হাসান আবিদুর রেজা জুয়েলের ‘চোখের জল ঢেলে এঁকেছি নদী’ যখন শুনি— মনে হয় এর চেয়ে সুন্দর কথা, এর চেয়ে সুন্দর সুর, এর চেয়ে সুন্দর কম্পোজিশন আর কী হতে পারে!
Published : 30 Jul 2024, 05:24 PM
জুয়েল ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদটি অপ্রত্যাশিত কিংবা খুব বিস্ময়কর ছিল না। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। অনেক বছর ধরে লড়াই করছিলেন ক্যানসারের সঙ্গে। মাঝে মধ্যে শুনতাম তিনি সুস্থ। আবার শুনতাম হাসপাতালে ভর্তি। অর্থাৎ জীবন ও মৃত্যুর দোলাচলেই ছিলেন। কিন্তু সেটি তার ভক্ত-অনুরাগীদের বুঝতে দেননি। যথাসম্ভব গান গেয়েছেন। টেলিভিশনের স্ক্রিনেও ছিলেন। কিন্তু জীবন ও মৃত্যুর দোলাচল থামিয়ে সত্যিই থেমে গেলেন।
খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল তার সংক্ষিপ্ত নামেই পরিচিত। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষ এবং আশির দশকের শুরুতে বাবার চাকরির সুবাদে তারা ছিলেন ঝালকাঠি শহরে। শহরের কোর্ট রোড এলাকায় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লিয়াকত আলী তালুকদারের (বর্তমানে ঝালকাঠি পৌরসভার মেয়র) যে বাড়িতে তারা ভাড়া থাকতেন, অনেক বছর পরে আমরাও সেই বাড়ির ভাড়াটিয়া হই। যদিও এই তথ্যটি জেনেছি আরও অনেক পরে। ততদিনে তার শিল্পীসত্তার সঙ্গে আমরা পরিচিত।
জুয়েল ভাই প্রথম মঞ্চে গান করেন ঝালকাঠিতেই। ১৯৭৮ সালে। তিনি তখন ঝালকাঠি সরকারি বালক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। বলা হয় ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’। ওই বয়সেই জুয়েল ভাই যেভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন, সেটি ছিল তার শিল্পী হয়ে ওঠার বড় অনুপ্রেরণা। বিবিসিকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘তাতে একটা ক্ষতিও হয়েছে। পাবলিক পারফরমেন্সের প্রেম পেয়ে বসলো আমাকে। ফলে আমার আর খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গান শেখা হয়ে ওঠেনি।’
জুয়েল ভাইয়ের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। তারপর আরও অনেকগুলো অ্যালবাম প্রকাশিত হলেও তার ‘এক বিকেলে’ অ্যালবামটি দারুণ জনপ্রিয় হয়। মনে আছে ৩৫ টাকা দিয়ে ‘এক বিকেলে’ অ্যালবামটি কেনার জন্য একশো টাকা খরচ করে ঝালকাঠির পাশের শহর বরিশালে গিয়েছিলাম। কোনো খ্যাতিমান শিল্পী, বিশেষ করে আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, ফিডব্যাকের মতো শিল্পী ও ব্যান্ড দলের নতুন অ্যালবাম আসার খবর পেলে আমরা বরিশাল শহরের বিবির পুকুর পাড়ে ঐশী ক্যাসেট ডিপোতে চলে যেতাম। কেননা ঝালকাঠি শহরে অ্যালবামটি আসত রিলিজ হওয়ার বেশ কিছুদিন পরে। আমাদের তর সইত না। যাদের কারণে আমরা অপেক্ষা করতে চাইতাম না, সেই তালিকায় ছিলেন জুয়েল ভাই। একটা লম্বা সময় তিনি আমাদের তারুণ্যকে এতটাই মুগ্ধ করে রেখেছিলেন যে, ঝালকাঠি শহরের নতুন কলেজ রোডে বন্ধু হাসানের বাসার সামনে সাউন্ড বক্সে উচ্চ স্বরে তার গান বাজাতাম। এজন্য মহল্লার মুরুব্বিদের বকাও খেয়েছি।
সিডি ও ডিভিডি-পূর্ববর্তী সংগীত দুনিয়ায় ফিতাওয়ালা ক্যাসেটের দাম ছিল তখন ৩৫ টাকা। তবে জনপ্রিয় শিল্পীর নতুন অ্যালবাম অনেক সময় কিনতে হতো ৪০ টাকা দিয়েও। টাকার সংকট থাকলে আমরা অবশ্য ঝালকাঠি শহরের কালিবাড়ি রোডে পপুলার ইলেকট্রনিকের উত্তমদার কাছে খালি ক্যাসেট দিয়ে আসতাম কোনো অ্যালবাম রেকর্ড করার জন্য। এর বিনিময়ে দিতে হতো দশ টাকা। জুয়েল ভাইয়ের ‘আমার আছে অন্ধকার’ অ্যালবামটি সম্ভবত এরকম কপি করেই নিয়েছিলাম।
গত শতাব্দীর শেষদিকে যখন বরিশাল সরকারি বিএম কলেজে পড়ি, তখন প্রায়ই মায়ের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে বরিশাল সিএন্ডবি রোডে পূর্বাশা নামে একটা ভবনের মেসে থাকা বন্ধুদের কাছে গিয়ে উঠতাম। দিন দুই পরে বন্ধু সাইদুল মায়ের চিঠি নিয়ে যেত। সেই চিঠি পড়ে সুড়সুড় করে বাড়ি ফিরে যেতাম। কিন্তু এই দুই তিনদিনের একটা বড় সময় কাটত আরিফ ভাইয়ের সঙ্গে। ঝালকাঠি শহরে যাদের গান, আবৃত্তি ও অভিনয় দেখে মুগ্ধ হতাম; যারা ছিলেন আমাদের কৈশোরের নায়ক—আরিফ ভাই তাদের একজন। তিনি তখন শিশু একাডেমির কর্মকর্তা। চাকরির সুবাদে বরিশাল শহরে থাকেন।
অভিমান করে বরিশাল চলে যাওয়ার ওই দিনগুলোয় খুব সকালে কিংবা সন্ধ্যার পরে আরিফ ভাইয়ের বাসায় যেতাম। গল্প করতাম। কখনো তার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে বরিশাল শহরে ‘শিল্পীসত্তা’র কার্যালয়ে গিয়ে বড়দের গান শুনতাম। মূলত আরিফ ভাইয়ের কাছেই তখন জানলাম যে জুয়েল ভাই তার সহপাঠী ছিলেন এবং কাকতালীয়ভাবে এটিও জেনে বিস্মিত হলাম যে, আমরা ঝালকাঠি শহরের যে বাড়িতে ভাড়া থাকি— জুয়েল ভাইয়ের শৈশবের কয়েকটি বছর কেটেছে ওই বাড়িতেই। ব্যাংকার বাবার চাকরির সুবাদে তারা সেখানে বসবাস করতেন। ততদিন শিল্পী জুয়েলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে গেছে এবং আজম খান, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, ফিডব্যাক ও মাইলসের মতো জুয়েল ভাইও আমাদের অনুভূতির একটা বিশাল জায়গা দখল করে নিলেন।
কাজের সূত্রে ঢাকায় চলে আসার পরে জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে দুয়েকবার এখানে-ওখানে দেখা হয়েছে বটে। তাতে সেরকম সখ্য গড়ে ওঠেনি। এমনকি তার শৈশবের গন্ধমাখা বাড়িতেই আমি বড় হয়েছি, সেটিও বলা হয়নি।
ফিতাওয়ালা ক্যাসেটের যুগ পেরিয়ে সংগীতের জগৎ যখন সিডি ও ডিভিডি প্লেয়ারে রূপান্তরিত হলো— তখনও এক বিকেলে, কুয়াশা, আমার আছে অন্ধকারের মতো অ্যালবামগুলো আমার সংগ্রহে ছিল। এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ডিভিডি প্লেয়ারও এখন অতীত। ইন্টারনেটের কল্যাণে জুয়েল ভাইয়ের গানগুলো এখন ইউটিউবেই শোনা যায়। মঞ্চে বা টেলিভিশন চ্যানেলে পারফরম্যান্সের কারণে এখন শুধু অডিও নয়, বরং ভিডিওসহই আমরা শুনতে পারি ‘আমার আছে অন্ধকার তোমাকে আমি দেব’ কিংবা ‘সেদিনের এক বিকেলে তোমার চোখে জল দেখেছি’…।
জুয়েল ভাই আমাদের কেন টানলেন? কেননা তখন আমরা তখন আজম খান, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, মাইলসের মতো ব্যান্ডগুলোয় যেভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম— জুয়েল ভাইয়ের গানের লিরিক, সুর ও কম্পোজিশন তার থেকে ভিন্ন ছিল। প্রধানত বিষণ্নতাই তার গানের মূল সুর। সম্ভবত এই বিষণ্নতা এবং তার ভরাট কণ্ঠের মাদকতাই আমাদেরকে মোহাবিষ্ট করেছিল। তার গান শুনলে আমাদের মন খারাপ হতো। আমরা একসময় উপলব্ধি করলাম, কলেজ রোডে বন্ধু হাসানের বাসার সামনে নুসরাত ফতেহ আলীর ‘দম মাস্ত কালান্দার’ কিংবা আজম খানের ‘অভিমানী তুমি কোথায় হারিয়ে গেছ’ গান উচ্চ ভলিউমে দিয়ে শোনার যে উন্মাদনা—জুয়েল ভাইয়ের ‘দূরে কোনো গির্জার মৃদু ঘণ্টা’ সেভাবে শোনা যায় না। কেননা এইসব গানে ইন্সট্র্যুমেন্টের ব্যবহার সীমিত। সেখানে কণ্ঠ ও কণ্ঠের ধীর লয়ের মাধুর্যই মুখ্য। ফলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জুয়েল ভাই সাউন্ড বক্সের উচ্চ আওয়াজ থেকে আমাদের ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলেন। সেজ মামা কুয়েত থেকে একটা ‘ওয়াকম্যান’ এনে দিয়েছেলেন। হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে হতো। ফলে জুয়েল ভাই ধীরে ধীরে নতুন কলেজ রোডে উচ্চ ভলিউমের সাউন্ড বক্স থেকে বেরিয়ে ওয়াকম্যানের হেডফোনে একা একা শোনা ও একা একা বিষণ্ন হওয়ার জাদুতে পরিণত হলেন।
সময় দ্রুত চলে যায়। পরিবর্তনের স্রোতে সবকিছু ভেসে যায়। কিন্তু এতসব পরিবর্তনের ভেতরেও হাসান আবিদুর রেজা জুয়েলের ‘চোখের জল ঢেলে এঁকেছি নদী’ যখন শুনি— মনে হয় এর চেয়ে সুন্দর কথা, এর চেয়ে সুন্দর সুর, এর চেয়ে সুন্দর কম্পোজিশন আর কী হতে পারে! চোখের জলেও নদী হয়।
বেঁচে থাকতে কখনো এই কথাগুলো জুয়েল ভাইকে বলা হয়নি। আজ যখন লিখলাম, তিনি পড়তে পারলেন না।