Published : 18 Jan 2022, 11:11 PM
সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ঘোর সমালোচক বহুল প্রচারিত দৈনিকের খবর, "মানুষ অনেক দিন পর একটি ভালো নির্বাচন দেখল নারায়ণগঞ্জে। প্রচার থেকে শুরু করে ভোট গ্রহণ পর্যন্ত প্রায় ১৮ দিন কোনো সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। ছিল না পেশিশক্তির দাপট। শান্তিপূর্ণ এই ভোটে আবারও মেয়র হিসেবে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে বেছে নিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মানুষ। রিটার্নিং কর্মকর্তার ঘোষিত বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী, মোট ১৯২টি কেন্দ্রে আইভীর প্রাপ্ত ভোট ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৬২ ভোট। দুই প্রার্থীর ভোটের পার্থক্য ৬৬ হাজার ৫৩৫ ভোট।"
আইভীর এই জয়ের প্রতীক নৌকা। ঘটনা প্রবাহ আর দেশের সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচন ও ফলাফল মাথায় রাখলে এটা ছিল অলৌকিক। মানুষ আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। ভোটের আগের রাতে চ্যানেল আই-এর টক শো তৃতীয় মাত্রায় ছিলাম। বলেছিলাম, ভোট যাই হোক জিতবে আইভী। এই বলার ভেতর অভিমান ছিল। বেদনা, রাগ আর অভিমান তখনই হয় যখন মানুষ তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়। বাংলাদেশে নির্বাচন হয়নি এমন তো নয়। বারবার ভোট হয়েছে আর মানুষ ঠিকমতো তাদের রায় দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে তারা কী চায় বা কেন চায়। সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন নামের প্রহসন গণভোট হ্যাঁ/না ভোট এসব বাদ দিলে বাকী নির্বাচনগুলো ছিল যুগান্তকারী। এমনকি বিএনপি-জামায়াত জোটের অবসান হবার পর ওয়ান ইলেভেনের শেষকালে যে নির্বাচন তাতেও মানুষ পরিষ্কার রায় দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারকে এনেছিল দেশ শাসনে। কিন্তু এরপর ভোট আর ভোট থাকেনি। গ্রাম-গঞ্জ থেকে পৌরসভা বা জাতীয় সব নির্বাচনই হয়ে উঠল প্রশ্নবিদ্ধ! এক পর্যায়ে যখন এটা ধরেই নেওয়া হয়েছিল সরকারি দল জিতবেই আর কেউ কোনও সুযোগ পাবে না, ঠিক সেই মুহূর্তে নৌকা প্রতীক নিয়ে সরকারি দলের মেয়র প্রার্থী জেতার পরও নারায়ণগঞ্জের ভোট ছিল মাইলফলক।
সেলিনা হায়াৎ আইভীর জন্য এই নির্বাচন সহজ ছিল না। প্রথমত, তিনি গত দুবারের নির্বাচিত মেয়র। ফলে জনগণ তৃতীয়বার তাকে কতটা চাইবে বা চাইবে না স্বাভাবিকভাবেই এই দ্বিধা ছিল। তারপর ছিল ওসমান পরিবারের প্রভাব। যদিও শামীম ওসমান এই আইভীর কাছেই লাখের বেশি ভোটে কুপোকাত হয়েছিলেন। তবু তার ও তার বাহিনীর প্রভাব এড়ানো সহজ ছিল না। কেন্দ্র থেকে সতর্ক করে দেওয়ায় শামীম ওসমান তেমন সুবিধা করতে পারেননি এটা মেনে নিয়েও বলা যায় তার সুললিত কথার ভাঁজে ভাঁজেই ছিল সন্দেহের বিষ। তিনি যে তৈমুরের জন্য নীরবে কাজ করতে পারেন সেই অনুমানও একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না। তবে যে ভাবেই হোক কোনও ষড়যন্ত্রই কাজ করেনি।
নির্বাচন কমিশনার হবার পরও মাহবুব তালুকদার এই কমিশনের একজন গোঁড়া সমালোচক, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনগুলি নিয়ে তার মন্তব্য সরকারকে বিব্রত করেছে অনেকবার। সেই তিনিই 'নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে আমার কথা' শীর্ষক বক্তব্যে বলেন, "নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন আমাদের কার্যকালে সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এটি ছিল আমার অনেক প্রত্যাশার স্থান। কারণ, আমি ইতোপূর্বে বলেছি যার শেষ ভালো, তার সব ভালো।"মাহবুব তালুকদার আরও বলেন, "বিগত ৫ বছরে যতগুলো সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে, আমার বিবেচনায় আমাদের প্রথম কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সর্বোত্তম।"
আমরাও তার সাথে একমত। এই নির্বাচন ও নির্বাচনের ফলাফল সরকারি দলের মনোভাব চাঙ্গা করতে যথেষ্ট। তারা মুখে যাই বলুক মনে মনে হয়তো ধারণা করতেন নানা কারণে ভোটাররা বিরক্ত। আর নীরব ভোটে পদ-পদবী হাতছাড়া হয়ে যাবে। অথচ সুষ্ঠু ভোটে নারায়ণগঞ্জের মানুষ জানান দিলো তারা সব মেনে নিয়েই নৌকার অগ্রযাত্রার জন্য ভোট দিতে রাজী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইমেজ আর তার নেতৃত্বে যে উন্নয়ন তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা আছে। আছে বলেই নৌকার জন্য ভোট দিয়ে আইভীকে তৃতীয় মেয়াদে মেয়র করতে কসুর করেনি জনগণ। কোনও পরিবারতন্ত্র বা গডফাদারের রাজত্ব মানুষ চায় না। সে কারণেই ওসমান পরিবারের সকল হুমকি আর অতীতকে ভোটাররা প্রত্যাখ্যান করে তাদের মতামত দিয়েছে উন্নতি আর সামনে যাবার আশায়।
এই নির্বাচন বিএনপি বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও বার্তা দিয়েছে। ভোট এড়ানো বা দায়-দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করার ভেতর জোশ আছে কিন্তু সমাধান নাই। তৈমুর ছিলেন একজন শক্তিশালী প্রার্থী। নাটক হোক আর যাই হোক তাকে তড়িঘড়ি করে অবসর দেওয়া বা দল থেকে সরিয়ে রাখার সিদ্বান্ত সঠিক নয়। এভাবে তাকে একা করে যে কৌশলের আশ্রয়ই নেওয়া হোক না কেন, তা হয়েছে আত্মঘাতী। এমনিতেই বিএনপির পায়ের তলায় মাটি নেই, সামান্য যেটুকু ছিল তাও তারা এভাবে হারাতে চলেছে। আমি বরং তৈমুর আলম খন্দকারকে স্যালুট জানাই। তিনি দীর্ঘদিন পর মাঠে থেকে লড়াই করে এবং বীরের মতো পরাজিত হয়েও আদায় করেছেন সম্মান আর শ্রদ্ধা। যে কারণে বিজয়ের পর আইভী বলেছেন তিনি তৈমুর চাচার কথাও শুনবেন। এই বিনয় বা ভালোবাসা আমাদের রাজনীতিতে বিরল। তৈমুর আলম খন্দকার তা আদায় করে নিয়েছেন।
আমাদের গণতন্ত্র বা ভোটের অন্তরায় যেমন সরকারি দল তেমনি বিরোধী দলের রাজনীতিও কম যায় না। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন থেকে তারা কী পাঠ নেবেন জানি না, তবে এটা নিশ্চিত জনগণকে এড়িয়ে কাচের ঘরে বসে বা মিডিয়ার মাইক্রোফোনে বিপ্লব হবে না। বিপ্লব কোনও দূর দেশে বসেও করা যাবে না। তৈমুরের মতো মাঠে থেকে লড়াই করে গণতন্ত্রকে বেগবান করতে হবে। অন্যদিকে সেলিনা হায়াৎ আইভী দেখিয়ে দিয়েছেন যে পেশী শক্তি বড় কথা না। বড় বিষয় মন জয় করা। জয়ের পর তার প্রতিক্রিয়াই তিনি বলেছেন, "তবে যত কিছু এখানে হয়েছে, সবকিছুর মূলেই কিন্তু আমাদের এ জনশক্তি, জনস্রোত, জনসমর্থন। জনসমর্থন যদি না থাকত, তাহলে আমি নারায়ণগঞ্জে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না।"
এই জনগণই হচ্ছে মূল শক্তি। যারাই এটা অস্বীকার করবে, তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। দেখে শুনে এ কথা বলতে ইচ্ছে করছে, নারায়ণগঞ্জে বয়ে গেল গণতন্ত্রের মৃদু মিষ্টি বাতাস।