Published : 16 Feb 2021, 03:56 PM
২০২১ সালের প্রথম দিন রাজধানী ঢাকার খালগুলোর দায়িত্ব পেয়েই মেয়রের ঘোষণা ঢাকাকে করা হবে ভেনিসের মতো। ১৫০০ বছরের পুরাতন ইউরোপের দৃষ্টিনন্দন শহর ভেনিস। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পরিবেশ দূষণমুক্ত ভাসমান শহর। ইতালির এই স্বপ্নের শহরের মতো রাজধানী ঢাকাকে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। এর আগেও মেয়র সাহেব ঢাকাকে সিঙ্গাপুর এবং পাবলিক টয়লেটগুলোকে ফাইভ স্টার হোটেলের মতো বানানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। ইতোমধ্যেই রাজধানী সিঙ্গাপুরের মতো হয়ে গিয়েছে এখন ভেনিস শহরের মতো গড়ে তোলার কাজ শুরু হবে। মেয়র সিঙ্গাপুর বানালেও আমাদের এক মন্ত্রী আকাশ থেকে ঢাকা শহরকে লস অ্যাঞ্জেলেস দেখেন, হাতিরঝিলকে প্যারিস শহরের কোনো অংশের মতো দেখেন। শুধু ঢাকার মেয়র নয়, সারা দেশে অনেক মেয়র আছেন যারা নিজ পৌরসভাকে সিঙ্গাপুর বানানোর শ্রমে নিবেদিত। জনপ্রতিনিধিদের বিশ্বখ্যাত শহর তৈরির প্রতিযোগিতায় আমরা ২০৪১ সালে উন্নত বিশ্বের কাতারে সামিল হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ বিশ্বখ্যাত শহরের দেশে পরিণত হবে। গ্রাম বাংলায় কথা আছে আশায় মরে চাষা। জনগণ আশায় থাকবে কবে রাজধানী ঐতিহাসিক স্বপ্নের শহর ভেনিসের মতো হয়ে যাবে। সিঙ্গাপুর আর ভাল লাগছে না।
আমাদের বিদেশ প্রীতি সর্বজনস্বীকৃত। শয়নে স্বপনে জাগরণে সবসময় আমরা বিদেশ দেখতে পাই। স্বাক্ষর-অনক্ষর, বিত্তবান-দরিদ্র রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল সবাই মন-প্রাণ বিদেশে রেখে দেশে পড়ে আছে। মোক্ষ লাভের জন্য বিবেক থেকে শুরু করে সম্পদ উৎসর্গ করে বসে আছে। যেকোনো ভাবে একটা সুযোগ পেলেই হয়। ব্যতিক্রমরা সমাজে বোকা হিসেবে পরিচয় পায়। নিজেদের অজ্ঞাতেই বহু শতাব্দীর ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতির ও রক্তে শংকর মানুষ নিজস্ব ভৌগলিক অবস্থান ও কৃষ্টি কালচারে অসন্তুষ্টি থেকেই এ ধরনের বিদেশ প্রীতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে কিনা বলতে পারব না। তবে বর্তমান সময়ে সামাজিক বিবর্তন মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড বিদেশ প্রীতি ফুটিয়ে তুলছে। সব শ্রেণি-পেশার মধ্যে এ আগ্রহ মানুষের নৈতিক মূল্যবোধকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা ব্যক্তিদের নীতি-আদর্শ, আত্মসম্মান ও চেতনা হারাতে দেখে দেশের অনক্ষর-অনাহারি মানুষগুলো পর্যন্ত নিজেদের নীতিনিষ্ঠা ও সততা হারিয়ে ফেলছে।
সম্প্রতি বেশকিছু বিষয় বিদেশ প্রীতির কারণে আলোচনায় এসেছে। বিদেশে অর্থ পাচার, সেকেন্ড হোম, প্রশিক্ষণ, ভ্রমণের অনেক সংবাদ প্রায়শই প্রকাশ পাচ্ছে। ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা মানুষদের এসব বিষয়ে আগ্রহের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। এ ব্যাপারে সবাই আপসহীন। দেশের মানুষের গড় আয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার মার্কিন ডলার হলেও আয় বৈষম্য দিনে দিনে আকাশ ছোঁয়া হয়ে যাচ্ছে। ফলে কিছু মানুষের আয় স্বপ্নের মতো। এমন আয় বৃদ্ধি কিভাবে সম্ভব তা সাধারণ মানুষের বোধগম্যের বাইরে। নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্য মতে একজন সংসদ সদস্যের প্রদত্ত হিসেবে প্রথম নির্বাচনের আয় ছিল ২২ লাখ টাকা আর দ্বিতীয় নির্বাচনের সময় তা ২ কোটি টাকার উপরে। উনি কতদিন ধরে আয় করেন তা জানা না থাকলেও মাত্র ৫ বছরে আয়ে যে এমন ব্যাপক পরিবর্তন হতে পারে তা রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী বাদে অন্য কেউ জানে কিনা বলতে পারব না। সাধারণ মানুষ যেসব ব্যবসায়ীদের দেখে থাকে তাদের কারো এমন পরিবর্তন দেখতে পায় না। রাজনীতি সংশ্লিষ্ট থাকার কারণেই পাপিয়া, সম্রাটরা বিপুল অর্থের মুখ দেখতে পেয়েছে। আয়ের এই বৃদ্ধিটা অবশ্য অন্য অনেকদের থেকেই কমই। আরো অনেকগুণ বৃদ্ধির প্রমাণ নির্বাচন কমিশনে আছে। তারপরও দেশের সাধারণ ব্যবসায়ীদের আয় বৃদ্ধির এই প্রক্রিয়াটি যদি শিখিয়ে দেয়া যায় তবে ২০৪১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো না। তার অনেক আগেই আমরা উন্নত দেশের কাতারে সামিল হতে সক্ষম হতাম।
মানুষ সর্বভুক। ভোগ করার আর উপভোগ করার সীমাহীন লোভে ছুটে চলেছে। ধর্মীয় ও সামাজিক নীতি নৈতিকতা পর্যন্ত বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। সহাবস্থানের কথা সবাই ভুলে গিয়েছে। কাড়াকাড়ি করে সবকিছুতে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। সামনে পেছনে দেখার সময় নেই। সবকিছুই তার চাই। কিছু মানুষের এহেন চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সম্পদের বন্টন ব্যবস্থা অসম হয়ে পড়ছে। বিপরীতে কিছু মানুষ মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্মগত অধিকার হারিয়ে ফেলছে। কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির প্রসার ঘটছে। অর্থনৈতিক দুর্নীতির পাশাপাশি দায়িত্ব পালন না করার বা অবহেলা করার দুর্নীতি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আস্ফালন ও আশ্বাসে ইথার ভরপুর। এই পথ ধরে দায়িত্বপ্রাপ্তরা কেউ আর আমাদেরকে আমাদের মতো থাকতে দিতে রাজি না। অন্ধের হাতি দেখারে মতো করে নিজের স্বার্থ পূরণের দেখা দেখছে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির দেশী-বিদেশী প্রকল্পগুলো সেই আলোকেই তৈরি হচ্ছে, বাস্তবায়ন হচ্ছে, জনকল্যাণের নামে প্রকল্প কতটা জনকল্যাণে সমর্থ হচ্ছে তা বিবেচনা করার, জবাবদিহিতা করার কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
যশোর অঞ্চলের ভৈরব নদকে বহতা দেখতে এলাকার মানুষ ৩০/৩৫ বছর ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করার পর সরকার সংস্কারে ব্রতী হয়েছে। যদিও জনগণকে বহতা নদ উপহার দিতে নয়, এলাকার ড্রেনেজ ও সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করতে। সংস্কারের নামে যে চাঁচাছোলার কাজ চলমান তা যে জনকল্যাণে কোনো ভূমিকা রাখবে না তার আলামত এখনই পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। সংস্কার পূর্ব অবস্থায় ফেরৎ যাওয়ার গতি দেখে এলাকার মানুষ শংকিত। উৎসে পানির নিশ্চয়তা না থাকায় নদী যে কয়েক বছরেই পূর্বের রূপ ধারণ করবে তা জানা সত্ত্বেও প্রকল্প তৈরি ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা যায় শহর এলাকায় একশত ফুট চওড়া করে নদ সংস্কারের জায়গা নেই। দখলদারদের কারণে নয়, প্রকৃতই নদের নিজস্ব জায়গা নেই। স্বাধীনতার পরও এলাকার মানুষ বর্ষা মৌসুমে নদে যে এলাকা জুড়ে পানি দেখেছে তার সিকিভাগও আজ নদের জায়গা নয়। ব্যক্তি মালিকানায় বিশাল বিশাল অট্টালিকা এসব জায়গায় গড়ে উঠেছে যারা দখলদার নয়। গত শতকের ত্রিশ দশকের সার্ভে রেকর্ড তা প্রমাণ করে। প্রশ্ন জাগে অতীতের প্রমত্তা ভৈরব নদ কি ব্যক্তি মালিকানার জমিতে প্রবাহিত ছিল? ভাবতে খুব আনন্দ লাগছে একশ বছর পর যদি মানুষ দেখ আজকের পদ্মা-যমুনা-সুরমা নদী একশ ফুট চওড়া তাহলে কি আশ্চর্য হবে? কোন খুঁটির জোরে নদী তার জমি হারিয়ে ফেলেছে তার জবাবদিহি নেই। এটাও জনকল্যাণেই ঘটেছে। এভাবে জমি উদ্ধার না হলে একজন জনপ্রতিনিধি ২০ বিঘা জমি থেকে ২০০০ বিঘা জমির মালিকানা কিভাবে পাবে?
ভৈরব নদ প্রকল্পের সময়সীমা শেষ হয়ে গেলেও জনপ্রতিনিধিদের স্বপ্নের অনেক কাজ বাকি। এখনকার জনপ্রতিনিধির অনেক স্বপ্ন আছে এলাকাকে ভেনিস না হতে পারে অন্যকোনো বিশ্বখ্যাত শহরের আদলে গড়ে তুলতে হবে। দেশে ছোট বড় সব প্রকল্পের মতো নির্ধারিত ব্যয় ও সময়ে ভেরব নদের প্রকল্প শেষ হবে না এটাই স্বাভাবিক। প্রকল্প জনকল্যাণকর না হোক দৃষ্টিনন্দন হোক। এতেই সংশ্লিষ্টদের কপাল ফেরে। তবে আশার কথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন যে বেগম পাড়ার বাসিন্দাদের মধ্যে সরকারি কর্মচারিদের সংখ্যা বেশি। সরকারের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে যে তালিকা প্রদান করা হয়েছে তাতে বিরোধী দলের রাজনীতিবিদ থাকলেও সরকারি দলের কেউ নেই। কোর্ট পূর্ণাঙ্গ তালিকা চাইলেও দেশের জনগণ খুব খুশি। এখন যুগ যুগ ধরে সরকার বিদেশপ্রেম্রী মানুষদের ত্রাণকর্তা হিসেবে সম্মান ও শ্রদ্ধা পাবেন। জনকল্যাণকামী সরকারের কাছে তো এটাই কাম্য। বাংলাদেশকে ভালোবেসে নিজেরা বিদেশে না গিয়ে দেশের সন্তানদের বিদেশে পড়াশোনা করার, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার, নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ করে দেয়া সাধুবাদযোগ্য। ফরিদপুরের ২০০০ কোটি টাকার মানি লন্ডারিং ব্যতিক্রম হিসেবেই থাক বরং পিকে হালদারের জন্য জিন্দাবাদ থাকুক।
সরকারের দায়িত্বশীলরা বিদেশে সেকেন্ড হোম করে না তাই বোধকরি রাজধানী ঢাকায় বসে বিশ্বখ্যাত স্বপ্নের শহরগুলো দেখতে চায়। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অনেক বিষয়ে রোল মডেল। এক্ষেত্রেও সেটা হয়ে যাবে। ১৯৬৯ সালে আমরা যে প্রেরণায় স্বাধীকার সচেতন হয়েছিলাম, ১৯৭১ সালে আমরা যে প্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম এবং লক্ষ প্রাণের ও মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করেছিলাম তা এই বিদেশ প্রীতির মধ্যে লুকিয়ে আছে কিনা সে বিশ্লেষণের ভার বিশেষজ্ঞদের ওপর রেখে দিলাম। লোকের মন ভুলানো চমক সৃষ্টি করে চোখ ধাঁধানো আস্ফালন এখন দায়িত্বপ্রাপ্তদের বাস্তবতা। সাধারণ জনগণের পক্ষে এসব মেনে নেওয়া কঠিন। পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে অস্বীকার করাও অসম্ভব। তারপরও বলা যায় বিশ্বাসের দূর্গে ফাটল ধরেছে। কপট বড় বড় কথা শুনে মানুষ ক্লান্ত। ভাত-কাপড়ের অভাবগ্রস্থ মানুষদের মৌলিক চাহিদা পূরণের নামে ৫০০ টাকার সামাজিক নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সংকট উত্তরণের বাস্তবতা আছে কিনা তা বিবেচনার সময় কোনো জননেতাকে দেখা যায় না। সাধারণ এসব মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের জনকল্যাণকর কার্যক্রম দেখতে চায়। নিজেদের কৃষ্টি-কালচারভিত্তিক পরিচয়ে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হতে চায়। স্বাধীনতার চেতনায় জাগ্রত মানুষ নিজেদের মুক্তির জন্য মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়ানোর মতো স্বাক্ষর ও শিক্ষিত করে তোলার নিশ্চিত কার্যক্রম চায়। কানাডা, সিঙ্গাপুর, প্যারিস, লস অ্যাঞ্জেলেস ইত্যাদির মতো হতে চায় না। কচুরীপানা ভর্তি পুকুরে আধুনিক ইয়ট চালানোর কোনো আস্ফালন প্রকল্প নয়। নিজেদের মতো করে স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে চায়।