Published : 09 Apr 2022, 07:41 PM
১৮৪৯ সনে ফরাসি লেখক জ্যঁ বাতিস্ত আলফোন্স কার লিখেছিলেন – আপাত দৃষ্টিতে যা মনে হয় বদলায়, ততই মনে হয় তা একই থেকে যায়। ১৮৪৮ সনে ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন নেপোলিয়ান, তার বাবা ছিলেন বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক নেপোলিয়ান বোনাপার্টের ছোট ভাই। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ১৭৯৯ সনে ফ্রান্সের ক্ষমতা নিয়েছিলেন, আর সেটার পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই তার পরিবারের আর একজন ফ্রান্সের ভাগ্য নির্ধারণকর্তা হয়েছিলেন। নেপোলিয়ান তার পিতৃব্যর মতোই দেশের চাষী ও অন্যান্য শ্রমজীবীদের মুক্ত ও উন্নত জীবনের আশ্বাস দিয়েছিলেন। আলফোন্স কার স্যাটায়ার লেখক ছিলেন, এই ধরনের আশ্বাস তিনি আগেও দেখেছিলেন এবং সেগুলো যে বাস্তবে পরিণত হয় না তা জানতেন – সেইজন্যেই হয়তো তিনি লিখেছিলেন, ওপরে জিনিস বদলালেও নিচে সেই পরিবর্তন পৌঁছায় না।
১৯৪৭ সনে যে-তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ভাবা হয়েছিল ১৯৭১- এর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, সেটি ওই তত্ত্বকে আমূল বদলে দেবে। এতদিন পরে আমরা জানি সেটি হয়নি। এটি না হবার নিদর্শন ১৯৭২ সাল থেকেই নানাভাবে পাওয়া যাচ্ছিল, যেটির চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পেল ১৯৭৫ সনে পরিবারসহ বঙ্গবন্ধু ও কারাগারে চার নেতার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। বলতে গেলে এই হত্যাকাণ্ডের হোতারা ১৯৭১ সনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনি, রাজাকার ও আল বদর বাহিনির modus operandi বা কার্যপ্রণালীকে অবলম্বন করেছিল। এরপরে স্বাধীনতার আদর্শের যে দীর্ঘ অবক্ষয় শুরু হয় সেটি কোনো ক্ষান্তি পায় না। আজ বাংলাদেশের তৃণমূলে যে আদর্শিক অবস্থান, সেটি ১৯৪৭- এর তাদের পূর্বসূরীরা যারা পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিল, তাদের থেকেও বহু দক্ষিণে অর্থাৎ ডানদিকে, ধর্মীয় রক্ষণশীলতার দিকে। শত বাধাবিপত্তির মধ্যেও ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে যে ব্যাপক অগ্রগতি দেখা গিয়েছিল, সমাজে যে সহনশীলতা ছিল সেটি আজ অস্তগামী। আপাত দৃষ্টিতে দেশে অনেক কিছুই বদলেছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু সমাজের গভীরে বিশাল ক্ষত দেখা দিয়েছে – এবং আমাদের রক্ষাকর্তারা শুধু যে তার প্রতি উদাসীনই নন, তাদের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, অবহেলায় সেই ক্ষত থেকে নিরাময়ের কোনো উপায় দেখা যাচ্ছে না। আপাত দৃষ্টিতে যা মনে হয় বদলায়, ততই মনে হয় তা একই থেকে যায়।
বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ এলাকা এককালে বৃহত্তর বিক্রমপুরের অন্তর্গত ছিল, বিক্রমপুরের ইতিহাস কিংবদন্তির মতো– কোনো এক রাজা বিক্রমাদিত্য থেকে শ্রমণ অতীশ দীপঙ্কর, ধর্মপাল থেকে বিজয় সেন। পরবর্তী সময়ে জ্ঞানে বিজ্ঞানে এই এলাকা নাম কুড়িয়েছে। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্মস্থান এটি, এই অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন নামের মধ্যে রয়েছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, সরোজিনী নাইডু, সত্যেন সেন, হুমায়ুন আজাদ।
এই মুন্সীগঞ্জের পঞ্চসারে একটি স্কুল আছে, সেটির নাম হলো বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়, সেটি ১৯১৯ সনে প্রতিষ্ঠিত। কে ছিলেন রামকুমার বা কেনই বা এই বিদ্যালয়ের নাম 'বিনোদপুর রামকুমার' সেটি স্কুলের সরকারি ওয়েবসাইটে পাওয়া গেল না, সাধারণত এইসব নিয়ে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপক পরিষদ মাথা ঘামান না। আমার মুন্সীগঞ্জের বন্ধুরা এই বিষয়ে ভাল জানবেন, আমি শুধু এটুকুই বলব যে সময়ে মুন্সীগঞ্জ আলোকিত ছিল সেই সময়েই এই স্কুলের পত্তন হয় এবং আমি অনুমান করছি (এখানে আমার ভুল হতে পারে) যারা স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাদের উত্তরসূরীদের মধ্যে অনেকেই এখন আর মুন্সীগঞ্জ থাকেন না।
তো এই স্কুলের এক বিজ্ঞান শিক্ষকের নাম হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। গণিত পড়ান, বিজ্ঞান পড়ান, বাড়ির দেয়ালে বীজগণিতের সূত্র লিখে রাখেন। উনি এক ছাত্রকে বললেন, "এই যে তারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পাস হয়ে বাতি জ্বলে এটা বিজ্ঞান। এই যে A+B হোল স্কয়ারের সূত্র, এগুলো হিসেব করে মেলানো। এটাই বিজ্ঞান যা প্রমাণ সাপেক্ষ। এগুলো কি ধর্মগ্রন্থে আছে? আমরা অনেক সময় বিজ্ঞানকে ধর্মের সাথে মিলাই যা ঠিক নয়। হ্যাঁ ধর্ম মানুষকে সুশৃঙ্খল রাখে। বিজ্ঞান আলাদা কথা। বিজ্ঞান বিজ্ঞানই।" [রেকর্ডকৃত আলোচনাটির ট্রান্সক্রিপ্ট ফেইসবুক থেকে নেওয়া]
এমনই হতভাগ্য শিক্ষক যে তার অমূল্য যুক্তিবাদী কথা তো সেই ছাত্র মনোযোগ দিয়ে শুনলোই না বরং তাকে ফাঁদে ফেলার জন্য রেকর্ড করলো। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি – "জীবনে পিতা-মাতার পরে স্থান হলো শিক্ষকের।" আর এমন খুব কম দিনই আছে যে যখন আমি আমার শিক্ষকদের স্মরণ করি না, অনেকের সঙ্গে তার মৃত্যুর আগে কেন দেখা করিনি বলে অনুশোচনা করি। আসলে শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র হতভাগ্য নন, হতভাগ্য হলো তার ছাত্র যার আসলে ছাত্র হবার কোনো যোগ্যতাই নেই। গোপনে শিক্ষকের কথা অসৎ উদ্দেশ্যে রেকর্ড করে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে যে আন্তরিক, বিশ্বস্ত, এমনকী বলব যে 'স্বর্গীয়' সম্পর্ক থাকার কথা সেটির সে বরখেলাপ করেছে। এই ছাত্র আরো হতভাগ্য কারণ সে হৃদয় কৃষ্ণের Socratic Method বা Discourse- এর গুঢ় অর্থ বোঝেনি। এই ছাত্র হতে পারতো বিজ্ঞানী জগদীশ বসু, অথবা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ যিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অগ্রদূত ছিলেন। না, বিক্রমপুরের আলোকিত অতীত সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। আমি বলবো শুধু সেই ছাত্রই নয়, সেই ছাত্রকে যারা প্ররোচিত করেছিল, তারাও হতভাগ্য- কারণ, সেই কথোপকথনের অর্থ উদ্ধার করার মতো তাদের শিক্ষা ছিল না। তাই তারা এক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিকে দিয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা দিল, পুলিশও সেটি নিল।
সেই শিক্ষা থাকলে এবং কিছুটা সময় দিলে, আড়াই হাজার বছর আগে দার্শনিক সক্রেটিস যে প্রক্রিয়ার প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে সূক্ষ্ম ও গভীর চিন্তার বিকাশ খুঁজছিলেন, সেই প্রক্রিয়ার কিছুটা অংশ তারা এই কথোপকথনে আবিষ্কার করতে পারতো এবং সেই আবিষ্কারে হয়তো বিস্মিত হত, আলোকিত হতো। কিন্তু এই দুর্ভাগা দেশের দুর্ভাগা সন্তানেরা সেই কথোপকথনে খুঁজছিল কিছু – ইংরেজিতে বলে Key Words – যা দিয়ে হৃদয় মণ্ডলকে ফাঁসানো যায়। এবং এই দুর্ভাগা দেশ তাদের জন্য সৃষ্টিই করে রেখেছিল এমন একটি আইন (পুরস্কার বলব) যে আইনের আকারটি এমনই নমনীয় – একেবারে প্লাস্টিক যাকে বলে– যাকে কিনা দুমড়ে-মুচড়ে যে কোনো পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা সম্ভব।
তাই সেই প্লাস্টিক আইন প্রয়োগ করে বলা হলো হৃদয় মণ্ডল ধর্মকে অবমাননা করেছেন, কিন্তু সেই কথোপকথনটি ভালভাবে পড়লে (বা শুনলে) বোঝা যাবে উনি কোথাও ধর্মকে অবমাননা করেননি, যেটা বলেছেন সেটা হলো, "…আমরা এখন ধর্ম নিয়ে গ্যাঞ্জাম করি! কেন করি? আমরা গ্যাঞ্জাম করব না। শিখব, জানব। কোনপ্রকার ঝামেলা করব না ধর্ম নিয়ে। অর্থাৎ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোন মানে নেই। জিনিসটা হচ্ছে তোমরা বুঝে কাজ করবে৷ ধর্ম একটা কথা বললেই ঝাঁপিয়ে পড়বে না। ধর্ম বললো কান নিয়েছে চিলে আর চিলের পেছনে দৌড়াতে হবে ব্যপারটা এমন নয়।…"
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে তো আমাদের কর্তৃপক্ষ বলতেন (এককালে অন্তত বলতেন)। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা হয়তো এখানে যে, হৃদয় মণ্ডল বলেছেন যে, ধর্মগ্রন্থগুলোতে (সব ধর্মের সব গ্রন্থের কথা হচ্ছে) বিজ্ঞানের কথা সরাসরি লেখা নেই। এটা যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের পর্যায়ে পড়ে তাহলে এই ব্যাপারে একটি সরকারি ঘোষণার প্রয়োজন – এখন থেকে "বিজ্ঞানের কথা ধর্মীয় গ্রন্থে নেই" একথা বলা যাবে না, কারণ এতে মানুষের অনুভূতিতে আঘাত লাগবে এবং এটি আইনত দণ্ডনীয় হবে। যেহেতু আইনটি প্লাস্টিকের মতো নমনীয়, তাই ওপরের ঘোষণাটিকেও এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করা সম্ভব। কিন্তু তারপর কী হবে? তারপর কি দেশে সমস্ত সক্রাটিক পদ্ধতি নিষিদ্ধ করা হবে? পারস্পরিক প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের পথকে নিরুৎসাহিত করা হবে?
এই কথোপকথনটিকে রেকর্ড করে প্রচারের মাধ্যমে একদিকে বাক-স্বাধীনতা, academic freedom এবং অন্যদিকে privacy সংক্রান্ত বহু কথা উঠে আসে। প্রথমত প্রাইভেসি – বাংলাদেশের সংবিধানে ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে – "৪৩। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের (ক) প্রবেশ, তল্লাশী ও আটক হইতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তালাভের অধিকার থাকিবে; এবং (খ) চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনতারক্ষার অধিকার থাকিবে।" "যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনতারক্ষার অধিকার" থেকে যে হৃদয় মণ্ডল বঞ্চিত হয়েছেন সেটি বোঝাই যাচ্ছে, সেই অর্থে ওনার সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে।
এবার বাক-স্বাধীনতা নিয়ে দু একটা কথা। সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদ মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। এতে বলা হয়েছে – "৩৯। (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।"
যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাক স্বাধীনতার ব্যাপারে আলাদাভাবে সংবিধানে বলা নেই, তবে ধরে নেয়া যায় হৃদয় মণ্ডলকে অভিযুক্ত করার মাধ্যমে তার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। এরপরে আবার বলা হয়েছে "যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে…" ইত্যাদি। ২০১৮র ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী, "যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কিছু ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচার করে, তাহলে সর্ব্বোচ ১০ বছরের সাজা। জরিমানা ২০ লাখ টাকা।" এই আইনটি যুক্তিসঙ্গত কিনা সেই আলোচনায় যাচ্ছি না (এবং 'অনুভূতিতে আঘাত' বলতে ঠিক কী বোঝান হয়েছে সে ব্যাপারেও যাচ্ছি না, তবে পাঠককে 'প্লাস্টিক' কথাটি আর একবার স্মরণ করতে বলি), এখানে শুধু প্রশ্ন করা যেতে পারে হৃদয় মণ্ডল ইচ্ছাকৃত বা জ্ঞাতসারে ডিজিটাল মাধ্যমে কিছু প্রচার করেছেন কিনা। প্রথমত উনি ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করেননি, আর যদি এই নিয়ে বিতর্কের অবকাশও থাকে, তাহলে আমরা লক্ষ্য করবো উনি নিজে কিছুই প্রচার করেননি এবং ধরেই নেয়া যায় এই প্রচারের বিরুদ্ধেই ছিলেন। কাজেই ২৮ ধারা তার বিরুদ্ধে কেমন করে প্রয়োগ হলো সেটা একটা প্রশ্ন। (আমি আইনবিদ নই, এখানে ডিজিটাল ২৮ ধারা প্রয়োগ হয়েছে বলে ধরে নিচ্ছি, ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী।)
এখানে এটা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ধর্ম ও বিজ্ঞানের তুলনা করতে গিয়ে হৃদয় মণ্ডল সনাতন ধর্ম থেকে কিছু উদাহরণ দিয়েছেন, তাতে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরা ক্ষুব্ধ হননি, কেন হয়নি সেটি ওপরের আলোচনার আঙ্গিকে বিচার করলেই কিছুটা বোঝা যাবে। অন্যদিকে ওয়াজ ইত্যাদিতে যে পরিমাণ হিন্দুধর্ম সম্পর্কে কুৎসা রটনা করা হয় সেটি নিয়ে কিছু বলছি না, কারণ মনে হয় সেখানে সরকার মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের বাক-স্বাধীনতা বলবৎ, ডিজিটাল ২৮ ধারা প্রয়োগযোগ্য নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমার তাতে আপত্তি নেই, শুধু সরকারের এই আনুকূল্যটুকু অন্য ধর্ম-অনুসারীদের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রয়োগ হোক- সেটাই কাম্য।
এরপরে আসি academic freedom সম্পর্কে। ১৯৯৭ সনে ইউনেসকো পৃথিবীর সব উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও গবেষকদের অধিকার নিয়ে কিছু সুপারিশ দিয়েছিল, এর মধ্যে এই বাক্যটি ছিল – "শিক্ষা, শিক্ষাদান এবং গবেষণার অধিকার সম্পূর্ণরূপে ফলপ্রসূ হয় উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিতে একাডেমিক স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসনের পরিবেশে। অনুসন্ধান, অনুকল্প এবং মতামতের উন্মুক্ত যোগাযোগই হলো উচ্চশিক্ষার আদর্শ এবং এই পদ্ধতিটি জ্ঞান-অন্বেষণ, গবেষণার নির্ভুলতা এবং বস্তুনিষ্ঠতার জন্য বড় নিশ্চয়তা।" ওই সুপারিশপত্রে আরো বলা হয়েছিল – "উচ্চ-শিক্ষার শিক্ষকদের, অন্যান্য সমস্ত গোষ্ঠী এবং ব্যক্তির মতো, সমস্ত নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নাগরিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারগুলি প্রযোজ্য হওয়া প্রয়োজন। অতএব, সমস্ত উচ্চ-শিক্ষার শিক্ষকদের চিন্তা, বিবেক, ধর্ম, মত-প্রকাশ, সমাবেশ ও সংঘের স্বাধীনতা, এবং সেইসাথে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা এবং চলাফেরার স্বাধীনতা উপভোগ করা উচিত।" এই ধারণাগুলি বাংলাদেশের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে যথাযথভাবে প্রয়োগ হয় তা বলা চলে না, অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় নির্দেশনামা দেন যা হয়তো একাডেমিক স্বাধীনতাকে খর্ব করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাডেমিক স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা একটি চলমান বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতাকে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী (amendment) বা সংযোজনের পরিপ্রেক্ষিতে দেখে এর পক্ষে রায় দিয়েছে। এখানে হয়তো প্রথম সংশোধনীটা উল্লেখ করা যেতে পারে, সেটিকে মোটামুটি এভাবে বলা যায় – "কংগ্রেস (কোনো বিশেষ) ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে আইন প্রণয়ন করবে না, আবার তার অবাধ অনুশীলন নিষিদ্ধ করতেও কোনো আইন প্রণয়ন করবে না। অন্যদিকে বাক স্বাধীনতা অথবা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে খর্ব করার জন্য, জনগণের শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হবার বিরুদ্ধে এবং (কোনো) অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করার অধিকারের বিরুদ্ধে কোনো আইন প্রণয়ন করবে না।" (লক্ষ করুন এর সঙ্গে বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদটির মিল।) ইদানীংকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধ্যাপক এবং গবেষকরা তাদের বক্তব্যের জন্য রাজনৈতিকভাবে বাম এবং ডান উভয় দিক থেকেই চাপ অনুভব করছেন। অনেকক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের বরখাস্ত করলেও পরে আইনত (প্রথম সংশোধনী অনুসারে) তাদের আবার পুনর্বহাল করতে বাধ্য হচ্ছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টের রায় একটি দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করছে। বলা প্রয়োজন যে এইসব ঘটনায় রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো হস্তক্ষেপ করার উপায় নেই এবং অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ ও নিষ্পত্তি সেই প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই হয়, নইলে আদালতে যায়, কিন্তু এখানে রাষ্ট্রের সাধারণত কোনো ভূমিকা নেই।
অনেক কিছু বললাম বাক-স্বাধীনতার ব্যাপারে। ধরে নিতে পারি ওপরে যা বললাম তার সঙ্গে বেশিরভাগ পাঠকই একমত হবেন, কিন্তু সেটি তার ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাগত জীবনে প্রয়োগ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
এবার আসি কেন এই রচনার নাম 'গ্যালিলেও মুহূর্ত' দিয়েছি সেই প্রসঙ্গে। ১৫৪৩ সনে কোপের্নিকাসের একটি বই প্রকাশিত হলো যাতে তিনি প্রতিষ্ঠিত পৃথিবীকেন্দ্রিক সৌরজগতের মতবাদ নাকচ করে দিয়ে সূর্যকে সৌরজগতের কেন্দ্রে স্থাপন করার মডেল দিলেন। ওই বছরই কোপের্নিকাসের মৃত্যু হয়। ক্যাথলিক চার্চ খুব জোরেশোরে এই তত্ত্বের বিরোধিতা করল কারণ বাইবেলে বর্ণীত আছে যে, পৃথিবী স্থিত এবং তার চারদিকে সূর্য, গ্রহ ও নক্ষত্ররা পরিভ্রমণ করছে। তাদের অন্যতম যুক্তি হলো যে, পৃথিবী যে চলনমান তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। ১৬১০ সনে ইতালিতে গ্যালিলেও তার ঘরে বানানো দুরবিন দিয়ে বৃহস্পতির চারটি চাঁদ এবং শুক্রগ্রহের যে কলা আছে সেটি আবিষ্কার করলেন। বৃহস্পতির চাঁদ আছে সেটি প্রমাণ করল যে পৃথিবী ছাড়াও এমন খগোল বস্তু আছে যার চারদিকে উপগ্রহরা ভ্রমণ করতে পারে, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, বছর জুড়ে শুক্রগ্রহের কলার পরিবর্তন দেখে সহজেই বোঝা যায় যে, শুক্র এবং পৃথিবী উভয়ই সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও, ১৬১৬ সনে, ক্যাথলিক চার্চের ভীতিকর অনুসন্ধান (inquisition) কমিটি এই সৌরকেন্দ্রিক মতবাদকে বাইবেল ও ধর্মবিরোধী বলে ঘোষণা দিয়ে গ্যালিলেওকে সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ প্রচার না করার জন্য আদেশ দিল।
এই ধরনের ইনকুইজিশন ১৬০০ সনে আর এক ইতালিও জিওর্দানো ব্রুনোকে ধর্মবিরোধী চিন্তার জন্য পুড়িয়ে মেরেছিল, ব্রুনোর একটি অপরাধ ছিল তিনি পৃথিবীর মতো আরো জগৎ কল্পনা করেছিলেন। এই সময়ে ব্রুনো ভেনিসে এক ধনপতি জিওভান্নি মোচেনিগো নামে এক ধনপতিকে পড়াতেন, কিন্তু তিনি যখন ইতালি ছেড়ে জার্মানি যাবার পরিকল্পনা করছিলেন তখন ক্ষিপ্ত হয়ে মোচেনিগো, ১৫৯২ সনে, রোমের ইনকুইজিশন কমিটিকে ব্রুনোর তথাকথিত ধর্মবিরোধী দর্শনের কথা রিপোর্ট করে। সেই কমিটি ব্রুনোকে মোটামুটি উদারপন্থী ভেনিস থেকে রোমে নিয়ে আসে এবং দীর্ঘ বিচারের পরে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। আধুনিক বাক-স্বাধীনতার সচেতনার ব্যাপারে তাই ১৬০০ সনকে সূচনা বছর ধরা হয়। আমি ব্রুনোর সাথে মোচেনিগোর ব্যবহারের সঙ্গে হৃদয় মণ্ডলের সাথে তার ছাত্রর ব্যবহারের (বা শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের শর্তভঙ্গ) মিল দেখে আশ্চর্য হয়েছি। আপাত দৃষ্টিতে যা মনে হয় বদলায়, ততই মনে হয় তা একই থেকে যায়। ৪২২ বছর কেটে গেছে এর মধ্যে।
ফিরে আসি গ্যালিলেওর কথায়। গ্যালিলেওকে চার্চ ১৬১৬ সনে সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ প্রচার না করার নির্দেশ দিল এবং গ্যালিলেও বেশ কয়েক বছর একটু চুপচাপই থাকলেন, কিন্তু ছালা থেকে বিড়াল একবার বের হলে কি আর তাকে ঢোকানো যায়? ১৬২৩ সনে চার্চের যে নতুন পোপ হলেন তিনি গ্যালিলেওর গুণমুগ্ধ ছিলেন এবং তার অনুমতি নিয়ে গ্যালিলেও একটি বই লিখলেন – 'বিশ্বসংক্রান্ত দুটি প্রধান মতবাদের মধ্যে দ্বিরালাপ,' এতে পৃথিবীকেন্দ্রিক এরিস্টোটলীয় মতবাদের পক্ষে যে চরিত্রটিকে উনি উপস্থাপনা করলেন তার নাম দিলেন Simplecio – অর্থাৎ 'সরল বোকা', পোপ খুব ক্ষেপে গেলেন কারণ বইটি সৌরকেন্দ্রিক মতবাদকেই প্রাধাণ্য দিয়েছিল। গ্যালিলেওর বিচার হলো, প্রাণে বেঁচে গেলেন, কিন্তু সবার সামনে তাকে বলতে হলো তিনি সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বে বিশ্বাস করেন না এবং পৃথিবী অনড়। বলা হয়ে থাকে তার স্বীকারোক্তির পরে তিনি নাকি বিড়বিড় করে বলেছিলেন – এপ্পুর সি মুয়েভে (Eppur si muove) – তবুও সেটি (পৃথিবী) চলমান। এই কথাগুলো তিনি যে বলেছিলেন সেটার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না, কিন্তু মানুষের মধ্যে কিংবদন্তির মতো এই কাহিনির প্রচলন প্রমাণ করে যে, সত্যকে শেষাবধি লুকানো যায় না।
হৃদয় মণ্ডলের কাহিনি শেষাবধি আর একটি এপ্পুর সি মুয়েভের মতো কিংবদন্তি। এটি একটি 'গ্যালিলেয় মুহূর্ত।' এখানে ইনকুইজিশনের দায়িত্ব চার্চের মতোই পালন করছে রাষ্ট্র (হয়তো নিজের চরিত্রকে যথার্থভাবে অনুধাবন না করেই) এবং রাষ্ট্রদ্বারা উৎসাহিত এক বিরাট গোষ্ঠী। ৪২২ বছর আগে রোমের ক্যাম্পো দ্যে ফিয়োরি চত্বরে জিয়ার্দানো ব্রুনোর অগ্নিহত্যাকাণ্ড দেখার জন্য নিশ্চয় উল্লসিত জনতার অভাব হয়নি, যেমন অভাব হয়নি অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয়, ফয়সাল আরেফিনের এবং সেরকম আরো অনেকের হত্যায় একটি গোষ্ঠীর অত্যন্ত আনন্দিত হওয়া। (শেষের বাক্যটি বিশ্বাস করতে আমার প্রাণ চায় না, দুঃখের বিষয় অন্তর্জালে তাদের অসংখ্য মন্তব্য আমাকে এই সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য করেছে।)
লেখাটা খুব বড় হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু যুক্তি ও সহনশীলতা নিয়ে দু একটি কথা না বললেই নয়। ১৫৯৩ সনে, ব্রুনোকে যখন ভেনিস থেকে রোমে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো সেই সময়েই (১৫৯১/৯২ সনে) সম্রাট আকবরের উচ্চারণ এইভাবে সংকলিত হয়েছিল – "ধর্মের বিচারে কারও জীবনে হস্তক্ষেপ করা চলবে না এবং যে কেউ নিজের ইচ্ছানুযায়ী ধর্মাচরণ করতে পারবে।" এই উক্তিটি আমি পেয়েছি অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের 'তর্কপ্রিয় ভারতীয়' বইটিতে। অমর্ত্য সেন লিখছেন, "…আকবর তার বন্ধু ও বিশ্বস্ত সহকারী (আরবি ও ফারসির সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত ভাষারও বিশিষ্ট পণ্ডিত) আবুল ফজলকে বলেছিলেন:
'যুক্তিবিচারের অনুসরণ এবং গতানুগতিকতা বর্জনের প্রয়োজন এমন জাজ্বল্যমান প্রতীয়মান যে তার পক্ষে সওয়াল করার কোনো প্রয়োজন নেই। পরম্পরার অনুসরণই যদি সঠিক পন্থা হত তা হলে পয়গম্বরেরা পূর্বসুরিদের অনুসরণ করেই ক্ষান্ত হতেন (নতুন বার্তা নিয়ে আসতেন না)।"
আকবরের এই উক্তিগুলো থেকে বলা যায় আলোকায়নের অনেক স্তম্ভ – ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বিকাশ, সহনশীলতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ, যুক্তি ও সামগ্রিক সামাজিক উন্নয়ন – প্রাচ্যেও বিকশিত হয়েছিল। এখানে আমি নিজেকে অধ্যাপক সেনের 'যুক্তিবিচার ও আলোকায়ন' শিরোনামের একটি অনুচ্ছেদের একটি প্যারার উদ্ধৃতি দেওয়া থেকে সামলাতে পারলাম না –
"বীভৎস কার্যকলাপে অন্ধকারাচ্ছন্ন এই পৃথিবীতে আশা ও ভরসার একটি প্রবল উৎস হচ্ছে যুক্তির পথে এগোনোর সম্ভাব্যতা। তার কারণটি সহজেই বোঝা যায়। কোনও কিছুতে যদি আমরা তৎক্ষণাৎ অতিশয় বিচলিত বোধ করি, বিরক্ত হই, আমরা চাইলে আমাদের সেই প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে পারি। জিজ্ঞাসা করতে পারি, আমাদের সেই প্রতিক্রিয়া যথাযথ কিনা এবং আমাদের আচরণ তার দ্বারা নির্ধারিত হওয়া উচিত কিনা। অন্য মানুষ, অন্য সংস্কৃতি, অন্যদের দাবি এ সব আমরা কী চোখে দেখব, তাদের সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করব – তা আমরা যুক্তি দিয়ে বিচার করতে পারি এবং শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার সঙ্গে বিভিন্ন যুক্তিগুলিকে বিবেচনা করতে পারি। আমরা নিজেদের ভুলগুলিকে যুক্তিপূর্ণভাবে বিচার করতে পারি ও চেষ্টা করতে পারি যাতে সেগুলোর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। দৃষ্টান্তস্বরূপ জাপানি ঔপন্যাসিক এবং দ্রষ্টা সমাজতাত্ত্বিক কেনজাবুরো ওয়ে প্রবল যুক্তি সহকারে এই মত ব্যক্ত করেছেন যে, জাপানি জাতির নিজের 'পররাজ্য আক্রমণের ইতিহাস' অনুধাবন করে, 'গণতন্ত্রের ধারণার প্রতি, এবং আর কোনওদিন যুদ্ধ না করবার সংকল্পের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবার যথেষ্ট কারণ আছে।' " [অমর্ত্য সেন, 'তর্কপ্রিয় ভারতীয়']
এরকম গুছিয়ে সুচারুভাবে খুব কম মানুষই যুক্তিবিচারের আলোকে সহনশীলতার কথা বলতে পারবে। অমর্ত্য সেন যে পদ্ধতির কথা বলছেন তার জন্য দরকার সংবেদনশীলতার অনুশীলন (sensitivity training)। ড. লতা সমাদ্দার পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তার কপালে ছিল টিপ, এক পুলিশ সমস্ত সংবেদনশীলতা ত্যাগ করে এক ঘৃণাপূর্ণ মন্তব্য করল। এরকম মন্তব্য প্রতিনিয়ত হচ্ছে, এইক্ষেত্রে লতা সমাদ্দারের সাহসী ভূমিকার জন্য সেটি আমাদের চোখের সামনে এল। শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার ট্রেনিং যেমন সেই পুলিশকে দেয়া হয়নি, তেমনই দেয়া হয়নি হৃদয় মণ্ডলের ছাত্রকে। কিছু মানুষের যদি সৌভাগ্য হয় তবে সে তার বাড়ি থেকে এবং সুযোগ্য শিক্ষক থেকে সংবেদী হতে শেখে, কিন্তু দুঃখের বিষয় রাষ্ট্র থেকে সংবেদনশীলতা ও সহনশীলতার কোনো ট্রেনিং তো দেয়াই হচ্ছে না বরং বিভিন্ন আইন দিয়ে ধীরে ধীরে সহনশীলতাকেই বেআইনি করা হচ্ছে। যে সমাজ সক্রাটিক পদ্ধতিকে বেআইনি করে, সহনশীল দ্বিরালাপকে বেআইনি করে সেই সমাজ শত আর্থিক উন্নয়ন সত্ত্বেও অজ্ঞানতার অথই তিমিরে ডুববে—তা ভাবাই স্বাভাবিক।
কামাল আতাতুর্ক নাকি বলেছিলেন, একজন ভালো শিক্ষক হলো মোমবাতির মতো, সে শেখাতে শেখাতে নিজেকে ক্ষয় করে ফেলে। গুগলে অনুসন্ধান করলে এই উক্তিটি পাওয়া যাবে, আতাতুর্ক আদৌ এটি করেছেন কিনা আমার জানা নেই, কিন্তু কথাটি হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের জন্য খাটে। উনি জ্ঞানের আলো জ্বেলে নিজেকে শুধু ক্ষয়ই করেননি, কারাগারে পর্যন্ত গেলেন। একে আমি 'গ্যালিলেও মুহূর্ত' বলে অভিহিত করছি, দেশের অনেক বিজ্ঞানী, দার্শনিক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী সেই মুহূর্তটার গূঢ় অর্থ ধরতে পারছেন না, আবার অধ্যাপক জাফর ইকবালসহ অনেকেই ধরতে পেরেছেন। আমি আশা করছি মাননীয় সরকার শুধু হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে যে মামলা দেয়া হয়েছে সেটি শুধু তুলেই নেবেন না, তাকে এবং তার মতো শিক্ষকদের নিরাপদে শিক্ষাদানের মতো পরিবেশ গড়ে দেবেন, নইলে বাংলাদেশ জ্ঞানবর্জিত এক অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে প্রবেশ করবে।
আর একটি কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশের অমুসলিম ক্ষয়িষ্ণু জনগোষ্ঠী এক বিরাট নিরাপত্তাহীনতায় বাস করছে। ১৯৭৫ সনের পর থেকে এই গোষ্ঠী ক্রমাগতই তার সাংবিধানিক অধিকার হারাচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করে সেই গোষ্ঠীকে ক্রমাগতই হয়রানি করা হচ্ছে এবং সেই হয়রানি বন্ধের কোনো উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে না। আমার বিশ্বাস এই আইনটি প্রকৃত ধর্মানুরাগী মানুষেরও কোনও কাজে আসছে না, বরং শান্তিপূর্ণভাবে তার ধর্মপালনে বাধা সৃষ্টি করছে। আমি আইনবিদ নই, কিন্তু সরকারের কাছে আমার এটি আকুল আবেদন – এই আইনটি সংশোধন করুন।