সহজ সমাধান হলো প্রতিটি রুটে ট্রেন ও বগির সংখ্যা বাড়ানো; ট্রেনের গতি বাড়িয়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্রুত যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া; রেলপথ নির্বিঘ্ন রাখা এবং সময়মতো প্রতিটি ট্রেনে ছাড়ার ব্যবস্থা করা।
Published : 18 Mar 2025, 10:29 AM
রোজার ঈদ উপলক্ষে ট্রেন যাত্রায় হয়রানি ও প্রতারণা এড়াতে ‘রেল সেবা’ অ্যাপ ব্যবহার করে টিকিট কিনতে যাত্রীদের পরামর্শ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকীর পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিপুল চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু অসাধু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান টিকিট কালোবাজারি করতে পারে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন আইডি থেকে কেনা টিকিট বেআইনিভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে বিক্রির চেষ্টা হতে পারে। এতে যাত্রী সাধারণের হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হবার আশঙ্কা রয়েছে।
শত ভাগ টিকিট অনলাইনে
এবার ঈদযাত্রায় রেলের শতভাগ টিকিট বিক্রি হচ্ছে অনলাইনে। eticket.railway.gov.bd এবং সহজ ডটকমের সাইট shohoz.com/bn থেকে অনলাইনে টিকিট কেনা যাচ্ছে। সহজ ডটকমসহ আরও কিছু অনলাইন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বাস, লঞ্চ ও আকাশপথের টিকিটও বিক্রি করছে।
রেলওয়ের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে গত ১৪ মার্চ থেকে। আাগামী পয়লা এপ্রিল ঈদ হবে— এটা ধরে নিয়ে তার আগের বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ২৭ মার্চের টিকিটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। গণমাধ্যমের খবর বলছে, অনলাইনে ২৭ মার্চের টিকিট কাটতে সোমবার (১৭ মার্চ) সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মাত্র আধা ঘণ্টায় দেড় কোটি হিট বা টিকিট কাটার চেষ্টা করা হয়েছে। ২৭ মার্চ ট্রেনে যাতায়াতের জন্য ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলোর আসন সংখ্যা ৩৩ হাজার ১৯৯টি। সারা দেশে এই আসন ১ লাখ ৭৩ হাজার ২৭৯টি। তার মানে যারা টিকিট কাটার চেষ্টা করেছেন, অধিকাংশই ২৭ মার্চের টিকিট কাটতে পারেননি বা যারা চেষ্টা করেছেন, তাদের খুব সামান্য সংখ্যক মানুষের ভাগ্যেই রেলের টিকিট জুটেছে। যারা রেলের টিকিট কাটতে পারেননি, তারা বাস বা অন্য কোনো উপায়ে বাড়ি যাবেন।
দেশের যেসব রুটে ট্রেন চলাচল করে, সেখানে মানুষেরা শুধু ঈদ নয়, সারা বছরের যাতায়াতেই ট্রেনকে অগ্রাধিকার দেন। কেননা ট্রেন নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক। অবশ্য রেলের টিকিট পাওয়া অনেক সময় চরম ভোগান্তিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে দুটি ঈদ এবং সরকারি ছুটির দিনগুলো সেই ভোগান্তি বেড়ে যায় বহুগুণ।
রেলের শত ভাগ টিকিট অনলাইনে দেয়ার ফলে টিকিট ছাড়া আধা ঘণ্টার মধ্যে বা আরও কম সময়ের মধ্যে টিকিট উধাও হয়ে যায়। যেমন সোমবার টিকিট ছাড়ার প্রথম আধা ঘণ্টার মধ্যে দেড় কোটি হিট হয়েছে। যাত্রীদের এই চাহিদা মাথায় রেখে টিকিটি কালোবাজারির অভিযোগও বেশ পুরোনো। আর এই কালোবাজারির সঙ্গে রেলের কিছু অসাধু কর্মী জড়িত— এমন অভিযোগও রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তারা ধরাও পড়েছে। ফলে এরকম বাস্তবতায় অনলাইনে শত ভাগ টিকিট দিয়েও যে জনমনে পুরোপুরি স্বস্তি ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে তা নয়। তবে সরকারের চেষ্টাটা ভালো। কেননা, এখন মোটামুটি শিক্ষিত সচেতন মানুষই স্মার্টফোন ব্যবহার করেন এবং তারা অনলাইনে টিকিট কেটে অভ্যস্ত। আবার নিজে কাটতে না পারলেও পরিচিতজনদের সহায়তা নিয়েও টিকিট কেটে ফেলা যায়।
তাছাড়া শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই অনলাইন টিকিটিং ব্যবস্থা পরিবহন খাতে স্বচ্ছতা আনায় বড় ভূমিকা রাখে। অনলাইন টিকিটিং টিকিটের কালোবাজারি প্রতিহত করতেও বড় ভূমিকা পালন করে। অনলাইনে ট্রেনের টিকিট যেহেতু জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে কাটতে হয়, ফলে সরকারের পক্ষে একটি ডাটাবেজ সংরক্ষণ করাও সহজ হয়। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হলো, ট্রেনের টিকিটের তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি। ফলে এর সহজ সমাধান হলো প্রতিটি রুটে ট্রেন ও বগির সংখ্যা বাড়ানো; ট্রেনের গতি বাড়িয়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্রুত যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া; রেলপথ নির্বিঘ্ন রাখা এবং সময়মতো প্রতিটি ট্রেনে ছাড়ার ব্যবস্থা করা। কেননা শুধুমাত্র শত ভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রির মধ্য দিয়ে হয়রানি ও ভোগান্তি কমানো তথা ডিজিটাল করার চেষ্টা করা হলেও ট্রেনের পুরো সিস্টেম যদি অ্যানালগ থাকে— তাহলে যাত্রীরা এর সুবিধা পাবে না। ঈদযাত্রায় ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় যেমন একটি বড় ভোগান্তির নাম— সেটি ঠেকানো না গেলে শুধু অনলাইন টিকিটিং দিয়ে যাত্রীসেবার মান বাড়ানো যাবে না।
সড়কের কী খবর?
অনলাইনে রেলের টিকিট কাটতে গিয়ে মানুষের যেরকম পেরেশানি, সড়ক বা নৌপথের চিত্রটা সেরকম নয়। কেননা প্রতিটি রুটেই একাধিক কোম্পানির বাস থাকে। খুব ব্যতিক্রম না হলে ঈদযাত্রায়ও অনলাইনে স্বচ্ছন্দে বাসের টিকিট কাটা যায়। অনলাইনে বাসের টিকিট বিক্রির অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান কাজ করে বলে এখানে ভোগান্তি ও প্রতারণার অভিযোগ কম। আবার বাসের যাত্রীদের বিরাট অংশই সরাসরি কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কাটেন। এমনকি ঈদযাত্রার সময়ও রাজধানীর গাবতলী-সায়েদাবাদ ও মহাখালী কাউন্টারে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে টিকিট কেটে অনেকে বাসে চড়ে বসেন। তবে সচেতন নাগরিক এবং যারা ঝক্কি এড়াতে চান, তারা আগেভাগেই বাসের টিকিটও অনলাইনে কেটে ফেলেন। রেলে যেমন একজন নাগরিক তার জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে একটি রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন এবং একজন যাত্রী একটি ট্রেনের সর্বোচ্চ চারটি টিকিট কাটতে পারেন, বাসের ক্ষেত্রে সে ধরনের সীমাবদ্ধতা নেই।
ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ভোগান্তি প্রতি বছরের ঈদযাত্রায় মোটামুটি নিয়মিত সংবাদ শিরোনাম। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, এবার ঈদযাত্রায় নারায়ণগঞ্জের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ভোগান্তির শঙ্কা নেই। রমজানের শুরু থেকেই মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। মহাসড়ক দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ দোকান ও স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করা হয়েছে, যা সড়কে যানজটের অন্যতম কারণ।
তবে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ১৮ কিলোমিটার এলাকা পড়েছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। এই ১৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সারা বছরই দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে। এ কারণে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বছরের পর বছর। বছর জুড়ে যানজটের নেপথ্যে রয়েছে রূপসী, বরপা ও ভুলতা বাসস্ট্যান্ড। এ তিন বাসস্ট্যান্ডের কারণেই এ মহাসড়কে যানজট প্রকোপ আকার ধারণ করেছে। ঈদ যত ঘনিয়ে আসে এ যানজটের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এ বছরও ঈদযাত্রায় এখানে ভোগান্তির আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকা-সিলেট-মহাসড়কের ভুলতা এলাকায় যানজটের পরিমাণ থাকে সবচেয়ে বেশি। যানজট নিরসনের জন্য ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও এশিয়ান বাইপাস সড়কে ৩৫৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে তিন তলাবিশিষ্ট ফ্লাইওভার। এতে দীর্ঘদিনের যানজটের নিরসন হবে বলে মনে করেছিল সাধারণ মানুষ। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। কারণ দূরপাল্লার ভালো কোম্পানির কিছু বাস ফ্লাইওভার দিয়ে চলাচল করলেও অধিকাংশ দরপাল্লার বাস ও লোকাল বাস ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলাচল করছে। ফপলে ফ্লাইওভার অনেকটা ফাঁকা থাকলেও ফ্লাইওভারের নিচে থাকে গাড়ির জটলা।
ঢাকা-রংপুর ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে চার লেনের কাজ চলায় যানজটের কারণে এসব এলাকার মানুষের এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তির নাও হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। আর রাজধানী থেকে পদ্মা সেতুর দিকে যাওয়ার পথ মাত্র একটি হওয়ায় হানিফ ফ্লাইওভারসহ সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ও কাঁচপুরে যানজটের আশঙ্কা রয়েছে।
গাজীপুর পার করাই চ্যালেঞ্জ?
এবার অবশ্য ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষকে গাজীপুর পার করাই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে পুলিশ। প্রতিবছর শিল্প সমৃদ্ধ এই জেলা থেকে লাখ লাখ মানুষ ঈদের ছুটিতে গাজীপুর ত্যাগ করে। এসব মানুষের বেশিরভাগই বাসে করে গন্তব্যে যায়। ঘরমুখো যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশ ও প্রশাসনকে।
এবার রাস্তার কারণে গাজীপুরের আলোচিত টঙ্গী থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়কে যানজটে কোনো শঙ্কা নেই। তবে বিআরটি প্রকল্পের কারণে বিভিন্ন স্থান সংকুচিত হওয়ায় যানজট সৃষ্টি হতে পারে। তার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শ্রমিকদের বিক্ষোভ। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের জেরে প্রতিনিয়তই তারা রাস্তায় নেমে আসেন এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করেন। সবশেষ সোমবারও গাজীপুর মহানগরের ভোগড়া এলাকায় বকেয়া বেতনের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা।
এমতাবস্থায় সম্প্রতি পুলিশ মহাপরিদর্শক গাজীপুরে গিয়ে শ্রমিকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন যাতে তারা অন্তত ঈদের ছুটির সময় সড়ক অবরোধ না করেন। কিন্তু তার সেই অনুরোধ যে কাজে আসবে কি না সেটি নির্ভর করছে শ্রমিকরা সময়মতো বেতন বোনাস পাবেন কি না তারওপর। তারা যদি সময়মতো বেতন ও ঈদ বোনাস না পান, তাহলে সঙ্গত কারণেই তারা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করবেন এবং তার ফলে ঢাকা থেকে সড়কপথে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং উত্তরব্ঙ্গগামী মানুষের ঈদযাত্রা ব্যাহত হবে। সুতরাং শ্রমিকদের যাতে রাস্তায় নামতে না হয়, সে বিষয়ে মালিকপক্ষকে আন্তরিক হতে হবে। সেইসাথে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনকেও এ বিষয়ে মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। সেইসাথে তৃতীয় কোনো পক্ষ যাতে স্যাবেটাজ করতে না পারে, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।
আকাশ ও নৌপথে ভোগান্তির শঙ্কা নেই
ঈদের সময় সড়ক, রেল ও নৌপথে বাড়তি চাপের কারণে স্বচ্ছল মানুষেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদ করার জন্য বাড়িতে যেতে সম্ভব হলে আকাশপথ ব্যবহার করেন। ফলে এই সময়ে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমানের ভাড়া বেড়ে যায়। কোনো কোনো রুটে, বিশেষ করে কক্সবাজারে। কিন্তু সোমবার সন্ধ্যায় অনলাইনে বিমানের টিকিট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা যায়, ঈদের দুয়েক দিন আগের টিকিটের দামও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে খুব বেশি নয়। এমনকি কক্সবাজারের টিকিটও পাওয়া যাচ্ছে। ২৭ মার্চ বৃহস্পতিবারের টিকিটের দাম একটু বেশি হলেও সেটি ঈদের সময়ের তুলনায়, অর্থাৎ বিগত বছরের তুলনায় বেশি নয়।
সড়ক ও রেলপথের তুলনায় নৌপথে এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তির হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে যাত্রী অর্ধেকেরও কমে নেমে এসেছে। এর ফলে লঞ্চে ভিড় তুলনামূলক কম হচ্ছে গত কয়েকটি ঈদে। শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয়, চাঁদপুরসহ অন্যান্য রুটেও যাত্রীদের চাপ কম থাকবে। গত ঈদে সদরঘাটে যাত্রীদের তেমন চাপ ছিল না। লঞ্চের অগ্রিম টিকিট বিক্রিতেও তেমন সাড়া ছিল না যাত্রীদের। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সড়কপথে যাত্রীদের চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় নদীপথের বিলাসবহুল লঞ্চগুলোর অগ্রিম টিকিট বিক্রিও হয়েছে ঢিমেতালে। এবারও পরিস্থিতির হয়তো কোনো পরিবর্তন হবে না।