাহ। বাঙালির জাতীয় জীবনের এতসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গেই যুক্ত আছে জিল্লুর রহমানের নাম। পঁচাত্তরের পরে দেশের রাজনীতি যে সব জটিল ঘটনার দোলাচলে আলোড়িত হয়েছে সেখানেও তিনি ছিলেন। আবার আমরা তাঁকে দেখেছি আশির দশকের শুরু থেকে নব্বইয়ের শুরুতে চলমান এরশাদবিরোধী আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করতে।
সদ্যপ্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এটাই যে, তিনি দলের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। আর মারা গেলেন রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান ব্যক্তির পদে আসীন থেকে। এই পদটি অলঙ্কৃত করেছিলেন তাঁর নেতা শেখ মুজিবুর রহমানও।
প্রয়াত জিল্লুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন নিঃসন্দেহে বর্ণাঢ্য ছিল। তবে এর চেয়েও বড় করে দেখতে হবে রাজনীতিতে তাঁর সুশীল ভূমিকাকে যে ভূমিকায় আমাদের দেশে আর কাউকে দেখা যায় না। এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন। কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগের একটি জনসভায় গ্রেনেড হামলার শিকার হয়ে তাঁর স্ত্রী আইভি রহমান মারা যান। স্ত্রীর বিয়োগব্যথায় পীড়িত হলেও জিল্লুর রহমান কখনওই রাজনীতিতে কোনো শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করেননি। তিনি নিজেও সে হামলায় আহত হয়েছিলেন্ বটে, তারপরও তাঁকে হিংস্র বা অযৌক্তিক কোনো কাজ করতে দেখা যায়নি।
এভাবেই তিনি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি পরিচ্ছন্ন উদাহরণ তৈরি করেছেন যেটি এখানে নেই বললেই চলে। ব্যক্তিগত দুঃখ তিনি নিজের মনেই নিভৃতে লালন করেছেন। আর প্রকাশ্যে থেকেছেন স্থিতধী ও সৌম্যতার প্রতিমূর্তি হয়ে। এটা আমাদের মনে এমন এক প্রশান্তি এনে দেয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে যার দেখা মেলা ভার।
এভাবেই আসলে তিনি আমাদের রাজনীতিতে শিষ্টাচার ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন যদিও অনেক আগেই এখান থেকে এসব মূল্যবোধ হারিয়ে গেছে।
জিল্লুর রহমানের আরেকটি বড় গুণ ছিল তিনি কখনও কোনো কিছু প্রদর্শন করতে চাইতেন না। তিনি জানতেন ইতিহাসে তাঁর জায়গাটি নির্ধারিত হয়েই আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন এক ব্যক্তিত্ব হিসেবেই তিনি স্বীকৃত হবেন যিনি মৃদুভাষী, কখনও দ্বেষের বশবর্তী হয়ে কর্মীদের চালিত করেন না, এমনকি সহিংসতার ডামাডোলের মধ্যেও যিনি শান্তি ও আশার বাণী শোনাতে পারেন।
আমাদের এ পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ হতে পারাটা বিরাট অর্জন। সদাবিনয়ী ও সদালাপী মানুষটি এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে আসীন হওয়ার পরও নিজের ওই পিতৃসুলভ মহিমাটি বজায় রাখতে পেরেছিলেন।
তিনি শান্তিতে থাকুন।
আফসান চৌধুরী: লেখক ও সাংবাদিক ।