কবরীর নায়িকা হবার মূল সুত্র সত্য সাহা। গুণী এ সংগীত পরিচালকই সুভাষ দত্তকে তার খবর দেন। অথচ কবরীকে খুঁজতে সুভাষ দত্ত যখন সত্য সাহাকে নিয়ে তাদের বাড়ি যান কবরী তখন ময়মনসিংহে। পরেরবার যখন জানানো হলো কবরী চট্টগ্রামে ফিরেছেন- তখন আর সুভাষ দত্ত যাননি। যোগসূত্র চট্টগ্রামের ড. কামালকে বলেন কিছু ছবি পাঠাতে। সে মোতাবেক ছবি পাঠানো হয় । কিন্তু কোনও খবর আসে না। কবরী ধরে নিয়েছিলেন তিনি সুযোগ পাবেন না। এদিকে ছবির মেয়েটির হাসিতে বিমোহিত সুভাষ দত্ত তখন ঠিক করে ফেলেছেন কবরী-ই তার নায়িকা। বাকিটা ইতিহাস।
কিন্তু চলচ্চিত্রে এসেই রাতারাতি কবরী বিখ্যাত হয়েছেন তেমন নয়। তার পথটা ছিল চড়াই-উৎরাইয়ে ভরা।
'সোয়ে নদীয়া জাগে পানি' সিনেমায় অসাধারণ অভিনয় তাকে লাইম লাইটে নিয়ে আসে। বলা হয়, এ ছবিটি মূলত মানিক বন্দোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি' উপন্যাসকে উপজীব্য করে বানানো। দুই দশকে 'রংবাজ', 'নীল আকাশের নীচে', 'দ্বীপ নেভে নাই', 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'সুজন সখী', 'সারেং বৌ' এর মত বহু ব্যবসা সফল এবং আলোচিত সিনেমায় প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। বলাবাহুল্য ঋত্বিক ঘটকের মতো পরিচালকের সাথে কাজ করা সহজ বিষয় না। তাকে বলা হয় 'ডাবল প্রতিভা'। শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র গুলে খাওয়া ঋত্বিকের 'তিতাস একটি নদীর নাম' সিনেমায় দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য কবরী তিনি বেঁচে থাকবেন দীর্ঘকাল ।
কবরীর রোমান্টিক ছায়াছবির প্রধান নায়ক ছিলেন এদেশের নায়করাজ রাজ্জাক। অনেকে এ জুটিকে আমাদের দেশে উত্তম-সুচিত্রা জুটির সাথে তুলনা করেন। আমি সিনেমাপাগল মানুষ হিসেবে বলবো তারচেয়েও বেশি কিছু। কারণ আমাদের ঢাকার চলচ্চিত্র জগত এর আগে জুটি ব্যাপারটি সেভাবে বুঝতো না। আর জুটি বেঁধে সীমিত দর্শকের মনে একের পর এক নতুন ইমেজ তৈরি করাও ছিল কঠিন ব্যাপার। রাজ্জাক কবরী তা করে দেখিয়েছিলেন।
সদ্য স্বাধীন দেশে এ জুটির 'রংবাজ' ছবিটি ছিল এক ব্যতিক্রম। আমরা তার শিল্পমান নিয়ে কথা বলছি না। এর জনপ্রিয়তা আর গল্পের নতুনত্ব ছিল অভিনব। আমাদের চলচ্চিত্র সাবালক হবার পথে এ ছবির অবদান অনেক। শোনা যায় এরপর জুটির ভেতর ভাঙ্গন ধরে। বলাবাহুল্য চট্টগ্রামের মেয়ে কবরী তার স্বভাবসুলভ চাটগাঁর জেদ আর সাহস থেকে একচুলও নড়েননি। নড়েননি বলেই অভিনয় জগত থেকে ক্রমে দূরে এসে পরিচালনা করার পাশাপাশি তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগের টিকেটে সংসদ সদস্য হয়ে আসা কবরী নারায়ণগঞ্জের ব্যাপারে আপসহীন ছিলেন সবসময়, যা আমরা সেখানকার মেয়র নির্বাচনের সময় আইভী রহমানেরর হয়ে কাজে নামার মধ্যে দেখতে পেয়েছিলাম ।
কবরীকে আমি সামনাসামনি দেখি সিডনিতে। ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সফরসঙ্গী হয়ে আসেন তিনি। সে সময় তার কর্মমুখরতা মনে করিয়ে দিয়েছিল তিনি চুপ থাকার মানুষ নন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষত ফেইসবুকের সুবিধা হচ্ছে যুক্ত হওয়ার সুযোগ। তার সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে কালেভদ্রে সৌজন্য বিনিময় ও কথা হতো। অসাধারণ ইংরেজি লিখতেন তিনি। শেষ জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা জানানোর পর তিনি আমাকে লিখেছিলেন God Bless you, Stay safe.
১৩ দিন করোনার সাথে লড়াইয়ের পর তিনি নিজেই হয়ে গেলেন অতীত। আমাদের প্রার্থনা, আমাদের আকুতি- কিছুই শুনলেন না ঈশ্বর। এ মহামারী এবার যাকে ধরছে তাকেই নিয়ে যাচ্ছে। কবির সেই কবিতার লাইনটি বেশ মনে পড়ছে- 'ভালোবসে যাকে ছুঁই সেই যায় দীর্ঘ পরবাসে'। কবরীও চলে গেলেন অজানা এক দেশে। যেখানে যাওয়া আছে, আসা নেই ।
মূল্যায়নের ধার না ধারেন না এমন কিছু মানুষ থাকেন। সত্যিকারের তারকা তো এরাই! এরা কোনওকালে, কখনো হারান না। প্রায়ই ফিরে ফিরে আসেন। যারা আজ ষাট বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের কবরী ছিলেন তাদের প্রজন্মের হার্টথ্রব । কিন্তু তার প্রিয়তা, তার ধারা বহমান- প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
আমাদের এ ছোট দেশে অনেক বড় বড় ইতিহাস আছে। দেশের সিনেমার ইতিহাসে তেমন একটি বড় জায়গা জুড়ে আছেন এবং থাকবেন কবরী। আমরা আমাদের সন্তানেরা গাইতে গাইতে মনে করবে 'মনের রঙে রাঙাবো'- গানে ঠোঁট মেলানো কবরীকে, যিনি আজীবন বাঙালির মন রাঙিয়ে দিয়ে গেছেন।
বিদায় কিংবদন্তী কবরী।