বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাই মুখ্য আলোচ্য বিষয়। এই অগ্রযাত্রায় কারা থাকবে, কারা থাকবে না, কাদের বাদ দিতে হবে— এ নিয়েই চলছে তর্ক-বিতর্ক।
Published : 28 Mar 2025, 08:59 AM
ছোটবেলার একটি স্মৃতি আজও চোখের সামনে ভাসে। একটি স্কুল মাঠ, লাল-নীল পতাকায় সুসজ্জিত। আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এটা কী?’ মাঠের চারপাশে সারিবদ্ধ মানুষের ভিড়, পাশে হট্টগোল। হঠাৎ দেখলাম, কিছু মানুষ মারামারি শুরু করে দিল। একজন এমনকি চেয়ার তুলে আরেকজনকে আঘাত করতে উদ্যত হলো। এই ভয়াবহ ও আতঙ্কজনক দৃশ্য আমার শিশুমনে গভীরভাবে গেঁথে গেল। আর এর নাম শুনলাম আম্মার আতঙ্কিত মুখ থেকে— ‘ভোট’ ও ‘নির্বাচন’।
সময় অনেক পেরিয়ে এসেছি আমরা। গ্রামের ওই ভোটদানের পদ্ধতিতেও এসেছে নানা পরিবর্তন। একসময় ভোট মানেই গ্রামে বিড়ির বস্তা আর নির্বাচনি প্রচার অফিসে চব্বিশ ঘণ্টা গরম চা ও বিস্কুটের ব্যবস্থা ছিল অবধারিত। যাই হোক, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। কে নির্বাচনে অংশ নেবে, কারা কী দায়িত্ব পালন করবে, আদৌ নির্বাচন কবে হবে— এসব প্রশ্নে ধোঁয়াশা বিরাজ করছে।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাই মুখ্য আলোচ্য বিষয়। এই অগ্রযাত্রায় কারা থাকবে, কারা থাকবে না, কাদের বাদ দিতে হবে— এ নিয়েই চলছে তর্ক-বিতর্ক। সম্প্রতি আমরা এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনের একটি ধাপ অতিক্রম করেছি। অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাস অতিবাহিত হয়েছে। এই ঘটনাবহুল সময়ে প্রতিদিনই নতুন নতুন ঘটনা ঘটছে, আর আমাদের প্রিয় স্বদেশ গুজবের তীর্থভূমিতেও পরিণত হয়েছে।
আমরা ভবিষ্যতে কেমন দেশ দেখতে চাই? কী ধরনের ভোট চাই? কোন ধরনের সংস্কার প্রত্যাশা করি? সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত? পুলিশ কবে আরও সক্রিয় হবে? কর্মসংস্থান, বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য, শ্রমিকদের মজুরি-বোনাস, কৃষকদের সমস্যা, শিক্ষকদের বেতন, ভারত প্রশ্নে বিতর্ক ও সমালোচনা, বাণিজ্য পরিস্থিতি, নারী নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, মব ভায়োলেন্স, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার, দখলদারিত্ব, তদবির বাণিজ্য, নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম— এমন হাজারও ইস্যু আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে আমাদের প্রধান প্রশ্ন, আগামী নির্বাচন কবে হবে এবং তার সুস্পষ্ট রোডম্যাপ কী হবে?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসক এসেছে, আর ওই স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইও হয়েছে। আমাদের দেশেও সম্প্রতি স্বৈরাচারবিরোধী সফল সংগ্রাম হয়েছে। এর আগে আমরা ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন দেখেছি, যা ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই। কিন্তু ২০২৪ সালের সংগ্রাম আরও গভীর। এই সময়কালে দেশে গণতন্ত্র ছিল না, বাকস্বাধীনতা ছিল না। গণতন্ত্রের নামে ভোটাধিকার হরণ, রাতে ভোট ডাকাতি, ক্রসফায়ার, হত্যা-খুন, সীমাহীন লুটপাট, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ওপর নির্মম দমন-পীড়ন, পরিবারতন্ত্র— এসবের মাধ্যমে দেশকে একটি স্থবির অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এসবই পূর্ববর্তী সরকার করেছে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকার ফল হিসেবে ২০২৪ সালের আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের করুণ পতন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
বিগত সরকারের দিকে তাকালে দেখি, পরপর তিনটি বিনা ভোটের নির্বাচন ও ‘খালি মাঠে’ ভোট উৎসবের মাধ্যমে তারা নির্লজ্জভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রেখেছিল। সংবিধান ও গণতন্ত্রের সকল বিধান লঙ্ঘন করে তারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগটুকুও দেয়নি। নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসনকে তারা ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার বানিয়েছিল। বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার, হাজার হাজার রাজনৈতিক মামলা দিয়ে বিরোধীদের দমন করে দেশকে তারা একটি জেলখানায় পরিণত করেছিল।
বিগত সরকার অর্থনীতির ক্ষেত্রে বড় কাঠামোগত পরিবর্তন দেখালেও তাতে জনগণের জীবনমানে মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। মেগাপ্রকল্প ও ভারতের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে বলি দেওয়া হয়েছে বরং। বিগত আওয়ামী রেজিমে দলীয় দুর্বৃত্তায়নের যে শ্রেণি গড়ে উঠেছিল, তা সব যুগকে হার মানিয়েছে। গ্রাম, মহল্লা থেকে শহর— সর্বত্রই লুটপাটতন্ত্রের একটি শক্ত কাঠামো তৈরি করেছিল তারা। এর ফলে একটি ভয়াবহ লুটপাটের অর্থনীতি গড়ে ওঠে, যার বড় ভাগীদার ছিল ক্ষমতাসীন শেখ পরিবারের বিভিন্ন সদস্য। গণমাধ্যমে এসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। দলীয় পদ থেকে নির্বাচনের টিকেট বিক্রি পর্যন্ত— সর্বত্রই ছিল পরিবারটির একচ্ছত্র আধিপত্য।
আজ বাংলাদেশ যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য দায়ী বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারী মনোভাব। আমাদের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা— সবকিছুকেই তারা ধ্বংস করেছে নানামুখী তৎপরতায়। ক্ষমতায় টিকে থাকার মোহ ও রাষ্ট্রবিরোধী শক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তারা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
একটি বিশাল রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে তারা দায়িত্ব পালন করছেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্কারে হাত দিয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ও নেতৃত্বদানকারী ছাত্র প্রতিনিধিরাও এই সরকারের অংশ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রসমাজই এই অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা তৈরি করেছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্রসমাজের ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থার পতন ঘটেছে। তাই এই সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিত ফ্যাসিবাদী ধারার মূলোৎপাটন। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার মূল সংকট ছিল গণতন্ত্রহীনতা, জবাবদিহিতার অভাব, দুর্নীতি, লুটপাট ও বৈষম্য। তাই এখন পর্যন্ত তাদের কাজের ধারা হলো— যে সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে স্বৈরতন্ত্র বিকশিত হয়েছিল, সেগুলোর নীতি ও পদ্ধতিতে সুস্পষ্ট সংস্কার আনা। নির্বাচন কমিশন, আইন, বিচার— সব ক্ষেত্রে সংস্কারের কার্যক্রম ও চিন্তাভাবনা চলমান। যদিও মুক্তিযুদ্ধের চার নীতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্ক ও সমালোচনাও দেখা দিয়েছে। সরকারের উপদেষ্টাদের কারও কারও বক্তব্য নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। সম্প্রতি সেনাবাহিনী নিয়েও নানা বিরূপ মন্তব্য শোনা যাচ্ছে, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
আমাদের সংকটের মূল ছিল গণতন্ত্রহীনতা। তাই একটি জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ধারাই এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এই পরিবর্তন তাহলে কারা আনবে?
বিগত আওয়ামী রেজিমের আগে বিএনপির শাসনকালও জনগণ নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছে। ওই সময়ও ক্ষমতাবানরা লুটপাটতন্ত্রে নিমজ্জিত ছিল। গুম, খুন, ক্রসফায়ার, বোমা হামলার মতো ঘটনাও আমরা দেখেছি তখন। বিনা ভোটের নির্বাচনের নজিরও রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে দলীয় প্রধান ও উপপ্রধানের অনুপস্থিতিতে আন্দোলন-সংগ্রামের উদ্যোগ নিলেও বিগত সরকার বিএনপিকে নির্মমভাবে দমন করেছিল। পুলিশি হয়রানি ও মামলার মাধ্যমে তাদের আন্দোলন মাঠে গড়াতে দেয়নি। এমনকি বামপন্থীদের দুর্বল শক্তিকেও তারা দমন করতে পিছপা হয়নি। মৌলবাদী দলগুলো গোপন কৌশলে কার্যক্রম চালিয়েছে। অন্যদিকে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল, আওয়ামী সরকার তা-ও নষ্ট করেছে। বরং মৌলবাদী শক্তিকে তারা নানাভাবে হেফাজত করেছে— কখনো টাকা, কখনো সম্পদ দিয়ে।
বিএনপি এবার নির্বাচনি আলোচনায় সতর্ক। ৫ অগাস্টের পর থেকে তারা ধৈর্য ধরার কৌশল গ্রহণ করেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে তাদের নেতাকর্মীরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা, তা বলা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, জামায়াত ইসলামীর অনুসারীদের কর্তৃত্ব দেখা যাচ্ছে প্রশাসনের সব স্তরে। মাঠ প্রশাসনে তাদের শক্তি বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি বলে মনে হচ্ছে।
ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নতুন দল এনসিপিও পিছিয়ে নেই। ব্যয়বহুল নানা আয়োজনের মাধ্যমে তারা জনমনে জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি করছে। এনসিপির নেতারা হেলিকপ্টার বা বিশাল গাড়ির বহর নিয়ে নিজ এলাকায় যাচ্ছেন, যা বিগত যেকোনো রেজিমের সঙ্গে মিলে যায়। সম্প্রতি পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন এলাকায় এনসিপি নেতাদের মোটর সাইকেল ও গাড়ির বহর নিয়ে শোডাউন— কীভাবে গ্রহণ করছে মানুষ? মানুষ কি এই গাড়িবহর ও পেশিশক্তির রাজনীতির পরিবর্তন চায় না? বিগত শাসকরা যে পথে চলেছে, ওই পথে যারা চলবে, তারা আদর্শের ভিন্নতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলে ফলাফল আগের মতোই হবে।
বাংলাদেশের মানুষ পরিবর্তন চায়। সেই পরিবর্তন কাগজে-কলমে নয়। রাজনীতি করতে হলে মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে করতে হবে। আকাশ থেকে বা ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে টাকার বান্ডিল নিয়ে রাজনীতির মাঠ দখলের স্বপ্ন যারা দেখে, তাদের স্বপ্ন দিবাস্বপ্নই থেকে যাবে। আরেকটি বিষয় হলো জোর করে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়া— যার সঙ্গে ভোট বা নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
তাই আমরা কোন পথে যাব, ওই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জনগণ কিন্তু ভুল করে না। ফ্যাসিস্টকে তারা বয়কট করেছে, নতুন ফ্যাসিস্ট এলেও তাকে একই পথ দেখাবে।
স্বাধীনতার মাস চলছে। আমাদের সব অর্জনের কেন্দ্রবিন্দু একাত্তর ও বাংলাদেশ। পাকিস্তানিদের চাপিয়ে দেওয়া শোষণ, বৈষম্য ও অধিকারহীনতার দাঁতভাঙা জবাব আমরা দিয়েছিলাম মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামের মাধ্যমে। ওই সংগ্রামের প্রধান অংশীজন ছিলেন এদেশের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুবকসহ সর্বস্তরের মেহনতি মানুষ। তাই এই অংশীজনদের বাদ দিয়ে সংস্কার বা নির্বাচন— কিছুই সফল হবে না।