Published : 04 Nov 2021, 05:10 PM
৪ নভেম্বর, ১৯৭২ গণপরিষদে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান 'সংবিধান বিল' হিসেবে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। দিনটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সাংবিধানিক ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লাগাতার রক্তাক্ত সংগ্রাম করেছে। দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং নয় মাসের একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ, মা-বোনদের সম্ভ্রম বিসর্জনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন একটি অনন্য ও ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ছিল।
২৩ মার্চ ১৯৭২ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক Constituent Assembly of Bangladesh Order, 1972 (P.O 22 of 1972) জারি করা হয়। রাষ্ট্রপতির ওই আদেশ বলে ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় 'বাংলাদেশ গণপরিষদ'। বহিষ্কৃত ও পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য পোষণকারীরা গণপরিষদের সদস্য পদ লাভে অযোগ্য ছিলেন। রাষ্ট্রপতির উক্ত আদেশের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী গণপরিষদকে একটি সংবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়ে ১০ এপ্রিল, ১৯৭২। বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামের সমর্থনে শাহ আব্দুল হামিদ ও তাজউদ্দিন আহমদের প্রস্তাবে এবং ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীর সমর্থনে জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ যথাক্রমে গণপরিষদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন।
পরদিন ১১ এপ্রিল গণপরিষদের অধিবেশনে ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করার উদ্দেশ্যে 'গণপরিষদের ৩৪ জন সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত খসড়া প্রণয়ন কমিটি-যার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. কামাল হোসেন'– প্রস্তাবটি উত্থাপন করলে তা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। মোট ৮৫ দিন কমিটির বৈঠক হয়। ১২ অক্টোবর ১৯৭২, কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন 'সংবিধান বিল' গণপরিষদে উত্থাপন করেন।
এ উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, "দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা যায় না, দশ মাসের মধ্যে কোন দেশ শাসনতন্ত্র দিতে পেরেছে। আমি নিশ্চই মোবারকবাদ জানাব শাসনতন্ত্র কমিটির সদস্যদেরকে। মোবারকবাদ জানাব বাংলার জনসাধারণকে। রক্তে লেখা এই শাসনতন্ত্র। যারা আজ অন্য কথা বলেন বা চিন্তা করেন, তাদের বোঝা উচিত যে, এ শাসনতন্ত্র আলোচনা আজ থেকে শুরু হয় নাই। অনেকে যারা বক্তৃতা করেন, তাদের জন্মের আগের থেকে তা শুরু হয়েছে এবং এ জন্য অনেক আন্দোলন করতে হয়েছে। অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। এই শাসনতন্ত্রের আলোচনা হতে হতে শাসনতন্ত্র কী হবে তার উপরে ভোটের মাধ্যমে শতকরা ৯৮ জন লোক তাদের ভোট আওয়ামী লীগকে দিয়েছেন। শাসনতন্ত্র দেওয়ার অধিকার আওয়ামী লীগের রয়েছে।… শাসনতন্ত্র ছাড়া কোন দেশ– তার অর্থ হল মাঝিবিহীন নৌকা, হালবিহীন নৌকা। শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকার থাকবে, শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যও থাকবে। এখানে Free style democracy চলতে পারে না। শাসনতন্ত্রে জনগণের অধিকার থাকবে, কর্তব্যও থাকবে। এবং যতদূর সম্ভব, যে শাসনতন্ত্র পেশ করা হয়েছে, সেটা জনগণের আশা-আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক হয়ে থাকবে, সে সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহ নেই। আমাদের আদর্শ পরিষ্কার হয়ে রয়েছে। এই পরিষ্কার আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এবং সে আদর্শের ভিত্তিতে এদেশ চলবে। জাতীয়তাবাদ-বাঙালী জাতীয়তাবাদ-এই বাঙালী জাতীয়তাবাদ চলবে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার আকাশ-বাতাস, বাঙালীর রক্ত দিয়ে বাংলার জাতীয়তাবাদ। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, জনসাধারণের ভোটের অধিকার বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি সমাজতন্ত্রে, যেখানে শোষণহীন সমাজ থাকবে। শোষক-শ্রেণী আর কোনদিন দেশের মানুষকে শোষণ করতে পারবে না।… আর হবে ধর্মনিরপেক্ষতা। … এই চারটি আদর্শের ভিত্তিতে বাংলার শাসনতন্ত্র তৈরী হবে। এটা জনগণ চায়, জনগণ এটা বিশ্বাস করে। জনগণ এই জন্য সংগ্রাম করেছে। লক্ষ লক্ষ লোক এই জন্য জীবন দিয়েছে। এই আদর্শ নিয়েই বাংলার নতুন সমাজ গড়ে উঠবে।"
সংবিধান বিল উত্থাপিত হওয়ার পর সর্বমোট ১৭টি অধিবেশনে বিভিন্ন সংশোধনী প্রস্তাবসহ বিলটির ওপর আলোচনার পর ৪ নভেম্বর ১৯৭২ গণপরিষদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
সংবিধান বিল গৃহীত হওয়ার পূর্বে আলোচনায় অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, "জনাব স্পীকার সাহেব, আজই প্রথম সাড়ে সাত কোটি বাঙালী তাদের শাসনতন্ত্র পেতে যাচ্ছে। বাংলার ইতিহাসে বোধহয় এই প্রথম যে বাঙালীরা তাদের নিজেদের শাসনতন্ত্র দিচ্ছে। বোধ হয় না-সত্যিই এই প্রথম যে, বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের ভোটের মারফতে এসে তাঁদের দেশের জন্য শাসনতন্ত্র দিচ্ছেন।… এই শাসনতন্ত্র শহীদের রক্ত দিয়ে লেখা। কোন দেশে কোন যুগে আজ পর্যন্ত এত বড় রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে এত তাড়াতাড়ি শাসনতন্ত্র দিতে পারে নাই।… তাই মানুষের মৌলিক অধিকার যাতে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে, তারই জন্য আমাদের পার্টি এই শাসনতন্ত্র প্রদান করল। আশা করি, জনগণ এই শাসনতন্ত্র গ্রহণ করবেন এবং করেছেন।… এই শাসনতন্ত্রের জন্য কত সংগ্রাম হয়েছে এই দেশে।… শাসনতন্ত্র এমন একটা জিনিস, যার মধ্যে একটা আদর্শ, নীতি থাকে। সেই শাসনতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে আইন করতে হয়।… এই মৌলিক আইন বিরোধী কোন আইন হতে পারবে না।… এটা জনতার শাসনতন্ত্র।… ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষনহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে, শহীদের রক্তদান সার্থক হবে।"
বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিষদের অধিবেশন মুলতবী করা হয় এবং ওই দিনটিকে ঠিক করা হয় সংবিধানে সদস্যদের স্বাক্ষর দানের জন্য। সংবিধান কবে থেকে কার্যকর হবে সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, "জনাব স্পীকার সাহেব, আজ এই পরিষদে শাসনতন্ত্র পাশ হয়ে যাবে। কবে হতে এই শাসনতন্ত্র বলবৎ হবে, তা আমাদের ঠিক করতে হবে। আমি মনে করি, সেইদিন, যেদিন জল্লাদ বাহিনী রেসকোর্স-ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও আমাদের বন্ধু-রাষ্ট্রের মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পন করেছিল, সেই তারিখ। সেই ঐতিহাসিক ১৬ই ডিসেম্বর তারিখ থেকে আমাদের শাসনতন্ত্র কার্যকর করা হবে। সেই দিনের কথা রক্তের অক্ষরে লেখা আছে। স্পীকার সাহেব, সেই ইতিহাস আমরা রাখতে চাই।"
১৪ ও ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭২ সংবিধানে গণপরিষদ সদস্যদের স্বাক্ষর দান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ তারিখ স্পিকারের আমন্ত্রণে সংবিধানে সর্বপ্রথম স্বাক্ষর প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- প্রথমে সংবিধানের বাংলা এবং পরে ইংরেজী পাঠে। তারপর অন্যান্য সদস্যরা সংবিধানে স্বাক্ষর করেন।
গণপরিষদের সিদ্ধান্ত ও অভিপ্রায় অনুযায়ী ১৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাত বারোটায় গণপরিষদের বিলুপ্তি ঘটে এবং রাত বারোটার পর অর্থাৎ ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭২ সংবিধান কার্যকর হয়।
উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর সংবিধান তৈরিতে সময় লেগেছিল প্রায় আট বছর। ঐ সংবিধান তৈরির পরপরই অব্যাহত সামরিক শাসন মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রকে একটি বর্বর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল, যেখানে সাংবিধানিক এবং আইনের শাসন ছিল অনুপস্থিত।
আমাদের সংবিধান– স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষার একটি অনন্য রাজনৈতিক দলিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে রকমারি বল্লমের অজস্র খোঁচায়। চেষ্টা করা হয়েছে সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূল চরিত্র পাল্টে দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় সাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার। সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগ বিভিন্ন প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও বিভিন্ন রায় প্রদানের মাধ্যমে সচেষ্ট থেকেছে এবং আছে সংবিধানের মূল চরিত্র ও কাঠামোকে রক্ষা করতে। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ ও লালনকারী সরকার ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা থাকায় ১৯৭২-এর সংবিধানে বহুলাংশে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়েছে।
সংবিধান বিলের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেছিলেন "ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে, শহীদের রক্তদান সার্থক হবে।" সময়ের বাস্তবতায় অসাম্প্রদায়িক-শোষণহীন বাংলাদেশ গড়া আজ সত্যিই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঁধে রয়েছে অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন বাংলাদেশ গড়ার অপরিসীম দায়িত্ব। সে কারণে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত, লালন ও বিকশিত করার জন্য প্রয়োজন সংবিধানের মর্ম উপলব্ধি, সঠিক চর্চা ও লালন। ইতোপূর্বে একটি লেখায় ৪ নভেম্বর দিনটিকে জাতীয় 'সংবিধান দিবস' পালনের প্রস্তাব রেখেছিলাম। বিভিন্ন মহল থেকেও এ দাবি উত্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সংবিধান গৃহীত বা কার্যকর হওয়ার দিনটিকে 'সংবিধান দিবস (Constitution Day)' হিসেবে বিভিন্ন আঙ্গিকে পালন করে থাকে। কোনো কোনো দেশে 'সংবিধান দিবস'-এ সরকারি ছুটি পালিত হয়। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক মহল 'সংবিধান দিবস' পালনের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে পারেন।