Published : 26 Nov 2021, 11:11 PM
ক্ষমতা বড় আজব জিনিস। আজ যে প্রবল ক্ষমতাধর, কাল সে পথের ভিখারী হয়ে যেতে পারে। রাতারাতি হিরো থেকে জিরোতে পরিণত হতে পারে। এ জন্য সীমা মেনে চলতে হয়, মাত্রাজ্ঞান থাকতে হয়। তা না হলে নক্ষত্রেরও পতন ঘটে। যারা হিসাব-কিতাব মেনে চলেন, তারা তেমন কোনো সমস্যায় পড়েন না। কিন্তু বেহিসাবি হলে অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যায় পড়তে হয়।
গাজীপুরে মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের কথাই ধরা যাক। কী প্রতাপশালী নেতাই না ছিলেন তিনি! ক্ষমতা-দাপট-অর্থ-বিত্ত সব কিছুই ছিল ঈর্ষণীয়। কিন্তু তিনি একটু ভুল করে ফেলেছিলেন। মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় বঙ্গবন্ধু। সেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে ফেলেছিলেন। এমন মন্তব্য হয়তো আড়ালে-আবডালে অনেকেই করে। কিন্তু তার এই মন্তব্য কে বা কারা ভিডিও করে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এতেই তিনি ধরা খেয়েছেন। পাপ তো অনেকেই করে। কিন্তু পাপের চিহ্ন রাখে কয়জন? জাহাঙ্গীর আলমের ভুলটা এখানেই। তার 'পাপ' ভিডিও হওয়ায় এবং তা প্রচার হওয়ায় তিনি ফেঁসে গিয়েছেন। অর্থাৎ হাতেনাতে ধরা খেয়েছেন। ধরা না পড়লে হয়তো তেমন কিছুই ঘটত না। তিনি আরও উপরে উঠতে পারতেন। যেমন অনেকেই উঠেছেন। হিসাব-কিতাব করে যারা চলছেন, তারা বহাল তবিয়তেই আছেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। দেশে এখন আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের তেমন কোনো অস্তিত্ব নেই। আওয়ামী লীগের দাপটের কাছে অন্য সব দল ম্রিয়মান। প্রায় অস্তিত্বহীন। দেশে এখন আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব কায়েম হয়েছে। টিকে থাকার জন্য সুবিধাবাদী শ্রেণি অন্তরে যাই থাকুক, মুখে আওয়ামী লীগের গুণগান করেন। আওয়ামী লীগের পরিচয় ধারণ করেন। এর মধ্যে 'সীমালঙ্ঘন' করে অনেকেই ধরা খেয়েছেন। ২০১৮-এর নির্বাচনের পর টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের পরই আওয়ামী লীগ ঘটা করে ঘরের ভেতর 'শুদ্ধি অভিযান' শুরু করে। আর এই 'শুদ্ধি অভিযানে' দলের বিভিন্ন স্তরের অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন এবং তাদের বিপুল বিত্ত-বৈভবের সন্ধান পাওয়া যায়। 'শুদ্ধি অভিযানে' যারা 'বলি' হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী, যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কাউসার মোল্লা, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ মারুফ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার সহযোগী আরমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মোমিনুল হক সাঈদ, নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়া, ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহামুদ শামীমসহ অনেক নেতাকর্মী। এসব নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার পর ভাবা হয়েছিল, দলের অন্যরা সমঝে চলবেন। ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, স্বেচ্ছাচারিতা, বেফাঁস মন্তব্য ইত্যাদি বন্ধ করবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেরকম কিছুই হয়নি। অনেকে সাবধানী হয়েছেন মাত্র। অনেকে ঠিকই ঘুষ-দুর্নীতি-চাঁদাবাজি-শৃঙ্খলাভঙ্গ-দাপট দেখানো ইত্যাদি নিঃশঙ্ক চিত্তে চালিয়ে যাচ্ছেন।
দল থেকে বহিষ্কারের পর জাহাঙ্গীর আলমকে মেয়র পদ থেকেও সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্তের কারণ হিসেবে প্রজ্ঞাপনে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে ভুয়া দরপত্র, নির্দিষ্ট কোম্পানিকে দর দেওয়ার অনুরোধসংক্রান্ত (আরএফকিউ) দরপত্রে অনিয়ম, বিভিন্ন পদে অযৌক্তিক লোকবল নিয়োগ, বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ভুয়া বিল–ভাউচারের মাধ্যমে ও একই কাজ বিভিন্ন প্রকল্পে দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, প্রতিবছর হাটবাজার ইজারার টাকা যথাযথভাবে নির্ধারিত খাতে জমা না রাখাসহ নানাবিধ অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এ ছাড়া ভূমি দখল ও ক্ষতিপূরণ ছাড়া রাস্তা প্রশস্তকরণসংক্রান্ত অভিযোগও রয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, উল্লিখিত অভিযোগগুলো ক্ষমতার অপব্যবহার, বিধিনিষেধের পরিপন্থী কার্যকলাপ দুর্নীতি ও ইচ্ছাকৃত অপশাসনের শামিল, যা সিটি করপোরেশন আইনানুযায়ী অপসারণযোগ্য অপরাধ। ইতোমধ্যে এসব অভিযোগের তদন্ত কার্যক্রম শুরু করার মাধ্যমে সিটি করপোরেশন অপসারণের কার্যক্রমও শুরু করেছে। সুষ্ঠু তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।
এর আগে ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাহাঙ্গীর আলমের কিছু বিতর্কিত মন্তব্যসংবলিত ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরই গত ৩ অক্টোবর জাহাঙ্গীর আলমকে শোকজ করা হয়।
যে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, তাকেই কিন্তু এতদিন আওয়ামী লীগ 'হিরো' হিসেবে উপস্থাপন করেছে। তাকে 'আধুনিক ও পরিকল্পিত গাজীপুর গড়ে তোলার কারিগর' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। গাজীপুরের সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান ও ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ যেখানে ৫ বছরে ১০০ কোটি টাকাও সরকারি বরাদ্দ আনতে পারেননি, সেখানে দায়িত্ব পাওয়ার প্রথম আট মাসেই নগরীর উন্নয়নের জন্য সরকারি ফান্ড থেকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন পেয়েছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। সিটির নিজস্ব প্রকল্প ছাড়াও ৪২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্প ও ঢাকা বাইপাস সড়কের উন্নয়নে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যার সমন্বয় করছে সিটি করপোরেশন। এ সবকিছুকেই জাহাঙ্গীর আলমের কৃতিত্ব হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এমন একজন ব্যক্তি কেন রাতারাতি নায়ক থেকে খলনায়ক হয়ে গেলেন? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কিন্তু নতুন নয়। জাহাঙ্গীর আলম ২০১৩ সালের গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে দলীয় নেতা আজমতউল্লাহ খানের বিরোধিতা করেন। জাহাঙ্গীর এবং তার অনুসারীদের বিরুদ্ধাচরণ সেই পরাজয়ের কারণ হিসেবে তখন জেলা আওয়ামী লীগ এক মূল্যায়ন করেছিল। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও সে কথা জানেন। কিন্তু এর জন্য জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়ইনি বরং তাকে সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। তার বিরুদ্ধে এখন আরও অনেক গুরুতর অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। তিনি অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন, দলের মধ্যে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেছেন, প্রবীণ ও ত্যাগী নেতাদের উপেক্ষা ও 'একঘরে' করেছেন, জামায়াত-বিএনপি-হেফাজত নেতাদের সঙ্গে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে নিজের প্রভাব বাড়িয়েছেন, স্বার্থ হাসিল করেছেন, দলের মধ্যে তার বিরোধিতাকারীদের খুন পর্যন্ত করিয়েছেন– এমন এন্তার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। অথচ বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তির ভিডিও ভাইরাল হওয়ার আগ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটি করেনি। বরং তাকে মহান ও অপরিহার্য নেতা আখ্যায়িত করে মাথায় তুলে নেচেছেন। যারা এক দশক ধরে জাহাঙ্গীর আলমকে আশ্রয়-প্রশ্রয়-সমর্থন দিয়ে এমন বেপরোয়া হতে সাহায্য করেছেন, তাদের বিচার কে করবে? অন্যায়কারীই কি কেবল শাস্তি পাবার যোগ্য? তার দোসর ও সহায়তাকারীরা রেহাই পেয়েই পাবে? কোন যুক্তিতে?
অনেকেই বলছেন, জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অ্যাকশন দুর্নীতিবাজ, বেপরোয়া, বেফাঁস মন্তব্যকারীদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। আসলেই কি তাই? এতে কি আদৌ কেউ সতর্ক হয়? আওয়ামী লীগে কি জাহাঙ্গীর আলম একজনই?
আসলে একজন বা দুজন জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কার করে, মামলা দিয়ে, জেলে ঢুকিয়ে পরিস্থিতি বদলানো যাবে না। এ থেকে কেউ শিক্ষাও নেবে না। বরং তারা আরও সতর্ক হবে। ঘুষ-দুর্নীতি, অবৈধভাবে টাকা বানানো, ক্ষমতার দাপট দেখানো౼ সব অপকর্মই তারা করবে। কিন্তু বেফাঁস মন্তব্যটা হয়তো করবে না। তাতে কি যায় আসে?
আসলে পরিবর্তন চাইলে দলের মধ্যে আদর্শিক রাজনীতির চর্চা বাড়াতে হবে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ হাজার হাজার জাহাঙ্গীর আলম সৃষ্টির মেশিনে পরিণত হয়েছে। এই মেশিনটা বদলাতে হবে। দলে নীতি-আদর্শ বিবর্জিত দুর্নীতিবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। দলের নেতৃত্বে এমন ব্যক্তিদের আনতে হবে যারা কোনোভাবেই দুর্নীতি ও অবৈধভাবে টাকা বানানোর সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। যারা প্রকৃত অর্থেই দলের নীতি-আদর্শ-শৃঙ্খলা মেনে চলবে, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার আসনে রাখবে। যারা প্রকৃত অর্থেই জনকল্যাণে কাজ করবে। ধান্দাবাজ, টাউট, বাটপার, আদর্শহীন ব্যক্তিরা যেন দলের প্রাথমিক সদস্য হতে না পারে সে ব্যাপারে আন্তরিক উদ্যোগ থাকতে হবে।
হিরো থেকে জিরো বনে যাওয়া জাহাঙ্গীর আলম কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেও একটা বড় বার্তা দিয়ে গেল। সীমা মেনে না চলে মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে যে কেউই রাতারাতি আমীর থেকে ফকির হতে পারে। ক্ষমতা জিনিসটা খুবই ঠুনকো। এই আছে, এই নেই। এটা অত্যন্ত স্পর্শকাতরও বটে। ক্ষমতাকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়। একটু গড়বড় হয়ে গেলে রাজভবন থেকে জেলখানায় যেতে হয়। চোখের সামনে কিন্তু এমন উদাহরণ অনেক আছে। কাজেই আওয়ামী লীগের অজস্র জাহাঙ্গীর আলমকে যেমন শিক্ষা নিতে হবে। আবার জাহাঙ্গীর আলমের ঘটনা থেকে আওয়ামী লীগকেও শিক্ষা নিতে হবে।