Published : 26 Jun 2021, 01:54 AM
প্রতিদিন যখন কোভিড মহামারীতে দেশ-বিদেশে মৃত্যুসংখ্যা বৃদ্ধির খবরে আতঙ্কিত মানুষ সেসময় ভিন্ন আরেকটি সংবাদে বুক কেঁপে ওঠে লক্ষ লক্ষ মা-বাবার, ঘরে যাদের উঠতি বয়সী সন্তান আছে। আর যাদের ঘরে মাদকাসক্ত ব্যক্তি আছে তাদের কাছে সংবাদটি বজ্রাহতের মতো। গত ১৮ জুন টিভিতে এবং তার পরদিন খবরের কাগজে ল্যাব বসিয়ে নতুন মাদক তৈরির সংবাদটি বেরিয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে, "১৫-২০টি ইয়াবা খেয়েও নেশা হচ্ছিলো না তাদের। তাই আরও বেশি নেশা হওয়ার মতো মাদক খুঁজতে গিয়ে তারা সন্ধান পায় নতুন মাদক আইস-এর। কিন্তু এটি সহজলভ্য না হওয়ায় নিজেরাই অল্প 'আইস' সংগ্রহ করে বেশি পরিমাণে বানানোর কৌশল শিখে নেয়। এরপর বাইং হাউসের আড়ালে মাদক তৈরির ল্যাব গড়ে তোলে চক্রটি।" সম্প্রতি এ চক্রের মূল হোতাসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য পেয়েছে র্যাব।
এ সংঘবদ্ধ চক্রটি সম্প্রতি উত্তরায় একটি 'মেথ ল্যাব' তৈরির চেষ্টা করছিল। এ মেথ ল্যাবটি মূলত গ্রেপ্তার হওয়া আরাফাত রুদ্র ওরফে ঝাকি রুদ্র তার কয়েকজন সহযোগীর সহায়তায় পরিচালনা করতো। তারা মাদকের সঙ্গে বিভিন্ন ওষুধ ও কেমিক্যাল মিশ্রণ করতো। পাতন পদ্ধতিতে ভেজাল দ্রব্য মিশিয়ে আইসের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে ইয়াবার রং পরিবর্তন এবং 'ঝাক্কি' তৈরি করতো।
'ঝাক্কি' তৈরিতে তারা তরল পানীয়ের সঙ্গে ইয়াবা, ঘুমের ওষুধ ও অন্য নেশাজাতীয় তরল মিশ্রণ করতো বলে জানিয়েছে। তারা ভেজাল ও পরিশুদ্ধ উভয় প্রকার আইস বাজারে বিক্রি করতো এবং তা নিজেরাও সেবন করতো। এছাড়া মাদক সেবনের জন্য তারা উত্তরায় একটি বাইং হাউসের নামে বাসা ভাড়া করে সেখানে অনৈতিক কাজও করতো। সেখানে সেবনকারী সিন্ডিকেটের একই 'রিং' বা পরিচিতরা আসা-যাওয়া করতো। তারা অনলাইনে বিভিন্ন কনটেন্ট থেকে 'মেথ ল্যাব' সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নিয়েছিল বলে জানা গেছে।
গ্রেপ্তারকৃত জুবেইন লন্ডন থেকে বিবিএ, তৌফিক বেসরকারি ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ, খালেদ বেসরকারি ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ পাশ, রুদ্র ও সাইফুল এইচএসসি পাশ করার পর ড্রপ আউট হয় এবং খালেদ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। তাদের মধ্যে রুদ্রের নামে ৩টি মাদক মামলা এবং জুবেইনের নামে একটি হত্যা চেষ্টা মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।
এক পুলিশ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ নিয়মিত ইয়াবা সেবনে তারা চরম আসক্তির পর্যায়ে পৌঁছায়। পরবর্তীতে আসক্তির মাত্রা বাড়াতে বিগত চার থেকে পাঁচ বছর যাবৎ তারা 'আইস' নেওয়া শুরু করে। গ্রেপ্তাররা বিভিন্ন সময়ে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের নেশায় উদ্বুদ্ধ করতো। ক্ষেত্রবিশেষে গোপন ভিডিও ধারণ করে তাদের ব্ল্যাকমেইল করতো। এছাড়া তারা অস্ত্র দ্বারা 'এমিং গেম' জুয়া খেলতো। গ্রেপ্তারকৃত আসামীরা একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের অংশ এবং সকলেই আইস গ্রহণে মারাত্মকভাবে আসক্ত। জিজ্ঞাসাবাদে আরও কিছু সিন্ডিকেট এবং এই মাদকের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পর্কে তারা তথ্য দিয়েছেন।
এর আগে এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড) মাদক সেবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে গিয়ে আরেকটি নতুন ধরনের মাদক 'ব্রাউনি কেক'–এর সন্ধান পায় পুলিশ। এ ধরনের মাদক কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
গত ১৫ মে থেকে নিখোঁজ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমান। এর আট দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে তাঁর লাশ শনাক্ত করা হয়। তার মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে এলএসডির সন্ধান পায় ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশ। ডিবি জানায়, হাফিজুরকে তার বন্ধুরা এলএসডি সেবন করান। এরপর তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে এক ডাব বিক্রেতার দা কেড়ে নিয়ে নিজের গলায় চালিয়ে দেন। এর কয়েক ঘণ্টা পর তার মৃত্যু হয়। ডিবির এই বক্তব্যের পর এলএসডি আলোচনায় আসে। একই সঙ্গে আলোচনায় আসে গাঁজার নির্যাস থেকে তৈরি ক্ষতিকর মাদক 'ব্রাউনি কেইক'।
মাদকের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। প্রথম দিকে মদ, ভাং, চরস, খৈনি, গুটকা,আফিম (পপি গাছের রস থেকে তৈরি এক প্রকার মাদক), গাঁজা ইত্যাদির ব্যবহার হতো মাদক হিসেবে। পরে বিভিন্ন প্রকার 'ড্রাগ' হয়ে ওঠে নেশার বস্তু। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মানুষের কল্যাণে আবিষ্কার করলেন বিভিন্ন ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ বা 'ড্রাগ', যা ধীরে ধীরে নেশার সামগ্রী হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। কোকেন, হেরোইন, এন ১০, ব্রাউন সুগার, কোরেক্স, মারিজুয়ানা, বারবিচুয়েট, ম্যানডেক্স, এলএসডি., ইয়াবা ইত্যাদি মাদক হিসেবে বহুল প্রচলিত। এই সমস্ত ড্রাগ আন্তর্জাতিক পাচারকারীদের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। ভিয়েতনাম,থাইল্যাণ্ড ও মায়ানমার মাদক চোরাচালানের স্বর্গভূমি হিসেবে পরিচিতি। এখন আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইরানেও মাদক তৈরি হচ্ছে। এছাড়া কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, সুদান, নাইজেরিয়া, রাশিয়া, আমেরিকাতেও এর বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রসঙ্গত, ফরাসি বিপ্লব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় পরাজিত ও আহত সৈন্যরা হতাশা ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ব্যাপকভাবে মাদকে আসক্ত হন। পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলিতেই প্রথমে বেদনানাশক ড্রাগগুলো নেশাদ্রব্যে পরিণত হয়। তারপর ধীরে ধীরে তা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেও সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ে।
গত কয়েক দশক থেকে বাংলাদেশেও মাদকের ব্যবহার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদকসেবীর সংখ্যা লাখের ঘরে নয়, অনেক আগেই তা কোটির ঘর পেরিয়ে গেছে এবং এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। করোনাভাইরাসের দ্বারা সৃষ্ট কোভিড-১৯ যদি প্যানডামিক হয় বাংলাদেশে এই মুহূর্তে মাদকসেবন বা মাদক সমস্যাকেও এখন মহামারী হিসেবে গণ্য করা দরকার।
সরকার জঙ্গিবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করলেও জঙ্গিবাদ দমন ছাড়া অন্য দুটি ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য খুব সামান্য। তার কারণও আছে। সে কারণ হলো, জঙ্গিবাদ বিস্তারলাভ করলে বা দেশ জঙ্গিশাসিত হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়বে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। বর্তমান সরকারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো কিছুই অবিকৃত রাখবে না জঙ্গিরা। যেকারণে সরকারের সকল পর্যায় থেকে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে উৎসাহ ও প্রতিরোধমূলক মনোভাব লক্ষ করা গেছে। কিন্তু অন্যদুটি ক্ষেত্রে এমন ঘটেনি। কারণ, দুর্নীতি নিয়ে দুর্নীতিবাজ সকলেই একাট্টা। সেখানে কমিউনিস্ট, বুর্জোয়া, আস্তিক-নাস্তিক, ডান-বাম, মৌলানা-ব্রাহ্মণ, আওয়ামী লীগ -বিএনপি, জামায়াত-হেফাজত ইত্যাদির মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। কাজেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সফল হয়নি।
একই ঘটনা মাদকের ক্ষেত্রেও। এ লাভজনক কারবারের সঙ্গে জড়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, সাংবাদিক, এনজিওকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, শোবিজ তারকা থেকে মসজিদের ঈমাম পর্যন্ত। এরা যার যার অবস্থান থেকে মাদকব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন এবং একে অপরের স্বার্থ রক্ষা করেন। এদের সিন্ডিকেট বা নেটওয়ার্ক খুবই শক্তিশালী এবং সুবিস্তৃত। মাদক কারবার এতই লাভজনক যে এই কারবার বন্ধ হোক তা আন্তরিকভাবে চাইছে না এ সিন্ডিকেট।
জঙ্গিবাদ দমন করলে যাদের লাভ মাদক কারবার ও দুর্নীতি বন্ধ হলে তাদের ক্ষতি কাজেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এমনকি জিরো টলারেন্স দেখানোর ঘোষণা দেওয়ার পরও তা সফল হয়নি। অবশ্য বলা উচিত সফল হতে দেওয়া হয়নি। লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে বিতর্কিত করতে একটি পক্ষ সবসময় সক্রিয় থাকে। ইয়াবাবিরোধী অভিযানের শুরুতে একটি ঘটনা দেশে-বিদেশে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছিল। ইয়াবা কারবারির অভিযোগ এনে টেকনাফ উপজেলা যুবলীগনেতা একরামকে 'ক্রসফায়ার'-এ হত্যা করা হয়েছিল। সে অপারেশনের অডিও অর্থাৎ একরামের পরিবারের সঙ্গে তার আলাপ ও পরবর্তী ঘটনার মোবাইলরেকর্ডিং ভাইরাল হয়েছিল তাতে অনেককিছু জানা হয়েছিল। এ ঘটনার পর স্থানীয়রা চরম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল এবং একরামকে নিরপরাধ এবং তাকে শত্রুতা করে ফাঁসানো হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। এ ঘটনায় দেশে-বিদেশে সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
মাদকবিরোধী অভিযানের ফলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হন, অর্থাৎ মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িতরা অভিযানকে ব্যর্থ করতে, বিতর্কিত করতে নানা প্রকার ষড়যন্ত্র করতে পারে। এমন অভিযান চলাকালে সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড নিয়েও অনেকের মধ্যে প্রশ্ন আছে কারণ সে ঘটনার পর ইয়াবাবিরোধী অভিযান একপ্রকার বন্ধ আছে। এখন টেকনাফের পরিস্থিতি কী, মাদক পাচার নিয়ন্ত্রণ হয়েছে কিনা সাধারণ মানুষ তা জানে না। কয়েকদিন পর পর ইয়াবার চালান ধরা পড়ার কথা শোনা যায় তবে কয়টি চালান পার হওয়ার পর একটি চালান ধরা পড়ে তা-ও জানে না জনগণ। বর্তমানে ইয়াবাবিরোধী অভিযানের কী খবর তাও জানা নেই।
মাদকের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ইয়াবা। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে গাঁজা, চরশের সঙ্গে মেনড্রেক্স নামের একটি ট্যাবলেট নেশাদ্রব্য হিসেবে তরুণ-যুবাদের কাছে জনপ্রিয় ছিল। কবি নির্মলেন্দু গুণ সে সময় তার একটি কবিতায় মেনডেক্সের কথা লিখেছিলেন। সেসময় নেশা করার সস্তা ও সহজলভ্য আরেকটি উপকরণ ছিল তাহলো সঞ্জীবনী সুরা। তখন প্রত্যেকটি আয়ুর্বেদীয় ঔষধালয় মণকে মণ এ সুরা উৎপাদন করতো। এর অতিরিক্ত স্পিরিট ও অ্যালকোহলের কারণে সন্ধ্যার পর সুরা পান করে অনেকে নেশা করত। আসলে সে সময় আয়ুর্বেদীয় ঔষধালয়গুলো ওষুধের নামে এই সুরা বেচেই অনেক অবৈধ মুনাফা করতো। এরশাদের সময় জাতীয় ঔষধনীতি ঘোষিত হলে অন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় ওষুধের মতো সুরা উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়।
গাঁজা, চরশের পর শুরু হয় ফেন্সিডিলের যুগ। একসময় এটি কফ সিরাপ হিসেবে প্রচলিত ছিল। স্বাস্থ্যনীতির সময়ে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ হিসেবে ফেন্সিডিল নিষিদ্ধ হয় বাংলাদেশে। কিন্তু কয়েকবছরের মধ্যে মাদক হিসেবে ফেন্সিডিল বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে এর উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ থাকায় ভারত থেকে চোরাইপথে আসতে থাকে ফেন্সিডিল। এটি অনেক জায়গায় 'ডাইল' হিসেবেও বেশ পরিচিত।
ফেন্সিডিল বোতলে বা বড় শিশিতে করে বিক্রি করা হয়। ফলে তা বহন ও বিক্রি করা কিছুটা ঝামেলার ছিল। অন্যদিকে কিছু মাদক ইনজেকশনের মাধ্যমে নিতে হতো বলে সেখানেও সামান্য ঝামেলা পোহাতে হতো। ইয়াবা আসার পর অনেক সমস্যার অবসান ঘটে। পরিবহনের ক্ষেত্রে ইয়াবা খুব সুবিধাজনক। পকেটে করেই অনেক ইয়াবা একসাথে বহন করা সম্ভব। যে কারণে মাদক হিসেবে ইয়াবা নেশাখোরদের কাছে খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সারাদেশে মাদকসেবিদের কাছে খুব সহজে ইয়াবা পৌঁছে দেওয়া সহজ হয়ে ওঠে।
বর্তমানে ইয়াবা খুব সহজলভ্য একটি মাদক। অনলাইনেও মাদক কেনেন অনেকে। কোভিডকালীন বন্ধ বা লকডাউনে ইয়াবা পেতে কারো অসুবিধা পোহাতে হয়নি। ঘরে ঘরে বা গ্রাহকের জন্য সুবিধাজনক স্থানে ইয়াবা পৌঁছে দেওয়ার মতো নেটওয়ার্ক তৈরি হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো এসব তথ্য কি সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নেই? দেশে তো পুলিশের অগোচরে এক প্যাকেট সিগারেট বিক্রি করাও সম্ভব নয়। আসল সমস্যা হচ্ছে সদিচ্ছার অভাব। আবার বলি, নিজেদের সুবিধার জন্য যাঁরা জঙ্গিবাদ দমনে একনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে তারাই আবার নিজেদের আর্থিক ক্ষতির কথা ভেবে দুর্নীতি ও মাদকবিরোধী অভিযান সফল করতে যথার্থ ভূমিকা পালন করেনি।
বর্তমানে মহামারী ঠেকানোর পরিস্থিতির সুযোগে অনেকে মাদক কারবার নির্বিঘ্নে করে যাচ্ছে। অন্যদিকে লকডাউন ও মহামারীর প্রতিক্রিয়ায় ডিপ্রেশনে ভুগে অনেকে মাদকের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি পরিস্থিতি এখন এতই ভয়ানক যে এটাকে এপিডেমিক হিসেবে দেখা উচিৎ।
আরেকটি হতাশাজনক বিযয় হচ্ছে, দেশে এ বিপুলসংখ্যক মাদকাসক্তের চিকিৎসারও আধুনিক ও কার্যকর ব্যবস্থা নেই। মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের নামে যতগুলো প্রতিষ্ঠান আছে তার অধিকাংশই ভুয়া। এখানে ভালোর আশায় ভর্তি করিয়ে নিরাশ হতে হয় অধিকাংশ অবিভাবককে। শারীরিক, মানসিকভাবে নির্যাতন করার অভিযোগও আছে অনেক চিকিৎসাকেন্দ্রের বিরুদ্ধে। আমি মনে করি প্রতিটি জেলায় সরকারি হাসপাতালে আলাদা ওয়ার্ড রাখার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে মাদকাসক্তদের সঠিক ও বিজ্ঞানসন্মত চিকিৎসার জন্য।
এর পাশাপাশি পুলিশের একটি আলাদা ইউনিট গঠন করা দরকার, যারা মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবে এবং সে সঙ্গে মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে। মাদকাসক্ত আছে এমন পরিবারের অবিভাবকরা সামাজিক লোকলজ্জার কারণে সমস্যার কথা কাউকে বলতে পারেন না। মা-বাবারা মাদকাসক্ত সন্তানের কাছে বাস্তবিক অর্থেই অসহায়। অনেক মা-বাবা সন্তানের হাতে নিগৃহীত হওয়ার পরও সে কথা কাউকে বলতে পারেন না। কারো কাছে বিচার চাইতে পারেন না। এমন মা-বাবাদের সংকটের সময়ে বিশেষ পুলিশ বাহিনী সহযোগিতা দিতে পারে। মাদকাসক্তদের মধ্যে সবাই অপরাধী নয়, কাজেই তাদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে বিষয়টি সবার মনে রাখা দরকার। তাদের সঙ্গে সাধারণ চোর-ডাকাতের মতো আচরণ করলে ফল উল্টো হতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ও প্রশিক্ষিত বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সন্তান মাদকাসক্ত হওয়ার জন্য মা-বাবাকে দায়ী করার পুরনো ধ্যানধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। নেশা করা বা মাদকাসক্ত হওয়ার মতো বয়স, পরিবেশ, সামাজিক ও পারিবারিক কোনও কারণ না থাকা সত্ত্বেও অনেকে নেশার জগতে পা বাড়িয়েছে। মা-বাবার কিছুই করার নেই, এরা অনেকে অসহায়। তবে তাদের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী যখন রাষ্ট্র, সরকার বা প্রশাসন তখন এ অসহায় লোকদের বাঁচাতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।