তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ পদ্মা সেতুর বাজেটের তুলনায় সামান্য। এই স্বল্প টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক ঋণের খুব বেশি প্রয়োজন নেই বলে মনে করছে দেশের মানুষ।
Published : 07 Mar 2025, 12:20 PM
সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে আলোচনার একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে তিস্তা প্রসঙ্গ। বিশেষত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে জোরালোভাবে মাঠে নেমেছে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ’-এর গড়ে তোলা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিএনপি সমর্থিত সামাজিক সংগঠন ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’। অন্তবর্তীকালীন সরকারও এ বিষয়ে সরব হয়েছে। সরব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটিও।
ইতোমধ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকার দুজন উপদেষ্টাসহ অংশীজনদের উপস্থিতিতে গণশুনানির আয়োজন করেছে। গণশুনানির এই আয়োজন তিস্তা পাড়ের পাঁচ জেলাতেই হচ্ছে এবং বিএনপি করেছে দুদিনব্যাপী গণঅবস্থানসহ নানান কর্মসূচি।
গণশুনানি থেকে গণঅবস্থান, সবখানেই আলোচিত হচ্ছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিজস্ব অর্থায়ন প্রসঙ্গ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে নিজস্ব অর্থায়নের দাবি জোরালো হচ্ছে। জনসাধারণের ভাষ্যমতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কঠিন শর্তে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। পদ্মা সেতুর মতো নিজস্ব অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব।
জানা যায়, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২০২০ সালের অগাস্টে ৮ হাজার ২১০ কোটি টাকার প্রিলিমিনারি ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট প্রোপোজাল (পিডিপিপি) অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে জমা দেয়া হয়েছিল। পিডিপিপির ব্যাপারে চীন সরকারও একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে। প্রতিবেদনে “বড় আকারের ভূমি উন্নয়ন ও ব্যবহার এবং নৌ-চলাচল ব্যবস্থার উন্নয়নের বিষয়ে অধিকতর বিশ্লেষণ না থাকা এবং বড় আকারের বিনিয়োগ বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে” বলে সংসদকে জানিয়েছিলেন সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীনের পরামর্শ ও সমীক্ষা বিবেচনায় পরে তিস্তা মহাপরিকল্পনা আরও সুস্পষ্ট এবং বিস্তৃত করা হয়। সর্বোচ্চ ১০-১২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এই প্রকল্প সম্পন্ন করা সম্ভব বলে মত দেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও পরিকল্পনাবিদরা। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ পদ্মা সেতুর বাজেটের তুলনায় খুবই সামান্য। এই স্বল্প টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক ঋণের খুব বেশি প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন দেশের সর্বস্তরের মানুষ। দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন করে আসা নদী অধিকার কর্মীদের মতও তাই। তারা তিস্তা আন্দোলনের শুরু থেকেই নিজস্ব অর্থায়নের দাবি জানিয়ে আসছেন। তারা ‘পদ্মা সেতুর মতো নিজস্ব অর্থায়নে’ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য নানা কর্মসূচি পালন করেছে।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা রেলসেতু পয়েন্টে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আয়োজিত হয়েছিল তিস্তা গণশুনানি। গণশুনানিতে তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের নেতারা তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ‘তিস্তা কর্তৃপক্ষ’ গঠন করার প্রস্তাব জানিয়েছেন। তাদের মতে, নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘তিস্তা কর্তৃপক্ষ’ গঠনের বিকল্প নেই। দেশীয় অর্থায়ন নিশ্চিত করতে তারা সরকারিভাবে ‘তিস্তা বন্ড’ চালু, জাতীয় বাজেটে তিস্তার জন্য বিশেষ বরাদ্দ প্রদান, সারচার্জ নির্ধারণ, স্বল্প ও মধ্য মেয়াদী নদী ব্যবস্থাপনার অর্থ তিস্তা তহবিলে প্রদান, তিস্তা অববাহিকার পাঁচ জেলায় আদায়কৃত রাজস্ব তিস্তা মহাপরিকল্পনায় ব্যবহার করার দাবি জানান। তাদের এই ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নে সরব তিস্তা জনপদের মানুষ। তারা ঋণে জর্জরিত দেশকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা ইস্যুতে নতুন করে বৈদেশিক ঋণের ফাঁদে ফেলতে সম্মত নন। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন যেসব শর্ত জুড়ে দিয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য কঠিন। বিশেষত সুদের হার বেশি এবং ঋণ পরিশোধের সময় স্বল্প হওয়ায় তা বাংলাদেশকে ঋণ ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। একই সঙ্গে পরিবর্তিত বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য তা অর্থনীতিতে আরো চাপ সৃষ্টি করবে। যা অভ্যন্তরীণ অর্থ ও বাজার ব্যবস্থাপনাতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের ঋণ গ্রহণের চিত্রে দেখা যায়, গত কয়েক দশকে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকার সব বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক সংকটের সময়েও চীনের কাছ আর্থিক সহায়তা নিয়েছে। এতে করে গত দেড় দশকে বাংলাদেশ চীনের কাছে অধিকতরভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এই ঋণ পরিশোধের বেশ চাপ রয়েছে। সেই সঙ্গে অন্যান্য বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সময়ও ঘনিয়ে আসছে। এমন মুহূর্তে পুনরায় ঋণ গ্রহণ করলে চাপ আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে, নতুন করে ঋণ গ্রহণ করাটা হবে অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। বিধায়, এর বিকল্প হিসেবে দেশীয় অর্থায়নে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। তিস্তা আন্দোলনকারীরা মনে করেন, একমাত্র নিজস্ব অর্থায়নই ঋণ ঝুঁকি কাটিয়ে তুলতে পারে। দেশের টাকাতেই নদী প্রকৌশলে উন্নত চীনা প্রযুক্তি ব্যবহারে ধাপে ধাপে প্রকল্পের কাজ সম্পন্নের মাধ্যমে তিস্তাপাড়ের জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব। এতে তিস্তাপারের মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা দুইই পূরণ হবে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তিস্তা অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও তিস্তার পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। যা বর্ষাকালে এই অঞ্চলকে ভয়াবহ বন্যার হাত থেকে রক্ষা করবে। ভাঙন হ্রাসের মাধ্যমে বসতবাড়ি ও কৃষিজমি রক্ষা পাবে। তিস্তার ভাঙনে বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার হওয়ায় পুনরায় তা চাষযোগ্য হয়ে উঠবে। যা তিস্তা চরের কৃষকদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এনে দেবে। একই সঙ্গে নদীকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে নদীপাড়ের মানুষের জীবনমান উন্নত হবে এবং দেশের প্রবৃদ্ধিতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক গতি বেগবান হবে। দেশীয় বাজার ব্যবস্থাপনাতে ভারসাম্য বজায় রাখতেও সহায়ক হবে এই প্রকল্প। ঋণ পরিশোধ বা সুদ প্রদানের চাপ না থাকায় তিস্তায় বিনিয়োগকৃত অর্থ ও প্রকল্প বাস্তবায়নোত্তর সুফলের পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত হবে। যা দেশের জন্য কল্যাণকর।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, তিস্তার মূলধারাটি ব্যাপক খনন করলে পুনরুদ্ধার হবে ১৭০ বর্গকিলোমিটার জমি। যার সম্ভাব্য মূল্য ১৩, ১১৬.৫১ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর নদী তীরবর্তী ১১, ২৩৯.২৭ কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা পাবে। এতে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নতি হবে। বাড়বে প্রবৃদ্ধি। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রায় দশলাখের অধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। ঋণ মুক্তভাবে যদি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে এই প্রকল্পের পুরো সুফল আমরা ভোগ করতে পাব। এজন্য তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোনো বৈদেশিক ঋণ নয়, নিজস্ব অর্থায়নই উত্তম পন্থা। জনগণের প্রত্যাশা, সরকারসহ সকল রাজনৈতিক দল তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিজস্ব অর্থায়ন প্রসঙ্গে জাতীয় ঐক্যমতে পৌঁছাক।