চিনি নিয়ে কান্না

চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় মিষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি কথাও হারিয়ে যাচ্ছে বোধ হয়। সবাই কেমন যেন তিতা তিতা কথা বলছেন। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের কথায় তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ঘরে কুরুক্ষেত্র তো আগেই ছিল, এখন বাইরেও তা শুরু হয়েছে।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 13 May 2023, 11:27 AM
Updated : 13 May 2023, 11:27 AM

ছোট ছোট সাদা সাদা দানার মিষ্টি এক জিনিস হচ্ছে চিনি। চিনির ইংরেজি নাম সুগার। তবে বাংলায় চিনি শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহার হয়। বিশেষ্য হিসেবে ‘চিনি’ বলতে বোঝায় ‘সুগার’; আবার ক্রিয়া হিসেবে ‘চিনি’ বলতে কাউকে চেনা (know) বোঝায়। শিশু শিক্ষার্থীদের চিনি শব্দটি নিয়ে বিপত্তির মুখে পড়তে হয়। এক শিক্ষার্থী ‘আমি তাকে চিনি’ এই বাক্যটির ইংরেজি লিখতে গিয়ে নাকি লিখেছিল, ‘আই সুগার হিম!’

চিনি শব্দটির মানে নিয়ে একটা বিখ্যাত আরও অনেক গল্প প্রচলিত আছে।

মরিস সাহেব ছিলেন শান্তিনিকেতনে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার অধ্যাপক। একা থাকলে তিনি প্রায়ই গুনগুন করে গান গাইতেন। একদিন তিনি তত্কালীন ছাত্র প্রমথনাথ বিশীকে বললেন : ‘গুরুদেব চিনির ওপর একটি গান লিখেছেন, তা কি তুমি শুনেছ? গানটি বড়ই মিষ্টি।’

বিশী : ‘কোন গানটি?’

মরিস : ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী...।’

বিশী : ‘তা চিনির গান তো মিষ্টি হবেই। কিন্তু এই ব্যাখ্যা আপনি কোথায় পেলেন?’

মরিস : ‘কেন, স্বয়ং গুরুদেবই তো আমাকে বলেছেন।’

চিনি শব্দটির মানে নিয়েই যে কেবল বিপত্তি ঘটে তা-ই নয়, চিনি খাওয়া নিয়েও অনেক বিপত্তি দেখা দেয়। চিনির তৈরি বিভিন্ন মিষ্টি দ্রব্য পছন্দ করেন না, এমন মানুষ বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না; কিন্তু সবাই সব সময় সমানভাবে মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য খেতে পারেন না। অনেকের রক্তে সুগার বা চিনির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। তখন চিনি বা মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য তার জন্য বিষ বা হারাম হিসেবে বিবেচিত হয়। যারা রক্তে চিনিসংক্রান্ত সমস্যায় ভোগেন তাদের আমরা ডায়াবেটিস রোগী হিসেবে চিহ্নিত করি। সাধারণভাবে বড়লোকদের মধ্যেই রক্তে এই ‘চিনি সমস্যা’ বেশি দেখা যায়। তাদের মন চাইলেও শরীর চিনিকে গ্রহণ করতে পারে না। অথচ যারা ভাতের মতো কেজি কেজি চিনি খেতে পারে সেই গরিব মানুষের কপালে এক চিমটি চিনিও জুটছে না। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!

চিনির স্বাদ সব সময়ই মিষ্টি। জোর করে খাওয়ালেও চিনি মিষ্টিই লাগে। কমবেশি সবাই তাই চিনি খেতে চান। আর মাগনা বা ‘ফ্রি’ পাওয়ার সুযোগ থাকলে কথাই নেই।

এক রোগী ওষুধের দোকানে গিয়ে বললেন : ‘ওষুধ তো দিলেন, চিনিটাও তো দেবেন।’

দোকানি : ‘চিনি তো বেচি না।’

রোগী : ‘বললে হবে, ওষুধেই তো লেখা আছে, ‘‘সুগার ফ্রি’’!’

আমাদের দেশে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কারসাজি হয়। মজুত করে, সরবরাহ কমিয়ে, দাম বাড়িয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। ভোজ্য তেলের পর এবার চিনি নিয়ে কারসাজি করছে একটি চক্র। বাজার থেকে অনেকটা ‘উধাও’ হয়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটি। অনেক ঘুরে দু-একটি দোকানে চিনি পাওয়া গেলেও বিক্রি করা হচ্ছে বেশি দামে। চিনির দাম প্রতি কেজিতে রেকর্ড বেড়ে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোথাও কোথাও আরো বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির হিসাব মতে, এক মাসে চিনির দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। আর এক বছরে বেড়েছে ৬২ শতাংশের বেশি। গত ১০ মে থেকে চিনির দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সরকারনির্ধারিত নতুন দাম অনুযায়ী, পরিশোধিত খোলা চিনির দাম বাড়িয়ে প্রতি কেজি ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত পরিশোধিত চিনির দাম প্রতি কেজি ১২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বাজার পরিস্থিতি ভিন্ন। বেশির ভাগ দোকান থেকে চিনি উধাও হয়ে গেছে। তবে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি টাকা গুনলে চিনি ঠিকই মিলছে!

আমদানিকারকদের বক্তব্য হচ্ছে, বাজারে চিনির সরবরাহে সমস্যা নেই। কিন্তু দাম নিয়ে অস্থিরতা থাকায় অনেকেই চিনি বিক্রি করছেন না। ডলার-সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এলসি করতে রাজি হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ছে, তাছাড়া এলসি কম থাকায় চিনির দাম বেশি।

বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৮ থেকে ২০ লাখ টন চিনি প্রয়োজন হয়। এই ১৮ থেকে ২০ লাখ টন চিনির মধ্য থেকে বাংলাদেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১ লাখ টন চিনি। আর বাকি চিনি বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বর্তমানে চিনি সংকটের প্রধান কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের চিনি ব্যবসায়ী ও মিলমালিকরা। চিনি ব্যবসায়ীরা মিলমালিকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে দেশের আমদানিকৃত সকল চিনি আটকে রেখে দেশের মধ্যে সংকটের সৃষ্টি করে। ফলে সারাদেশে ব্যাপক হারে চিনি সংকট দেখা দেয়। আর এই চিনি সংকটকে কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছেমতো চিনির দাম বৃদ্ধি করে। এ ব্যাপারে সরকার কেবলই সাক্ষী গোপালের ভূমিকা পালন করছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা মুখে ভালো ভালো কথা বলা ছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারছে না।

চাল, তেল, পেঁয়াজের পর চিনি নিয়ে কারসাজি মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কারণ বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবন চিনি ছাড়া চলে না। বাচ্চাদের খাদ্যের অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে চিনি। চা-কফিতে চিনি। সেমাই-সুজি-হালুয়ায় চিনি। আরো বিচিত্র সব আইটেম তৈরি করা হয় চিনি দিয়ে। বাদ্য ছাড়া গান আর চিনি ছাড়া খানা উভয়ই বাঙালির কাছে অপাঙেক্তয়। এই গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান চিনি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক হাহাকার।

চিনির কথা বললেই গৃহিণীরা তেড়ে উঠছেন, নো চিনি এট অল। নেভার চিনি। পিঁপড়াও আর চিনি খুঁজে পাচ্ছে না। চিনির পাত্র পাখিহীন খাঁচার মতো অনাদরে পড়ে আছে। মধ্যবিত্ত ঘরের ছোট্ট শিশুকে দুধভর্তি ফিডার মুখে দিলে সে এক চুমুক খেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় শিশুর দুধেও চিনির পরিমাণ কমে গেছে। অভ্যস্ত শিশু এখন আর পানসে দুধ খেয়ে মজা পাচ্ছে না। ফলে চিনি নিয়ে কান্না থামছে না।

মিষ্টি জাতের খাবার সেমাই, সুজি, হালুয়া তো দূরে থাক চা-কফিও হয়ে গেছে ‘সুগার ফ্রি’-ডায়াবেটিস রোগীর খাবার। চায়ে যতটা পারা যায় কম চিনি দেওয়া হচ্ছে। ঘরে চায়ে চিনির পরিমাণ নিয়ে ঝগড়া-কলহ তো হচ্ছেই, দোকানে পর্যন্ত চা-বিক্রেতাদের সঙ্গে ঝামেলা সৃষ্টি হচ্ছে। চিনি কম দিয়ে, পারলে না দিয়ে কীভাবে চা বানানো যায় ঘরে ঘরে এবং দোকানে দোকানে এখন চলছে সেই কসরত্। যাদের ডায়াবেটিস নেই তারা পড়েছেন মহা ফাঁপরে। সুস্থ মিষ্টিপ্রিয় মানুষের পক্ষে রোগীর পথ্য আর কাহাতক সহ্য হয়?

ঠিকমতো দুধ-চিনি দেওয়া চা খেতে না পারার কারণেই কি-না, বিএনপির নেতাকর্মীরাও কেমন তিরিক্ষি হয়ে উঠছেন। সরকারের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়ছেন। চিনির অভাব ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মনকেও তিক্ত বানিয়ে ফেলেছে। তারাও বিরোধী দলের প্রতি মিষ্টি আচরণের বদলে তিক্ত, রুক্ষ আচরণ করছেন। নানা কৌশলে বিএনপির আন্দোলনকে ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। আরেক দফা ক্ষমতায় থাকার জন্য বিচিত্র সব পদ্ধতি প্রয়োগের লাইনে অগ্রসর হচ্ছেন। এদিকে আম পাবলিকের অবস্থা কেরোসিন। কিন্তু আম পাবলিকের কথা এদেশে কে ভাবে?

আসলে চিনির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে সর্বত্র, সবখানে।

মিষ্টি এখন উচ্চবিত্তের শৌখিন খাবার (যদিও তারা ডায়াবেটিসের ভয়ে তা খেতে পারেন না)! আনন্দ আর খুশির খবরেও এখন আর মিষ্টির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, মিষ্টিমুখ করা হচ্ছে না। যাদের হাতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আছে, এখন তারাই কেবল মিষ্টির স্বাদ উপভোগ করছেন। চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় মিষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি কথাও হারিয়ে যাচ্ছে বোধ হয়। সবাই কেমন যেন তিতা তিতা কথা বলছেন। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের কথায় তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ঘরে কুরুক্ষেত্র তো আগেই ছিল, এখন বাইরেও তা শুরু হয়েছে।

চিনির দাম বাড়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপে ব্যর্থ হয়ে সরকার ক্রমেই গালাগালের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এই চিনি শেষ পর্যন্ত সরকারকে, সর্বোপরি দেশকে কোথায় নিয়ে যায়, আরো কত বিপত্তি ঘটায় কে জানে!

পুনশ্চ : বড়লোকরা নানা ধরনের চিনি খেয়ে থাকেন। তাদের আছে নানা বিকল্প। গরিবরা তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। এ ব্যাপারে একটা পুরোনো গল্প শোনা যাক।

একদিন এক লোক তার এক ধনী আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গেছে। সেই আত্মীয় তাকে জিগ্যেস করল : ‘কী দেব বলুন, ফলের জুস, চা, কফি, সফট ড্রিংকস নাকি অন্য কিছু?’

—‘চা।’

—‘সাধারণ, নাকি হারবাল? গ্রিন টি, নাকি আইস টি?’

—‘সাধারণ চা।’

—‘লাল চা, নাকি দুধ চা?’

—‘দুধ চা।’

—‘গরুর দুধ, গুঁড়ো দুধ, না কনডেন্সড দুধ?’

—‘গরুর দুধের।’

—‘ঠান্ডা, নাকি গরম?’

—‘গরম।’

—‘ফুলক্রিম, লো ফ্যাট, নাকি ফ্যাট ফ্রি?’

—‘উমমমম...তার চেয়ে বরং লাল চা-ই দিন।’

—‘চিনি, নাকি মধু দেব?’

—‘চিনি দিন দয়া করে।’

—‘ক্যান সুগার, নাকি বিট সুগার?’

—‘ক্যান সুগারই দিন।’

—‘সাদা, বাদামি, নাকি হলুদ চিনি?’

—‘থাক ভাই, চা লাগবে না! আপনি আমাকে এক গ্লাস পানি দিন!’

—‘মিনারেল, নাকি নরমাল?’

—‘মিনারেল।’

—‘ফ্লেভারড, নাকি নন ফ্লেভারড?’

—‘ভাই রে, অত কিছু বুঝি না! আমি কিছুই চাই না!’