ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির 'শিল্প ও সংস্কৃতি' বই দুটি আদ্যোপান্ত পাঠের পর অনুভব করতে পেরেছি, বিষয়টি শুধু চিত্রাঙ্কন কিংবা গান ও নাচের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর পরিসর আরও বিস্তৃত এবং ফোকলোরের সঙ্গে রয়েছে নিবিড় সংযোগ।
Published : 05 Aug 2023, 04:21 AM
ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর জন্য 'শিল্প ও সংস্কৃতি' নামে একটি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক জাতীয় শিক্ষাক্রম—২০২২ অনুযায়ী প্রণীত এই বইটি ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ানো শুরু করা হয়েছে। সন্দেহাতীতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা পেতে পারেন এমন একটি বিষয় মাধ্যমিকপর্যায়ে চালু করার জন্য।
কেননা, 'শিল্প ও সংস্কৃতি' বিষয়টি পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই নিজ সংস্কৃতি সম্পর্কে অবগত হবে। সংস্কৃতি একটি জাতির সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরে। 'শিল্প ও সংস্কৃতি' বিষয়ে অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা নিজ দেশ ও সংস্কৃতি জানার পাশাপাশি অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে নিজ সংস্কৃতির তুলনা করতে পারবে। এতে, একদিকে যেমন নিজ দেশ ও সংস্কৃতির প্রতি শিক্ষার্থীদের অনুভূতি জন্মাবে, তেমনি ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে।
শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়টি সম্পর্কে শুরুতে বলা হয়েছিল আগের চারু ও চারুকলা বিষয়ে যে পাঠদান করা হতো তার সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে নৃত্য ও সংগীতের মতো বিষয়গুলো। প্রকৃতপক্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির 'শিল্প ও সংস্কৃতি' বই দুটি আদ্যোপান্ত পাঠের পর অনুভব করতে পেরেছি, বিষয়টি শুধু চিত্রাঙ্কন কিংবা গান ও নাচের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর পরিসর আরও বিস্তৃত এবং ফোকলোরের সঙ্গে রয়েছে এর নিবিড় সংযোগ। কিন্তু দুঃখ ও আক্ষেপের বিষয় হলো শিল্প ও সংস্কৃতির আধার ফোকলোর (যা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অন্তর্ভুক্ত এবং যার বিষয় কোড ১২৩) নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন করেও মাধ্যমিক পর্যায়ের এই 'শিল্প ও সংস্কৃতি' বিষয়ে শিক্ষাদানের কোনো সুযোগ মিলছে না। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ফোকলোরে শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত এতো এতো কোর্স অধ্যয়নের পরেও মাধ্যমিক পর্যায়ের এই 'শিল্প ও সংস্কৃতি' বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োগের ক্ষেত্রে ১) চারু ও কারুকলা বিভাগ ২) সংগীত বিভাগ এবং ৩) নৃত্যকলা বিভাগের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। অনুল্লেখিত থেকে যাচ্ছে শিল্প ও সংস্কৃতির শেকড় ফোকলোর বিভাগের কথা। উল্লেখ্য, ওই বিভাগ তিনটি শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও শিল্প ও সংস্কৃতির শেকড় খোঁজা, জানা ও অধ্যয়ন পুরোটাই ফোকলোরের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যুক্ত করা যেতে পারে বাংলা এবং নাট্যকলা বিভাগকেও এবং যাচাইবাছাই করে দেখার সুযোগ আছে বিষয়টিতে আবেদনকারীরা পাঠদানের যোগ্যতা রাখেন কিনা?
তবে 'শিল্প ও সংস্কৃতি' বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগদানের ক্ষেত্রে যে ফোকলোরের সংযুক্তি অনিবার্য, এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের অপেক্ষা রাখে না। ফোকলোরের একজন শিক্ষার্থী হওয়ায় আমি জানি, আমাদের প্রতিটি ব্যাচেই, বিশেষ করে অনার্সে দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ বর্ষ এবং মাস্টার্সে সংস্কৃতি নিয়ে শিক্ষার্থীরা মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করে থাকেন এবং তাত্ত্বিকভাবে তো বটেই, ব্যবহারিকভাবে সংস্কৃতি বিষয়ে অধ্যয়নে যুক্ত হন।
মাধ্যমিক পর্যায়ের 'শিল্প ও সংস্কৃতি' বিষয়ের সঙ্গে ফোকলোরের কোর্সসমূহ কতটুকু সম্পর্কযুক্ত তা আলোচনা না করলে সহজে সকলের বোধগম্য হবে না বিষয়টি ৷ সপ্তম শ্রেণির 'শিল্প ও সংস্কৃতি' পাঠ্যপুস্তকের সূচিপত্রে মোট বারোটি অধ্যায় নিয়ে আলাপ করে দেখতে পারি আমরা। এগুলো হলো: ১) ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা’; ২) ‘নকশা খুঁজি নকশা বুঝি’; ৩) ‘মায়ের মুখের মধুর ভাষা’; ৪) ‘স্বাধীনতা আমার’; ৫) ‘বৈচিত্র্যে ভরা বৈশাখ’; ৬) ‘কাজের মাঝে শিল্প খুঁজি’; ৭) ‘প্রাণ-প্রকৃতি’; ৮) ‘প্রাণের গান’; ৯) ‘চিত্রলেখা’; ১০) ‘শরৎ উৎসব’; ১১) ‘সোনা রোদের হাসি’ ও ১২) ‘আমার দেশ আমার বিজয়’। এই অধ্যায়গুলোর আলোচ্য বিষয় ফোকলোরের ভিন্নি ভিন্ন কোর্সের বেসিক আলোচনার অন্তর্ভুক্ত ও সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২ অনুযায়ী প্রণীত এবং ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে নির্ধারিত 'শিল্প ও সংস্কৃতি' পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষক সহায়িকা অনুযায়ী—
প্রথম অধ্যায় 'বিশ্বজোড়া পাঠশালা'য় বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান, প্রাকৃতিক বর্ণচিত্র, গীত-বাদ্য-নৃত্য প্রভৃতির শিখন পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায় 'নকশা খুঁজি নকশা বুঝি’তে পরিবেশ, পরিবেশনা ও প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন নকশা ও প্যাটার্ন শিক্ষণ পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। এই অধ্যায় দুটি হলো ফোকলোরের লোকশিল্প (FL-301), লোকসংগীত (FL-302) ও পরিবেশনা ফোকলোর-লোকনৃত্য(FL-201) কোর্সের বেসিক অধ্যয়ন।
তৃতীয় অধ্যায় 'মায়ের মুখের মধুর ভাষা'র আলোচ্য বিষয় ও শিক্ষক সহায়িকাতে ভাষা, গান, কবিতার মাধ্যমে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার ভিন্নতা এবং ভাষার সাংস্কৃতিক উপাদান চিহ্নিতকরণের কথা বলা হয়েছে। উল্লেখিত এই অধ্যায়ের বিস্তারিত অধ্যয়ন করা হয় ফোকলোরের মৌখিক সাহিত্য (FL-105) এবং সমাজ ভাষাতত্ত্ব ও লোকভাষা (FL-401) কোর্সে।
চতুর্থ অধ্যায় 'স্বাধীনতা আমার' এবং দ্বাদশ অধ্যায় 'আমার দেশ আমার বিজয়'-এ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শিল্প ও সংস্কৃতির অবদান নিয়ে শিক্ষাদানের কথা বলা হয়েছে যা ফোকলোরের বাংলাদেশ অধ্যয়ন (FL-304) এবং বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের ইতিহাস (FL-404) কোর্সের আলোচ্য বিষয়।
পঞ্চম অধ্যায় 'বৈচিত্র্যে ভরা বৈশাখ' এবং দশম অধ্যায় 'শরৎ উৎসব'-এ গ্রামবাংলার উৎসব আলোচনা, উৎসবের আচার-সাজসজ্জা, বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীদের উৎসব প্রভৃতি আলোচ্য বিষয় হিসেবে রয়েছে৷ উল্লেখিত অধ্যায় দুটির বিস্তারিত আলোচনা করা হয় ফোকলোরের লোকউৎসব (FL-102), নন্দনতত্ত্ব (FL-302) এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী ও দেশজ জ্ঞান (FL-403) কোর্সে।
ষষ্ঠ অধ্যায় 'কাজের মাঝে শিল্প খুঁজি'তে বিভিন্ন লোকশিল্প যেমন—মৃৎশিল্প, তাঁতশিল্প, বাঁশ-বেত শিল্প, লোকশিল্প নির্ভর পেশা প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, যা ফোকলোরের লোকশিল্প (FL-301) কোর্সের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।
সপ্তম অধ্যায় 'প্রাণপ্রকৃতি'তে আলোচ্য বিষয় ও শিক্ষক সহায়িকাতে পরিবেশ বিপর্যয়, পরিবেশ সংরক্ষণ, সম্পদের পুনঃব্যবহার প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষাদানের কথা বলা হয়েছে যা সরাসরি ফোকলোরের বাংলাদেশ অধ্যয়ন (FL-304) এবং লোকপ্রযুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন (FL-307) কোর্সের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
অষ্টম অধ্যায় 'প্রাণের গান'-এ বিভিন্ন আঞ্চলিক গান যেমন—ভাটিয়ালি, সারি প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়টির বিস্তারিত অধ্যয়ন করা হয় ফোকলোরের লোকসংগীত ও গীতিকা (FL-301) কোর্সে। এই অধ্যায়ে শিক্ষাদানের জন্য একজন শিক্ষককে সংগীত বা নৃত্যশিল্পী হতে হবে এমন নয়। বরং বিভিন্ন লোকসংগীত বিষয়ে ধরণা ও কনটেক্সচুয়ালভাবে লোকসংগীতের স্বরূপ বিশ্লেষণ জরুরি, যা ফোকলোরের লোকসংগীত ও গীতিকা কোর্সে বিস্তারিত অধ্যয়ন করা হয়।
মাধ্যমিক পর্যায়ের এই 'শিল্প ও সংস্কৃতি' বিষয়ের সঙ্গে ফোকলোরের বিভিন্ন কোর্স এত নিখুঁতভাবে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার পরেও কর্মক্ষেত্রে ফোকলোরকে প্রাধান্য দেয়া তো দূরের কথা ফোকলোরের নাম পর্যন্ত উল্লেখ না থাকার বিষয়টি ফোকলোরের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের বেদনাহত করেছে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর একটি বিভাগ হিসেবে চালু হয়েছে ২০১৪ সালে। তারও পরে ২০১৫ সালে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয় বিভাগটি। এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই ফোকলোর পড়ানো হতো এবং সেখানে বিভাগটি চালু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতেও বিষয়টি পড়ানো হয়। তাই, মাধ্যমিক পর্যায়ের এই 'শিল্প ও সংস্কৃতি' বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতি বিষয়ক নিখুঁত ও মানসম্মত শিক্ষাদান এবং কর্মক্ষেত্রে ফোকলোরের সংশ্লিষ্টতা এখন শুধুমাত্র সময়ের দাবি।