Published : 20 Mar 2021, 05:49 PM
বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালিদেরই নন, সব ভারতীয় নাগরিকের কাছেই তিনি একজন বীর। বঙ্গবন্ধুর একশ একতম জন্মদিনে টুইট বার্তায় এমনটাই লিখেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। একই বার্তায় তিনি বঙ্গবন্ধুকে মানবাধিকার ও স্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ঐতিহাসিক মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ঢাকায় আসার বিষয়ে তার আগ্রহের বিষয়টিও তিনি আড়াল করেননি তার এই টুইট বার্তাটিতে।
দুই
ভারতের প্রখ্যাত কলামনিস্ট রাম মাধব বঙ্গবন্ধুর একশ একতম জন্মদিনে একটি চমৎকার কলাম লিখেছেন ওপেন ম্যাগাজিনে। বঙ্গবন্ধুকে তিনি আখ্যায়িত করেছেন ভারতীয় উপমহাদেশের নাগরিক হিসেবে। আক্ষরিক অর্থে তিনি ছিলেনও তাই। তার চুয়ান্ন বছরের স্বল্প-পরিসর জীবনে একাধারে অবিভক্ত ভারত এবং তারপর পাকিস্তান এবং সবশেষে তার নিজ হাতে সৃষ্ট বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন জাতির জনক।
পাকিস্তানের বাবা-ই-কাওম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মিল ছিল একটিমাত্র জায়গায় – তারা দুইজনই পাইপের বিষয়ে সৌখিন ছিলেন, কিন্তু তাদের অমিলের জায়গাগুলোয় ফারাক ছিল যোজন-যোজনের। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত জিন্নাহ যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাসে ধর্মের যথেচ্ছা অপব্যবহার করেছিলেন, সেখানে বঙ্গবন্ধু ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ নামক একটি অনন্য জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা আর অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে। আর তার এ বন্ধুর যাত্রাটিকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের রাজনীতিতে যার অভিষেক হয়েছিল অনেকটাই অকস্মাৎ তাসখন্দে প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর আকস্মিক মৃৃত্যুতে। শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল ইন্দিরার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হবে স্বল্পস্থায়ী, অনেকটাই ট্রানজিশনাল। কার্যত অবশ্য হয়েছিল ঠিক উল্টো। কঠিন হাতে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল বাড়ি আন্দোলন আর মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডের বিচ্ছিনতাবাদীদের দমন করে তিনি রাজনীতিতে এমন একটি উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন যে কংগ্রেসের বিভক্তি সত্ত্বেও তিনি একাত্তরের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার সরকারের নিঃশর্ত সমর্থন যেমন একদিকে একাত্তরে কোটি বাঙালি শরণার্থীর জীবন বাঁচিয়েছিল, তেমনি অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় আর পাকিস্তানের কারাগার থেকে বন্দি বঙ্গবন্ধুর মুক্তিকেও করেছিল তরান্বিত। সে সময়কার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অকুণ্ঠ সমর্থনে বেপরোয়া ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে শ্রীমতি গান্ধীর এমন ভূমিকা ছিল এক কথায় অসাধারণ। রাম মাধবের প্রবন্ধটিতে এসব বিষয়ে চমৎকার, প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা রয়েছে।
তিন
ডেইলি সানে এ মাসের ১৮ তারিখে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ প্রতিবেদনটির কি গুরুত্ব থাকতে পারে তা অবশ্য আমার বোধগম্য হয়নি। প্রতিবেদনটিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রতি ড. আরিফ আলভির সাথে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনার ইমরান সিদ্দিকীর সাম্প্রতিক সাক্ষাতের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। মুজিব জন্মশতবার্ষিকী আর বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে আমন্ত্রিত হয়ে ঢাকায় আসছেন প্রতিবেশি পাঁচটি দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানরা। তালিকায় সঙ্গত কারণেই অনুপস্থিত পাকিস্তান। এই প্রেক্ষাপটেই পাক রাষ্ট্রপতি ইসলামাবাদে তলব করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত তার রাষ্ট্রদূতকে। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের এই উদযাপনে কিভাবে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত হওয়া যায়।
চার
ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে 'মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র' নামে একটি ভাস্কর্যের উদ্বোধন করেছেন। ভাস্কর্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। দেশ স্বাধীনের একদিন পর এখানে পাকিস্তানিদের আকস্মিক আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছিলেন বহুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা আর ভারতীয় সেনা। আহতদের আর নিহতদের একই স্ট্রেচারে করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল যুদ্বক্ষেত্র থেকে। বাঙালি আর ভারতীয় রক্তের মিলিত যে স্রোতধারায় বাংলাদেশের জন্ম তার মূর্ত প্রতীক এই 'মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র'।
পাঁচ
সম্প্রতি ঢাকার একটি গ্যালারি পরিদর্শনে গিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত ইমরান সিদ্দিকী মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের ভাতৃপ্রতীম সম্পর্ককে গভীরতর করাই বাংলাদেশে তার অন্যতম মিশন। তার পূর্ববর্তী কর্মক্ষেত্র, পাশ্চাত্যের একটি শহরে তিনি পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যে যে মিল-মহব্বত দেখে এসেছেন, তা-ই তিনি এদেশেও বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখছেন।
ছয়
বাংলাদেশে দুইটা প্রধান রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ আর বিএনপি, এ দুটিকে কেউ যদি রাজনৈতিক দল বলে মনে করেন তাহলে বড় ভুল করবেন। বঙ্গবন্ধু তার কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন তিনি আওয়ামী লীগকে একটি 'প্রতিষ্ঠান' হিসেবে গড়ে তুলতে চান। বাস্তবতাও তাই-ই। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি আসলে দুইটা 'স্কুল অব থট' – বিপরীতমুখী দুটি আদর্শিক প্ল্যাটফর্ম। এদেশে প্রগতিশীল রাজনীতি আর অসাম্প্রদায়িকতার ধারক ও বাহক বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ, আর অন্যদিকে বিএনপি হচ্ছে সেই সব 'বাংলাস্তানি'দের প্লাটফর্ম যারা সত্তরেও ভোট দেয়নি আওয়ামী লীগকে, আর ত্রিশ লাখ শহীদ আর তিন লাখ বীরঙ্গনার কাছে যাদের দায়বদ্ধতা পাকিস্তানিদের চেয়ে এক আনাও কম নয়।
সাত
ভারতে যেবার নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার প্রথমবারের মত জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে, সেবার ঢাকার রাস্তায়-রাস্তায় মিষ্টির বন্যা বইয়েছিল বিএনপি আর জামাতিরা। তাদের ধারণা ছিল অবশেষে ভারতে তাদের 'স্কুল অব থট'টি প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তাদের সেদিনের সেই হিসেব যে কতটা বেহিসেবী ছিল তা তো বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী মোদীর টুইট বার্তাতেই স্পষ্ট। উদাহরণ আছে এমনি আরো ভুরি-ভুরি। তাই বলে চ্যালেঞ্জটাও কিছু কম না। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরে যে ঢেউ উঠে তার ধাক্কা গিয়ে লাগে ইসলামাবাদের রাষ্ট্রপতি ভবনেও। আর দেশে যে কত 'বাংলাস্তানি'র হৃদয়ে তা রক্তক্ষরণের কারণ হয়, সেই আলোচনায় না হয় নাই গেলাম।
আট
স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ-ভারতের রক্তের বন্ধন মুখ থুবড়ে পড়েছিল পঁচাত্তরের পনের অগাস্টের পর। আজ তা আবার ছুঁয়েছে একাত্তরের সেই উচ্চতাকে। দুই দেশের মধ্যকার আজকের যে সম্পর্ক তার সুফল ভোগ করছে বাংলাদেশ আর ভারতের ভাতৃপ্রতীম জনগণ। দুই দেশ একসাথে, হাতে হাত রেখে ছুটছে তো ছুটছেই। তবে পিছু টেনে ধরার লোকও কম নেই দুই দেশেই ঘরের ভেতরে যেমন, তেমনি ঘরের আশপাশেও। কারোনাকালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বিদেশ সফর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বিশ্ববন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে। দুই দেশের ঐক্যের আর ভাতৃত্বের প্রতীক যে বঙ্গবন্ধু তা এর মাধ্যমেই আরো একবার প্রতিভাত। ভেতর-বাইরের সব বাঁধাকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরের প্রাক্কালে এমনটাই প্রত্যাশা।