Published : 11 Apr 2021, 09:57 PM
গত কয়েক দশকে সাম্যবাদ নামের এক অলীক বস্তুর প্রেমে এককালীন বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানরা হারিয়ে গেলেন স্থান-কালের নিষ্ঠুর ব্লাকহোলে। আমার ছাত্রজীবনে দেখেছি নামজাদা শিক্ষার্থীদের, যারা ছিলেন লেখাপড়া, আচার আচরণে, মননে, বহুবিদ জ্ঞানে, বিচিত্র প্রজ্ঞায়, মার্জিত রুচিতে, সাংস্কৃতিক দক্ষতায় তুলনাবিহীন। এক শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ গড়ার স্বপ্নে এরাই সমাজতন্ত্রের অমোঘ মাধ্যাকর্ষণে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। নিজেদের সঁপে দিয়েছিলেন এক মহান সমাজ ও দেশ গড়ার স্বপ্নে।
১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিলের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আদর্শবাদী শিক্ষার্থীদের অনেকেই দলে দলে যোগ দিয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নে। ১৯৫৭ সালের ২৪ এবং ২৫ জুলাই ঢাকার রূপমহল সিনেমার মিলনায়তনে জন্মলাভ করেছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি অথবা সংক্ষেপে ন্যাপ। ন্যাপ ছিল বামপন্থী ও প্রগতিবাদীদের ছত্রচ্ছায়া।
১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টাঙ্গাইলের কাগমারী সম্মেলনে মাওলানা ভাসানীর সাথে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি নেতা হোসেন সোহরাওয়ার্দীর গুরুতর মতভেদ ঘটে। আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান জোটের সমর্থনে সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। মতভেদের কারণ ছিল দুইটি। ভাসানীর নেতৃত্বে বামপন্থীদের দাবি ছিল নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি এবং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। অদৃষ্টের পরিহাস ৯ বছর যেতে না যেতেই স্বায়ত্তশাসন ভিত্তিক গণআন্দোলনের নেতৃত্ব থেকে অনেকটা ছিটকে পড়ল ন্যাপ।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। আমরা যদি ফুটবল খেলার রূপকল্প চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাই, একদিকে খেলছেন পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক সাথে নিয়ে রাষ্ট্রের সৈন্য-সামন্ত-আমলা-পুলিশ আর প্রতিপক্ষে সেন্টার-ফরওয়ার্ডে খেলছেন শেখ মুজিব, সাথে ছিল ছাত্রলীগের মাঠ-দুরস্ত নেতাকর্মী এবং ঝানু সম্পাদক যুগল সিরাজউদ্দিন হোসেন ও মানিক মিয়া।
বামপন্থিদের কিছু অংশ যোগ দিয়েছিলেন বি-টিম অথবা এক্সট্রা হিসেবে। শেখ মুজিব একের পর এক দক্ষতার সাথে গোল করে গেলেন। অর্জিত হল মহান স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য যে নেতারা আওয়ামী লীগ ভেঙ্গেছিলেন ১৯৫৭ সালে, স্বায়ত্তশাসন নামক খেলার মাঠে তারা ততটা দৃষ্টিগোচর হলেন না।
অথচ বামপন্থি কর্মীরা স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হয়ে অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার যূপকাষ্ঠে আত্ম-বলিদান করেছেন অনেক বামপন্থি মুক্তিযোদ্ধারা। কাউন্টারকারেন্টস ডট ওআরজি (countercurrents.org) ম্যাগাজিনে প্রতিথযশা লেখক ফারুক চৌধুরীর ২০১৯ সালের ২৬শে মার্চের প্রবন্ধ "The Bangladesh Left in the Glorious War for Liberation: A brief note" এ পাওয়া যাবে বামপন্থিদের বীরত্বের সারমর্ম। তিনি বস্তুত নির্যাতিত জনগণের মুক্তি আন্দোলনের অগ্র-সৈনিক এক কালীন আমার আলমা ম্যাটার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের নামজাদা ছাত্র হায়দার আকবর খান রনো সম্পাদিত 'মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীরা' বইটির আলোচনা করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য রনোর একটি বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশিত হয়েছিল। বইটির নাম কোয়ান্টাম জগত-কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন।
মহান আদর্শবাদী এবং পরম শ্রদ্ধেয় নেতা মস্কোপন্থি মনি সিংহ বইটিতে লিখেছেন, ১৭ হাজার মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন তার দল, সহযোগী দল ও ছাত্র সংগঠন মিলে। পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট রেভল্যুশনারী-সিআর (Communist Revolutionary-CR) অথবা কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ২৭ হাজারের বেশি। এ বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে বিশ্রাম না নিয়ে সত্যিকার অর্থে গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। নগরকেন্দ্রিক (urban) গেরিলা যুদ্ধে সিআর (CR) রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। পদার্থবিজ্ঞানে আমার ক্লাসমেইট মেধাবী ছাত্র শহিদুল্লাহ খান বাদল আরবান গেরিলাদের ত্রিপুরার অনুশীলন কেন্দ্র পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। একটু ভিন্ন ভাবধারায় অনুরক্ত পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির বামপন্থী কর্মীরা সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
স্বাধীনতাপূর্ব বাম আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা উপধারার জটিলতার সহজ বর্ণনা রয়েছে মুক্তমনা ব্লগার বিপ্লব রহমানের একটি লেখায় "সিরাজ সিকদার: অন্য আলোয় দেখা"। তার বর্ণনা অনুযায়ী স্বাধীনতা পূর্ব বাম আন্দোলন প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। ভোট ও গণআন্দোলনে বিশ্বাসী মনি সিংহ এর নেতৃত্বে ছিল মস্কোপন্থীরা। আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে এরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। অপর ধারায় ছিল মাও সে তুং এর গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে কৃষক বিপ্লব ঘটিয়ে স্বাধীন গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েম করা। এরাই পিকিংপন্থী হিসেবে পরিচিত।
গ্রামীণ গেরিলা যুদ্ধ নির্ভর পিকিংপন্থী অনেক দল-উপদলগুলো আবার ছিল তিনটি উপধারায় বিভক্ত। মুক্তিযুদ্ধ একটি উপধারার কাছে বিবেচিত ছিল 'জাতীয় মুক্তি আন্দোলন' হিসেবে। এদের তাত্ত্বিক নেতৃত্বে প্রাধান্য ছিল টিপু বিশ্বাস ও দেবেন সিকদারের। অন্য উপধারার গুরু ছিলেন মতিন ও আলাউদ্দিন। এই উপধারার থিসিস অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের শ্রেণিশত্রু ছিল পাকবাহিনী এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী। তৃতীয় পিকিংপন্থী উপধারা পূর্ববাংলা সর্বহারা দলের লক্ষ্যবস্তু ছিল পাক-বাহিনী ও মুজিব-বাহিনী।
উপরোক্ত বর্ণনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বামপন্থিরা ছিলেন বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত। এক অংশ প্রবাসী জাতীয় সরকারের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। অপর অংশ প্রবাসী সরকার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করেছেন। একটি ব্যাপার পরিষ্কার যে বামপন্থিদের কেউ কেউ ছিলেন প্রবাসী সরকার বিরোধী, কিন্তু কখনোই ছিলেন না দেশদ্রোহী অথবা খুনি পাক-বাহিনীর পেয়ারের দোস্ত। অবশ্য কতিপয় পিকিংপন্থীদের রণকৌশল ছিল আত্মঘাতী। স্বাধীনতা-উত্তর এদের করুণ পরিণতি অনেকেই লক্ষ্য করেছেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধে পিকিংপন্থিদের সঠিক মূল্যায়নের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ভূমিকা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের জ্যাকোবিন (Jacobin) ম্যাগাজিনে ২০১৮ সালের ৭ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের বামপন্থিদের নিয়ে একটি প্রবন্ধ। লিখেছেন চতুর্থ আন্তর্জাতিকের (লিয়ঁ ট্রটস্কিপন্থি) নেতৃস্থানীয় ডাচ প্রাবন্ধিক অ্যালেক্স দ্য ইয়াং (Alex De Jong)। প্রবন্ধটির শিরোনাম হল বাংলাদেশের অসম্পূর্ণ বিপ্লব- "Bangladesh's Incomplete Revolution"। ইয়াং এর ধারণা অনুযায়ী ১৯৬০ ও ৭০ দশকে ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে গণ প্রজাতন্ত্রী চীন ও পাকিস্তানের বন্ধুত্বের মূল কারণ ছিল ভারত-বিরোধিতা। আবার পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বের কারণে পিকিংপন্থিদের অনীহা ছিল প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরোধিতা করা। তাদের কিছু অংশের দোদুল্যমানতা এবং সংশয় ছিল আইয়ুবের তথাকথিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকা দুর্বল হতে পারে যদি তারা পূর্ব বাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৩ সালে চীন ভ্রমণের সময় মাওলানা ভাসানী চীনের সাথে বন্ধুত্বের জন্য পাক সরকারের প্রশংসা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর মাত্র ১৬ দিন পর ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল পাকিস্তানি পত্র-পত্রিকা চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এর একটি বার্তা ছাপিয়েছিল। পাঠক, তখনও অপারেশন সার্চ লাইট (Operation Searchlight March 26, 1971 – May 25, 1971) নামক পাক সেনাদের নিষ্ঠুর গণহত্যা চলছিল। বার্তায় চৌ এন এন লাই পাকিস্তানকে প্রশংসা করেছেন দেশের ঐক্য বজায় রাখার জন্য এবং গণহত্যাকে চিহ্নিত করেছেন পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ঘটনা হিসেবে। শুধু এখানেই শেষ নয়। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তখন পাকিস্তানকে মুক্ত হস্তে দিয়েছিল সুদ-মুক্ত একশত মিলিয়ন ডলারের ঋণ। অ্যালেক্স ইয়াং এর প্রবন্ধ অনুযায়ী, "বাংলাদেশী ও অন্য দেশের কিছু মাওপন্থিরা স্বাধীনতা যুদ্ধকে সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় সম্প্রসারণবাদী ভারতের চীন-বিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে নিন্দা করেছেন। অনেক মাওপন্থিরা এই ব্যাখ্যাকে বিতৃষ্ণ অবজ্ঞায় পরিত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। ভাসানী নিজেই তার অনুসারীদের স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েমের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন।"
যুদ্ধক্ষেত্রে পিকিংপন্থি দল উপদলগুলোর পরস্পর বিরোধী ভূমিকায় চীনের অমানবিক নীতির কতটা প্রভাব ছিল-তা নিয়ে গবেষণা করলেই অনেক অজানা কার্যকারণ শনাক্ত হবে। পাক-বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল পিকিংপন্থিদের একটি বড় সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। যদিও কয়েকটি মাওবাদী দল উপদল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তথাপি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ভূমিকা বামপন্থি আন্দোলনের সমূহ ক্ষতি সম্পাদন করেছিল।
বাংলাদেশি বাম আন্দোলনের আর ও একটি ক্ষতিকারক দিক হল খণ্ডিত-বিখন্ডিত হওয়ার প্রবণতা। মার্কসবাদের প্রতিপাদ্যের অন্তর্নিহিত গুরুত্বপূর্ণ দুইটি অংশ হল: আর্থসামাজিক কাঠামো ও শ্রেণিতথ্য নির্ধারণ এবং তার ভিত্তিতে শ্রেণি সংগ্রামের রণকৌশল প্রয়োগ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বামপন্থিদের প্রকাশিত লিটারেচারে চোখে পড়েছিল কাঠামো নির্ধারণের নিয়ামক উপাদান হল: সামন্তবাদী, পুঁজিবাদী, আধা সামন্তবাদী এবং আধা পুঁজিবাদী। কমবিনেটরিকস এ সম্ভাব্য কাঠামো হতে পারে: (১) সামন্তবাদী, পুঁজিবাদী; (২) সামন্তবাদী, আধা পুঁজিবাদী; (৩) আধা সামন্তবাদী, পুঁজিবাদী; এবং (৪) আধা সামন্তবাদী, আধা পুঁজিবাদী। তিনটি শ্রেণি সংগ্রামের কৌশল থেকে উপরোক্ত চারটি কাঠামোর প্রতিটি বেছে নিতে পারে যে কোনো একটি কৌশল।
তাহলে ১২টি সম্ভাব্য বামপন্থি দলের আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর মাঝে যদি অন্তর্ভুক্ত করা হয় ব্যক্তি নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের জন্য ন্যূনতম দুই, ফলাফল হল চব্বিশটি বামপন্থি রাজনৈতিক দল। নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত বামপন্থি দলের লিস্ট করলাম কিছুক্ষণ আগে। আমার লিস্টে রয়েছে ২৩টি বামপন্থি রাজনৈতিক দল। আমার হিসেব নিকেশ অথবা স্বতঃসিদ্ধ অনুমানে ভুল থাকতে পারে। তথাপি অবাক বিস্ময়ে দেখছি, এক আকস্মিক মিল রয়েছে আমার হিসেবে এবং বাংলাদেশের বামপন্থি দলগুলোর সংখ্যা নিকেশে। করজোড়ে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি পাছে যদি কেউ মনোকষ্ট পেয়ে থাকেন। সম্ভবত আমার গাণিতিক বিশ্লেষণ খুবই সাদাসিধা (naïve) ধরনের।
তাহলে দেখা গেল ভূ-রাজনৈতিক দাবার চাল এবং ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাথে তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের অশুভ মিশ্রণে বামপন্থিরা খণ্ডিত বিখণ্ডিত। তাই বাংলাদেশে প্রচলিত ওয়েস্ট মিনিস্টার ধরনের গণতান্ত্রিক কাঠামোতে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বামপন্থিরা মোটামুটি পঙ্গু। এছাড়াও রয়েছে কোনো কোনো বাম নেতাদের সাথে লুসিফারের চর মেফিস্টফেলিসের ফাউস্টিয়ান দর কষাকষি।
আমি জার্মানির অতি পরিচিত এক লোকগাঁথার মূল চরিত্র ড. ফাউস্টের বহুল আলোচিত বিবিধ ধাঁচে বিভিন্ন লেখক দ্বারা রচিত কাহিনীটির কথা বলছি। বিশেষ করে এ নিয়ে চমৎকার নাটক লিখেছেন জার্মানির নামজাদা কবি ও নাট্যকার গোয়্যেটে (Goethe)। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও অর্থের লোভে ড. ফাউস্ট তার আত্মা বিক্রি করেছিলেন শয়তানের চরের কাছে। বাংলাদেশের বামপন্থি নেতাদের কেউ কেউ তাদেরই ঘোষিত শ্রেণি শত্রু সামরিক স্বৈরশাসকদের তল্পিবাহক হয়েছেন। আবার কতিপয় বামপন্থি বেঁচে আছেন আদর্শের আপসহীন অনুরাগে। আদর্শবাদীদের দেখে আমি এক সময় কবিতার পঙ্ক্তিতে লিখেছিলাম-
"শুধু কতিপয় নেমে যায় লাঙ্গলের মতো মাঠে
খুঁড়ে যাবে গহীন পাথর কিংবা ভেঙ্গে যাবে ফলা।
আকাশের স্বপ্নে তারা হয়ে যায় দুর্দম
এ মাঠে যতই কাঁকর থাক,
শস্যে শস্যে ভরে দেবে এ মাটির বুক।"
(কবিতার নাম: সকলেই প্রায় অন্তরীণ। কবিতার বই: বিনষ্ট রূপান্তরের বিকারতত্ত্ব)।
এ আদর্শবাদীদের দেখলে আরও মনে পড়ে ফরাসি লেখক আলব্যের ক্যামুর সাড়া জাগানো দার্শনিক প্রবন্ধ 'দ্য মিথ অব সিসিফাস' (The Myth of Sisyphus)। বাংলাদেশের কতিপয় কর্মী ও নেতা রয়েছেন যারা আদর্শকে জলাঞ্জলি দেননি। জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তাদের নীতি সমৃদ্ধ আদর্শে। সমতার ভিত্তিতে নির্যাতিত জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য যারা জীবনের চাওয়া পাওয়াকে তুচ্ছ করে এখনও স্বপ্ন দেখছেন এক শোষণহীন সমাজের।
বিবর্তনের এ অদ্ভুত পৃথিবীতে অতি জটিল অণু-পরমাণুর আশ্চর্য সমাবেশে যে মনুষ্য কুলের আবির্ভাব ঘটেছে- তাদের রয়েছে বিচিত্র ইচ্ছা, প্রচেষ্টা, আশা, ঈর্ষা, বিদ্বেষ, ক্ষমতার লোভ, অর্থ বিত্তের নেশা, বহুবিধ প্রেমের বাসনা, দয়া, মায়া, জিঘাংসা, নিষ্ঠুরতা, ইত্যাদি। কখনও রয়েছে মানসিক রোগ। এ বিচিত্র বিবর্তিত বানরদের নিয়ে শোষণহীন সাম্যের পৃথিবী গড়া, মহান চিন্তাবিদ কার্ল মার্কসের তত্ত্ব অনুযায়ী যেখানে থাকবে না কোনো নিষ্ঠুর হানাহানি (antagonistic contradictions), আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হয়। মনে হয় এক দূরতর ইউটোপিয়া- যার অবস্থিতি হয়ত অনুপস্থিত এমনকি বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর সমান্তরাল পৃথিবীতে।
অতএব কতিপয় কর্মী যারা এখনও অবিশ্রাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এক অসম্ভবের সম্ভাবনার আশায়, তাদের কথা মনে হলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। আবার একই সাথে মনে হয় গ্রিক কিংবদন্তীর সিসিফাসের কথা। এক নিদারুণ খাড়া পাহাড়ের চড়াইয়ে এক বিশাল পাথরের বলকে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে সিসিফাস শৃঙ্গের কাছাকাছি চলে যান। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছার আগেই ভারী পাথরের বলটি আবার গড়িয়ে পড়ে যায় নীচে। সিসিফাস আবারও চেষ্টা করেন। তাঁর এই পরিশ্রম আর প্রচেষ্টাই হল নিষ্ঠুর নিয়তি। আলব্যের ক্যামুর বিশ্লেষণে সিসিফাস বেছে নিয়েছেন এ কঠোর নিয়তি। অবিরাম ক্লান্তিতে বিধ্বস্ত, বিজয়ের কোনো আশা নেই, তবুও চেষ্টা। তার কোনো অভিযোগ নেই। অ্যাবসার্ড পৃথিবীর বিরাজমান অর্থহীনতায় নিমজ্জিত তার অস্তিত্ব।