Published : 24 Apr 2022, 12:52 PM
গত বছর থেকে গুগল, ফেইসবুকের মতো টেক-কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) দেওয়া শুরু করেছে। এর ফলে একজন বিজ্ঞাপনদাতার গুগল বা ফেইসবুকে বিজ্ঞাপন দিলে যে খরচ পড়ছে, তার সমপরিমাণ খরচ পড়ছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম- এ বিজ্ঞাপন দিলে। কিন্তু বিজ্ঞাপন থেকে গুগল বা ফেইসবুক এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম- এর আয় কিন্তু সমান হয় না। এর কারণ হলো, বিজ্ঞাপনদাতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম- এর বিল থেকে উৎসে আয়কর কেটে তারপর বিল পরিশোধ করে, যা গুগল বা ফেইসবুকের ক্ষেত্রে হয়না। গুগল বা ফেইসবুক বিজ্ঞাপনের সম্পূর্ণ টাকা পেয়ে যায়।
তাই বিজ্ঞাপনদাতার খরচ সমান থাকলেও, বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের পরিমাণ সমান থাকছে না। এজন্য এখনো দেশের চিরাচরিত বিজ্ঞাপন মাধ্যম এবং বৈশ্বিক টেক-কোম্পানিগুলোর মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা রয়েই গেছে।
ধরুন, কোন বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ১ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন দিয়েছে। বিডিনিউজ এর পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপন বিল ইস্যু করার সময় ১৫ শতাংশ মূসক যোগ করে মোট ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা উক্ত বিজ্ঞাপনদাতাকে কোম্পানিকে দাখিল করা হয়েছে।
যখন বিজ্ঞাপনদাতা বিডিনিউজকে বিল পরিশোধ করবে তখন প্রথমে মূসক বাবদ ১৫ হাজার টাকা উৎসে কর্তন করবে এবং তারপর ১ লাখ টাকা থেকে ৫ শতাংশ হিসেবে ৫ হাজার টাকা কেটে রেখে বাকি ৯৫ হাজার টাকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-কে পরিশোধ করবে।
অন্যদিকে ফেইসবুক-এ একই বিজ্ঞাপনদাতা ১ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন দিলে অনলাইনে ফেইসবুক বিজ্ঞাপনদাতার কাছ থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা কেটে নিবে। মূসক বাবদ ১৫ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিবে। আর বাকি ১ লাখ টাকার পুরোটাই ফেইসবুক নিয়ে নিবে। তার ফল হচ্ছে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ৫ হাজার টাকা এখনো কম পাচ্ছে। তাই অসম কর ব্যবস্থা রয়েই গেছে। এজন্য এই টেক কোম্পানিগুলোকেও আয়করের আওতায় আনতে হবে।
টেক-কোম্পানিকে কীভাবে আয়করের আওতায় আনা যাবে?
বর্তমানে ফেইসবুক এবং গুগল তাদের মূসক প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রতিমাসে মূসক রিটার্ন দাখিল করে। যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্য সংযোজন কর এবং সম্পূরক শুল্ক আইন মেনে মূসক দিচ্ছে- তাই একইরকম ব্যবস্থা যদি আয়কর অধ্যাদেশে রাখা হয়, তাহলে টেক-কোম্পানিগুলোকেও খুব সহজেই আয়কর প্রদানের আওতায় আনা যাবে।
বিষয়টি একটু জটিল, কিন্তু অসাধ্য নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড টেকনিক্যাল বিষয়ে দেশের আইটি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারে। আর কীভাবে আয়করের বিষয়টি অধ্যাদেশে নিয়ে আসা যায়, তার জন্য বিভিন্ন প্রফেশনাল বডি, যেমন: দ্য ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারে।
আমাদের আগে থেকেই বিভিন্ন দেশ ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স (ডিএসটি) বাস্তবায়ন শুরু করেছে। যারা আগে থেকেই এই কর ব্যবস্থা চালু করেছে তাদের আইনগুলো পর্যালোচনা করলে বিষয়টা আরো সহজভাবে করা যাবে।
কোন কোন দেশে ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স (ডিএসটি) রয়েছে?
ইতোমধ্যে অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ইতালি, পোল্যান্ড, স্পেন, তুরস্ক এবং যুক্তরাজ্য ডিএসটি চালু করেছে। এই কর ব্যবস্থার ওপর বেলজিয়াম, চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়া প্রস্তাব পাস করেছে। আলোচনার পর তারা এই ব্যবস্থা কার্যকর করবে। আর লাটভিয়া, নরওয়ে এবং স্লোভেনিয়া এ কর ব্যবস্থা তাদের দেশে কার্যকর করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
তবে অস্ট্রেলিয়া ২০২০ সালে একেবারে নতুন এক ডিএসটি আইনের কথা সামনে নিয়ে আসে। অস্ট্রেলিয়াসহ প্রতিটি দেশের সংবাদ ও গণমাধ্যমগুলো যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সেটি ওই প্রস্তাবিত আইনে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রিন্ট মিডিয়া বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর ফেইসবুক, গুগল ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিউজ ফিড- এ শেয়ার হচ্ছে এবং এসব প্লাটফর্মের ইউজাররা এ খবরগুলো পড়ছেন। এতে করে গুগল ও ফেইসবুক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মূল সংবাদমাধ্যমের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। দিনে দিনে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে তাদের অবস্থা নাজুক হচ্ছে।
তো এ প্রেক্ষাপটে অস্ট্রেলিয়ার প্রস্তাবিত আইনে যা বলা হয়েছিল তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, সংবাদ প্রকাশকদের কাছ থেকে গুগল বা ফেইসবুকের বাণিজ্যিক চুক্তি থাকতে হবে। অর্থাৎ কারও কোনও খবর যদি ফেইসবুক বা গুগল প্রকাশ করে, তাহলে মূল সংবাদ প্রকাশকারী প্রতিষ্ঠানকে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। আইনে সংবাদের অংশবিশেষ প্রকাশের জন্যও সংবাদ ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ পরিশোধের কথা ছিল।
যখন অস্ট্রেলিয়ায় এই কর ব্যবস্থার কথা জোরালো হয়, তখন গুগল থেকে বলা হচ্ছিল, তারা ব্যবসা অস্ট্রেলিয়া থেকে গুটিয়ে নিবে। শেষ পর্যন্ত আলোচনার ভিত্তিতে অস্ট্রেলিয়া গত বছর আর ডিএসটি আইন পাস করেনি।
তবে আইনটি পাস হলে দুইটি সুবিধা হতো।
এক, অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়া হাউজগুলো টেক-কোম্পানি থেকে রয়্যালটি পেত, যার ফলে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা মজবুত হতো।
দুই, দেশের সরকার তা থেকে রাজস্ব পেতো।
২০১৮ সালে টেক-কোম্পানিগুলো যে কর সুবিধা পাচ্ছিলো তা প্রত্যাহার করে তাদের উপরেও সমান হারে কর ব্যবস্থা চালুর দাবি তোলে অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যমগুলো। কয়েক বছর পরে ২০২১ সালে গণমাধ্যমগুলো মূসক দিলেও টেক কোম্পানিগুলোর আয়কর সুবিধা আর প্রত্যাহার করা হয়নি।
আয়করের হার কত হবে এবং কখন দিতে হবে?
এখন পর্যন্ত যে দেশগুলো ডিএসটি বাস্তবায়ন করেছে তার হার দেশভেদে ১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই সীমার মধ্যে যেকোনও হার নির্ধারণ করতে পারে। তবে এই করের হার নির্ধারণ হয় মোট প্রাপ্তির ওপর।
আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-তে ৮২সি ধারায় ন্যূনতম কর উল্লেখ রয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো মোট টার্নওভারের ওপর ২ শতাংশ হারে ন্যূনতম কর দিয়ে থাকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই হারেই টেক-কোম্পানিগুলোর জন্য ডিএসটি নির্ধারণ করতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো, কোন টেক-কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এই হারে করারোপ করা হবে?
যদি কোন কোম্পানির বিশ্বব্যাপি আয় ৭৫ কোটি ইউরো হয় এবং একটি নির্দিষ্ট দেশ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় প্রাপ্ত হয়, তাহলেই কেবল ওই কোম্পানিকে নির্ধারিত হারে ডিএসটি দিতে হয়।
আমাদের দেশের ক্ষেত্রে, যেসব কোম্পানির বৈশ্বিক আয় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ এবং বাংলাদেশ থেকে ২৫ কোটি টাকা যেসব টেক কোম্পানি আয় করে নিয়ে যায়, তাদের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ হারে ডিএসটি দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করা যেতে পারে। এখন দেখা গেল, গুগল বিশ্বব্যাপি সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করেছে, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তার আয়ের পরিমাণ ২৫ কোটি টাকার নিচে- তাহলে গুগলকে বাংলাদেশে কোনও কর দিতে হবে না।
ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স কেন গুরুত্বপূর্ণ?
করোনাভাইরাস শুরুর আগ থেকে অনলাইনে লেনদেনের পরিমাণ বেডেছিল। কোভিড-১৯ সংক্রমণে মানুষ যখন ঘরবন্দি হয়ে পড়লো- তখন অনলাইনে লেনদেনের পরিমাণ অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়ে যায়। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য অনলাইনে বৃদ্ধি পাওয়াতে অনেক দেশই তখন সরকারের রাজস্ব আহরণের এক নতুন ক্ষেত্রে খুঁজে পায়। অর্থনৈতিক স্থবিরতার সময় বিভিন্ন দেশের সরকার এক নতুন আশা দেখতে পায়।
বাংলাদেশ সরকারও বিগত কয়েক বছর ধরে বাজেটের আকার বৃদ্ধি করে চলেছে এবং পাশাপাশি বৈদেশিক নির্ভরতা কমিয়ে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন ক্ষেত্র এবং করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কীভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-কে আরও যুগোপযোগী এবং আধুনিক করা যায় সেদিকেও মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।
এ অবস্থায় ডিএসটি বাংলাদেশের জন্য রাজস্ব আহরণের এক অন্যতম ক্ষেত্র হতে পারে। এতে একদিকে যেমন সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়বে, তেমনি দেশিয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ পাবে।