Published : 21 Mar 2021, 07:29 PM
সবসময় নেতিবাচক খবর শিরোনাম হয়। যেকোনো নেতিবাচক বিষয় নিয়ে আমাদের সংবাদমাধ্যমের উৎসাহ অধিক। অথচ এমন কিছু কিছু বিষয় মাঝেমধ্যেই খবর হয় যার ভেতর আছে আনন্দ, আছে প্রেরণা। উৎসাহ উদ্দীপনায় এগিয়ে যাবার মতো খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায় অনুপস্থিত। তারপরও এমন নিউজ কেন গুরুত্ব পাবে না? খবরটা দেখুন- "আবারও বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় সবার ওপরে ফিনল্যান্ড। বাংলাদেশের আছে ৬৮তম স্থানে। ২০১২ সাল থেকে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), গড় আয়ু, সামাজিক উদারতা, সামাজিক সহায়তা, স্বাধীনতা এবং দুর্নীতির ওপর ভিত্তি করে সুখী দেশগুলোর তালিকা করা হচ্ছে। এ বছর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি। এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় এক নম্বরে ফিনল্যান্ড। এরপর যথাক্রমে আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের উন্নতি হয়েছে অষ্টাদশ থেকে দেশটি এখন চারধাপ এগিয়ে চতুর্দশতম স্থানে। অবনতি হয়েছে যুক্তরাজ্যের, ত্রয়োদশ থেকে দেশটি নেমে গেছে অষ্টাদশে। অস্ট্রেলিয়া তাদের গতবারের অবস্থান ধরে রেখেছে, আছে দ্বাদশ স্থানে।"
পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার এসব দেশ গোনাতেই আসেনি। এই যে আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে এই পথ কি সহজ বা সুগম ছিল? আমরা এদেশের জন্ম দেখেছি। বালক বেলায় আমাদের চোখের সামনে হাড় জিরজিরে বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছিল বলশালী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। আমরা বিস্ময়ের সাথে দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা এড়িয়ে কেমন করে জেগে উঠেছিল স্বদেশ। এসব কোনো অলীক বানানো গল্প না। আপনি এখন চাইলেই ইউটিউব বা মোবাইলে দেখতে পারেন, সেই অবিনাশী মুক্তিযোদ্ধাদের কীর্তি। ছেঁড়া গেঞ্জি-লুঙ্গি মালকোচা মারা সেই যোদ্ধাদের কারণেই স্বাধীন হয়েছে এই দেশ। আমরা স্বাধীনতার পর দেখেছি বঙ্গবন্ধুর সহজ জীবন ও উচ্চ আর্দশের দেশ। আমরা পঁচাত্তরের অগাস্ট দেখেছি, দেখেছি সামরিক শাসনের অনাচার। জিয়াউর রহমানের আমলে একের পর এক ক্যু, এরশাদের আগমন, অতঃপর খালেদা জিয়া। কোথায় উন্নয়ন কোথায় সংহতি? শুধু গদী আর মারামারি। বংলাদেশ তখন এগোয়নি। এগোলেও তার সামনে কোনো ভিশন বা দিক নির্দেশনা ছিল না। এটা বিএনপিকে মানতেই হবে। এরশাদ একা দেশ চালাতেন। কিন্তু বিএনপি চালাতো পরাজিত স্বাধীনতার দুশমন আর এলিট শ্রেণি। যতদূর মনে করি এরা হয়তো দেশের শাসন যতটা দরকারি ভাবতেন ততটা ভাবতেন না মানুষের কথা।
একসময় আমেরিকা আমাদের ডাকত 'তলা বিহীন ঝুড়ি'। তখন পাকিস্তানিরা বিশ্বাস করত কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না বাংলাদেশ। একসময় ভেঙে পড়ে তাদের কাছে ফিরে যেতে বাধ্য হবে। ভারত মনে করত আমাদের বগলে থাকা দেশ। যা বলব তাই শুনতে হবে। এ সবকিছু বদলে গেছে আজ। এই যে রিপোর্টের কথা বলছি তাতে ভারতকে টপকে অনেক এগিয়ে আমাদের দেশ। এটা কোনো ম্যাজিক? না কোনো যাদু? না দীর্ঘসময় আওয়ামী লীগ বা একটি দলের শাসনের ফলাফল? যাকে আমরা বলছি ধারাবাহিক স্থিতিশীলতা? এ বিষয়টা বুঝতে হলে ওয়ান ইলেভেনের পরের বাংলাদেশকে জানতে হবে।
আওয়ামী লীগ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। দেশের এমন কোনো গ্রাম বা এলাকা নেই যেখানে জান দিতে পারে এমন একজন আওয়ামী লীগার নাই। আজ তার ওপর চেপে বসা লুটেরা ধনী, ব্যাংক ডাকাত বা চোরদের কথা বাদ দিলে ত্যাগীরাই হলো আওয়ামী লীগের শক্তি। সে শক্তি এখন আন্দোলন বিদ্রোহ বা রাজপথে নাই। এ কারণে দেশে উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হয়নি। অন্যদিকে বাকী রাজনৈতিক দলগুলির সে শক্তি নাই। সেটা খালেদা জিয়ার কারাগারে গমনের পরই পরিষ্কার হয়ে গেছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের একজন শক্ত কাণ্ডারির প্রয়োজন ছিল। যা মিটিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে ধারাবাহিক উন্নয়নের কারণেই আজ বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই সম্মান লাভ করেছে।
এই জরিপ বা রিপোর্ট বলছে দেশের মানুষ সুখী। এটা নিয়ে তর্ক হতেই পারে। কারণ একটি বিশেষ মহল আর দেশের সাধারণ জনতার ভেতর অসুখ কিন্তু আছে। আবার এটাও মানতে হবে ভাত কাপড় বাসস্থান সমস্যা তেমন প্রকটভাবে না থাকলেও সমস্যা যায়নি। সবচাইতে বড় সমস্যা জীবন ও জীবনযাপনে অন্ধত্বের বাড়াবাড়ি। যে কারণে প্রায়ই বাংলাদেশে এমন সব ঘটনা ঘটে যাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাবমূর্তি বিপাকে পড়ে। এ লেখা যখন লিখছি সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লায় ঘটে গেছে ভয়াবহ এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। বলাবাহুল্য এর পেছনেও আছে সরকারি দলের পাণ্ডারা। যুবলীগের এক নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এই যুবলীগ প্রায় ই ভয় আর আতংকরে কারণ। তারপর ও চলছে তাদের তাণ্ডব।
সুখী দেশে কি সব মানুষ সুখী থাকবে না? আমাদের পাহাড়ে বা সমতলে ভিন্ন ধর্ম ও মতাবলম্বী মানুষরা কি আসলেই সুখী? একটা কথা মানতে হবে নিন্দা কুৎসা বা অপপ্রচারের বাইরে যে সমালোচনা বা মত তাকে গ্রহণ করতে হবে। আজকের বাংলাদেশে সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কোনো শক্তি নাই। হলে ভয়টা কোথায়? কোন কাল্পনিক জুজু বা দানবের ভয়ে এত কঠোরতা? আমি মনে করি বাংলাদেশের মানুষেরা পরিশ্রমী আর উন্নয়নমুখি বলেই দেশ এগুচ্ছে। তাদের একজন নেতার প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন কাঠামো আর দিকনির্দেশনা। মোটামুটি ভাবে সেটা পাবার পরই দেশ এগিয়ে চলেছে। কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ আর নারী শক্তি মিলে আজ এই দেশকে আলোর মুখ দেখাচ্ছে। এনে দিচ্ছে একের পর এক সম্মান। এখানে মুজিব কোটধারী নব্য নেতাদের কোনো ভূমিকা নাই। বরং তারা মানুষের চোখে ভিন্ন গ্রহের মানুষ। সুখ যা তার ভাগ এরা দেয়নি দিয়েছে প্রয়াত বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার রক্ত। দিয়েছে স্বপ্ন দেখা রাজনীতি। দিয়েছে ত্যাগী মানুষেরা। এখন তাই প্রয়োজন শান্তি।
সুখ ও শান্তির ভেতর সেতু না গড়লে আগামীতে এসব উড়াল সেতু বা বড় বড় সেতু কি আমাদের দেশের জনগণকে ভাল রাখবে? সবচেয়ে বড় কথা দেশের ও দেশের বাইরের বাংলাদেশীদের ভেতর অনেক প্রশ্ন, অনেক জিজ্ঞাসা। একটি সত্যিকার সুখী দেশ বা সুখী সমাজে সবচেয়ে বেশি থাকে জবাবদিহিতা। এর কোনো বালাই দেশে নাই, নাই সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার গ্যারান্টি। বাহ্যিক চাকচিক্যের বাইরে অন্তর্গত কষ্ট আর বেদনা আছে লুকিয়ে। রাজনীতি যাই বলুক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের ৫০ বছরে আমরা সুখী দেশের তালিকায় যতটা এগিয়ে শান্তি কল্যাণে ও ততটা এগিয়ে না থাকলে সময় কি ছেড়ে কথা বলবে?
পাখির যেমন দুই ডানা, এছাড়া সে উড়তে পারে না, সুখ ও শান্তি তেমন দুই পাখা। একটার সাথে আরেকটা না জুড়লে এই অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে। তারপরও অভিনন্দন। জয় হোক বাংলাদেশের। তার সম্মানে আমাদের সবার সম্মান। তার জয়ে আমাদের জয়।