Published : 26 Nov 2020, 04:50 AM
দিয়েগো মারাদোনা মারা গেছেন। খবরটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গিয়েছিলাম ১৯৮৬ সালে। বিশ্বকাপ সেবারই প্রথম দেখা। অনেক রাত জেগে থাকতে হত। সেই বিশ্বকাপে আলো ছড়িয়েছিল মারাদোনা। মাত্র ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতা নিয়ে কী কাণ্ডটাই না ঘটিয়েছিল! প্রায় একাই আর্জেন্টিনাকে জিতিয়ে দিয়েছিল বিশ্বকাপ।
তখন আমাদের চোখে মারাদোনাই নায়ক। মনে আছে, লেখার খাতার প্রচ্ছদেও উঠে এসেছিল তার মুখ। আমরা সেই ছবি দেখে খাতা কিনতাম।
মারাদোনার মৃত্যুর খবর শুনে আবার মনে পড়ল ১৯৯৪ সালের আরেক ঘটনার কথা; নিজের বাড়ির সামনে সাংবাদিকদের দিকে গুলি ছুড়ে মেরেছিলেন তিনি। তার কথা ছিল, সাংবাদিকরা তাকে বিরক্ত করছে।
এই হল মারাদোনা; একের পর এক কাণ্ডে আলোচিত হয়েছেন, সমালোচিত হয়েছেন, উপরে উঠেছেন, নিচে নেমেছেন; কিন্তু নায়কের আসন থেকে চ্যুত হননি।
দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনার জন্ম হয়েছিল আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসের এক শ্রমিকের ঘরে; ফলে দারিদ্র্য কী, সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে হয়েছে তাকে। আর এর বিরুদ্ধে যুঝতে তার অস্ত্র হয়ে উঠেছিল ফুটবল।
"বল দেখলেই আমি তার পেছনে ছুটতাম, তখন আমি হয়ে যেতাম বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষ"- বলতেন মারাদোনা। কী ভুলে যেতে চাইতেন তিনি- উত্তর খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে- দারিদ্র্য, বঞ্চনা।
গোটা ফুটবল জীবনে এই লড়াইটা চালিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। অনেকে তাকে ফুটবলের ঈশ্বর বললেও লড়াইটা তিনি চালিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মতো করেই। সেজন্য তার সেই লড়াই নিয়ম-কানুন মেনে চলেনি, শঠতার আশ্রয় নিতেও কার্পণ্য দেখায়নি, শালীনতার সীমা অতিক্রম করতেও দ্বিধা করেনি।
১৯৮৬ সালের আগেও বিশ্বকাপ খেলেছিলেন মারাদোনা; ১৯৮২ সালের সেই বিশ্বকাপে একের পর এক ফাউলের শিকার হয়েছিলেন, রেফারির কাছ থেকে সমর্থন না পেয়ে নিজেই তুলে নিয়েছিলেন আইন; সোজা লাথি মেরে বসেন ব্রাজিলের এক খেলোয়াড়কে। নিয়ম অনুযায়ী লাল কার্ড পান, সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল তার বিশ্বকাপ।
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে রেফারির চোখ ফাঁকি দিয়ে ইংল্যান্ডের জালে হাত দিয়ে ঢোকান বল। স্বীকার করেননি তখন। ইংলিশ ফুটবলাররা যখন বলছিলেন, ওটা মারাদোনার হাতে লেগেছে; তিনি পাল্টা বলেন, ওই গোলে 'ঈশ্বরের হাত' ছিল। পরে স্বীকার করেছেন যে নিজের হাতেই গোলটি করেছিলেন; আর যে যুক্তি দেখান, সেটাও লড়াইয়ের। বললেন, ওটা ফকল্যান্ড যুদ্ধের প্রতিশোধ। ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ হারিয়েছিল আর্জেন্টিনা; অর্থাৎ সেই 'প্রতিশোধ' নিয়ে জাতীয় দায়িত্ব পালন করলেন তিনি।
সেই খেলায় মারাদোনা হাতের গোলের কালিমা অবশ্য মুছে দিয়েছিলেন চার মিনিট পরেই করা গোলে; যাকে এখন আমরা বলি 'গোল অব দ্য সেঞ্চুরি'।
বিশ্বকাপ জেতার চার বছর পর আর্জেন্টিনার ভাঙাচোরা একটা দলকে আরও নিয়ে গিয়েছিলেন ফাইনালে। তবে পেনাল্টির গোলে হার কাঁদিয়েছিল মারাদোনাকে। এখনও মনে আছে, লোথার ম্যাথিউসের হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি উঠলেও টিভি ক্যামেরা খুঁজে নিচ্ছিল মারাদোনাকে। হারলেও তখনও তিনিই নায়ক। আর্জেন্টিনাকে হারানো হয়েছে, এটা এখনও বিশ্বাস করেন অনেকে।
আরও চার বছর গেল, আবার বিশ্বকাপে মারাদোনা; একটি গোলও করলেন; তারপরই মারাদোনা নিষিদ্ধ হলেন, নিষিদ্ধ ওষুধ সেবনের দায়ে। বিদায় নিতে হল ফুটবল থেকে মারাদোনাকে। তারপরও মারাদোনা নায়কই; ভক্তদের বিশ্বাস, সবই ষড়যন্ত্র।
বদমেজাজী মারাদোনা অন্য অনেক কৃতী ফুটবলারের মতো কারও মন রক্ষা করে চলতে পারেননি, পাত্তাই দিতেন না বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফাকে। নিজ দেশের ফুটবল সংস্থাকে ছাড়তেন না।
কোকেন নিতেন, স্বীকার করেছেন। সাংবাদিককে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিলেন, শাস্তি মেনে নিয়েছেন, কিন্তু অনুতপ্ত হননি।
ঘৃণা করতেন যুক্তরাষ্ট্রকে; বলতেনও– "যুক্তরাষ্ট্র থেকে যা কিছুই আসে, আমি তা ঘৃণা করি, সর্বশক্তি দিয়ে ঘৃণা করি।"
২০০৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের আর্জেন্টিনা সফরের প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। সমর্থন জানিয়েছিলেন ভেনেজুয়েলার বামপন্থি প্রেসিডেন্ট উগো চাবেসকে।
মাদকাসক্তি ছাড়াতে শরণ নিয়েছিলেন কিউবার কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর; ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর মারা গিয়েছিলেন কাস্ত্রো; তার চার বছর পর একই দিনে মারাদোনা। কী অদ্ভুত যোগাযোগ!
একজন ক্যাথলিক হিসেবে গিয়েছিলেন পোপ জন পলের সঙ্গে দেখা করতে। তাকেও ছেড়ে কথা বলেননি। দরিদ্র শিশুদের জন্য পোপের উদ্বেগ দেখে বলেছিলেন, ভ্যাটিকান প্রাসাদের সোনায় মোড়ানো ছাদ বিক্রি করে দিয়ে শিশুদের জন্য ব্যয় করছেন না কেন?
মারাদোনা বলতেন, "আমার জীবনে আছে সাদা অথবা কালো, এর মাঝামাঝি কিছু নেই।"
২০০০ সালে ফিফা যখন শতাব্দী সেরা ফুটবলার নির্বাচনে ভোট আয়োজন করেছিল, তখন দেখা গেল মারাদোনাই পেয়েছেন সবচেয়ে বেশি ভোট। দ্বিতীয় স্থানে থাকা পেলে তখন অবাক হয়ে বলেছিলেন, ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী সম্মানীত হওয়ার মতো মহত্ব মারাদোনার আছে কি না, তা নিয়ে তার সংশয় রয়েছে।
কিন্তু মারাদোনাকে কখনও মহৎ হওয়ার পথে চলতে দেখা যায়নি।
তার ভাষায়- "আমি মারাদোনা, আমি গোল করি, আমি ভুল করি। আমি সব কিছুই নিতে পারি, আমার কাঁধ এত বড় যে যুদ্ধ করতে পারি প্রত্যেকের সঙ্গে।"
এটাই মারাদোনা, আর সেজন্য তিনি অতি সাধারণ হয়েও অসাধারণ!