Published : 02 Jun 2021, 09:31 PM
বাজেট মেটারস ফর হেলথ।
অব্যাহত ভয়ঙ্কর মহামারীর চ্যালেঞ্জের ভেতরেই ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হতে চলছে। গতবারের মত এবারও বাজেটে সকলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা। সরকার বলছে স্বাস্থ্যখাত তার অগ্রাধিকার। গত বছরের বাজেটে কোভিড মহামারীর শুরুতে স্বাস্থ্যখাতের চরম দুরাবস্থা স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরে ও সামনে গভীর অনিশ্চয়তা দেখেও মহা পরিকল্পনা নিতে দেখা যায়নি। এই বছরের বাজেটে কি স্বাস্থ্য খাতকে পাল্টে দেওয়ার মত কোন বড় পরিকল্পনা দেখা যাবে!
কোভিড মহামারীতে অসহায়ভাবে বিপর্যস্ত ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর জনগণ ভ্যাকসিন সুরক্ষা নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে মাস্ক খুলে ভ্রমনে বের হচ্ছে। তাদের অর্থনীতি ঘুরে দাড়াতে শুরু করেছে। বাংলাদেশসহ এশিয়ার ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ দেশগুলোর অর্থনীতি করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ধাক্কায় আরও একবার পতনের প্রান্তে।
অজানা, অদৃশ্য ভাইরাস যখন শনাক্ত হলো গতবছরের শুরুতে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আতঙ্কেই ভেঙ্গে পড়লো। করোনাকালে স্বাস্থ্যসেবার ভঙ্গুর, দুর্দশাগ্রস্ত চিত্র মানুষের কাছে প্রকট হয়ে উঠলো। চিকিৎসকদের অবহেলা, স্বাস্থ্যখাতে অব্যবস্থা, স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির চমকদার গল্প বড় হয়ে ধরা পড়লো। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে থেকে জনগণের চিকিৎসা সেবা নিয়ে হাহাকার, দুঃসহ অবস্থা ছিল। এ অবস্থা যে বছরের পর বছর উপেক্ষিত থাকা ও সঠিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যখাত গড়ে না তোলার প্রতিফল তা কি জনগণের কাছে স্পষ্ট হলো!
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশেরও কম, সেটা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। স্বাস্থ্যখাতে ২০২০-২১ সালে বরাদ্দ মোট বাজেটের আকারের তুলনায় মাত্র ৫ দশমিক ১ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হতে হবে দেশের জিডিপির ৫ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ। আমাদের স্বাস্থ্য বাজেটের অনুন্নয়ন ব্যয় ৬০ শতাংশের উপর, অর্থ চলে যাচ্ছে মূলত ভৌত অবকাঠামো, পরিচালন খাতে, বেতন-ভাতা ইত্যাদিতে। প্রকৃতপক্ষে রোগীর সেবার জন্য বরাদ্দ খুবই কম। বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতের মোট ব্যয়ের ৭৪ শতাংশ ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে (OOP) বহন করে। বৈশ্বিক মানদণ্ডে যা ৩২ শতাংশের নীচে। ব্যক্তির এই ব্যয়ের ৬১ শতাংশ যায় শুধু ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয়ে। আকস্মিক চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর ১ কোটি ১৪ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে।
এ কঠিন সময়ে অতীতের ভুল সংশোধন করতে কি বাজেটে উদ্যোগ আছে? জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির আলোকে গৃহীত স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশলপত্রে (২০১২-২০৩২) স্বাস্থ্য বাজেট জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশে উন্নীত করা ও স্বাস্থ্যসেবা পেতে ২০৩২ সালে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করেছিল। পর্যায়ক্রমিকভাবে সেখানে পৌছাতে সরকারের বাধা কোথায়?
বাজেট ঘোষণার এ সময়ে বার বার বাজতে থাকবে ভাঙ্গা রেকর্ড- শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে হবেনা, স্বাস্থ্যখাত কম বরাদ্দ টাকাও খরচ করতে পারে না, যোগ্য লোকের অভাবে বরাদ্দ অর্থ ফেরত যায়, তারা বাজেট চাইতেও পারেনা, সেই কম বাজেটেরও অধিকাংশ বরাদ্দ দুর্নীতিবাজদের পকেটে চলে যায় ইত্যাদি। স্বাস্থ্যখাতে দক্ষতা বৃদ্ধি, সক্ষমতা তৈরী, আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করা, দুর্নীতি রোধ বা সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নাই। এসব বিষয়কে সামনে এনে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য বাজেট সংকুচিত করার অজুহাত খোঁজার সুযোগ নাই। বরং স্বাস্থ্য খাতের দূর্বলতা দূর করে সক্ষমতা সৃষ্টির জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় আনতে হবে।
বাজেট প্রণয়নে আমাদের দূর্বলতা অনেক। এখানে প্রতিবছরে যে বাজেট বরাদ্দ থাকে তার বিপরীতে সামান্য বাড়িয়ে একধরনের দাক্ষিণ্য দেখানো হয়। বাজেটকে অংশীদারিমূলক করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে কতটুকু অর্থপূর্ণ প্রাক-বাজেট আলোচনা হয়েছে? অবশ্যই বাজেট বাস্তবায়ন সক্ষমতা বৃদ্ধি হলে অপচয় রোধ হবে, অপ্রতুল বাজেটের মধ্যেও সুফল পাবে জনগণ। বাজেট প্রস্তবনার ভিতর থাকবে সেই দক্ষতা, সক্ষমতা তৈরীর উদ্যোগ। বাজেট প্রণয়নের দক্ষতার সাথে জড়িয়ে থাকে বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা। আমরা কি জানি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্টরা তাদের সক্ষমতার নিরিখে কী কী প্রয়োজনীয় বরাদ্দ চেয়েছিল আর তার বিপরীতে কী দেওয়া হয়েছে!
বরাদ্দের দু'একটি ক্ষেত্র নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। আমরা জানি গবেষণা এখানে উপেক্ষিত। তার অর্থ এটা নয় যে, প্রজ্ঞাপন জারি করলেই গবেষণা হবে। আর অর্থের অভাবেই যেন সব গবেষণা বন্ধ আছে! স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেই উচ্চতায় উঠলেই তার গভীরে সৃষ্ট গবেষণা অবদান রাখতে সক্ষম। উচ্চমানের প্রতিষ্ঠান গড়ে দেয় গবেষণার পরিবেশ, তৈরী করে গবেষক। সরকারী নির্দেশনায় গবেষণা শুরু হয়না। তাই বরাদ্দকৃত ১০০ কোটি টাকা অব্যবহৃত থেকে যায়। প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে বিনিয়োগ না করে, প্রতিষ্ঠানের ভিতর পরিবেশ তৈরী না করে- এ ধরনের বরাদ্দ উদ্দেশ্য সফল না করে অপচয়ে পরিণত হয়।
সরকার কি স্বাস্থ্যখাতকে সত্যি বদলে দিতে চায়? কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলে, কতটা পরিকল্পিত বৃহৎ বিনিয়োগ হলে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্য অর্জিত হবে? বাংলাদেশের অদক্ষ, ভঙ্গুর, বিশৃংখল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে টেনে তুলতে, জনগণকে স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে আর্থিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে জাতীয় কৌশল কী হবে? অবশ্যই পৃথিবীর নিম্নমধ্যম ও মধ্যম আয়ের দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সুকঠিন রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা, বিনিয়োগ ও সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় সফল হবে বাংলাদেশ।
বাজেট সেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার একটি বছর। তাই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা পূরণের পথে থেকেই সরকারকে বর্তমানের দুঃসহ সময়কে কিছুটা সহনীয় করতে হবে তার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় জনগনের আস্থা ধরে রাখতে। অবশ্যই এ মহামারীতে জীবন বাচানো জরুরী। তাই এ মুহূর্তে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি সামাল দিতে ত্বরিত গতিতে ভ্যাকসিন সংগ্রহ, হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ উন্নত ও নিশ্চত করা, আইসিইউ সেবা দিতে দক্ষ জনশক্তি তৈরীতে মনোনিবেশ দেওয়া, হাসপাতালে কোভিড বেড ও সেবাকে ভবিষ্যতের আকস্মিক প্রয়োজনের নিরিখে বৃদ্ধির পরিকল্পনা তৈরী রাখা ও তা অনুশীলনসহ অন্যান্য চলমান পদক্ষেপগুলি জোরালভাবে অব্যাহত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ উন্মুক্ত রাখতে হবে।
করোনা মহামারীতে স্বাস্থ্যসেবা পেতে জনগণের অসহায়ত্ব আরও বেড়ে গেছে, অন্যান্য রোগে মৃত্যু আরও বেড়ে গেছে কিনা তার সঠিক পরিসংখ্যান নাই। গত এক বছরে জনগণের চিকিৎসা নেওয়ার সক্ষমতা অনেক কমেছে। এ অবস্থাকে কিছুটা সহনীয় করতে সংকটগ্রস্ত স্বাস্থ্যখাতের অগ্রাধিকারের লম্বা তালিকা থেকে এবারের বাজেট বরাদ্দকে সামনে রেখে পাঁচটি প্রস্তাবনা:
১. সরকার একটি এসেনসিয়াল হেলথ সার্ভিস প্যাকেজ তৈরী করেছে। তার ব্যয় বিশ্লেষণও করিয়েছে। সেখান থেকে আর কিছু না পারুক ওষুধ সরবরাহটি সরকার নিশ্চিত করতে চাইলেই জনগণের হাফ ছেড়ে বাঁচার জায়গা তৈরী হবে। সরকার অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে জেনেরিক নামে স্বচ্ছতার সাথে ক্রয় করতে পারবে। ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত ও মসৃণ করতে হবে।
২. উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের আদলে নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। প্রথম থেকেই ডাবল শিফট চালু রাখতে হবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাথে টানা-হেঁচড়ায় না থেকে এ মুহূর্তে এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে গড়ে তুলতে দেওয়া বাস্তবোচিত। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফারাল রোগীদের অগ্রাধিকার দিতে নির্দেশনা দিতে হবে।
৩. নার্স ও মিডওয়াইফ, প্যারামেডিক্সের ঘাটতি পূরণ ও প্রশিক্ষণ উন্নত করে স্বাস্থ্য জনশক্তির ঘাটতি দ্রুত পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে। জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ হাব তৈরী করা প্রয়োজন। চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরীর প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ।
৪. সকল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইমার্জেন্সী সার্ভিসে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, দক্ষ জনবল, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সন্নিবেশ করে আন্তর্জাতিক মানে উন্নত করার প্রকল্প গ্রহণ করা হোক।
৫. এর আগে বহু লেখায় একটি জাতীয় স্বাস্থ্য ডেটাবেজ নির্মাণের কথা বলেছি। যা সুযোগ করে দিবে বাস্তব সময়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের। জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি করে কমিউনিটি ক্নিনিক থেকে সরকারী-বেসরকারী সকল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রকে সংযুক্ত করবে ন্যূনতম স্বাস্থ্যতথ্যের সংরক্ষণ দিয়ে শুরু হয়ে। যা পর্যায়ক্রমে পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজে রূপান্তরিত হবে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জরুরী নয়। বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যম স্বাস্থ্য। কোন অর্থনীতিই টেকসই নয় স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ ছাড়া। স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিবে, যা এ বছরের বাজেটের প্রধান প্রতিপাদ্য।