Published : 21 Jun 2022, 07:41 PM
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১০টি অনুচ্ছেদ 'বিল অব রাইটস' হিসেবে পরিচিত। এই ১০টি অনুচ্ছেদ যুক্তরাষ্ট্রের আদি বা মূল সংবিধানে ছিল না, এগুলো পরবর্তীতে ১৭৯১ সালে যুক্ত করা হয়। অধিকার সম্পর্কিত এই অনুচ্ছেদগুলোতে বাক-স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, বিচারের ক্ষেত্রে নাগরিকদের কতিপয় অধিকার ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়েছে। ২য়, ৩য় ও ৪র্থ সংশোধনীতে যুদ্ধ, অস্ত্র, তল্লাশি ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। ২য় সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণকে অস্ত্র বহন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ৩য় সংশোধনীতে শান্তিকালীন সময়ে বেসামরিক নাগরিকদের বাসস্থানকে সামরিক বাহিনীর লোকদের আবাসন হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যুদ্ধকালীন এরকম আবাসন আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, এমনটাও বলা হয়েছে। ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে অযৌক্তিক তল্লাশি থেকে নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায়শয়ই স্কুল-কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ বিভিন্ন জনসমাগমের স্থানে বন্দুকের গুলিতে নিহতের ঘটনা ঘটে। ইদানীংকালে এটা অনেক বেড়ে গিয়েছে। ২য় সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা অস্ত্র রাখার অধিকার পান। আর এই অধিকারের অপপ্রয়োগেই এমন ঘটনাগুলো ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের একটা গর্বের ইতিহাস আছে, সেটা আমাদেরও আছে। আর তা হলো ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন। সারা বিশ্বের সামনে আমরা নিজেদের যুদ্ধের জন্য সাফাই গেয়েছি কারণ যুদ্ধ ছিল ন্যায়যুদ্ধ আর নিজেদের স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষেও আমরা ন্যায্যতা অর্জনে যুক্তি তুলে ধরেছি। তাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ব্রিটিশ কলোনির অধীন না থেকে কেন স্বাধীনতা চান তার সুস্পষ্ট ব্যাখা আছে। এই ঘোষণায় নিজেদের অবস্থানের ন্যায্যতা যাচাই করেছেন তারা। এটিকে মানবাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও আত্মমর্যাদার অধিকার অর্জনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের জাতিগোষ্ঠীর জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে দেখা যেতে পারে। সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে জন-জীবনকে কীভাবে অতিষ্ঠ করে তোলা হয়েছিল সেটিও বলা আছে। স্বেচ্ছাচারী ব্রিটিশ রাজা যে সামরিক বাহিনীর যথেচ্ছ অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ করেছে সেই সম্পর্কে ঘটনাভিত্তিক বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। স্বাধীনতা পাবার পরও দেশের অভ্যন্তরে কিছু ঝামেলা ছিল।
জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পদের অধিকার যাতে সমুন্নত রাখা যায় সেজন্যই ২য় সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণকে অস্ত্র রাখার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। এতে করে কেউ তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে আসলে তারা যেন প্রতিহত করতে পারেন। এই প্রতিকারটি মূলত তাদেরকে আত্মরক্ষার লাইসেন্স দিয়েছিল। আইনের উদ্দেশ্যটি প্রকৃতপক্ষে এমনই ছিল। অর্থাৎ অধিকার হরণের বিরুদ্ধে এমন অধিকার দেওয়া হয়েছিল। এই ধরনের অধিকারকে তলোয়ার হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ কোনো সভ্য সমাজে নেই; বরং ঢাল হিসেবেই এটাকে বিবেচনা করে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ৩য় সংশোধনীতে আমরা দেখব মানুষের বাসাবাড়িতে সামরিক বাহিনীর অনধিকার প্রবেশ বারিত। সামরিক বাহিনীর এরকম অনধিকার চর্চার রেওয়াজ ছিল। তাই অযৌক্তিক তল্লাশি ৪র্থ সংশোধনীতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা আছে। স্বাধীনতা পেয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রশাসনের ক্ষমতার এরকম অপপ্রয়োগ বন্ধ করার জন্যই অধিকারগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। ২য় সংশোধনীতে একটা সামরিক বাহিনী গঠনের কথাও বলা হয়েছে। এই অস্ত্র রাখার অধিকারকে দুই দিক থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথম দিকটি হচ্ছে ব্যক্তিগত অধিকার। এখানে ব্যক্তির অস্ত্র রাখার অধিকারের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়। আবার অন্য দিক থেকে এটি বলা যেতে পারে যে যেহেতু এই অনুচ্ছেদে একটি সামরিক বাহিনী গঠনের কথাও বলা হয়েছে সুতরাং অস্ত্র রাখার এই অধিকারকে সামষ্টিক অধিকারের অংশ হিসেবে দেখা যায়। সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে এই দুটি ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যগত মৌলিক পার্থক্য আছে৷ ১৯৩৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট সামষ্টিক বা যৌথ অধিকারকে বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় আগ্নেয়াস্ত্র আইন ১৯৩৪ অনুযায়ী অস্ত্র রাখা নিয়ন্ত্রণে কংগ্রেসের ক্ষমতাকে বহাল রাখলেও পরবর্তীতে প্রায় ৭০ বছর পর ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট অন্য একটি মামলায় ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। ১৯৩৯ সালে আদালত বলতে চেয়েছিলেন অস্ত্র বহন করার অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে সংবিধান প্রণয়নকারীদের উদ্দেশ্য ছিল একটি সুনিয়ন্ত্রিত কার্যকর সামরিক বাহিনী গঠন করা। কিন্তু পিস্তল বহনের অধিকার নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটন ডিসি-এর আইনকে চ্যালেঞ্জ করা হয় এবং ২০০৮ সালে কোর্ট অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের আইনটি বাতিল করে বলেন ২য় সংশোধনীর ফলে নাগরিকরা ব্যক্তিগতভাবে আগ্নেয়াস্ত্র দখলে রাখার ক্ষেত্রে অনুমতিপ্রাপ্ত। নয় জন বিচারকের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঁচ জন এমন যুক্তির পক্ষে রায় দেন। আদালত অবশ্য আরও কিছু কথা বলেন। যেমন, অপরাধী বা মানসিকভাবে অসুস্থদের ক্ষেত্রে অস্ত্র বহনের অধিকার নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষে বলেন আদালত। এখন দেখা যাচ্ছে অস্ত্র বহনের অবারিত ও অবাধ অধিকার নতুন নতুন অপরাধী বানাতে কাজ করছে। সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীও অধিকার নিয়েই কথা বলে। কোনো অঙ্গরাজ্য নাগরিকের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি লাভের অধিকারকে লঙ্ঘন করে কোনো আইন বানাতে পারে না– এই বিধানটির সাথে ২য় সংশোধনীর যোগসূত্র স্থাপন করে ২য় সংশোধনীকে ব্যক্তিগত অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে যান বিচারকরা। অবশ্য এখানে একজন জজ ও তার সমর্থকদের যুক্তি ছিল 'যথাযথ প্রক্রিয়া' অনুসরণের; অন্যদিকে অন্য জজ 'বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি'-এর দিকে ইঙ্গিত দেন। অর্থাৎ তাদের দৃষ্টিকোণ ভিন্ন ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত নিকট অতীতে ২০১৬ সালে ম্যাসাচুসেট্সে স্ট্যানগান দখলে রাখা নিষিদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে স্ট্যানগানের দখলকে ২য় সংশোধনীর আওতায় সুরক্ষিত বলেছেন। ২০২০ সালে হ্যান্ডগানের ক্ষেত্রে লাইসেন্স প্রত্যাশীকে যথাযথ কারণ দেখানোর আদেশকে বহাল রেখেছেন নিউইয়র্ক সেকেন্ড সার্কিট (আপিল আদালত)। আপিলের অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও বিশেষ অধিকার মঞ্জুর করে সুপ্রিম কোর্ট এ সংক্রান্ত মামলা শোনেন। উভয়পক্ষ ২০২১ সালের নভেম্বরের ৩ তারিখে মৌখিক তর্ক উপস্থাপন করেন। এখনও আদালত আদর্শ পরিমাপক নির্ধারণ করতে পারেননি। কিছু প্রশ্নের উত্তর এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। সংবিধানে যেসকল পূর্বসুরীরা ২য় সংশোধনী সন্নিবেশিত করেছিলেন তাদের উদ্দেশ্যে ছিল একটা সুশৃঙ্খল সুগঠিত নিয়মতান্ত্রিক সামরিক বাহিনী গঠন এবং মার্কিনীদের নিরাপত্তা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু এই ২য় সংশোধনীকে পুঁজি করে জনসমাগম ঘটে এমন জায়গায় গুলি চালানো, বসতভিটার সামনে গুলি চালিয়ে হত্যা করা, নানান কায়দায় বন্দুকের গুলিতে নিরীহ জনসাধারণ হত্যা করার অধিকার কাকে কে দিয়েছে? এখন তো যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী একটা সামরিক বাহিনী আছে। আর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপেরও সুযোগ নেই। কারণ আপাতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সুসংহত। আর যদি স্বাধীনতায় আঘাত আসে তবে সামরিক বাহিনীর অস্ত্র নিয়ে সকল নাগরিক তা মোকাবেলা করতে পারেন। কারণ সামরিক বাহিনী ও অস্ত্রের ভাণ্ডার জনগণেরই সম্পদ। প্রশ্ন হলো ২য় সংশোধনীতে যে অধিকার দেওয়া হলো সেই আইন কি আজও প্রাসঙ্গিক? এখন যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের জনগণই পরিচালনা করেন; কোনো কলোনি নেই, ভিনদেশি কোনো রাজার কর্তৃত্ব নেই, নেই জনগণের ওপর কারও অনধিকার চর্চা করার আশঙ্কা। তবে কেন এই অধিকারকে বাতিল করা হচ্ছে না? আসলে ওই অধিকারটা এই সময়ে এসে প্রয়োজনীয়তাই হারিয়েছে। যে অধিকার মানুষের নিরাপত্তা না দিয়ে বরং মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে সেটা কোনোভাবেই বলবৎ থাকতে পারে না। তাও আবার এমন অধিকার মূলত মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্যই সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। কিন্তু এই অধিকারের ফায়দা লুটে আজ তা মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে অপব্যবহৃত হচ্ছে। মানুষের জীবন হচ্ছে বিপন্ন; মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, একই জাতির মানুষ হওয়া সত্ত্বেও একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্র যদি স্বাধীনতার ঘোষণার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় তবে অবশ্যই এরকম ঢালাও অযৌক্তিক অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ। অস্ত্র কেনা-বেচা, দখলে রাখা ইত্যাদি বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা উচিৎ। অধিকার চর্চার নামে যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটে গেল তার দায় কে নেবে? শুধু অস্ত্র বহনের অধিকার দিয়েই খতম! হত্যার দায় বহন করার ব্যাপারটিও দেখা চাই। এখনকার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের নিরাপত্তার জন্য সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী আছে, অভ্যন্তরীণ কোনো হুমকি নেই। তবে এই বন্দুকধারীরা আত্মরক্ষার ক্ষেত্র তৈরি করছে। তবে এই ক্ষেত্রটি ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছেন না মানুষজন; তাই অকাতরে প্রাণ দিতে হচ্ছে মানুষকে। ঘটছে অপমৃত্যু। অস্ত্র বহন করার, নিজ দখলে রাখার ঢালাও, বেসামাল ও অনিয়ন্ত্রিত অনাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের নতুন করে ভাবার সময় এসছে। এ বিষয়ে কাজ করার অবকাশ আছে। কারণ সাধারণ মানুষের জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলা ঠেকানো অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের পবিত্রতম সাংবিধানিক দায়িত্বের আওতায় পড়ে। ১৮ বছর বয়সী যে কারও অবাধে অস্ত্র কেনার আইনগত অধিকারে লাগাম টেনে না ধরতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রকে ভবিষ্যতেও দেখতে হতে পারে নির্দয় ও পাশবিকভাবে নিরস্ত্র ও নিরপরাধ ব্যক্তির প্রাণের হানি। অস্ত্র বিক্রেতারা অস্ত্র বিক্রি করে মুনাফা করার জন্য অনধিকার অধিকারের চর্চার মতো বিষয়কে উস্কে দিতে দ্বিধাবোধ করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা অবশ্য একটা বড় নিয়ামক। আর তাই এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনগণকে বুঝিয়ে এই মুনাফাখোরদের লাগাম টানা। নিরপরাধ প্রাণগুলো ঝরে পড়ার দায় কেন কর্তৃপক্ষ বহন করবে না? যদি প্রাণের সঞ্চারে গতি আনতে হয়; যদি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেবার পৈশাচিক এই খেলাকে বন্ধ করে নিরাপদ জনপদ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে টিকে থাকতে হয় তবে অবশ্যই দরকার বাস্তবমুখী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ, তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, রাষ্ট্রপ্রধান, অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার, সুশীল সমাজসহ সমাজের সবপক্ষ ও নানান মত-পথের লোককে এই বিষয়ে মনে হয় নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবার সময় এখন হাজির৷