রাজনৈতিক দলগুলো এই সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ না করলে এটা হবে এক অর্থহীন বিনিয়োগ। সংস্কার বস্তুটি ‘তিক্ত ওষুধ’ নয়, যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও, প্রাণের দায়ে, গলাধঃকরণ করতেই হয়।
Published : 18 Jan 2025, 08:39 PM
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশনগুলো সুনির্দিষ্ট সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে শুরু করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো নিয়ে। বর্তমানের রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির মধ্যে শুধু গণতন্ত্র রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত নতুন পাঁচ মূলনীতিতে। বাদ পড়েছে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সুপারিশ করা নতুন পাঁচটি মূলনীতি হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র।
উল্লিখিত প্রস্তাব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। সংস্কারকে জরুরি মনে করেও অনেকেই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি পরিবর্তনের সুপারিশ নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছেন। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের উদ্যোগের সমালোচনা করে আসছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। বিএনপির ভাষ্য, সংস্কার দরকার আছে, কিন্তু সেটা নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। পক্ষান্তরে অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা বলেছেন, ৫৩ বছরেও যারা কোনোরকম সংস্কারের উদ্যোগ নেয়নি, ওই রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া যায় না।
বিএনপি অবশ্য তাদের মতো করে সংস্কারের ব্যাপারে উদ্যোগ-আয়োজন অব্যাহত রেখেছে। গত নভেম্বরে সংবিধান সংস্কার কমিশনে গিয়ে ৬২টি প্রস্তাব দিয়েছিল। এর মধ্যে সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার বিধান করা, উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রী পদ তৈরি করা, সংসদে উচ্চকক্ষ সৃষ্টি, অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের অধীন রাখা, গণভোটের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করা, প্রজাতন্ত্র, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব উল্লেখযোগ্য।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপির কয়েকটি প্রস্তাবের মিল থাকলেও সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনসহ অনেকগুলো প্রস্তাবের ব্যাপারে দলটি একমত হতে পারছে না। ইসলামী দলগুলোও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে সহমত নয়। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার প্রস্তাব অনেকেই পছন্দ করছেন না। ‘বহুত্ববাদ’ নিয়েও প্রশ্ন আছে। গণতন্ত্র থাকলে বহুত্ববাদের প্রয়োজন কোথায়౼ এই প্রশ্ন উঠেছে। আবার অনেক ইসলামী দল নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। কোনো কোনো বামপন্থী দল সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আলোকে বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়েছিল। এসব মূলনীতি বাদ দিয়ে সংবিধানের কোনো সংশোধনী আনা হলে তা বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনেক প্রশ্নকেই তীব্র করে তুলেছে। রাষ্ট্রধর্ম অটুট রেখে এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে ছেঁটে, ‘বহুত্ববাদ’ কীভাবে দেশের সব ধর্মের মানুষের অধিকার ও ধর্মপালনের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করবে?
সংসদ সদস্য প্রার্থী হওয়ার বয়স ২৫ থেকে কমিয়ে ২১ বছর করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। আবার রাজনৈতিক দলগুলোকে কমপক্ষে ১০ শতাংশ তরুণ প্রার্থী দেওয়ার কথা বলেছে। এটি সুচিন্তিত প্রস্তাব নয় বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। কমিশনের প্রস্তাবকে কেউ বলছেন, উচ্চাভিলাষী, কেউ বা যুক্তরাষ্ট্রের ফটোকপি মনে করছেন। কেবল প্রেসিডেন্টের জায়গায় প্রধানমন্ত্রী বসানো হয়েছে।
সংবিধানের সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবকে অনেকেই অবাস্তব বলেও মন্তব্য করছেন। কারণ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে না౼ এটা বড় দলগুলো মানবে বলে মনে হয় না। পাঁচ বছরের পরিবর্তে চার বছর পর পর নির্বাচনকেও অনেকে অপ্রয়োজনীয় বলছে। কারণ আমাদের দেশে নির্বাচনে অনেক প্রাণহানি হয়, সম্পদ বিনষ্ট হয়। নির্বাচন পরিচালনার জন্য অনেক ব্যয়ও হয়। এই ব্যয় বাড়ানোর কোনো মানে নেই।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এর মধ্যে নিম্নকক্ষের ৩০০ জনকে একক নির্বাচনি এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসতে হবে। আর নিম্নকক্ষের ১০০ জন নারী সদস্য সারা দেশের সব জেলা থেকে নির্ধারিত ১০০ নির্বাচনি এলাকা থেকে কেবল নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। নিম্নকক্ষে দলগুলোর পাওয়া আসনের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে।
অভিজ্ঞজনের মতে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের ভার বইতে বাংলাদেশ এখনও প্রস্তুত নয়। সংসদ সদস্যের সংখ্যাবৃদ্ধির বিষয়টিও দেশের আয়তন বিবেচনায় সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অতিরিক্ত ১৫৫ জন সংসদ সদস্যের কারণে রাষ্ট্রের ব্যয় বাড়বে। নারীদের জন্য ১০০ আসন নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় কোটা প্রথা তৈরি হবে বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করছেন। যে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে দেশে এত কাণ্ড ঘটে গেছে, ভিন্ন অবয়বে সেই কোটা আবার চালু হোক— তা অনেকেই চাইছেন না। কমিশনের প্রস্তাবে আরও নানা সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। উচ্চকক্ষের ৫ জন সদস্য নির্বাচন করার একক ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে যেভাবে রাখা হয়েছে, তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংসদ সদস্য হওয়ার বয়স নিয়েও সমালোচনা আছে। সংসদ সদস্য হওয়ার বয়স ২৫ থেকে কমিয়ে ২১ করা অযৌক্তিক।
সংবিধান সংস্কার কমিটির প্রস্তাবিত নতুন পাঁচটি মূলনীতিকে অনেকেই শব্দের খেলা হিসেবে চিহ্নিত করছেন। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার౼এই তিনটি আসলে একই জিনিস। মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলে সাম্য ও সামাজিক সুবিচার কায়েম হবে। সাম্য থাকলে মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার কায়েম হবে। সামাজিক সুবিচার থাকলেও সাম্য ও মানবিক মর্যাদা থাকবে। আবার বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রের মানেও আসলে একই রকম। বহুত্ববাদ মানেই গণতন্ত্র। গণতন্ত্র থাকলে বহুত্ববাদ থাকবে এমনটাই মনে করছেন অনেকে। এই দুটিকেও আলাদা করে উল্লখ করার কোনো মানে নেই।
‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ ঠিক রেখে বাংলায় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার মধ্যেও অভিনবত্ব নেই। নাগরিকরা প্রজা থেকে নাগরিকতন্ত্রে উত্তীর্ণ হয়ে কী সুবিধা পাবে? তাদের মৌলিক অধিকার কি তাতে সংরক্ষণ হবে? সুশাসন পাবে? ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, নিজের বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার পাবে?
দেশ যখন স্বাধীন হয়েছিল, তখন আমরা যে সংবিধান গ্রহণ করেছিলাম, সে সংবিধানের গোড়াতেই বলা হয়েছিল: স্বাধীন দেশের নাগরিকরাও স্বাধীন। থাকবে তাদের চিন্তার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। থাকবে ন্যায়ের নিশ্চয়তা— সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ন্যায়। আজ সেই স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক পরাধীন প্রজায় পর্যবসিত। তাদের মতামতের তোয়াক্কা না করেই ট্যাক্স বাড়ে, মূল্য সংযোজন কর বাড়ে। একই আইন ও বিচার প্রক্রিয়ায় একসময় যে দণ্ডিত হয়, পরে সে আবার নির্দোষ হিসেবে বীরের বেশে বের হয়ে আসে। এমন পরিবেশে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে যে ধরনের সাড়া পড়ার কথা ছিল তা হয়নি।
দেশে এখন গুটিকয় দল ও মহল বিশেষের স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। জাতীয় ঐক্য আজ বহুমুখী বিভাজনের কবলে। এ পরিস্থিতিতে সংস্কার প্রস্তাব কতটুকু কী সুফল বয়ে আনে, তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো এই সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ না করলে এটা হবে এক অর্থহীন বিনিয়োগ। সংস্কার বস্তুটি ‘তিক্ত ওষুধ’ নয়, যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও, প্রাণের দায়ে, গলাধঃকরণ করতেই হয়। সংস্কার একটি নিয়মিত ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। জাতির শিয়রে শমন উপস্থিত হবার পরে নয়, এই পথে হাঁটতে হয় পথটি কাম্য বলেই। কিন্তু দেওয়ালে পিঠ সম্পূর্ণ ঠেকে না গেলে সংস্কারের কথা ভাববার অভ্যাস আমাদের রাজনীতিবিদদের নেই। তাই তো এখানে ‘কলসালটেন্ট’ হায়ার করতে হয় সংস্কারের জন্য। সংস্কার জরুরি বলেই রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের পথে হাঁটতে হবে। কিন্তু তা কেবল কাগুজে সংস্কার নয়। শব্দের খেলাও নয়। আপাতত দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিক, অর্থ পাচারকারী, দ্বৈত পাসপোর্টধারীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ঠেকাতে কার্যকর সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্বৃত্তায়িত ব্যবস্থায় রাজনীতি ও অর্থনীতি চললে এই সংস্কার সম্ভব নয়। এই ব্যবস্থার অবসান কীভাবে সম্ভব, সবার আগে ভাবতে হবে তা নিয়ে। কাঠামোগত সংস্কারের আগে দরকার চিন্তা বা মনের সংস্কার।