Published : 03 Apr 2022, 08:01 PM
এ বছরের ২৫ মার্চ দুইটি ঘটনা ছিল আমাদের ইতিহাসে অতীব গুরুত্ব এবং তাৎপর্য বহনকারী। প্রথমটি কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে জনাব তোফায়েল আহমেদের লেখা প্রবন্ধ এবং অন্যটি দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকায় জনাব আমির হোসেন আমুর ভাষণ।
বয়োজ্যেষ্ঠ এই দুই নেতাকে বলা যায় আমাদের দেশের গত ৭৫ বছরের ইতিহাসের নির্ভুল সাক্ষী, যাদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার কানায় কানায় পরিপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের বাইরে যে ব্যক্তি তার সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়ে, বঙ্গবন্ধুর বহু অপ্রকাশিত কথা জানতে পেরেছিলেন, তিনি তোফায়েল আহমেদ। আমির হোসেন আমুও তার দীর্ঘ জীবনের বিরাট অংশ বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে কাটিয়েছিলেন বলে তিনি বঙ্গবন্ধু বিষয়ে এক মূল্যবান তথ্য ভাণ্ডার, ইংরেজিতে বলতে গেলে দুইজনই 'Treasure Trove of Informations'।
তোফায়েল সাহেবের লেখনীসমূহে প্রথমবারের মতো এসেছে যে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের জিন্নাহ-লিয়াকত এবং পূর্ব বাংলার নাজিমুদ্দিন চক্র এখানকার বাঙালিদের ধোকা দিয়েছে এ অঞ্চলকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহারের জন্য, বাংলা ভাষা সাহিত্যকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার পরিকল্পনায়। তোফায়েল সাহেব লিখেছেন "পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি (বঙ্গবন্ধু) উপলব্ধি করেন এ পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য নয়। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। সে লক্ষ্য সামনে নিয়ে ধীরে ধীরে ১৩টি মূল্যবান বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন।"
"নির্বাচনের পর পরই ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ডেকে চার জাতীয় নেতার সামনে আমাদের চারজনকে- মনি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই ও আমাকে একটি ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। ভারতে চলে গেলে আমরা কোথায় আশ্রয় পাবো, থাকবো, সে জন্য আমাদের চার টুকরা কাগজ দিয়ে বলেছিলেন- মুখস্থ কর। কাগজে ঠিকানা লেখা ছিল, 'সানি ভিলা, ২১ নং রাজেন্দ্র রোড, নর্দান পার্ক, ভবানিপুর, কোলকাতা'। অর্থাৎ বহু আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা করেন। সেই ১৯৬২ সালে তিনি দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা নিয়ে আগরতলা গিয়েছিলেন। আগরতলার মামলাতো মিথ্যা ছিল না। কিন্তু পরিকল্পনা মতো কাজ হয়নি। আগরতলা মামলায় যারা অভিযুক্ত তারা তো আসলেই স্বাধীনতার জন্য একটি সশস্ত্র পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এটা সত্য, যার জন্য 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' বললে যারা অভিযুক্ত তারা অসন্তুষ্ট হন। তারা বলেন, আমরা তো ষড়যন্ত্র করিনি, আমরা তো দেশের স্বাধীনতার জন্যই একটি পরিকল্পনা করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের মধ্যেই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তার বড় প্রমাণ ছয় দফা, তিনি বিচক্ষণ নেতা ছিলেন।"
"নির্বাচনের পরই তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার পরিকল্পনা করেন। এ পরিকল্পনার ছক এঁকেছিলেন যখন তিনি ৬৯-এর অক্টোবরে লন্ডন সফরে যান। সেখানে ভারতীয় প্রতিনিধি ফনীন্দ্র নাথ মুখার্জি তথা পিএন মুখার্জী- যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে 'মিস্টার নাথ' বলে সম্বোধন করতাম- লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের ভূমিকা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন, যেগুলো পরবর্তীতে বাস্তবায়িত হয়।"
"প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য এ রকম একটি চূড়ান্ত ঘোষণায় পৌঁছাতে বঙ্গবন্ধুকে ২৪টি বছর বাঙালি জাতিকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য স্থির করে, ধাপে ধাপে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা করে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে, শাসকগোষ্ঠির সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, জেল-জুলুম-হুলিয়া ফাঁসির মঞ্চ উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়েছে। একদিনে হয়নি। বহু বছর ধরে, অগণিত মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণাকে শিরোধার্য জ্ঞান করেছে।"
১৯৬২ সালেই বঙ্গবন্ধু আগরতলা গিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে, যে মিশন পূর্ণতা পায়নি। তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফায়ই নিহিত ছিল স্বাধীন বাংলা সৃষ্টির ভ্রুণ। তিনি আরও লিখেছেন- ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন ভ্রমণে গেলে স্বাধীন বাংলা সৃষ্টির পরিকল্পনা বহুলাংশে পূর্ণতা পায়। সে সময়কালে তিনি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলেন, ফনীন্দ্রনাথ মুখোপধ্যায়, তথা পিএন মুখোপধ্যায়ের মাধ্যমে।
আমির হোসেন আমু গত ২৫ মার্চ ভোরের কাগজ পত্রিকার অনুষ্ঠানে বলেন, "দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিষবৃক্ষ যে পূর্ব বাংলার মানুষদের পায়ে বেড়ি লাগিয়ে এখানে পশ্চিম পাকিস্তানিদের উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, সে কথা বুঝতে বঙ্গবন্ধুর দেরি হয়নি। পাকিস্তান সৃষ্টির সাথে সাথেই তিনি তা বুঝতে পারেন"। তিনি আরও বলেন, "১৯৪০ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুসহ সে সময়ের কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতার ধারণা এবং দাবি ছিল বাংলাকে না ভেঙে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, যা শেরে বাংলা ফজলুল হক সাহেব উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবে ছিল। সেটি ব্যর্থ হওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী-শরত বসু-আবুল হাসিম এবং কিরণ শংকর রায় বৃহত্তর স্বাধীন বাংলার যে পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন, সেটিতেও তখনকার তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব পুরোপুরি অংশীদার ছিলেন।"
আমু সাহেব বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা ৬০ দশকের শুরুতেই পরিষ্কার হয়ে যায়; যা আরো বেশি প্রস্ফুটিত হয় প্রথমত ছয় দফা ঘোষণার মাধ্যমে এবং পরে আগরতলা পরিকল্পনায়, যাকে শত্রুরা 'আগরতলা ষড়যন্ত্র' বলে ঘৃণ্য ঘটনা বলার চেষ্টা করে।"
'সত্য মামলা আগরতলা' বইয়ের লেখক কর্নেল (অব.) শওকত আলি, যিনি সে মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং পরে আমাদের সংসদের ডেপুটি স্পিকার হয়েছিলেন, সেই বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, "ঐতিহাসিক আগরতলা মামলাকে এখনো মিথ্যা মামলা বলে যারা অসম্মান করেন, তারা নিজেদের অজান্তে বঙ্গবন্ধু সহ অন্যান্য অভিযুক্তদের অসম্মান করেন।"
তিনি ১৬২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন "কিন্তু 'accused doc' এ অভিযুক্তদের সঙ্গে বসে অভিযোগনামা শুনতে শুনতে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধু আমাদের সার্বিক পরিকল্পনার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন এবং সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনায় তিনি সম্মতি দিয়েছিলেন। আমার এ বিশ্বাস আরোও বদ্ধমূল হয় মামলা শুরু হওয়ার পরবর্তী দিনগুলোতে। আমার মনে আরো বিশ্বাস জন্মাতে থাকে, বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের রাজনীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির সুখ-দুঃখ-বেদনা-বিক্ষোভ তিনি নিজের জীবনে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি যে কোন পরিস্থিতিতে বাঙালি জাতির মুক্তির চিন্তা করতেন এবং সে লক্ষ্যে কাজ করতেন। আইনের দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই প্রখর, যা তার মধ্যে অসাধারণ আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি করেছিল।"
"আমি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার কাজ শুরু হওয়ার প্রথম দিন জনাব মঞ্জুর কাদেরের মুখে অভিযোগনামার বিবরণ শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকৃত পক্ষেই একজন তুলনাহীন নেতা। আমি ভেবে গর্বিত হয়েছিলাম, আমার নেতা মুজিব ভাই এই মামলায়ও আমার নেতা।"
"লেফটেন্যান্ট মোজাম্মেল হোসেন আরোও সাক্ষ্য দেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৈঠকে উল্লেখ করেন, বিপ্লবী সংস্থার পরিকল্পনার সঙ্গে তার নিজের চিন্তার মিল রয়েছে।"
"বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে এবং সে জন্য প্রয়োজন সশস্ত্র বিপ্লব। বঙ্গবন্ধু তার পক্ষ থেকে যাবতীয় সাহায্য সহযোগিতারও আশ্বাস দেন।"
"১৯৬৫ সালের ১৫ থেকে ২১ জানুয়ারির মধ্যে করাচিতে বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী সফরের সময় বিপ্লবী সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় করাচিতে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসায়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু তার পূর্বের আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেন এবং বিপ্লবী সংস্থার কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।"
কর্নেল শওকত ১২০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন "১৮ জানুয়ারি ১৯৬৮ মধ্যরাতের পর বঙ্গবন্ধুকে সামরিক তত্ত্বাবধানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আনা হয়। বঙ্গবন্ধু পরে আমাদের জানিয়েছিলেন, তিনি কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটের বাইরে এসে সামরিক যানে আরোহনের আগ মুহূর্তে ভূমি স্পর্শ করেন এবং তার ধুলোমাখা হাতের আঙ্গুল দিয়ে কপাল স্পর্শ করেন।"
১১৬ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, "বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত ছিল আইয়ুব খানের জন্য মারাত্মক ভুল। বাঙালিদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তার ব্যাপকতা পরিমাপে আইয়ুব খান ব্যর্থ হয়েছিলেন। বাঙালিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচারের মাত্রা এবং তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বাঙালিদের সংকল্পের গভীরতা পরিমাপ করতেও আইয়ুব খান ব্যর্থ হয়েছিলেন।"
বাঙালি জাতির যুগসন্ধিক্ষণে জন্মগ্রহণ করা এই দুই নেতা, তোফায়েল আহমেদ এবং আমির হোসেন আমু সেদিন যা লিখেছেন বা বলেছেন, এ সত্য কথাগুলো অনেকেই বলেন না হয় লজ্জায় বা ভয়ে। কিন্তু কথাগুলো যে আমাদের জন্য গৌরবের, এগুলো যে বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম এবং বাঙালির মুক্তির জন্য তার দৃঢ়তার বড় প্রমাণ এবং তিনি যে আজীবন বাঙালির মুক্তির কথাই ভাবতেন সেই বাস্তবতাকে আরো বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়, যা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারছেন না। মুক্তিযুদ্ধ যে বঙ্গবন্ধুর বহু বছরের সাধনা এবং পরিকল্পনার ফল, সে কথা সকলকে বোঝানো দরকার এই জন্য যে- তারা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারবেন এক নগন্য, অজানা, অচেনা, অখ্যাত, হঠাৎ করে উদীত হওয়া মেজরের হুইসেলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। বঙ্গবন্ধু নিজেও ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বলেছিলেন, "স্বাধীনতা সংগ্রাম কেবল ৯ মাসেই হয় নাই; স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সনের পর থেকে। তার পর ধাপে ধাপে সে সংগ্রাম এগিয়ে গেছে। সে সংগ্রামের একটা ইতিহাস আছে। তাকে আস্তে আস্তে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। একদিনে সে সংগ্রাম চরম পর্যায়ে পৌঁছে নাই। ৯ মাস আমরা যে চরম সংগ্রাম করেছি, সে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল বহুদিন থেকে। ১৯৪৭ সনে উপমহাদেশ ভাগ করে সংখ্যায় মেজরিটি থাকা সত্ত্বেও বাঙালিরা সব কিছু হারিয়ে ফেলে। জনাব জিন্না সাহেব, যাকে অনেকে তখন নেতা বলে মানতেন, বাঙালিকে এক শকুনের হাত থেকে আর এক শকুনের হাতে ফেলে দিয়ে করাচিতে রাজধানী কায়েম করলেন। এমনকি জিন্না সাহেব মরার পূর্বে তার সম্পত্তির যে দলিলপত্র করে গিয়েছিলেন, সেই দলিল অনুসারে ভাগ পেয়েছিল পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, পেয়েছিল বোম্বের হাসপাতাল এবং করাচির স্কুলকেও তিনি কিছু দান করেছিলেন। কিন্তু বাংলার মানুষ আমরা বুঝতে পারি না, হুজুগে মেতে পরের ছেলেকে বড় করে দেখি, এই ছিল আমাদের দুর্ভাগ্য। … বাংলাদেশের যে সকল নেতা সংগ্রাম করেছেন আমরা তাদেরকে বুঝতে পারি নাই। আমরা বুঝেছি মি. জিন্না বুঝি আমাদের নেতা হয়ে চলে এসেছেন বোম্বাই থেকে। যা হোক, সেই ইতিহাস এবং ১৯৪৭ সনের করুণ ইতিহাস অনেকেই জানেন। জনাব স্পিকার সাহেব, ১৯৪৭ সন থেকে এক বিরাট ষড়যন্ত্র চলেছিল, বাংলাদেশের মানুষকে একটা কলোনি করে রাখার জন্য। বহু আগেই পশ্চিমা শক্তিকে এ দেশ ত্যাগ করে চলে যেতে হতো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে একদল লোক ছিল, যারা স্বার্থের লোভে, পদের লোভে, অর্থের লোভে তাদের সাথে বার বার হাত মিলিয়েছে, তারা বার বার চরম আঘাত হেনেছে আমাদের উপর। আঘাত হেনেছে ১৯৪৮ সনে, আঘাত হেনেছে ১৯৫২ সনে, আঘাত হেনেছে ১৯৫৪ সনে। এমনকি ১৯৫৬ সনে শাসনতন্ত্র রচনার সময় যখন বাঙালিরা পরিষদ থেকে 'ওয়াক আউট' করে তখনও বাঙালিদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক বেঈমানি করে পশ্চিমাদের সঙ্গে হাত মিলায় মন্ত্রিত্বের লোভে। ১৯৫৮ সনে মার্শাল ল বাংলার উপর আসে বাঙালিকে শোষণ করার জন্য।"
বাংলাদেশের প্রাক্তন ডেপুটি স্পিকার, প্রয়াত কর্নেল শওকত আলি আগরতলা পরিকল্পনার ব্যাপারে প্রথম মুখ খুললেও তার লেখা সমাদৃত হয়নি। ৭১- এর ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সাহসী সভাপতি, গবেষণাধর্মী সাংবাদিক এবং চিত্রনির্মাতা শাহরিয়ার কবিরও ১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধুর ত্রিপুরা যাত্রার কথা বহু আগেই বিশ্বাসযোগ্য তথ্যসহ উল্লেখ করেছিলেন। এটিও উল্লেখযোগ্য যে পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও বঙ্গবন্ধু এবং সোহরাওয়ার্দী সাহেব বেশ কিছু সময় পূর্ব বাংলায় আসেননি, যখন দেখতে পেয়েছিলেন জিন্না-লিয়াকত-নাজিমুদ্দিন গং পূর্ব বাংলাকে পশ্চিমাদের কলোনি করার পরিকল্পনায় মত্ত। তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে পূর্ব বাংলায় যাওয়ার কথা বললে সোহওয়ার্দী সাহেব রাজি না হয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন পূর্ব বাংলায় যেতে এবং নিশ্চিত করতে যেন সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না হয় এবং হিন্দুরা যেন পূর্ব বাংলা ত্যাগ না করে। কথাগুলো বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেখা রয়েছে।
ইতিহাস এমনি বিষয় যা কখনো ঢেকে রাখা যায় না। এক সময় তা অনাবৃত হয়, সত্য প্রকাশ হয়। সেই অর্থে ১৯৪০ থেকে আমাদের ইতিহাসকে পুরোপুরি সত্য তথ্য সম্বল করে প্রকাশ করা তাদের দায়িত্ব যারা সেসব তথ্য ভালো করে জানেন। তোফায়েল আহমেদ এবং আমির হোসেন আমু মহান জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন, কেননা ভবিষ্যত বংশধররা এ বিষয়টি তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারবে- বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভাবতেন। আশা করা যাচ্ছে এই দুই নেতার, যারা তথ্যের ভাণ্ডারও বটে, কথা বলার পর এ বিষয়ে যারা এখনো মুখ বন্ধ রেখেছেন, তারাও সত্য প্রচারে দ্বিধাগ্রস্ত হবেন না। এগুলো আমাদের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়ের প্রকাশনা, যা বঙ্গবন্ধুর মহত্ব, দেশপ্রেম, দূরদৃষ্টি এবং আত্মত্যাগের ইতিহাসের অংশ বটে। বলা যায় তিনি ছিলেন একজন বিরল বৈশিষ্ট্যের 'ভিশনারি'।