Published : 06 Nov 2021, 02:23 PM
বাঙালি জাতিকে স্যালুট। তবে এই লেখা পড়ে কারো মন খারাপ হলে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি'। তবু বলি বাঙালি এক মজার জাতি। কটাক্ষ এবং সমালোচনায় বাঙালি মারমুখো। মতদ্বৈততা এবং দ্বিধা তার স্বভাবসুলভ মানসিকতা। কবি নির্মলেন্দু গুণ তার এক কবিতায় এই প্রশ্নটা খানিক ভিন্নভাবে করেছিলেন, 'এতই যদি দ্বিধা তবে জন্মেছিলে কেন?' আবার এই দ্বিধাও সবসময় থাকে না, মেনে নেওয়াটাই হয়তো নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। যেমন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত ও নিহত হওয়ার একসপ্তাহ পর যখন রবার্ট ক্লাইভ তার সাত-আটশত সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদে আসেন বাঙালি তখন মজা করেছে। ইংরেজদের চেহারা ও ভাষা নিয়ে আলোচনা করেছে। মজা দেখার জন্য সমবেত হাজারো বাঙালি ইংরেজদের দিকে একটা ইটও ছোঁড়েনি।
লক্ষণ সেনের পর দীর্ঘকাল বাঙালিরা বাংলা শাসন করেনি। হাজার বছরে একজন বাঙালি আমরা পেয়েছিলাম যার ডাকে পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা এক হয়েছিল, তার নামে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মাত্র নয়মাসে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে যেদিন সপরিবারে হত্যা করা হয় সেদিনও বাঙালি ফুঁসে ওঠার পরিবর্তে এক ধরনের 'স্বেচ্ছা গৃহবন্দী' থেকে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্তই যেন নিয়েছিল!
সকল মেনে নেওয়াটা আবার মেনে নেওয়া যায় না। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পর ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি পাকিস্তানি জান্তা। বরং জাতীয়তাবাদের ঐক্য ভাঙ্গতে হিন্দু ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া, বাজারে হিন্দুদের দোকানপাট লুট ও জমি দখলে ইন্ধন দেয় পাকিস্তানিরা। এসব করার জন্যও কিন্তু তখন বাঙালির অভাব হয়নি। অভাব হয়নি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে বেঈমানি করার মানুষের। যারা বেঈমানি করেছিল স্বাধীনতার পরও আমরা তাদের মেনে নিয়েছি। কখনো রাজনীতির আন্দোলনে এক হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, কখনোবা আঁতাত করে ক্ষমতায় গিয়ে মন্ত্রীত্ব দেওয়ার নামে। মেনে নেওয়ার সব যাতনা অবশ্য এক অনুভূতির নয়। ক্ষমতায় যেতে বা থাকতে না পারার বেদনার সাথে পার্বতীকে না পেয়ে ক্রমশঃ দেবদাস হবার বেদনার সাথে এক ধরনের মিল হয়তো আছে। দুঃখের আগুনে পুড়ে যায় অন্তর!
বাংলার জন্য আপনার যেমন অন্তর পোড়ে তেমনি বাংলা নিয়ে নাক সিটকানো বাঙালিরও অভাব নেই। বিদেশি মদের দাম যখন খুব বেড়ে যায় তখন শ্রেণি সচেতনতা ভুলে কেউ কেউ কেরু কোম্পানির মদ খায়। কাব্য করে তখন বাঙালি বলে এটা কিন্তু 'এক্সপোর্ট' কোয়ালিটি যদিও 'মেইড ইন বাংলাদেশ'! এর চেয়েও নিচে নামতে হলে বাঙালি বলে, 'বাংলা' আছে খাবেন? স্রেফ বাংলাতে নামলে কী অপমানবোধ হয়? ভিসিআর যুগে ভিডিও ক্যাসেটের দোকানে লেখা থাকতো, 'এখানে বাংলা ছবির ক্যাসেট ভাড়া দেয়া হয় না'। আবার সিগারেট যদি ফাইভ ফিফটি ফাইভও হয় তাহলে সেটা ভাগ করা হতো দুইভাগে। একটাকে বলা হতো 'লন্ডন ফাইভ' আরেকটাকে অবজ্ঞা করে বলা হতো 'বাংলা ফাইভ'। দামে সস্তা বলে কেউ কেউ বাংলা ফাইভ ফুঁকলে ট্যাগ লাইন জুড়ে দিতেন এভাবে যে, 'একটু কড়া তাই খাই'। বাংলা মদ থাকলেও বাংলা নামের কোনো গাঁজা নেই। সেই হিসেবে নায়িকার মানদণ্ডে শাবানা ও ববিতাই শুধু বাংলার ছোঁয়া পেয়েছিলেন। ববিতাকে বলা হতো, 'বঙ্গ বিজয়ী তারকা' আর শাবানাকে বলা হতো, 'শাশ্বত বাংলার নারী'!
শাশ্বত বাংলার মানুষ কেমন? যখন খুব সাধারণ তখনও হয়তো বেচা-বিক্রিতে প্রতারণা করে। ধরুন, আপনি সাড়ে ছয়ফুট লম্বা মানুষ। গেছেন ছোট মাছ কিনতে। হাত দিয়ে ধরে, চোখ দিয়ে দেখে বললেন, 'ওই মাছওয়ালা আপনার মাছ তো আধা পচা'। মাছওয়ালা মাথা সোজা করে আপনাকে দেখার পর হয়তো বলবে, 'কী বলার লাগছেন? মাছ তো দেখতাছেন দোতালা থিক্কা। মাছ চিনতে হইলে জলে নামতে হয়'!
বাঙালি চিনতে হলে তাদের সাথে মিশতে হবে। ধরুন আপনি একটু জটিল। প্যাচগোচ কম বোঝেন না। পাঁচ বছর প্রেমের পর আপনার প্রেমিকা হয়তো অন্য কাউকে বিয়ে করে চলে গেছে। একদিন মদ খাবার পর আপনার ফিলিংস যখন চরমে তখন ভাবলেন প্রতিশোধমূলক কিছু একটা করা দরকার। আপনি পানশালা থেকে সোজা বেরিয়ে প্রেমিকার স্বামীর আলিশান বাড়ির গেটে যখন 'ওপেন হিসি' করছেন, তখন হয়তো প্রেমিকার স্বামী জায়গা মতো টর্চলাইট মেরে জানতে চাইলো, ভাই হচ্ছেটা কী? আপনার প্যাচানো উত্তর, ভাই আমি আসলে কাঁদছি। কিন্তু জল যে কোন পথ দিয়ে বের হচ্ছে বুঝতে পারছি না। আজকের দিনে মদ খাওয়া সম্ভবত ঠিক হয়নি।
বাঙালি নাকি ঠিক কাজটা সময় মতো করে না, যখন যেটা করার দরকার সময় এলে সেটা নাকি ঠিকই ভুলে যায়। বাঙালি যা বিশ্বাস করে সেটা নাকি বলে না আর যা বিশ্বাস করে তা নাকি পালন করে না। রবীন্দ্রনাথের মতে, 'পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস্'! আর প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ বলতেন, বাঙালি নারীর চরিত্র চিত্রণ হয় এটা মেপে যে সে পরপুরুষে আসক্ত কি না! আর পুরুষের চরিত্র বিচার হয় সে মদ্যপান করে কিনা কিংবা পরনারীতে আসক্ত কি না!
বাঙালি নাকি স্বভাবগত ভাবেই ফাঁকিবাজ। নিজের দেশে বসে সে পায়ের ওপর পা তুলে খেতে চায়। অন্যকে শাসন করতে চায় আর চাপাবাজি করে নিজের বংশ পরিচয় অন্যদের চেয়ে বড় জাহির করে রাজা উজির মারতে চায়। কোনো কাজ ভালমতো না শিখে সে যখন জমি বেচে বিদেশ যায় তখন তাকে বিদেশে গিয়ে বাজে কাজটাই হয়তো (ইংরেজিতে বলে-অড জব) করতে হয়। একারণে বিদেশেও বাঙালিদের নিয়ে অনেক গল্প আছে যেগুলো খুব একটা সুখকর নয়। যেমন এক লোক প্রতিবছর এক মাস বাড়তি ছুটি চায় এবং জানতে চাইলে অফিসের বসকে বলে, তার বউয়ের বাচ্চা হবে। বিদেশি বস তিন তিনবার সহ্য করার পর চতুর্থ বছরে যখন ওই বাঙালি আবারো ছুটি নিতে চাইল তখন বস জিজ্ঞাসা করল,
–রোদ বাড়লে বা বৃষ্টি নামলে কী করো?
–স্যার ছাতা ব্যবহার করি।
বস এবার ক্ষেপে গিয়ে বললো, বউয়ের সামনে যেয়ে যখন আবেগায়িত হয়ে যাও তখন ছাতার মতো কিছু একটা ব্যবহার করতে মনে থাকে না? এরপর থেকে এটা মনে না রাখলে চাকরি থাকবে না।
বাঙালির ধ্যানজ্ঞান থাকে চাকরি পাওয়া নিয়ে। চতুর্থ শ্রেণির সরকারি চাকরির জন্য পাঁচ-দশলাখ টাকাও খরচ করে ফেলে। জমি বিক্রি করে বিদেশে গিয়ে হয়তো 'অড' জব করে। বিদেশ যেতে না পারলে আফ্রিকার কোনো দেশ থেকে হয়তো এক নৌকায় তিনশ জন রওনা করে এবং সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে মারাও পড়ে। বাংলার চেয়ে অন্যান্য দেশের হাতছানি বাঙালির কাছে মধুরতম। হয়তো বাঙালি 'অন্যদেশ কাতর'-এর মতো বেশিমাত্রায় 'পরশ্রীকাতর'!
'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, 'পরশ্রীকাতরতা ও বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধ হয় দুনিয়ার কোনো ভাষাতেই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, পরশ্রীকাতরতা।'
বাঙালির পরশ্রীকাতরতা নিয়েও অনেক গল্প আছে। যেমন, দুই প্রতিবেশির গল্প। এক প্রতিবেশি অন্য প্রতিবেশিকে হিংসা করে, দৌড়ের ওপর রাখে। একজন অন্যজনের উঠোন নষ্ট করে তো অন্যজন ক্ষেতের ধান কেটে নেয়। এই পরিস্থিতিতে একজন দরবেশ এলো সেখানে। দুই প্রতিবেশিকে ডেকে বলল, তোমরা আমার কাছে ভাল কিছু চাও। অন্যের জন্য যা চাইবে নিজের বেলায় তার দ্বিগুণ পাবে। এক প্রতিবেশি জানত অন্য প্রতিবেশির একটা কিডনি নষ্ট। সে কোনো কিছু না ভেবেই দরবেশকে বলল ওনার ভাল কিডনিটা নষ্ট করে দেন! তার প্রতিবেশি মারা গেলেও দুটো কিডনি হারিয়ে মারা গেল সে নিজেও! বাঙালি হয়তো এখনও জানে না পরশ্রীকাতরতার কারণে তাদের দ্বিগুণ ক্ষতি হচ্ছে।
ক্ষতি নাকি অলসতাও করেছে। প্রকৃতিগত কারণে বাঙালি নাকি দারুণ অলস। নিজে গাছ না লাগালেও পাখির মাধ্যমে গাছ হয় এখানে। ফসল লাগালে ফসল হয়। আর কিছু না থাকলে আগে মাছ ধরে মাছ বেচে খেত বাঙালি। যার জন্য অনেকেই বলত, 'লেখাপড়া করিয়া কেন মরিব দুঃখে? মৎস ধরিব খাইব সুখে'! অলসতা নাকি শয়তানি, সমালোচনা, হীনমন্যতা আর পরশ্রীকাতরতা বাড়ায়। অলসতা কখনো সখনো নাকি বাঙালিকে কাজে সক্রিয় না রাখলেও বিছানায় সক্রিয় রাখে। একটা পরিসংখ্যান থেকে ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে পারে। ১৯৪৭-এ এই মুল্লুকের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে তিন কোটি, ১৯৭১-এ সাড়ে সাত কোটি, ২০২১ -এ এসে নির্ঘাত আঠার কোটি পার হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম কী একারণে লিখেছিলেন যে, 'ভিতরের দিকে যত মরিয়াছি/ বাহিরের দিকে তত/ গুনতিতে মোড়া বাড়িয়া চলেছি গরু ছাগলের মতো।'
বাঙালি সংখ্যায় বাড়লেও প্রজননের সৃষ্টিশীলতা ছাড়া অন্যকিছুতেও সৃষ্টিশীল হয়েছে কি না তা এখনো নির্ণীত না। হুমায়ুন আজাদ তার গরীবের সৌন্দর্য কবিতায় লিখেছিলেন, 'যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়'। রাজনৈতিকভাবে ১৯৭১ আর ১৯৯০ সাল ছাড়া এদেশবাসীর এক হওয়ার নজির আর মেলেনি। বিভাজনই যেন বাঙালির নিয়তি। ইংল্যান্ড বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেলে বুঝবেন বাঙালির বিভাজন কেমন। প্রথম কেউ বানাবে বৃহত্তর মার্কিন অমুক জেলা সমিতি। এরপর এটা ভেঙ্গে হবে মার্কিনস্থ বৃহত্তর অমুক সমিতি। এটাও ভাঙ্গবে এবং চেয়ার ছোঁড়াছুড়ির পর মারামারি হবে। নতুন করে জন্ম নেবে তমুক সমিতি, যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ক, খ, ঙ, চ, র ইত্যাদি নামে ওই একই জেলার শত শত সংগঠন হবে। বিভাজন কমবে না। একে অন্যকে টেনে নামানোর চেষ্টাও থামবে না।
বাঙালিদের 'টেনে' নামানোর গল্প সবচেয়ে পুরাতন। ওই যে সতের ফুট গভীরতার জলহীন এক কুয়ায় পড়েছে চার বাঙালি। একজন হিসেব করে দেখল একজনের ঘাড়ে একজন এমন করে তিনজন দাঁড়ালেই তারা কুয়ো থেকে উঠে আসতে পারে। দেখা গেল তিনজন দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে চতুর্থ জন তাদের টেনে নামায়। এই টেনে নামানোই চলতে থাকে, কুয়ার উপরে ওঠা আর হয় না। হাজার বছর ধরেই কী এমন চলছে?
কবি জীবনানন্দ দাশ হাজার বছর ধরে পথ হাঁটলেও বনলতা সেন মাত্র দু দণ্ডের জন্য তাকে শান্তি দিয়েছিল। বাঙালি স্বাধীনভাবে শান্তিতে থাকুক।